#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০২
ফারিহা জান্নাত
– মিস পৃথিশা, দয়া করে আমাদের কাজে কোন বাধা দেবেন না। আপনার নামে করা মা’র্ডা’র কেসের সাক্ষীও আছে। তারাই থানায় অভিযোগ করেছে। আপনি আমাদের সাথে চলুন।
পৃথিশা হতভম্ব হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো যে ছেলেটাকে তখন ছুরিকাঘাত করেছিলো তার সাঙ্গপাঙ্গরা-ই অভিযোগ করেছে।
– বিশ্বাস করুন,আমি কিছু করি নি। ছেলেটা আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলো বলেই আমি নিজেকে সেভ করেছি। আমার বোন এখানে ভর্তি। বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে, আমার বোনকে তারা..
পৃথিশার কথা আটকে গেলো। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
– আমার বোনকে তারা রে”’প করেছে। আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে তাদের উপর অভিযোগ করছি। আপনি তাদের অ্যারেস্ট করুন। আমাকে নয়।
পুলিশটি বিরক্ত হলো। সাথে থাকা মেয়ে পুলিশটিকে ইশারা করতেই তিনি এগিয়ে পৃথিশার হাতে জোর করে হাতকড়া পড়াতে লাগলো। পৃথিশার মামা এতক্ষণ হাসপাতালের একাউন্ট সেকশনে ছিলেন। এখানে আসতেই এ দৃশ্য দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। পুলিশটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– কি সমস্যা এখানে? ও কি করেছে?
– আপনি কে বলুন তো? মাঝখান থেকে এসে প্রশ্ন করা শুরু করলেন? আমাদের কাজ আমাদেরকে করতে দিন।
– লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিরুল ইসলাম। বলুন কি সমস্যা? কি করেছে আমার ভাগ্নি?
পুলিশের মুখের রং পাল্টে গেলো। মেয়ে পুলিশটিকে বলল সরে দাঁড়াতে।
– আসলে স্যার,ওনার (পৃথিশাকে দেখিয়ে) উপর মার্ডার কেসের অভিযোগ আছে। তাকে একবার থানায় যেতেই হবে। ছেলেটার মামা এমপি তো,বুঝতেই পারছেন উপরমহলের প্রেশার। এক রাত থাকুক, তারপর জামিন করিয়ে নিয়েন।
পৃথিশার মামা কিছু বলার আগেই তারা পৃথিশাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। পৃথিশা তার মামার দিকে চেচিয়ে বলল,
– বুবু আর বাবাকে দেখে রেখো মামা। মা’কে কিছু খায়িয়ে দিয়ো।
পৃথিশার মামা তার পিছু পিছু এলেন। পুলিশগুলোকে থামানোর চেষ্টা করেও পারলেন না। শেষে পৃথিশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– আমি তোকে বের করে আনবো পৃথি মা। তুই চিন্তা করিস না।
পৃথিশাকে গাড়িতে উঠানো হলো। তার মামা বাহির থেকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন। হুশ ফিরতেই মোবাইল বের করে তার ভাইকে কল করলেন।
– ভাইজান,পৃথিশাকে পুলিশ নিয়ে গেল আমার চোখের সামনে দিয়ে। আপনি কিছু করুন তাড়াতাড়ি। আজ রাতে বের করতে পারলে ভালো। যত টাকা লাগে দেব। আপনি ওদের একটু বলে দিন,যাতে সমস্যা না হয়।
পৃথিশাকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে আপাতত সেলে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। পৃথিশা সেলের এক কোণে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বোনের র’ক্তা’ক্ত দে’হটা। বাবা হুট করে এত মেজর হা’র্ট অ্যা’র্টা’ক করলো কেন,তার তো হার্টের সমস্যা ছিলো না। হুট করে এক রাতের মধ্যে কি হয়ে গেলো। পৃথিশা বুঝতে পারলো,সে সহজে জেল থেকে বের হতে পারবে না। যে ছেলেটা মারা গেছে তার মামা এমপি। ছেলেটাকে বেশ
ভালোভাবেই চেনে সে। পথে-ঘাটে মেয়েদের প্রায়ই বিরক্ত করতো। মণিদীপার কথা মনে হতেই চোখ বেয়ে জল গড়ালো তার। মণিদীপার এবার গ্রাজুয়েশন করার কথা ছিলো।সামনের মাসেই ইয়ার ফাইনাল হতো। কিন্তু এখন এসব ভেবে লাভ নেই। বোনের কথা মনে হতেই পৃথিশার মন আতঙ্ক ভর করলো। মণিদীপার বিয়ের কথা চলছে। তার প্রায় পাঁচ বছরের প্রেম। হবু বর মণিদীপাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। কিন্তু এই অবস্হায় নিশ্চয়ই পরিবার মেনে নিবে না। পৃথিশা আর ভাবতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। বিড়বিড়িয়ে বলল,
– “আমাদের সব শেষ, সব শেষ হয়ে গেলো বুবুরে। সব শেষ হয়ে গেলো। তুই কি নিয়ে বাঁচবি বুবু,তুই কীভাবে বাঁচবি? তোকে যে কেউ মেনে নেবে না। কেউ তোর কষ্ট বুঝবো না’রে বুবু। তুই কীভাবে থাকবি বুবু? তোর না পৃথিবী দেখার শখ? তুই কীভাবে দেখবি। শ’য়’তা’ন-গুলো যে তোর চোখ-ও গে’লে দিয়েছে। তুই কেমনে বাঁচবি বুবু?কেমনে বাঁচবি?”
__
পরদিন সকালেই পৃথিশাকে সেল থেকে বের করে আনা হলো। পৃথিশা বুঝলো মামা-ই সব ব্যবস্হা করেছে। বের হতেই মামাকে বসা দেখলো সে। তবে মামার মুখ অন্ধকার দেখে মনে ভয় জাগলো তার। বাবা কিংবা বুবুর কি কিছু হয়েছে – মনে প্রশ্ন উঁকি দিলো পৃথিশার।
পৃথিশার মামা এগিয়ে এলেন তার দিকে। মাথায় হাত রেখে আদর করলেন। তারপর পৃথিশাকে ধরে বললে,
– “আমার সাথে চল মা। ঠিক আছিস তো?”
– “ঠিক আছি।”
পৃথিশা কথা না বাড়িয়ে মামার সাথে চলতে লাগলো। মামা গাড়ি নিয়ে এসেছেন।পৃথিশা সামান্য টলছে। কাল সন্ধ্যার পর কিছু মুখে তুলেনি। গাড়িতে উঠে পৃথিশা মাথা এলিয়ে দিলো। এসি চলছে। ঘামে ভেজা শরীরে বাতাস লাগায় ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বসলো সে। মামা গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। পৃথিশা বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো গাড়ি হাসপাতালের দিকে না গিয়ে অন্য দিকে যাওয়া শুরু করেছে। পৃথিশা ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
– কোথায় যাচ্ছো মামা? এটা তো হাসপাতালের রাস্তা নয়।
পৃথিশার মামা উত্তর দিলেন না। পৃথিশাও আর প্রশ্ন করলো না। করতে ইচ্ছা করলো না। শরীর আর মনটা নিতে পারছে না এসব।
হুট করেই পৃথিশার মামা বললেন,
-নিজেকে সামলাবি পৃথি। তোকেই কিন্তু এখন সব দেখতে হবে। ভেঙ্গে পরবি না। এখন তোদের দেখার কেউ নেই।
পৃথিশা হঠাৎ এরূপ কথার মানে বুঝলো না। কিছু সময় গাড়ি থেমে গেলো। পৃথিশা চারপাশে তাকিয়ে দেখলো এটা তাদের দাদা বাড়ি। এখানে সচরাচর আসা হয় না। কেউ মা’রা গেলে কিংবা দাওয়াতে আসা হয়। মনটা কু ডেকে উঠলো পৃথিশার। আবার কার কি হলো। কিন্তু নিজের বাবা কিংবা বুবু’র কিছু হওয়ার কথা মেয়েটার আসলো না। পৃথিশার মামা তাকে ধরলেন। আস্তে-ধীরে হাঁটা শুরু করলেন। কিছুদূর যেতেই নাকে আগরবাতির- গোলাপজলের গন্ধ এসে ঠেকলো। সচকিত দৃষ্টিতে আশ-পাশ দেখলো। আরেকটু সামনে যেতেই দেখলো বাড়ির উঠোনে মানুষের ভীড়। পৃথিশার মামা ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন। উঠোনের মাঝখানে একটা খাটিয়া। তার সামনেই পৃথিশা মা, দাদী,চাচীরা বসে। পৃথিশার দৃষ্টিতে বিস্ময়। সে এগিয়ে গেলো খা’টি’য়ার দিকে। লা””শে””র মুখ ঢাকা। পৃথিশা এসে দাঁড়াতেই একজন মুখ খুলে দিলো। পায়ের তলা কেঁপে উঠলো পৃথিশার। দুনিয়া যেন ঘুরে উঠলো। ধকল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই তার মামা ধরে নিলেন। সিক্ত গলায় বললেন, “নিজেকে সামলা মা। ”
পৃথিশার মনে হলো কানে কিছু সে শুনছে না। আশে-পাশে ঘটে যাওয়া কোন কিছু তার বোধগম্য হচ্ছে না। বিড়বিড়িয়ে ‘বাবা’ বলে খাটিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সে। তার কান্নার ধ্বনি যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলো। গুনগুন কান্নার যে আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো তা-ও থেমে গেলো। পৃথিশা পাগলের মতো কাঁদছে। বাবা পাগল মেয়ে ছিলো তার। মায়ের থেকে বাবার সাথেই তার বনে বেশি। সব কথার সঙ্গী বাবা। এই বাবাই তাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছে। এইতে গতকালও এই সময় তারা গল্প করছিলো। তার বিলাপ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেল।
– তুমি চলে গেলা বাবা,তুমিও একা ফেলে গেলা। এখন তো মাত্র শুরু বাবা আমাদের,এই মাঝপথে এসে ছেড়ে যাবা বাবা। বাবা ফিরে আসো প্লিজ। আমাদের তোমাকে দরকার বাবা। তুমি ছাড়া তো কেউ নাই বাবা৷ তুমি ছাড়া তো কেউ নাই। এত তাড়তাড়ি এ’তি’ম করে দিও না বাবা। পৃথিবীর কঠোরতা তো সহ্য করতে পারি না বাবা।ফিরে আসো, ফিরে আসো।
চলবে,