সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০৬

0
151

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমে: মম সাহা

৬.
‘আম্মা, আমি হয়তো একটু ঝগড়া বেশি করি তাই বইলা তুমি আমারে চোর বানাইতে পারো না।’

মেয়ের উগ্র কণ্ঠে মানসুরা বেগম কিছুটা থতমত খেলেন। অতঃপর মেঘমন্দ স্বরে বললেন, ‘না, আমি ভাবছিলাম হয়তো তুই রাগ কইরা পলাইছত।’

‘এতডি গয়না আমি রাগ কইরা পলামু? আমার এত ক্ষমতা নাকি!’
বেশি বিরক্তি নিয়েই বলল বেলি। মানসুরা বেগম আর জবাব দিলেন না। চুপ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেলি মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে তৈরি হওয়ায় মনযোগ দিল।

রাত হলেও ভূঁইয়া বাড়ির সকল ঘরে ঘরে আলো জ্বালানো। নিদ্রার আভাসটুকু নেই কারো চোখে। এতগুলো গহনা হারানোর পর শোকে যেন পাথর হয়ে গিয়েছেন মুনিবের বাবা।
বেলি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে এক এক করে টেবিলে রাখল সাজিয়ে। তারপর সবাইকেই খেতে ডাকল। শ্বশুরের ঘরে গেল শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্বামীকে ডাকতে।

ঘরের মাঝে চুপচাপ মা-বাবার সাথে বসে ছিল মুনিব। বেলি দরজায় দাঁড়িয়েই বলল, ‘মা, খাওন বাড়ছি। খাইতে আসেন।’
মুক্তা ভূঁইয়া স্বামীর পায়ে তেল মালিশ করছিলেন। বেলির কণ্ঠ পেতেই সকলের দৃষ্টি গিয়ে আটকাল দরজায়। জামাল ভূঁইয়া তো চোখ মেলেই ওকে দেখে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন, ‘ও আমার ঘরের সামনে কী করে? ওরে যাইতে বলো মুক্তা। বাড়িতে বউ তুলতে না তুলতে এত বড়ও সর্বনাশ হইলো আমার। অর লগে কুফা আসলো আমার বাড়িডায়।’

মুনিব বাবার আক্রোশের তীব্র প্রতিবাদ করে বলল, ‘আব্বা, ওর সাথে আপনি ভালো ভাবে কথা বলতে পারলে বলবেন নয়তো বলার দরকার নেই। সব ব্যাপারে আপনি এমন বাড়াবাড়ি করতে পারেন না।’

‘দেখছো, দেখছো, আমার নিজের ছেলে নাকি আমার লগে এমন আচরণ করতে পারে! বাপের প্রতি অর কোনো টান নাই। দুইদিনের বউয়ের লাইগ্যা যেন দুনিয়া আটকায় যাইতাছে।’

‘দুই দিনের বউ হোক আর একদিনের, কথা তো দিয়েছি চিরজীবন পাশে থাকার। আপনার আচরণ ঠিক করেন, আব্বা।’
‘ঠিক করমু না। কী করবা তুমি? হ্যাঁ?’

এবার বেলি দরজায় দাঁড়িয়েই উত্তর দিল, ‘হেয় আর কী করব? করতাছে তো উপরওয়ালা। আমারে গয়না দেওনের সময় কইছিলেন না এই গয়না আমার শরীরে মানাইবো না? এহন চোরের হাতে মানাইতেছে না? এক্কেরে ঠিক কাম হইছে। মাইনষেরে ছোডো কইরা কথা কইলে তা নিজের উপরে ফিরা আহে। বুঝছেন।’
বেলির কথা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতন কাজ করল। জামাল ভূঁইয়া আরও রেগে গেলেন। মুহূর্তে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন। তিনি তাজ্জব হয়ে যাচ্ছেন রীতিমতো নতুন বউয়ের কথা শুনে। বাড়ির এতগুলো গয়না চুরি হলো অথচ মেয়েটার মনে কোনো হা-হুতাশ নেই? বলে কি-না ঠিক হইছে?

অবস্থা বেগতিক দেখে মুনিব তাড়াতাড়ি বেলিকে নিয়ে চলে এলো সেখান থেকে। বাবার শরীর এমনেতেই খারাপ হয়ে গিয়েছে। পরে চেঁচামেচিতে আরও খারাপ হয়ে গেলে সমস্যা। এমনেতেই একটা স্ট্রোক করে ফেলেছেন মানুষটা কিছুদিন আগে। আজকে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে আরেকটা স্ট্রোক করলে জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

রাত তখন ভালোই হয়েছে। যার যার ঘরে ঘুমিয়ে আছে সকলে। কেবল সজাগ বেলি। আজও দক্ষিণ দিকের জানালাটা মেলে দিঘির সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে। বাড়িতে আজও বিদ্যুৎ নেই। রাত হলেই বিদ্যুৎ থাকে না ইদানীং। অতিরিক্ত গরম কিংবা বৃষ্টি হলে বিদ্যুৎ চলে যায়।
বাহিরের মৃদুমন্দ বাতাস এসে গায়ে লাগছে। এক ধারে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এরপর পানি খাওয়ার জন্য গেল ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলো কাজের মহিলাটি সজাগ। চা বসিয়েছেন চুলাতে। হয়তো তার শাশুড়ির জন্য। ভদ্রমহিলা আবার চা খেতে পছন্দ করেন।

‘নতুন বউ, ঘুমান নাই অহনো?’
ফরিদা বিবির কথায় রান্নাঘরের দরজায় তাকাল বেলি। পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল, ‘না। ঘুমাইলে কি আর পানি খাইতে আসতে পারতাম।’

ফরিদা বিবি হাসলেন নতুন বউয়ের কথায়। রান্নাঘর থেকে আরেকটু এগিয়ে এসে বেলির কাছাকাছি দাঁড়ালেন। কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘জানেন আইজ কী হইছে? আপনে তো বাড়িত আছিলেন না, বড়ো বউ আপনের নামে কী কইছে জানেন?’

বেলি ভ্রু কুঁচকালো। মাথা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কইছে?’

ফরিদা বিবি সাবধানী কণ্ঠে বললেন, ‘গয়না চুরির কথা ছড়ায় যাওনের পর বড়ো বউ কয় গয়না না-কি আপনে নিছেন। কারণ এর আগে কহনো এ বাড়িতে চুরি হয় নাই। আপনে আহনের পর হইছে তাই হের সন্দেহ আপনিই কামডা করছেন।’

ফরিদা বিবির কথায় ফুসে উঠল বেলি, ‘কী! হেয় এত বড়ো কথাডা বলছে! সত্যি?’

‘খোদার কসম, নতুন বউ। হেয় বলছে। পরে মুনিব বাপজান আইস্যা এডি শুইন্যা অনেক চিল্লাফাল্লা করছে। হের লাইগ্যাই তো কেউ আর কিছু কয় নাই আপনারে। না হইলে এতক্ষণে আপনারে ছিঁড়া ফেলতো।’

বেলি হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘আমিও ছিঁড়তে জানি।’

কথা শেষ করেই ঘরে চলে গেল সে। মুনিব তখনও ঘুমুচ্ছে অথচ বেলি জেগে রইল নিশি। ঠান্ডা বাতাসে ঘর ভরে গেল অথচ কোনো এক চিন্তায় ঘুম এলো না বেলির।

বাড়ির মেহমান তেমন আর নেই। গয়না চুরি হওয়ার পরের দিনই প্রায় সকলে চলে গিয়েছে। কেবল ফুপি শাশুড়ি আর উনার মেয়ে কণিকা রয়ে গিয়েছে। জামাল ভূঁইয়া দুই দিনেই যেন গহনা হারানোর শোকো কুঁজো হয়ে গিয়েছেন তবে বেলিকে দেখলে তার যথারীতি আক্রোশ ছোড়া অব্যাহত আছে।
সকালে খাবার টেবিলে বসেছে সকলে। কেবল মুনিব আর বেলি বাদে। বেলি সবাইকে খাবার দিচ্ছে আর মুনিব দাঁড়িয়ে আছে অকারণ।

জামাল ভূঁইয়া খেতে খেতে বললেন, ‘তোমার কী হইছে? সবার লগে খাইতো বও না ক্যান? নতুন কইরা নিয়ম বানাইছো না-কি?’
মুনিব অকপটে বলল, ‘খিদে নেই।’

‘খিদা থাকব না ক্যান? প্রতি বেলা এক কথা কও। কাহিনি কী?’

‘যেহেতু এক কথাই বলি তার মানে কাহিনি তো আছেই কিছু একটা যা আপনাদের বলা যাবে না। তাহলে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করার কী আছে?’

এবার মুনিবের ফুপু তানু ভূঁইয়া খোঁচা মেরে বললেন, ‘কাহিনি তুই না কইলে কী হইছে? আমরা কি জানি না লাগে? বউ পাগল এতই হইছত যে অহন বউরে ছাড়া খাইতে পারছ না।’

ফুপুর মুখে কোনো কালেই লাগাম ছিল না তা জানে মুনিব। তাই কিছুটা রাগান্বিত চোখেই ফুপুর দিকে তাকাল। কণিকা নিজের মায়ের আচরণে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আহা আম্মা! এত কথা কেন বলতে হবে তোমার?’

তানু ভূঁইয়া মেয়েকে ধমকে বললেন, ‘কমুই তো। আমি তো মিছা কিছু কই নাই। তুই চুপ থাক।’

‘সত্যই কইছেন ফুপু। কিন্তু আপনেরে তো কেউ সত্য কইতে কয় নাই এইহানে। আর হেইদিন দেখলাম ফুপা আপনার লাইগ্যা খাওনের টেবিলে অপেক্ষা করতাছিল, মাছের অর্ধেক টুকরা রাইখ্যা দিছিল, আপনের বাতের ব্যথা বাড়ব দেইখা নিজে মোড়া ছাইড়া আপনেরে বইতে দিছিল। ফুপার ভালোবাসা আপনি যে নিতাছেন আমরা কি কিছু কইছি কহনো? তাইলে আপনে কেন এত কথা কইবেন বুঝান আমারে।’

বেলির মোক্ষম সময়ে মোক্ষম কথায় চুপ করে গেলেন তানু ভূঁইয়া। মুনিব হাসল চাপা হাসি। ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘ফুপি, এ জন্য বলি এত কথা সবসময় বলবেন না। বেলির সামনে তো না-ই।’

মুনিবের বউকে এত আশকারা দেওয়া যেন মানতে পারল না চামেলি। তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘বাপরে, যেমনে বউরে মাথাত তুলো মনে হয় বউ না যেন শিন্নি।’

‘তাতে আপনের বড়ো জ্বলে তাই না, আপা?’
বেলির টিটকারিতে রেগে গেল চামেলি। ধমকে বলল, ‘তুমি আমার লগে এমন কইরা কথা কইবা না বইলা দিলাম।’

‘তাইলে আপনেও হুদাই খোঁচা দিয়েন না। খোঁচা দিলে খোঁচা খাইতেই হবে।’

জামাল ভূঁইয়া এবার পুরো ঘর কাঁপিয়ে ধমকে উঠলেন, ‘ একটা কথা বলা যায় না আজকাল এই ঘরে। কী একটা বউ যে এলো এর চোপাই শেষ হয় না!’

বেলি মুখ ভেংচি দিল। আরও কিছু বলত কিন্তু মুনিবের ইশারায় চুপ করে গেল। তাছাড়া এমনেতেও তার ঝগড়ার মন নেই।

সবাই খেয়ে উঠতেই খেতে বসল মুনিব। মুখ-চোখ অন্ধকার করে তাকে খাবার দিতে লাগল বেলি। মেয়েটা যে রাগ করে আছে তা বুঝতে বাকি নেই মুনিবের। তাই সে বেলির ডান হাতটা টেনে ধরল। মৃদু স্বরে বলল, ‘রাগ করেছো?’

বেলি টেনে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। কণ্ঠ ভার করে বলল, ‘না, রাগ করমু কেন? খুশি হইছে। আপনার আব্বা কইলো আমি না-কি চোপা করি। তো আমি খুশি হমু না এমন একটা কথা হুইন্যা?’

‘আব্বা ভালো হোক। তারপর তুমি তার কথার উত্তর দিয়ে দিও, কেমন? এখন তো আব্বুর শরীরটা একটু খারাপ তাকে উত্তেজিত করা যাবে না। নাহয় সমস্যা হবে।’

বেলি আর কথা বলল না। মুখ ফুলিয়েই রাখল। মুনিব খাবার নিয়ে মুখের সামনে ধরতেই মুখ ফিরিয়ে নিল। মুনিব হাত ধরে টেনে বসিয়ে খাবার পুরে দিল মেয়েটার মুখে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘রাগ করো না। আজ বিকেলে তোমাকে মেলা ঘুরতে নিয়ে যাব কেমন?’

এবার বোধহয় রাগ পড়ল বেলির। মুখের খাবার চিবুতে চিবুতে থাকা বলল, ‘সত্যি?’

‘একদম সত্যি।’

পুরো বাড়ি ঘুমে নিমগ্ন। হুট করেই চেঁচামেচির শব্দে কান খাঁড়া হলো মুনিবের। সজাগ হয়ে দেখলো এই রাতে বেলি তার পাশে নেই। ড্রয়িং রুম থেকে তাহলে নিশ্চয় মেয়েটাই চেঁচাচ্ছে!
মুনিব আর সাত-পাঁচ না ভেবে ছুটে গেল। বেলি টেবিলের সাথে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুনিব যেতেই জড়িয়ে ধরল তাকে। ততক্ষণে সজাগ হয়ে গিয়েছে সকলে। বাহির থেকে ছুটে আসতে দেখা গেল ফরিদা বিবিকে। হাতে মোটা লাঠি। মুনিব ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধাল, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে?’

বেলি তখনো কাঁপছে। ফরিদা বিবি কপালে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘চোর আইছিল মনে হয়। ঘুম থেইকা উইঠ্যা দেহি বহনের রুমে কেডা জানি ফিস ফিস করে। আমি জিগাইলাম— কে। কোনো জবাব আইলো না। এরপরই দেখলাম বড়ো বউয়ের দরজায় শব্দ হইলো আর ছুডো বউ দৌড়ায় আইস্যা চিৎকার দিল ভয়ে।’

জামাল ভূঁইয়ার কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। উনার বাড়িতে চোর আসছে আজকাল ব্যাপারটা যেন হজম হলো না। বড়ো বউয়ের রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন দরজা আটকানো কিন্তু দরজার সামনে পায়ের ছাঁপ রয়েছে কারো!

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে