সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০৯

0
211

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমে: মম সাহা

৯.
ভর সন্ধ্যে বেলার উষ্ণ গরমের মাঝে ভুঁইয়া বাড়িতে যে থমথমে আবহাওয়ার সৃষ্টি হলো তা নেহাতই অপ্রত্যাশিত ছিল। বেলি অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। কিন্তু হিংস্র বাঘের ন্যায় হুঙ্কার ছেড়ে উঠল মুনিব,
‘ভাবি, আপনার এতো বড়ো সাহস! বেলির গায়ে হাত দেন!’
চামেলি উদ্ভ্রান্ত। হুঙ্কারে ভয় পেলো কি-না বুঝা গেলো না ঠিক। কেবল সাপের মতন ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘একশ বার হাত তুলমু। অর সাহস হয় কী কইরা আমার চরিত্র নিয়া কথা বলার?’

হতভম্ব বেলির বিস্ময় কেটে গেল। চোখমুখে ছড়িয়ে পড়ল তীর্যক রাগ। ক্ষোভে ফুঁসে উঠে বলল,
‘এমন ভাব করছেন যেন আপনি ম্যালা ভালো! আপনার কাহিনি এ বাড়ির সবাই জানে একটু হলেও। নিজেকে সাধু ভাবেন না-কি?’

চামেলি তেড়ে এলো, ‘এই, কী, কী জানে আমার কাহিনি? বলো এখুনি। বাড়িতে আসলা শুক্কুর শুক্কুর আষ্টদিন হয় নাই আর এখনি এত বড়ো সর্বনাশ করছো আমার!’

‘আমি সর্বনাশ করার কে, ভাবি? আপনে যদি রাত-বিরেতে বাড়িতে পরপুরুষ ঢুকান তাইলে আমরা বললে কী সমস্যা?’
বেলির কথায় মুখের রাগ নিভে গেল চামেলির। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বলল, ‘আমি পরপুরুষ ঢুকাই?’

‘ঢুকান না? না ঢুকাইলে চোর কেন আপনের ঘরের দরজার সামনে দিয়া খালি হাঁইট্টা গেছে বুঝান আমারে।’

চামেলির চোখে-মুখে বিস্ময়। ভাব এমন করছে যেন এ সম্পূর্ণ কিছুই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বেলি কুটিল হাসল। আরাম করে সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘আপা, আপনের বিয়ার দিন না-কি আপনার চাচাতো ভাই অনেক ঝামেলা করছিলো? কেন করছিলো?’

চামেলির মুখ ছোটো হয়ে এলো। কথার মোড় ঘুরে এমন স্পর্শকাতর অংশে গিয়ে দাঁড়াবে সে বোধহয় এটা আঁচ করতে পারেনি। কেবল মুহূর্তটাকে অন্যদিকে ফেরানোর জন্য বলল,
‘তোমারে না-কি সেইদিন মেলায় একজন আমার নাম কইরা চুড়ি দিয়া গেছে? তুমি না-কি এডা বলছো সবাইরে?’

‘হ্যাঁ। মিথ্যা বলি নাই তো। দিছেই তো!’

‘কে দিছে? আর দিলে সেটা তুমি এই পর্যন্ত আমারে না বইলা পুরা বাড়ি ছড়ায় ফেলছো ক্যান? পুরা বাড়ির মানুষ জানে আমারে কেউ একজন চুড়ি দিছে। অথচ আমি জানি না!’

‘আমি পুরা বাড়ি ছড়াই নাই, ভাবি। আপনার দেবর জানতো খালি।’

‘কী জানতো হ্যাঁ? কী জানতো? আমাকে মেলায় কে চুড়ি দিতে যাবে? শুধু শুধু এসব কথা ছড়াইতাছো ক্যান তুমি? তোমার লগে আমার কিয়ের এত শত্রুতা?’
কথা বলতে বলতে চামেলির চোখ উপচে জল এলো। শরীরটাও কাঁপছে মৃদু। মুক্তা ভূঁইয়া বড়ো বউয়ের আচরণে অতিষ্ঠ বোধ করলেন। তাই রেগে গিয়ে কয়েকটা কথা শুনাবেনও ভাবছিলেন। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল মুনিব। সেই হিংস্র মুনিবের কণ্ঠে রইল কেবল অমোঘ নিরবতা।
‘থাক, আম্মা। আর কিছু বলার দরকার নেই ভাবিকে।’

ছেলের বারণের উর্ধ্বে গিয়ে কিছু বলার মতন মা মুক্তা ভূঁইয়া নন। তাই তিনি থেমে গেলেন। বেলি নরম চোখে তাকাল মুনিবের দিকে। লোকটার মুখে কেমন বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। কিছু নিয়ে অতিরিক্ত ভাবছে নিশ্চয়। অতিরিক্ত ঝগড়া আর অতিরিক্ত পর্যায়ে রইল না। নিমিষেই সেই ঝগড়ায় বিরতি ঘোষণা করা হলো। চামেলি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেল। মুক্তা ভূঁইয়া গেলেন রান্নাঘরে। ড্রয়িং রুম জুড়ে কেবল রয়ে গেল বেলি ও মুনিব।
দু’জন নিজেদের মতন চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। এরপর মুনিব ধীরে ধীরে বেলির পাশ ঘেঁষে বসল। মুনিবকে বসতে দেখে বেলি নিজেকে গুটিয়ে নিল অনেকটা। মুনিব সবটাই ভালো ভাবে খেয়াল করল। হাসলো খানিক। এরপর আলগোছে নিজের হাতের মুঠোয় বেলির ডান হাতটা মুড়ে নিল। বেলি চুপচাপ। কোন প্রশ্ন করল না। মুনিবই প্রথম কথাটা বলল,
‘চুরি গুলো সত্যিই ভাবিকে দিয়েছিল তো?’

স্বামীর প্রশ্নে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো বেলি। চমকে উঠল প্রায়। তার নিঃশ্বাসের গতি অস্বাভাবিক। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না প্রায় এমন নাজুক অবস্থা। তবুও আমতা-আমতা করে বলল,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। নাহয় কারে দিবো?’

মুনিবের ঠোঁটে হাসি অক্ষত। কেমন যেন বাঁকা হাসি। নিখুঁত ভাবে চাইলে এই হাসির মানে পড়া যাবে অনায়াসেই। বেলির শরীরে ঘাম ছুটল। মুনিব আবার বলল, ‘সত্যিই ভাবিকে দিতে বলেছে?’

বেলি চোখ নামিয়ে ফেলল। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। ধরা পড়ে যাওয়া গলা বলল,
‘আমাকে তো ভাবিদের দিকে দেখাইয়া বলছিল চুড়ি গুলো দিতে। আমি সেজন্য ভাবছি হয়তো ভাবির জন্য চুড়িডি। যদি ভাবির না-হয় তাহলে কণিকা আপুর হবে।’

‘তুমি যদি না-ই জানো সঠিক ভাবে চুড়ি গুলো কার তাহলে কেন ভাবির নামটা উচ্চারণ করে ছিলে?’

মুনিবের প্রশ্নে বেলির মুখটা এটুকুন হয়ে গেলো। থুঁতনির সাথে লেগে গেল বুক।

‘ভাবির নামে এমন একটা কথা বলার আগে তোমার ভাবা উচিত ছিল না?’

‘আপনেও তো সঠিক ভাবে জানেন না ভাবি সত্যি কথা কইতাছে কি-না। তাইলে কেন ভাবির পক্ষে কথা কইতাছেন? হইতেই পারে ভাবি মিথ্যা বলতাছে। ঐদিন চোর কিন্তু পুরা বাড়ি ঘুরে নাই। ভাবির ঘর পর্যন্ত ছিল। এত ঘটনার পরও আপনে কেন ভাবির পক্ষ নিতাছেন?’

বেলির অভিযোগ মাখা কথায় মুনিব শ্বাস ফেলল। বেলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘আসলে ভাবির চরিত্র নিয়ে এসব মানতে পারছি না।’

‘না পারার কী হইলো? আমি যেদিন আপনাগো বাড়িত আইলাম সেদিন ভাবি টিটকারি মাইরা কইতাছিল আপনের না-কি ভাবির প্রতি টান আছিল। ভাবি সুন্দর ছিল বইলা। ভাবি যদি এমন কইতে পারে আপনারে নিয়া তাইলে আপনে তার পক্ষ ধরেন ক্যান?’

বেলি প্রতিটা কথাই যুক্তিসঙ্গত তাই মুনিব আর রা করল না। কেবল বেলির চুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে আপনমনে কী যেন ভাবল।

টানা কয়েকদিন যাবত বৃষ্টি হচ্ছে। কালবৈশাখি ঝড়ে নড়েচড়ে যাচ্ছে যে চারপাশ। বাগান থেকে হরেক রকমের ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে ঝড়ো হাওয়ায়। বেলি উন্মাদ হয়ে যায় ঝড় ছুটলেই। বৃষ্টিতে ভেজা যেন তার নেশা। এইতো কিছুক্ষণ আগে দুপুরের তীব্র রোদের আকাশ মুহূর্তেই অন্ধকার করে শুরু হয়ে গেলো ঝড়। বেলি তখন রান্নাঘরে ছিল। শাশুড়ির সাথে রান্নার কাজে নিমগ্ন। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাতাস আসতেই বেলির মন ফুরফুরে হয়ে গেল। বাচ্চাদের মতন বেজায় আনন্দিত স্বরে বলল,
‘মা, বৃষ্টি আসবো লাগে!’

মুক্তা ভূঁইয়া মাছ ভাজছিলেন। দৃষ্টি তার কালো কড়াইটাতে ছিল। পুত্রবধূর কথায় তিনি দৃষ্টি নড়চড় না করেই বললেন,
‘হ। বাতাস তো তা-ই কইতাছে।’

বেলির আনচান আনচান মন উন্মনা হয়ে যাচ্ছে বারে বারে। জানলার দিকেই চোখ চলে যাচ্ছে তার। কিন্তু শাশুড়িকে বলার সাহস হচ্ছে না তার চঞ্চল মনের আবদার।
এর মাঝেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো। বৃষ্টির অনন্ত ধারায় ভরে গেল আঙ্গিনা। বেলি খুশি মনে বার বার জানলা দিয়ে বাহিরে হাত বের করে দিচ্ছে। মুক্তা ভূঁইয়া সবটাই দেখলেন নীরব চোখে। কিন্তু বেলিকে কিছু বললেন না।

অবশেষে বেলিই গাঁইগুঁই করে আবার শাশুড়িকে ডাকল, ‘মা, আপনি বৃষ্টি পছন্দ করেন?’

‘করতাম। যহন তোমার মতন বয়স ছিল। এহন বয়স বদলাইছে চাহিদাও বদলাইছে।’

বেলি শাশুড়ির দিকে তাকাল। কাজ শিঁকেয় তুলে জড়িয়ে ধরল তাকে। বাচ্চা মেয়েটির মতন আবদার করে বলল,
‘চলেন না একটু ভিজি। বয়স বাড়লে চাহিদা বদলায় কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজার আনন্দ সব বয়সে একই থাকে। আহেন না মা, একটু ভিজি।’

বেলির আচমকা জড়িয়ে ধরাটা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে মুক্তা ভূঁইয়া অবাক হয়ে গেলেন। তার উপর এমন প্রাণখোলা আবদার!
তিনি কতক্ষণ শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন পাথরের মতন। বেলি দ্বিধায় পড়লো তাই। হাতের বাঁধন আলগা করতে চাইল। কিন্তু তার আগেই মুক্তা ভূঁইয়া তাকে আরও শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরলেন। আহ্লাদ করে বললেন,
‘ভিজবা তুমি বৃষ্টিতে? চলো। আজ রান্নাবান্না সব হবে পরে। আগে আমরা আনন্দ কইরা লই।’

খুশিতে আত্মহারা বেলি শাশুড়িকে নিয়ে এক ছুটে বাড়ির বাহিরে চলে গেল। ভারি বর্ষণে ভিজে গেলো দু’জনেই। তাদের খিলখিলিয়ে হাসি ভুঁইয়া বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রেমের বীণা বাজাতে আরম্ভ করল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মুনিব মুগ্ধ হলো এই দৃশ্যে। জামাল ভূঁইয়া কাজ করছিলেন ঘরে। এমন হাসির শব্দে তিনিও জানালা ভেদ করে নিচে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। নিজের রাগী স্ত্রীর এমন শৈশব মেশানো আনন্দ দেখে তার ভারি মন ভালো হয়ে গেলো।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ধরা পড়ল সওদাগর বাড়ির আঙ্গিনায়।

বৃষ্টি বাড়ল। সাথে বাড়তে লাগল আনন্দ। কিন্তু হুট করেই সেই আনন্দে বড়ো বিস্ময় দিয়ে বেলি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। শরীর হয়ে গেল অবচেতন, নিশ্চুপ।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে