সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০১

0
63

#সূর্যকরোজ্জ্বল
ফারিহা জান্নাত
পর্বসংখ্যা:০১

ন’গ্ন অবস্হায় নিজ বোনকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো পৃথিশা। দৌড়ে বোনের কাছে যেতেই বুঝলো যা হওয়ার হয়ে গেছে। এদিকে পৃথিশার মতো একা একটা মেয়েকে আসতে দেখে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো বখাটে ছেলেগুলো। পৃথিশা তখন বোনের মাথা কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। কাঁধে পুরুষালি হাতের ঘৃণ্য ছোঁয়া পেতেই গা শিরশিরিয়ে উঠলো তার। মূহুর্তেই তা ক্রোধে পরিণত হলো। বোনকে রাস্তায় শুয়িয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। ওড়নার নিচ থেকে লুকানো ছুঁড়িটা বের করলো। মূহুর্তেই তা ছেলেটার পেটে বসিয়ে দিলো। গগনবিদারী চিৎকারে যেন আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠলো। ছেলেটার এরূপ অবস্হা দেখে অন্যরা আর সেখানে দাঁড়ানোর সাহস পেলোনা। জলদি পালিয়ে গেলো।
পৃথিশা গায়ের ওড়না খুলে বোনকে ঢেকে দিলো। কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে বাবার নাাম্বার ডায়াল করলো।

– বাবা বুবুকে খুঁজে পেয়েছি। মোড়ের পিছনের গলিতে আসো বাবা। মা’কে আনার দরকার নেই।তুমি মামাকে নিয়ে আসো। গাড়ি এনো।

– মেয়েটা ঠিক আছে মা? হুট করে হারিয়ে গেল কেমনে বলেছে কিছু?

মুখ চেপে কান্না আটকালো পৃথিশা। রাস্তায় পড়ে থাকা বোনটার দিকে তাকিয়ে বলল,

-তুমি তাড়াতাড়ি আসো বাবা। সব ঠিক করে দাও এসে।

ফোন রেখে বোনের দিকে নজর দিলো পৃথিশা। পৃথিশার বড় বোন মণিদীপা, সুন্দর দেখতে বলে তার এক দাদী এই নাম দিয়েছিলেন। মণিদীপা আসলেই সুন্দর ছিলো অনেক। শ্যামলা গায়ের পৃথিশা তার পাশে দাঁড়ালে কেমন বেমানান লাগে সবার কাছে। অথচ এই বড় বোনই তাকে আগলে রাখতো কড়া বাস্তব জগৎ থেকে। ছোট বোনকে আগলে রাখতে গিয়ে নিজেকেই সামলে রাখতে পারলো না। পৃথিশা বোনের মাথা কোলে তুলে নিলো। গলায়,ঘাড়ে ক্ষ’ত চিহ্ন, খা’ম’চি’র দাগ, মাথা ফেটে র’ক্ত পড়ছে, গায়ের কাপড় নেই, মাথার জায়গায় জায়গায় চুল নেই। হুট করে পৃথিশা খেয়াল করলো মণিদীপার বাম চোখ বেয়ে গড়িয়ে র’ক্ত পড়ছে। চোখের পাতাটা খুলতেই চিৎকার করে উঠলো সে। মণিদীপার এক চোখ নেই,ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। নিজেকে আর আটকাতে পারলো না পৃথিশা। বোনের দে’হ জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। কিছুসময় পরই গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখে পড়লে সেদিকে তাকালো সে। তার বাবা ও মামা এসেছে। পৃথিশার বাবা রাশেদুল চৌধুরী গাড়ি থেকেই নেমেই মেয়েদের দিকে ছুটলেন।

– মণি কোথায়, ওকে দেখি। মেয়েটা হুট করে হাওয়া হয়ে গেলো। আমাদের কি চিন্তা হয় না?

তিনি এগিয়ে আসছিলেন। কাছাকাছি এসে পৃথিশার কোলে থাকা অচেতন মণিদীপাকে দেখেই তিনি থেকে গেলেন। পা টলমলিয়ে উঠলো তার। পড়ে যেতে নিলেই পৃথিশা মামা আমিরুল ইসলাম তাকে ধরে নিলেন। পৃথিশা তখনো বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলছে। রাশেদুল চৌধুরী ধাক্কা সামলাতে পারছেন না। তার আদরের সোনা মেয়ের এই অবস্হা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। পৃথিশাকে ধাক্কিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

– কি, কি হয়েছে আমার মণির? মণি, মা আমার কথা বল।

পৃথিশা উত্তর দিতে পারলো না। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই বাবাকে বলল,

– বাবা বুবুকে বাঁচাতে হবে বাবা। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। উঠো বাবা। তাড়াতাড়ি করো।

রাশেদুল চৌধুরীকে টেনে তুলল পৃথিশার মামা।

– বাবা তোমার ফতুয়া দাও তাড়াতাড়ি।

রাশেদুল চৌধুরী শরীর থেকে ফতুয়া খুললেন। তার মনে হলো তিনি মারা যাচ্ছেন। পৃথিশার মামা তাকে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁরালো। এদিকে পৃথিশা তার বোনকে ফতুয়া দিয়ে ঢাকলো। পৃথিশার মামা এসে মণিদীপাকে কেলো তুলে গাড়িতে বসালেন। রাশেদুল চৌধুরী কথা বলার অবস্হায় নেই। তিনি নিশ্চুপ হয়ে মণিদীপার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুসময় পর তারা হাসপাতলে পৌঁছালো। জরুরী বিভাগে নেওয়া হলো মণিদীপাকে। পৃথিশার ব
মামাই সব করলেন। পৃথিশার বাবা চেয়ারে বসে আছেন। পৃথিশা ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। ডাক্তারের নির্দেশে কিছুসময় পরই মণিদীপাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। মণিদীপার অবস্হা খারাপ ছিলো। যৌ’ন নি”পী”ড়”ন ও আ”ঘা”তের কারনে তার গাঁয়ে বেশ ইনজুরি হয়েছিলো। অপারেশন শেষ হলো, কিন্তু ডাক্তাররা খুব একটা আশা দিলেন না। মণিদীপাকে আইসিউ-তে নেওয়া হলো। নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তাকে।
এদিকে পৃথিশার বাসার সবাই খবর পেয়ে হাসপাতালে এসেছে। পৃথিশার মা হাসপাতালে আসার পরই মেয়েকে দেখার জন্য পাগালমি শুরু করলেন। তাকে কেউ কিছু জানায় নি। পৃথিশার মা’কে কেউ সামলাতে পারলো না। শেষমেশ পৃথিশা তার মার সাথে আইসিইউ এর রুমে ঢুকলো।

মণিদীপার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। চোখটাও বাঁধা। পৃথিশার মা মেয়েকে দৌঁড়ে ধরতে গেলেন। কিন্তু ডাক্তাররা যেতে দিলো না। পৃথিশার মা বেডের পাশের বোর্ডে লাগানো পেশেন্টের কেইস হিস্ট্রি খেয়াল করলেন। সেখানে বোল্ড লাইনে লিখা ‘রে””ই””প”” কেস’। তিনি ঝট করে পৃথিশার দিকে তাকালেন। পৃথিশা তাকে বাহিরে টেনে আনলো। পৃথিশার মা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি বারবার পৃথিশাকে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলেন,

– মণির কিছু হয় নি। ওরা ভুল লিখেছে তুই বল।ওরা ভুল লিখেছে তাই না? আমার মেয়ের সাথে এটা কেন? না না,আমার মেয়ের সাথে এটা হতেই পারে না। কোনভাবেই না, এটা মিথ্যা।সব মিথ্যা, তোরা সবাই মিথ্যুক,সবাই মিথ্যুক।

পৃথিশা মা’কে বুকে চেপে ধরলো। ভাঙ্গা গলায় বলল,

– চুপ করো মা।দোহাই লাগে চুপ থাকো। বুবু পবিত্র মা,সে পবিত্র। তোমার মেয়ের কিছু হবে না। কিছু না।

পৃথিশার মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। পৃথিশা তাকে উঠে বসালো। রাশেদুল ইসলামকে সে ধাক্কা দিতেই তিনি ঢলে পড়লেন। মূহুর্তেই তাকে জরুরী বিভাগে নেওয়া হলো। জানা গেলো অতিরিক্ত শকে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পৃথিশা যেনো নিজেকে আর শক্ত দেখাতে পারলো না। মা’কে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। বেশ কিছুটা সময় পর রাশেদুল ইসলামের হার্টের অপারেশন শুরু হলো।

পৃথিশা ডাক্তারের পারমিশন নিয়ে নিজের বোনকে আবারে দেখতে গেলো। আশেপাশে আরো অনেক রোগীই আছে। কিন্তু মণিদীপার মতো এমন শোচনীয় অবস্হায় কেউ নেই। পৃথিশা তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

– বুবু, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? তুই তো ভালো বুবু,তাহলে তোর সাথে কেন হলো এটা? তুই-ই কেন বুবু? বুবু,বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে। ডাক্তার বলল প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে। বুবু তুই কেন সন্ধ্যা বেলায় বের হলি? আমি, আমি পারছি না বুবু। আমার মনে হচ্ছে আমার ভেতরা কেউ খুব যত্ন করে প্রতি মূহুর্তে থেঁতলে দিচ্ছে। তোর চোখগুলো কত সুন্দর ছিলো। তারা…তারা কি করে এমন কাজ করতে পারলো?

পৃথিশা একটু থামলো। মণির মাথায় হালকা করে হাত ছুঁইয়ে বলল,

– তুই ম’রে যা বুবু। ওটাই তোর মুক্তি। বেঁচে থাকলে তুই প্রতি মূহুর্তে ম’র’বি। এর থেকে ভালো তুই এখনই চলে যা বুবু।

পৃথিশা চোখ মুছে বাহিরে আসলো। মায়ের পাশে বসে কাঁধে মাথা রাখলো। মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। অথচ এই কয়েকটা ঘন্টাই তাদের জীবনের উথালপাতাল করা সময়। হুট করেই করিডোরে হইচই আওয়াজ পাওয়া গেলো। একদল পুলিশ এসে ঘিরে ধরলো পৃথিশাদের। তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

– মিস পৃথিশা চৌধুরী কে?

পৃথিশার মা কথা বলার অবস্হায় নেই। তিনি মলিন চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। পৃথিশা এগিয়ে গেলো তাদের দিকে।

– আমি-ই পৃথিশা চৌধুরী। কি সমস্যা?

– আপনার নামে মার্ডারের অভিযোগ আছে। আপনি আমাদের সাথে থানায় চলুন,সেখানেই বাকি প্রসেসিং হবে। এই, হাতকড়া পড়াও।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে