সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০৮

0
147

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমে: মম সাহা

৮.
ছাদে আচারের বয়াম রোদে দিয়েছেন মুক্তা ভূঁইয়া। আচার রোদে দিলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে। তাই তিনি রোদ উঠলেই আচার শুকাতে দেন ছাদে। তাছাড়া বৃষ্টির মৌসুম, সবসময় রোদ পাওয়া যায় না। যখনই রোদ উঠে তখনই রোদের সঠিক ব্যবহার করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
মুক্তা ভূঁইয়া আচার রোদে দিতে দিতেই বেলি উড়নচণ্ডীর মতন হাজির হয়। উসকোখুসকো চুল গুলো খোলা। উদাস বাতাসে উড়ছে মৃদু মৃদু। শাড়িটাও ঠিক মতন পরনে নেই। কোণা দিয়ে পেট দেখা যাচ্ছে সামান্য। মুক্তা ভূঁইয়া ভ্রু কুঞ্চিত করলেন পুত্রবধূর এমন বেহাল দশায়।
‘এ কী অবস্থা! তুমি ঘুমাও নাই?’
বেলি শাশুড়ির দিকে আড়চোখে তাকাল। ঠোঁট উল্টে বলল, ‘দুপুরে আমার ঘুম হইতে চায় না। আগে তো দুপুরে কখনোই ঘুমাইতাম না। সেই অভ্যাস যায় নাই।’

মুক্তা ভূঁইয়া ছেলে বউয়ের দিকে নিবিড় পায়ে এগিয়ে এলেন। কোমড়ে হাত রেখে বললেন,
‘না ঘুমাইয়া কী করতা?’
‘ক্যান! পথে পথে হাঁটতাম। আর দেখতাম কারো বাড়ির আম পাঁকছে কি-না। কারো বাড়ির গাছে জাম ধরছে কি-না।’
‘মাইনষের বাড়ির আম-জাম দিয়া তোমার কী কাম আছিল?’

শাশুড়ির প্রশ্নে লাজুক হাসল বেলি। কাপড়ের আঁচলে আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, ‘লুকাইয়া সেই গাছ থেইক্কা এগুলান পাইড়া আনতাম। তারপর খাইতাম।’

বেলির লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন মুক্তা ভূঁইয়া। বেলির কাছাকাছি এসে মাথায় হাত বুলালেন মেয়েটার। এই ছেলের বউকে দেখলে তার ভীষণ মায়া মায়া লাগে। কন্যা সন্তান তার ভীষণ পছন্দের ছিল যদিও সৃষ্টিকর্তা তাকে কন্যা দেননি। ভেবে ছিলেন ছেলের বউদেরকে নিজের মেয়ের মতন রাখবেন কিন্তু বড়ো বউ আসতেই তার সেই ধারণা বদলে গেলো। বড়োলোক বাপের মেয়ে ছিল বড়ো বউ। তেমন করে কারো সাথে মিশতে চাইতো না। আলাদা আলাদা থাকতেই যেন তার ভীষণ ভালো লাগে। তাই আগ বাড়িয়ে মুক্তা ভূঁইয়ার আর মেয়ে পাওয়া হলো না। কিন্তু ছোটো বউ সেই আফসোস ঘুচিয়ে দিল যেন। প্রথম যেদিন এলো সেদিনই পুরো বাড়িতে অবিশ্বাস্যকর চঞ্চলতা ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটাকে একটু বেয়াদব লেগেছিল যদিও কিন্তু দিনে দিনে বড়ো কাছের হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। বড়ো মায়া পড়ে যাচ্ছে।

‘লুকাইয়া খাওয়া চুরি, জানো না?’
শাশুড়ির প্রশ্নে বেলি চোখ গোল গোল করে তাকাল। গাল ফুলিয়ে বলল, ‘কে কইলো চুরি? শৈশবের সবকিছুই আনন্দ, স্মৃতি আর সুখ। কোনোকিছুই চুরি না।’

‘বাপরে! এত জ্ঞানী কথাও জানো তুমি? ভাবছিলাম তো বাসর ঘরের গান ছাড়া তেমন কিছু জানো না হয়তো।’
শাশুড়ির ঠেস মারা কথায় বেলির গোল গোল চোখ লজ্জায় নিভু নিভু হয়ে গেল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেলল দ্রুত। দাঁত দিয়ে নখ কেঁটে পরিস্থিতি হালকা করতে চাইল।

মুক্তা ভূঁইয়া ছেলের বউয়ের জব্দ হওয়া মুখমন্ডল দেখে হেসে কুটিকুটি। বেলিও কতক্ষণ হাঁসফাঁস করে পরমুহূর্তেই হেসে দিলো। তাদের মধ্যে কথোপকথন গাঢ় হলো। মুক্তা ভূঁইয়া ছেলের বউকে বসিয়ে মাথায় তেল দিতেও শুরু করে দিলেন। সাথে কত গপ্পো!
দুপুরের রোদও নিভে এসেছে ততক্ষণে। বাতাসের বেগ বেড়েছে কিছুটা। ঠান্ডা বাতাসে আড্ডা জমে গেল আরও। দু’জনের সুখের কথা, শোকের কথা দু’জনকে বলতে লাগল বন্ধুর মতন। আড্ডার এক সময় মুক্তা ভূঁইয়া হুট করেই বেলিকে বললেন,
‘একটা কথা সত্যি কইরা বলবা?’

বেলি বসে ছিল সোজা মুখ করে। পেছনে বসে মুক্তা ভূঁইয়া তেল দিয়ে দিচ্ছিলেন। শাশুড়ির কথায় বেলি শাশুড়ির মুখের দিকে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘কী?’

‘বড়ো বউরে বলে সেদিন মেলায় একজন চুড়ি দিয়া গেছিলো? এডা সত্যি?’

বেলি হয়তো এই প্রশ্নটা আশা করেনি। তাই কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। তার উপর সেদিন মুনিব বলেছিল এই চুড়ির কথাটা বাড়ির কেউ যেন না জানে। তাহলে মা জানলেন কী করে তা ভেবে ভেবে মাথা ব্যথা হয়ে গেল তার। মুখটা শুকিয়ে ছোটো হয়ে গেল। আমতা-আমতা করতে লাগল বারংবার। মুক্তা ভূঁইয়া ভরসা দিলেন। আশ্বস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমারে কও। আমারে কইলি কিচ্ছু হইবো না।’

বেলি ভরসা পেল না তবুও মুনিবের কথা অমান্য করার সাহস পেল না। মুক্তা ভূঁইয়া ছেলে বউকে চুপ করে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হতাশ কণ্ঠে বললেন,
‘বড়ো বউরে বাড়িতে আনছি তিন বছর। বিয়ার কয়েকমাস পরেই আমার পোলাডা বিদেশ গেলো গা। অল্প বয়সী মাইয়া, স্বামীর সাথে সোহাগ বাড়ার আগেই স্বামীর সাথে দূরত্ব বাড়লো। কিন্তু তাই বইলা সে বাহিরে কারো সাথে এমন সম্পর্ক করব তা মন মানতে চায় না। তোমার শ্বশুর যখন কইলো আমার তো পায়ের নিচ থেইকা মাটি সইরা গেলো। মাইয়াটা উগ্রমেজাজী, রাগী, কটু কথা কয় সব মানছি। কিন্তু তাই বইলা চরিত্রে সমস্যা! এখন হাতেনাতে ধরতে না পারলে তো জিজ্ঞাসা করাও যায় না। কোন কথা কেমনে ঘুরাই ফেলবো কওয়া যায়! য়ে চালাক এই মাইয়া!’
শাশুড়ির এমন হাপিত্যেশে বেলি চুপ করে থাকে। তারও মন খারাপ হয় ভীষণ।

বেলি অবেলায় শুয়ে আছে বিছানায়। রুম অন্ধকার। মুনিব বাহির থেকে এসে এই অন্ধকার রুমটা দেখে অবাক হয় গিয়েছিল প্রথম পর্যায়ে। পরবর্তীতে ধাতস্থ হলো রুমে বেলি শুয়ে আছে। ভর সন্ধ্যে বেলা বাড়িতে লম্ফঝম্প না করে শুয়ে আছে মেয়েটা এই ব্যাপারটা বড়োই বিস্ময়কর ঠেকল মুনিবের কাছে। এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। বেলির পাশ ঘেঁষে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসলো। নরম হাতে মাথায় হাত রাখলো।
মেয়েটার কাছে এলেই মুনিবের কী যেন হয়। পৃথিবীর সমস্ত মুগ্ধতা এসে ভর করে তার চোখে-মুখে। বুকের উত্তাল ঢেউ নিরব হয়ে যায়। নিজেকে মনে হয় সর্ব সুখী।

মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেতেই ঘুম ছুটে গেলো বেলির। চোখ মেলে তাকালো। আবছা চোখে দেখতে পার়ছিল না প্রথম অবস্থায় কিন্তু ধীরে ধীরে অন্ধকার রুমে পুরুষ অবয়বটা স্বচ্ছ হতেই আঁতকে উঠল। খানিক চেঁচিয়ে বলল, ‘কে? কে?’

আকস্মিক বেলির ভীতি দেখে চমকে গেলো মুনিবও। দু’হাতের গাঢ় আলিঙ্গনে মেয়েটাকে বুকের মধ্যিখানে এনে ভরসা দিয়ে বলল,
‘আমি। আমি মুনিব। ভয় পেয়ো না।’

বেলির বুকের গতি ওঠা-নামা করছে দ্রুত। মারাত্মক ভয় পেয়েছে যে তা তার শরীরের কম্পন দেখেই আঁচ করা যাচ্ছে ভালো ভাবে। কিন্তু এতটা ভয় পাওয়ার তো কিছুই হয়নি!
মুনিব ধীরে ধীরে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। চুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে শরীরের কম্পন দূর করার চেষ্টা করল। এবং এক পর্যায়ে গিয়ে সে সক্ষম হলো। বেলির শরীরের কাঁপুনি কমে এলো। স্থির হলো অনেকটা। এমন বেপরোয়া মেয়েটার ইদানীং ভয় পাওয়ার ঘটনায় মুনিবের মনে চিন্তা বাড়তে থাকল। কী এমন কারণ যে মেয়েটা এত ভয় পেয়ে আছে? ওকে কি কেউ ভয় দেখিয়েছে?
মনের সন্দেহ মনেই রাখে মুনিব। উপর উপর বলে,
‘ঠিক আছো তুমি, মল্লিকা? ভয় গিয়েছে?’

বেলি বুকে মাথা গুঁজে রেখেই মাথাটা নাড়ায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘ঠিক আছি।’
মুনিবের আলিঙ্গন ভরসা রেখে এবার নৈকট্যের দিকে যায়। ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে একটু একটু করে। তন্মধ্যেই বাহির দেখে হৈচৈ ভেসে আসে ভয়ঙ্কর ভাবে। দু’জনেই ছুটে যায় দ্রুত। ড্রয়িং রুম জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তা ভূঁইয়া এবং উনার বড়ো ছেলের বউ চামেলি। মূলত উচ্চকণ্ঠটা চামেলির ছিল।

বেলি যেতেই চামেলি ছুটে আসে বেলির কাছে। শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে চ ড় বসায় বেলির গালে। আক্রোশে ফেটে পড়ে মুহূর্তেই। চেঁচিয়ে বলে,
‘তুমি কেমনে আমার নামে এমন বদনাম ছড়াইতাছো? তুমি কি-না আমার চরিত্র নিয়া গুজব ছড়াও! এতো বড়ো সাহস তোমার!’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে