#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৯
ফারিহা জান্নাত
থানায় প্রায় আধ ঘন্টা যাবত অপেক্ষা করছে পৃথিশা ও মণিদীপা। সেদিন মণিদীপা কথাটা বলার পর পৃথিশা ভেবেছিলো মণিদীপা রাগের বশে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই মণিদীপাকে সময় দিয়েছিলো সে। কিন্তু মণিদীপা নিজ সিদ্ধান্তে কঠোর ছিলো। পৃথিশা পাল্টা কিছু বলে নি। সে নিজেও তাই চেয়েছিলো। ওই নরকের কীটগুলোকে এভাবে বাহিরে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে দেওয়া যায় না। এজন্যই তারা আজ এখানে এসেছে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো। তাদের ডাক পড়লে তারা ভিতরে যায়। সেই পুরোনো পুলিশ অফিসার বসা। তিনি পৃথিশাকে দেখেই চমকে গেলেন। মণিদীপাকে না দেখায় তিনি চিনতে পারলেন না। তবে পৃথিশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– আপনি এখানে কি করছেন?
পৃথিশা তার কথার উত্তর না দিয়ে সামনে রাখা চেয়ারগুলোতে বসলো। পুলিশটিকে এখন আরও বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে। পৃথিশা মণিদীপার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
– মাফুজুর রহমান ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করতে।
নামটা শুনে পৃথিশার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকালেন তিনি। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললেন,
– কি নাম বললেন? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?
– মাফুজুর রহমান। তার নামে নারী নির্যাতনের মামলা করতে এসেছি। এজ আ অফিসার, আপনি সাধারণ জনগণের কেস নিতে বাধ্য। এখানে অন্য প্রসঙ্গ আসছে কেন?
মণিদীপা এতক্ষণে মুখ খুলল। পুলিশটি তার দিকে তাকিয়ে বলল,
– আপনি’ই কি মণিদীপা চৌধুরী?
– জি আমি মণিদীপা। এবং এই মামলাটা আমার পক্ষ থেকেই হচ্ছে।
– আপনারা বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তো? আপনাদের কিন্তু ভবিষ্যতে এর জন্য অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। এত তাড়াতাড়ি কোন সমাধান আপনারা পাবেন না।
– আমরা কোন কিছুতে ভয় করি না। আপনি লিখা শুরু করুন।
পুলিশ অফিসার তাদের দিকে তাকিয়ে লিখা শুরু করলেন।পরবর্তীতে বললেন,
– আপাতত আমি অভিযোগ লিখে রেখেছি।কাল এই ঠিকানায় যাবেন। স্যার-ই সব দেখবেন।
পৃথিশারা বেরিয়ে গেলো। রাস্তার ধারে আসতেই মণিদীপা বলল,
– পৃথি চল আজ ঘুরি। তোর রেজাল্টের গিফ্ট।
– একদম না বুবু, তোকে ডাক্তার বেশি হাঁটাচলা করতে না বলেছিলো।তুই তো শুনিস না একদম। এখন বাসায় চল।
– ধুর, আয় তো আমার সাথে।
মণিদীপা পৃথিশার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। শপিং মলের তৃতীয় তলায় আসতেই মণিদীপা আদিদকে দেখতে পেলো, সাথে তার মা। মণিদীপা সেদিকে যাবে কি না ভাবতে লাগলো। পরমুহূর্তেই আদিদ তাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসলো। আদিদের মা মুখ ফিরিয়ে উল্টো দিকে যেতে লাগলো। মণিদীপা উশখুশ করছে। পৃথিশা ভাবলো তাদের একা ছেড়ে দিবে,তাই চলে যেতে নিলেই মণিদীপা আটকে দিলো। ধীর গলায় বলল, “তুই এখানেই থাক।”
আদিদ এসে মণিদীপার সামনাসামনি দাঁড়ালো। কোন কথা বললো না। মণিদীপার মুখের কিছু জায়গায় কালসিটে দাগ, ক্ষত শুকিয়ে গেলেও দাগ যায়নি। গলা,ঘাড় ওড়না দিয়ে আড়াল করা। আদিদ জিজ্ঞাসা করলো,
– কেমন আছো মণি?
মণিদীপা কি বলবে ভেবে পেলো না। আস্তে করে বলল,
– ভালো আছি।
বলেই একমুহূর্ত দাঁড়ালো না। তড়িঘড়ি করে চলে গেলো। তা দেখে পৃথিশা আদিদকে বলল,
– বুবু কি চায় তা আমি বুঝে ওঠতে পারছি না। তবে আপনার যদি কোন সমস্যা থেকে থাকে সেই বিষয়ে, তাহলে দয়া করে আমাদের সামনে আসবেন না।
_________
পৃথিশা ও মণিদীপা এই মূহুর্তে একজন পুলিশ অফিসারের রুমে বসে আছে। গতকালের দেওয়া ঠিকানায় আজ তারা এসেছে। পুলিশ অফিসারটি তাদের নাম জানার পর থেকেই কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। পৃথিশা অবশেষে না পেরে বলল,
– আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন,
– তোমাদের সাথে আর কেউ আসে নি?
– আর কে আসবে? আমরা কি যথেষ্ট নই?
– আমি কখনো কোন পুরুষ গার্ডিয়ান ছাড়া এভাবে এরকম কেস নিয়ে আসতে দেখিনি। যাই হোক, আপনারা কি বুঝতে পারছেন না আপনারা যেচে নিজের কাঁধে ঝামেলা নিচ্ছেন?
– আপনার এরকম কেন মনে হলো?
– আপনারা কাদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন? এমপি ফজলুর করিমের ভাগ্নে মাফুজুর রহমানের উপর। আপনারা কি ভাবছেন মামলা করলেন আর হয়ে গেলো? তারা প্রচন্ড ক্ষমতাশালী। এই কেস নিয়ে আপনাদের অনেক ঘুরতে হবে। জায়গায় জায়গায় টাকা ফেলতে হবে, অযথা ঘুরবেন।দিনশেষে কোর্টে ওদের কথাই বহাল থাকবে।
– তাই বলে কি অন্যায়ের প্রতিবাদ করব না? এভাবে আর কতদিন? আপনার কথায় আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না।
– যা ভালো মনে হয় করতে পারো।আমার তো হাত বাঁধা, তোমাদের কথা শুনতে বাধ্য। তবে তোমাদের সাবধানে থাকতে হবে।
বলে তিনি একটা কাগজ দিয়ে তাদের একটা রুম দেখিয়ে দিলেন। বললেন সেখানে গিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে মামলা কনফার্ম করতে।
– পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে রে, আর কতবার এখান থেকে ওখানে যাবো রে পৃথি?
মণিদীপার ক্লান্ত স্বর।পৃথিশা সেদিকে খেয়াল করলো না তার মনে এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। যেদিকেই যাচ্ছে সবাই তাদের সাবধান করছে।বারবার মামলা করতে না করছে। পৃথিশা এমনিতেও জানতো এমন কোন ঝামেলা হবেই কিন্তু ব্যাপারটা তার থেকেও জটিল। অফিসারের বলে দেওয়া রুমে ঢুকে দেখতে পেলো এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বসে আছেন আয়েশ করে। তারা সামনে রাখা চেয়ারে বসলো। মণিদীপা তার দিকে মামলার চার্জ শীটটা এগিয়ে দিলো। তিনি তা পড়ে তাদের উদ্দেশ্যে কড়া স্বরে বললেন,
– ভিক্টিম কে?
পৃথিশার বুকে একটা ধাক্কা লাগলো। মণিদীপার দিকে আড়চোখে তাকালো। সে মুখ শক্ত করে বসে আছে। তাদের চুপ দেখে লোকটা আবারও বলে উঠলো,
– আরে ভিক্টিম কে? কথা বলেন না কেন? আজব পাবলিক যত্তসব।
– আমি ভিক্টিম।
লোকটা মণিদীপার দিকে কোণা চোখে তাকালো। চোখে তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি। পৃথিশা নড়েচড়ে বসলো। লোকটা কৌতুকের স্বরে বলল,
– কিছু প্রশ্ন করবো। উত্তর দিবেন,হেয়ালি করবেন না।
মণিদীপা দ্বিধান্বিত হয়ে পৃথিশার দিকে তাকালো। পৃথিশার চোখে ভয়, সে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। তাদের ভাবনার মাঝেই লোকটা প্রশ্নের তীর ছুঁড়লো,
– কয়জন ছিলো একসাথে? কোথায় নিয়ে করছে?
মণিদীপা প্রশ্নটা বুঝে উঠতে পারে নি প্রথমে। লোকটা আবারও একই প্রশ্ন করলে তার বোধ আসে। থমকানো গলায় বলে উঠে,
– ছ…ছয়জন ছিলো।
– কোথায় করছে? মানে ব্যাপারটা ঘটলো কোথায়?
– আমাদের এলাকার এক পুরাতন গলির মাথায়, সেখানটায় কেউ থাকে না। নির্জন গলি।
পৃথিশা উত্তর দিলো।মণিদীপা পৃথিশার হাত আঁকড়ে ধরে বসে আছে মাথা নিচু করে।তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
– ভিক্টিমকে কথা বলতে দিন। কি করছে? কার দ্বারা আপনি মলে”স্টেনশনের শিকার হয়েছেন? একজন নাকি যারা ছিলো সবাই?
পৃথিশা চেঁচিয়ে উঠলো,
– ভদ্রভাবে কথা বলুন। এসব কি প্রশ্ন?
– থামেন আপনি। কথা নিতে না পারলে এখানে আসছেন ক্যান? যা প্রশ্ন করি সবই উত্তর দিতে হবে। মামলা সাজাতে হবে তো।
মণিদীপা মাথা তুললো এতক্ষণে। তার চোখের কোণে অশ্রু। দৃঢ় গলায় বলল,
– সবাই করে নি। যার নামে মূল মামলা করেছি সে ছিলো। আমার পুরোটা সময় জ্ঞান ছিলো না। তাই সঠিকভাবে বলতে পারব না।
লোকটা মুখ দিয়ে বিরক্তিকর ‘চ’ শব্দ করলেন। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলেন, “কাম কইরা গেছে তার লগে অথচ খেয়াল ছিলো না।” পৃথিশা কথাটা শুনলো। কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। এভাবে কয়জনের মুখ বন্ধ করবে সে।
সেদিন বাড়ি ফেরার পর দুইদিন সব স্বাভাবিক ছিলো। মণিদীপা ঠিক করলো সে ভার্সিটি যাওয়া শুরু করবে। সকালে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য পৃথিশাকে নিয়ে বের হলো। পৃথিশা নিজেও যেতে চাইছিলো তাই আর না করে নি সে। তবে বাসার নিচে আসতেই মাফুজুরকে দেখতে পেলো সে। মণিদীপার দিকে ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। এতদিন পর তাকে দেখতে পেয়ে মণিদীপার ভয়ে অন্তর-আত্না শুকিয়ে গেলো। সে এখনো সেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি নি সে। মাফুজুর তার দিকে এগিয়ে আসতেই পৃথিশা মণিদীপার সামনে এসে দাঁড়ালো। মাফুজুর তার দিকে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
– সরে যাও সামনে থেকে। আমার বোঝাপড়া তার সাথে।
– কু”ত্তা/ র বাচ্চা, তোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। কোন সাহসে এই মুখ নিয়ে আমার সামনে এসেছিস? নাকি সেদিন মার খেয়ে মন ভরে নি?
– সাহস কিভাবে হয় আমার সাথে এভাবে কথা বলার। তোমরা মামলা করার সাহস কিভাবে পেয়েছ? আমি কি করতে পারি তার ধারণা আছে তোদের মতো চুনোপুঁটির?
– ফ/কি/র সারাজীবন এইসব নিয়েই কথা বলে গেলি। তুই তাকিয়ে দেখ কি করি। তোকে চৌদ্দ শিকের ভাত না খাওয়ানো পর্যন্ত আমি পৃথিশা শান্তি পাবো না।
পৃথিশা দাঁড়ালো না আর। মণিদীপাকে নিয়ে বাসার ভেতরে চলে গেলো। ভার্সিটিতে আর যাওয়া হলো না। দিন না গড়াতেই পৃথিশার মায়ের ফোনে আদিদের মায়ের কল আসলো। তিনি রেগে হুশ হারিয়ে উল্টাপাল্টা বললেন পতাকে।তার কথার সারমর্ম এই- যা হয়েছে হয়ে গিয়েছে, এখন আবার মামলা কেন করা হলো। সবাই খবর জেনে গিয়েছে, তাদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে যেহেতু মণিদীপার সাথে আদিদের এনগেজমেন্টের খবর সবাই জানে। ফোনটা লাউডস্পিকারে ছিলো।মণিদীপা সবটাই শুনলো চুপচাপ। কিন্তু কিছু বলল না। চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। বারবার বলেও দরজা খুলাতে পারলো না পৃথিশা। সেদিনের ঘটনার পর এই প্রথম মণিদীপা একা থাকলো। তবে অস্হিরতায় সারারাত ঘুমাতে পারলো না পৃথিশা। কে জানে আগামীদিন কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
চলবে,