সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৩

0
138

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা:০৩
ফারিহা জান্নাত

পৃথিশার কান্না থামছে না। কোনভাবেই তাকে লা’শে’র সামনে সরানো যাচ্ছে না। এদিকে জা”না”যা”র সময় এগিয়ে আসছে। পৃথিশার মামা এগিয়ে তাকে টেনে সরিয়ে আনলেন। পৃথিশা মামার হাত থেকে ছুটে মা’র দিকে এগিয়ে গেল। পৃথিশার মা যেন পাথর বনে গেছেন। একদিকে মেয়ের এমন অবস্হা তারউপর আবার স্বামীর আকস্মিক মৃ”ত্যুতে তিনি শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। পৃথিশা মা’কে ঝাঁকিয়ে বলল,

– কাঁদছো না কেন মা? কাঁদো আজ, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে মা,সব শেষ হয়ে গেছে।

পৃথিশার মা পৃথিশার ধরে কেঁদে উঠলেন। কিছু সময় পরই লা”শ সরিয়ে নেওয়া হলো জানাযার জন্য। পৃথিশা ও তার মা’কে ঘরে এনে বসানো হলো। পৃথিশার চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। সে চুপচাপ ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। হুট করে পৃথিশার চাচী জিজ্ঞেস করলো,

– আচ্ছা, মণিদীপা কোথায়? তাকে তো একবারও দেখলাম না।

পৃথিশা ঝট করে মাথা তুললো। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। পৃথিশা বুঝলো,মণিদীপার খবর কেউ এখনো জানে না। পৃথিশা বলল,

– বুবু অসুস্থ। প্রচন্ড জ্বর,তাই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। জ্ঞান নেই তার। তাকে বোধহয় মামা আনে নি।

– কিন্তু তুই কোথায় ছিলি? তোকে পরে আনা হলো কেন? তুই লা”শে”র সাথে আসিস নি কেন?

ফের প্রশ্ন করে উঠলো চাচী। পৃথিশার একটা ধাক্কা খেল। লা”শ! বাবা মা””রা গেছে কয়েক ঘন্টা হলো এখনি তারা এভাবে কথা বলছে।

– তুমি যাকে লা””শ বলছো সে আমার বাবা চাচী। আর এই মূহুর্তে তোমাকে এসব কথার জবাব দিতে আমি ইচ্ছুক নই।

পৃথিশা উঠে মায়ের পাশে বসলো। তাকে আস্তে করে বলল, “কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। পরে দেখা যাবে বিষয়টা।”

জানাযা পড়ানো শেষে শেষবারের মতো মুখ দেখানোর জন্য পৃথিশা ও তার মাকে নিয়ে যাওয়া হলো। পৃথিশার মা খাটিয়া ধরে কাঁদছেন। তার পেছনে পৃথিশা দাঁড়িয়ে আছে শান্তভাবে। কিছুসময় পর খাটিয়া নেওয়ার জন্য তৈরী করা হলো। সেই মূহুর্তে পৃথিশার মনে প্রচন্ড একটা ধাক্কা লাগলো। কানের পাশে কে যেন বলল, পৃথিশা তোর বাবা চলে যাচ্ছে,তাকে আর কোনদিন দেখতে পাবি না। তোকে বুঝার মতো আর কেউ নেই এ পৃথিবীতে। পৃথিশা হুমড়ি খেয়ে পড়ল খা’টিয়ার উপর। কান্নারত স্বরে বলতে লাগল, “বাবাকে নিয়ে যেও না তোমরা। বাবা একটু রাখো আমার কাছে। “পৃথিশাকে টেনে সরিয়ে আনা হলো। অবশেষে দা” ফ”ন করা হলো রাশেদুল চৌধুরী তথা পৃথিশার বাবাকে। সব আত্মীয়-স্বজন যাওয়া শুরু করেছে দা”ফনকার্য শেষে। পৃথিশাদের পরিবারই আছে একমাত্র। হুট করেই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। পৃথিশার চাচা ও মামা বেরিয়ে এলেন। পৃথিশাকে একেবারে ছেড়ে দেওয়া হয় নি। বাবার মৃ’ত্যুর জন্য সাময়িক ছাড়া পেয়েছিল। এখন আবার পুলিশ এসে পড়েছে তাকে নিতে। অথচ পৃথিশার মামা বলে এসেছিলেন তিনিই দিয়ে আসবেন। পুলিশের কথা শুনে পৃথিশাও ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পৃথিশা তাদের দকে এগিয়ে গেল।পৃথিশাকে দেখে পুলিশটি বলে উঠলেন,

-ওহ আপনি এসে গেছেন। তাহলে এবার আমরা চলি ভাইসাহেব। আপনি বিষয়টা এমপি মহাশয়ের সাথে ডিসকাস করে নিয়েন।

পৃথিশা দেখলো পুলিশের সাথে সেই এমপি আর ছেলেগুলোও আছে।একটা ছেলে এমপির কানে কিছু বলতেই তিনি এগিয়ে এসে বললেন,

– ওই মেয়েকে সহজে ছাড়া যাবে না। কত বড় সাহস আমার ভাগ্নিকে সে মেরেছে।

পৃথিশা এগিয়ে ছেলেটার গালে থাপ্পড় লাগিয়ে গেল। তার কান্ডে সবাই চমকে উঠলো।পৃথিশার মামা তাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আসতেই পৃথিশা তাকে বলল, “থামো মামা। আমাকে কথা বলতে দাও।” এরপর পৃথিশা ছেলপটার চুল মুঠি করে ধরে বলল,

– সত্য কথা বল শ”য়”তা”নের বাচ্চা। আমি তোদের অকারণে মেরেছি? সত্য না বললে ওইটার মতো তোকেও এখানে মেরে তারপর জেলে যাবো।

পৃথিশা একটু মারকুটে ধরনের মেয়ে। মেয়েকে রাশেদুল চৌধুরী নিজেই এসব করতে সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। ছেলেটা মুখ খুললো না। এমপি এতক্ষণে মুখ খুলল,

– তোমার এত সাহস,তুমি আমার সামনে আমারই ছেলেদের মারছো।

– হে মা”র”ছি।আরও একশবার মারব। তারা যে কাজ করেছে তার মামলা আমি আজই থানায় করবো। তখন দেখবো ভাগ্নির কাজে আপনি কোথায় মুখ লুকান।খুবই তো জনগণের জন্য দরদ দেখান সবার সামনে। এখন একটা সাধারণ মেয়েকে হেনস্তা করছেন? আপনার এই দু’মুখো ব্যবহারের কথা আমি যদি সামনে টেনে আনি? তখন কি হবে?

– খুব বড় গলা করে কথা বলছো দেখি।তা কি করেছে তারা শুনি? যে তুমি আমার ভাগ্নিকে এভাবে ছুরিকাঘাত করলে? সে এখন হাসপাতালের আইসিইউ -তে আছে।

– দলএবার তো সত্যি কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো।মার্ডার কেসের আসামী করলেন অতচ কোন মার্ডার হয় নি। আপনার ওই শ”য়”তান ভাগ্নি এখনো বেঁচে যে আছে সেটাই পৃথিবীর জন্য অভিশাপ। আপনার চ্যালা’দের জিজ্ঞেস করুন কি করেছে তারা।

এমপি ইশারা করতেই এলজন ছেলে তাকে আস্তে করে সব বলল। শুনে তিনি রেগে গেলেন।

– তোরা আমাকে আগে এসব জানাস নি কেন? এতবড় ঘটনা ঘটিয়ে রেখেছিস এখানে?

– জানালে কি করতেন? মেয়েটাকে সরিয়ে দিতেন আগেভাগেই?

এবার পৃথিশার চাচা মুখ খুললো। তাদের আসলে কিছু জানানো হয় নি বলেই তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। তবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন তিনি।

– সমস্যাটা কি কেউ আমাকে বলবেন? কি নিয়ে কথা হচ্ছে?

এমপি কিছু বললেন না। পুলিশকে কিছু একটা বলে তিনি গাড়িতে উঠে পড়লেন। পুলিশটি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

– বিরক্ত করার জন্য মাফ চাই ভাইসাহেব। আপনাদের আর থানায় যেতে হবে না। আসি।

বলেই তিনি চলে যেতে লাগলেন। তবে পৃথিশার ডাকে তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হলো। পৃথিশা তাদের উদ্দেশ্য করে বলল,

– আমাকে জেলে না দেওয়ার জন্য ধন্যবাদস্বরূপ যে আমি আপনার ভাগ্নির বিরুদ্ধে মামলা করবো না তা নয়। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব জনাব মাহবুব উদ্দিন।

পৃথিশার চাচা এবার পৃথিশার দিকে অবাক চোখে তাকালেন।

– কি নিয়ে কথা বলছিস তোরা? তুই কি নিয়ে মামলা করবি।

– সময় হলে তোমরা জানতে পারবে চাচা। এখন এ নিয়ে কথা নয়

তারপর মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– বাসায় যেতে চাই মামা। এখনি।

পৃথিশার চাচা তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন,

– মানে কি? এখনি কোথায় যাবি? আজ রাতটা থেকে যা।

– থাকতে পারবো না মামা। বুবু অসুস্থ জানোই তো। মিলাদের দিন আসবো। আর খাওয়ানোর টাকার ব্যাপারে ফোনে কথা বলে নিবো।

পৃথিশার চাচা আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। খুব দ্রুতই পৃথিশারা চলে গেল। গাড়ি চলছে, পৃথিশা ও তার মা পেছনে বসা। সামনে তার মামা গাড়ি চালাচ্ছে।

– আমি হাসপাতালে যাবো মামা।তুমি মা’কে নিয়ে বাসায় যাও। কাল সকালে এসো।

– কিন্তু তোর রেস্টের দরকার বেশি।

– আমি বুবুর কাছে থাকি মামা। মা কাহিল হয়ে গেছে।

পৃথিশার মামা কিছু বলতে পারলেন না। লুকিং গ্লাসে ঘুমন্ত বোনের দিকে তাকালেন। তিনি জানেন কিসের জন্য তাদের একসাথে এত শাস্তি পেতে হচ্ছে। মেয়ের করুন অবস্হা সহ্য করতে না পেরে রাশেদুল চৌধুরী মারা গেছেন।এছাড়া ডাক্তার বলল তার নাকি আগে থেকে হার্টে চারটা ব্লক ছিলো, এটা ধরা না পড়ায় অবস্হা এত খারাপ হয়ে গেছিলো। পৃথিশাকে নামিয়ে দিয়ে তার মামা চলে গেলেন। পৃথিশা প্রথমেই হাসপাতালের ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হবার জন্য।
আয়নায় থাকা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো সে। দুই দিনে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সে। তার লম্বা চুলগুলো মণিদীপার খুব পছন্দের। পৃথিশার চুলের ধরন সুন্দর ছিলো বলে সে নিজেই যত্ন নিতো অনেক। তারই যত্নে চুলগুলো কোমড় ছেড়ে হাঁটু ছুঁইছুঁই। পৃথিশা নিজের দিকে তাকিয়ে হাসলো।নিজের ভাগ্যের উপর হাসি পেলো তার।

– তোর আর কেউ থাকলো না পৃথি।আজ থেকে তুই একা, একদম একা।

বলেই হেসে উঠলো পৃথিশা।হাসতে হাসতে চোখে পানি এলো তার। পরপরই আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,

– যে হাত পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচিয়ে আমার বড় করেছিল সে হাত আজ আমায় ছেড়ে গেছে। বাবা তুমি যে বলতে তুমি আমাকে কখনো একা রেখে যাবে না, আজ আমি একা বাবা।দেখো,আজ আমি একা।কেউ নেই আমার।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে