সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০৭

0
212

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমেঃ মম সাহা

৭.
বড়ো বউ এত বেশি ঘুমে নিমজ্জিত ছিল যে তার দরজায় পর পর অনেকগুলো কষাঘাত করার পর সে দরজা খুললো। ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থা। টেনেও চোখ মেলে রাখতে পারছে না। জামাল ভূঁইয়া ধমকে উঠলেন চামেলিকে,
‘কী ঘুম ঘুমাও তুমি হ্যাঁ? বাড়িতে চোর পড়লো নাকি ডাকাত পড়লো কোনো খবরই নাই তোমার!’

চামেলির ঘুমে বিভ্রান্ত মস্তিষ্ক। অস্ফুটস্বরে বলল, ‘চোর! চোর আইছিলো আবার!’

‘চোখ খুইল্যাই দেখো। তোমার ঘরের সামনে চোর তার চিহ্ন রাইখা গেছে।’

চামেলি ঘুমে নিভে আসা চোখ জোড়াকে টান টান করে ফ্লোরের দিকে তাকাল। পায়ের ছাপ স্পষ্ট ফ্লোরে। চমকে গেল সে। ঘুম এবার পালালো বোধহয়। দেখা গেল আতঙ্ক তার মুখে। আঁতকে উঠে বলল,
‘কখন আইছিল চোর? আল্লাহ্, ভাইগ্যডা ভালা দরজা আটকাইয়া আজকে ঘুমাই ছিলাম।’

বেলি তখনও মুনিবের বুকের কোণায় লেপটে আছে। জামাল ভূঁইয়া চামেলির দিকে গাঢ় সন্দেহ নিয়ে তাকাল। তার যেন বার বার মনে হতে লাগল চামেলির এই চোখ টেনে আসা ঘুমটা নেহাৎই নাটকীয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। বরং গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘তালেব যতদিন না আসব তোমার সাথে ফরিদা বিবি ঘুমাইবো। তারে সঙ্গে নিয়া আইজ থেইক্যা ঘুমাইবা।’

শ্বশুরের আদেশ পছন্দ হলো না যেন চামেলির। সে কপাল কুঁচকে বলল, ‘কেন?’

‘আমি কইছি তাই। তালেব বিদেশ থেইক্যা আইলে ফরিদা বিবি আবার নিজের জায়গায় ঘুমাইবো না।’

‘না, আব্বা। আপনে তো জানেন অন্য কারো লগে আমি ঘুমাইতে পারি না।’

‘ঘুমাইতে হইবো এখন। বাড়িতে যা কীর্তিকলাপ শুরু হইছে তোমারে তো একলা রুমে আর দেওন যাইবো না। একলা মাইয়া মানুষের রুমে চোরও যদি ঢুকে কী খারাপ হইবো ব্যাপারটা ভাবছো একবার? আর কোনো কথা হইবো না।’

শ্বশুরের সিদ্ধান্ত অপছন্দ হলো চামেলির কিন্তু জামাল ভূঁইয়া তাতে আশকারা দিলেন না। বরং ফরিদা বিবিকে নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি আইজ থেইকা বড়ো বউয়ের সাথে ঘুমাইবা। কান সজাগ রাখবা। কে, কী করে, কে আসে, কে যায় আমারে জানাইবা।’

জামাল ভূঁইয়ার শেষ কথায় ইঙ্গিত ছিল যা অন্যকেউ তেমন বুঝতে না পারলেও মুনিব বুঝল ঠিক। কিন্তু বেলির সামনে সেই ইঙ্গিত নিয়ে কথা বললে খারাপ প্রভাব পড়বে বলে সে বুঝেও চুপ থাকে।

দখিন দিকের জানালা ঘেঁষে সূর্যের আভা এসে পড়ছে কোণাকুণি খাটে। বেলির কৃষ্ণাভ মুখমন্ডলে সেই আলো দেখাচ্ছে আধ্যাত্মিক সুন্দর। সুন্দর, সূঁচালো ভ্রু জোড়া সাথে চোখের অত্যাধিক বড়ো বড়ো পাপড়িযুগলই যেন বেলির পুরো মুখের সৌন্দর্যতা বর্ধনে একাই ভূমিকা পালন করছে। মুনিব হাত-মুখ ধুয়ে সবে বের হয়েছে। সারারাত ঘুম না হওয়ায় চোখ জোড়া ফুলে লাল হয়ে আছে। শেষ রাতের দিকে বেলির যে-ই গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো! এরপর কি আর ঘুমিয়ে থাকা যায়? জলপট্টি দেওয়া, শরীর মুছিয়ে দেওয়া সব করেছে একা হাতে।

ঘরে ঢুকতেই রৌদ্রস্নানে মুখরিত ঘুমন্ত বেলিকে দেখে সারা রাতের ক্লান্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মুনিবের। এত শান্ত, কোমল মুখখানি পৃথিবীর সবটুকু শান্তি যেন ধারণ করে আছে। মুনিব গিয়ে রোদের বরাবর দাঁড়াল। অতিরিক্ত রোদে মেয়েটার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে বিধায় সে জানালা আটকে দিল। পুরো রুম জুড়ে আধো অন্ধকার নেমে এলো নীরবেই। মুনিব গিয়ে আলগোছে বেলির কপালে হাত ছুঁয়ালো। ঝ্বর কমেছে অনেকটা। কাল রাত এত বেশিই ভয় পেয়েছে যে মেয়েটার জ্বরই উঠে গিয়েছে!
কপালের হাত গাল স্পর্শ করল। তারপর আঙ্গুল স্পর্শ করল রুক্ষ ঠোঁট গুলো। যেন কত বছরের পিপাসায় ক্লান্ত এই ঠোঁট জোড়া। মুনিবের সাধ জাগলো একবার পিপাসা মোচনের কিন্তু মেয়েটার ঘুম ভেঙে যাবে বলে সে নিজেকে সংযত রাখল। মাথায় পর পর কয়েকবার হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। যাওয়ার আগে দরজাটা টেনে দিতে ভুললো না।

খাবার টেবিলে সকলেই সকালের খাবারের জন্য একত্রিত হয়েছে। চামেলি খাবার এগিয়ে-পিছিয়ে দিচ্ছে। সাথে ফরিদা বিবি সাহায্য করছেন। মুনিবকে দেখেই মুক্তা ভূঁইয়া প্রথমে প্রশ্ন করলেন,
‘ছোটো বউ কই? উঠে নাই আইজ?’

মুনিব মাথা নাড়ালো। টেবিলে বসতে বসতে বলল, ‘না, জ্বর এসেছে। সারারাত ঘুমায়নি। তাই এখন ঘুমাচ্ছে।’

বিচলিত হলেন মুক্তা ভূঁইয়া। ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, ‘জ্বর! মাঝ রাতেও না ভালো দেখলাম?’

‘হ্যাঁ। হয়তো ভয় পেয়েছিল রাতে। তাই জ্বরটা এসেছে।’

‘কী যে শুরু হইলো বাড়িডাতে! ভুঁইয়া বাড়িতে কহনো চোর পা রাখার সাহস করতে পারে নাই। এই এলাকার কারো এত কলিজা নাই। কিন্তু কয়দিন ধইরা হেই ভুঁইয়া বাড়িত কি-না চোর ঢুকতাছে! আমার কেমন ডর ডর লাগতাছে। বড়ে ভাই, আপনে কিছু ভাবেন না কী করবেন?’
মুনিবের ফুপু তানু ভূঁইয়ার কথায় মাথা নাড়ালের জামাল ভূঁইয়া। কী যেন ভাবতে ভাবতে কঠিন হয়ে এলো তার মুখ-চোখ। নিরানন্দ স্বরে বললেন, ‘দেহি কী করা যায়। কিছু না কিছু তো করতেই হইবো।’

‘এমন চোর কি এর আগে কহনো আইছিল এই বাড়িত?’

জামাল ভূঁইয়া উত্তর দেন না। মুখটা কেমন শুকিয়ে যায় কোন ভাবনায়। কিছু হয়তো ভাসতে থাকে চোখের পর্দায়। যা বলতে পারেন না অথচ অন্তরে রাখলেও ব্যথা হয়।

খাবার দাবার শেষ হতেই বাবার ঘরে এলো মুনিব। জামাল ভূঁইয়া তখন মোটা খাতায় ব্যবসায়ের হিসাব কষছেন। ছেলেকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে খাতাটা বন্ধ করে দিলেন। রাশভারি কণ্ঠে বললেন,
‘কিছু বলবা?’

মুনিব এসে কাঠের টুলটায় বসলো। তীর্যক চোখে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। মনে যেই প্রশ্ন গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে তা আদৌ বাবাকে বলা কতটুকু যুক্তিসংগত হবে তাই ভাবছে ভেতর ভেতর।
জামাল ভূঁইয়া বললেন, ‘কী কথা কইতে এত সময় নিতাছো?’
মুনিব এবার আর সংশয় ধরে রাখল না। কিছুটা বিব্রত কণ্ঠেই বলল, ‘আব্বা, আপনার কী মনে হয়? চুরির ব্যাপারটা আসলে কী?’

জামাল ভূঁইয়ার চোখে চিকন গ্লাসের চশমা ছিল। ব্যবসায়ের হিসেব কষতে নিলে তিনি চশমা ব্যবহার করেন। আজও সেই সূত্রে চোখে দিয়েছিলেন। সেই চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন৷
‘চুরি ব্যাপার কী হইবো? চুরি তো চুরিই না-কি!’

মুনিব বাবার চতুরতা সম্পর্কে অবগত তাই বাবার কথা ঘোরানোর এমন পারদর্শিতায় মোটেও বিচলিত কিংবা উত্তেজিত হলো না। ঠাঁই বসে থেকে বলল,
‘ভাবিকে সন্দেহ করার কারণ কী?’

ছেলের কথায় এবার জামাল ভূঁইয়া নড়েচড়ে বসলেন। কপালে পড়ল তিন ভাঁজ।
‘সন্দেহ করি!’

‘করেন না বলছেন?’

মুনিব যে একেবারেই বাবার মতন চতুর হয়েছে তা জানেন জামাল ভূঁইয়া। তাই আর কথাকে ঘুরিয়ে নয়-ছয় না করেই বললেন,
‘তালেব দেশে নাই আড়াই বছর। বড়ো বউয়ের বয়স মাত্র তেইশ। এ বয়সে তার স্বামীর দূরে থাকাটা হয়তো তার জীবনে পাপ করার বড়ো কারণ হইয়া দাঁড়াইতাছে। তাই না?’

‘বিনা কারণে সন্দেহ করাটা অমূলক নয় কি?’

জামাল ভূঁইয়া ছেলের প্রশ্নে মাথা দুলালেন। আলগোছে খাট থেকে নেমে জানালা বরাবর দাঁড়ালেন। বললেন, ‘বহু বছর আগে এমন ঘটনা এ বাড়িতে ঘটেছিল। তুমি তো জানো সেইটা না-কি?’

‘সবসময় এক ঘটনাই বার বার ঘটবে তেমনটা তো না।’

‘মুনিব, আইজ সকালে তোমার জিলহজ চাচা আসছিল। জানো সেইডা?’

হুট করেই কথার প্রসঙ্গ নব্বই ডিগ্রি ঘুরে যেতেই মুনিব অবাক হলো। সুর টেনে বলল, ‘তো?’

‘গত কয়েকদিন যাবত তোমার চাচা রাতে আমাদের বাড়িতে একটা ছেলেকে ঢুকতে দেখেছেন। প্রথমে ভাবছিল তুমি হইবা। বা বাড়িতে কত মেহমান একজন না একজন হইবো। কিন্তু কাইল রাইতে দেখছে একজন কেউ ছেলেটারে বাড়িতে ঢুকাইতাছে। মেয়েলি অবয়ব ছিল। অন্ধকারে মুখ দেহে নাই তোমার চাচা। কিন্তু কয়েকবার ডাকাডাকি কইরা জিজ্ঞেস করছে কিন্তু কোনো সাড়া দেয় নাই। চোরকে কেউ নিজে যেচে বাড়িতে আনবো বইলা তোমার মনে হয়?’

মুনিব বাবার কথায় হতভম্ব হয়ে গেল। মাথা ঘুরাতে লাগল তার। মনের মাঝে যে কথাটা জাগ্রত হলো সেই চরিত্রের সাথে ভাবির চরিত্র মেলাতে বড়ো খারাপ লাগছে তার। সে বিমর্ষ মনে বলল, ‘আপনি যা ভাবছেন তা আদৌ সম্ভব?’

‘সম্ভব কি-না জানি না। কিন্তু অসম্ভবও তো না তুমিই কও।’

মুনিব আনমনে মাথা নাড়াল। আর কিছু বলার মতন শব্দ পেল না।

বেলিকে নিয়ে যদিও আগের দিন মেলা ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি। তাই আজ মুনিব ঠিক করলো বেলিকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। শুধু বেলি নয় সাথে ভাবি এবং কণিকাও যাবে। বেলির জ্বরটা নেমেছে। মুখ-চোখ শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটা একদিনের জ্বরেই।
বেলির শাশুড়ি বেলিকে একটা সুন্দর শাড়ি পরিয়ে দিলেন। মাথা ভর্তি চুলগুলোকে সুন্দর করে বেঁধে দিলেন। শাশুড়ির এমন যত্নে মুগ্ধ হলো বেলি। হেসে বলল,
‘আইজ সূর্য কোন দিকে উঠছে কন তো, আম্মা?’

মুক্তা ভূঁইয়া তখন চুলের শেষ অংশের বেণীখানি করছিলেন। ছেলের ভউয়ের কথায় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, ‘ক্যান?’

‘এই যে আপনি এত যত্নআত্তি করতাছেন। এই যত্ন আমার ভাইগ্যে আছে ভাবতেই পারতাছি না।’

মুক্তা ভূঁইয়া চোখ রাঙালেন। বেলিকে মিছি মিছি শাসিয়ে বললেন,
‘এত কথা একদম কইবা না। শুধু শুধু মানুষরে খোঁচা দেও ক্যান?’
‘অ্যাহ্! শুধু শুধু খোঁচা দিছি না কারণে তা আপনে ভালোই জানেন।’

মুক্তা ভূঁইয়া আর কথা বললেন না। মেয়েটা এত মুখের উপর কথা বলে! কোনো কিছু মানে না।

আকাশে সূর্য তখন ঢলে পড়েছে নিজ ভঙ্গিমায়। আলো আঁধারের মিশেলে অপূর্ব এক আকাশ বুক ফুলিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে মাথার উপর। বেলিরা মেলাতে এসে প্রত্যেকেই যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে এত আলোকসজ্জা, এত সুন্দর সুন্দর জিনিস যেন কোন আনন্দের বাজার এটা।
মুনিব পরিচিত একজনের সাথে কথা বলে আসতেই দেখলো বেলি আশেপাশে নেই। ভাবি আর কণিকা মাটির জিনিসপত্রের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র দেখছে। মুনিব আশেপাশে চোখ বুলাতেই খেয়াল করল বেলি একটা দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মুনিব সেখানে যেতেই দেখল একটা ছেলে দ্রুত বেগে ছুটে যাচ্ছে।
আচমকা মুনিবকে দেখে যেন ভূত দেখার মতন চমকে উঠল বেলি। আর তার চমকে উঠাটা এতই অস্বাভাবিক ছিল যে মুনিবের চোখে লেগে গেল। সে অবাক স্বরে বলল, ‘তুমি এখানে কেন? কে ছিল ছেলেটা? তোমার পরিচিত?’

মুনিবের পর পর প্রশ্নে চুপ হয়ে গেল বেলি। থতমত খেয়ে আছে। তার মাঝেই বেলির হাতে এক মুঠ চুড়ি নজরে এলো মুনিবের। চুরি গুলো ছোঁ মেরে নিজের কাছে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
‘এগুলো কে দিয়েছে তোমাকে? কার থেকে নিয়েছ?’

বেলির মুখটা এটুকু হয়ে এলো ভয়ে। কথা বেরোচ্ছে না। তবুও অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ঐ ছেলেটা গিয়েছে।’

মুনিব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলল, ‘ঐ ছেলে দিয়েছে? কেন? কে হয় তোমার?’

বেলি মাটির দিকে তাকিয়ে মিন মিন করে বলল, ‘আমি তো চিনি না। আমারে হুট করে এইখানে ডাইকা আইন্যা কইলো বড়ো ভাবিরে চুড়িডি দিতাম। আর কাউরে যেন না কই। এরপরেই তো আমি কিছু কওয়ার আগে দৌড়ায় গেলো গা।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে