সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০৫

0
185

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমে: মম সাহা

৫.
বেলির যে রুমে অবস্থান সে-ই রুমের দক্ষিণ দিকের জানলা খুললে দেখা যায় একটি শান্ত, নিবিড় দিঘি। পূর্ণিমার রাতে যে দিঘিতে চাঁদের জোছনা স্নান করে আহ্লাদে। দিঘিটির নাম চন্দ্রমল্লিকা। দিঘির জল গুলো কুচকুচে কালো। বুক থৈথৈ জল। কালো জলেও এই দিঘি যেন সমগ্র রূপ বুকে নিয়ে বসে আছে।
অদ্ভুত ভাবে বেলি আজ খেয়াল করল দিঘিটাকে। সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিয়েছিল। জানালা খুলে দিতেই সুন্দর, স্নিগ্ধ বাতাসে ঘরটা ভরে যায়। তখনই সে খেয়াল করে দিঘিটিকে। মনে হয় তাকিয়ে থাকতে সেই দিঘির দিকে। দিঘির চারপাশে খোলা জঙ্গল তাই হয়তো বাড়ির পিছনের এই দিঘিটির সাথে বাহিরের কেউ তেমন পরিচিত নয়।

মুনিব ঘরে ছিল না। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় বাহিরে গিয়েছিল কোনো একটা কাজে। যখন ঘরে ফিরল তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে যাবে ভাব। ঘরে ঢুকতেই দেখে চঞ্চল বেলি দিঘির পানে মুখ করে তাকিয়ে কী যে ভাবছে উদাস চোখে। সেই চোখে চঞ্চলতা নেই, দুষ্টুমি নেই। আছে এক রাশ আনমনা ভাবনা। যেই ভাবনার প্রখরতা এতই বেশি যে মুনিবের ঘরে প্রবেশ করার শব্দটুকুও আমলে নিল না।

‘কী ভাবে আমার উড়নচণ্ডী? কোথায় তার মন? কে নিল তার চঞ্চলতা শুনি?’

বেলির বাহিরে থাকা দৃষ্টির ধ্যান চ্যুত হয়। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে মুনিব তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। একদম নিকটে।
বেলি মৃদু হেসে জবাব দেয়, ‘কিছু না।’

মুনিব এক হাতে বেলির বাহু জড়িয়ে ধরে। আরেক হাত মেয়েটার থুতনিতে রেখে শুধায়, ‘আমার কথা ভাবছিলে বুঝি?’

বেলি উত্তরে কেবল হাসে। মুনিব নিজেই তখন বাহিরের দিকে তাকায়। দিঘিটার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে, ‘এই যে দেখছ দিঘিটা, ওর নাম কি জানো?’
বেলি উত্তর দিল, ‘না।’

‘দিঘিটার নাম চন্দ্রমল্লিকা। চাঁদের আলো এসে দিঘিটায় পড়ে বলে এই নাম রাখা হয়েছিল। আর মল্লিকা রাখার কারণ দিঘির আশপাশ জুড়ে তখন নানান রঙের মল্লিকা ফুলের গাছ ছিল।’

বেলি উৎসাহী গলায় বলল, ‘তাই না-কি! কে রাখছিল এমন নাম?’
‘আমার দাদা। এটার নামকরণ করে আমার দাদা। শুনেছি তিনি খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। ফুল, জল, পাতা, আকাশ ছিল দাদার প্রথম ভালোবাসা। সবকিছুর তিনি নাম রাখতে ভালোবাসতেন।’

‘তার জন্যই কী আপনিও নাম রাখেন এত?’
বেলির প্রশ্নের মানে বুঝলো না মুনিব। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, ‘কী?’

বেলি এবার মুনিবের দিকে ঘুরল। চোখে চোখ রেখে বলল, ‘এই যে আপনে আমারে কহনো মল্লিকা, কহনো উড়নচণ্ডী ডাকেন কিন্তু আমার নাম তো বেলি। আপনে তো আমারে অন্য নামে ডাকেন সেডাই কইছি। আপনিও কি নাম রাখতে ভালোবাসেন কি-না জিগাইলাম।’

মুনিব হাসল বেলির আগ্রহ দেখে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘বেলির সমার্থক নাম মল্লিকা। আমার দাদা বেলিফুলকে মল্লিকা ডাকতেন। সেজন্য আমিও তোমায় মল্লিকা ডাকি। আমি দাদার মতন সবকিছুর নাম রাখি না। শুধু যেগুলো যেগুলো আমি ভীষণ ভালোবাসি, সেগুলোর নাম রাখি।’

মুনিবের কথায় খানিক হাসল বেলি। এরপর কিছুটা ঘুরে দিঘির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী সুন্দর ঘ্রাণ আইতাছে কন? বেলিফুলের গাছ আছে দিঘির লগে নাকি?’

‘হ্যাঁ, আছে। গতবছর লাগিয়ে ছিলাম আর দেখো এ বছরই ফুল হয়ে গিয়েছে। কী সুন্দর ঘ্রাণ! একটা গোপন কথা শুনবে?’

বেলি আগ্রহ ভরা কণ্ঠে বলল, ‘কী কথা?’

মুনিব বেলিকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বেলির কাঁধে থুতনি রেখে বলল, ‘এই গাছ গতবছর আমি লাগিয়ে ছিলাম। জানো কেন লাগিয়ে ছিলাম? কারণ গতবছরই আমি প্রথম তোমাকে দেখি। তুমি মাঠে তোমার আব্বুর খাবার নিয়ে যাচ্ছিলে সেদিন। আমার চোখ আটকে যায় তোমার দিকে। কালো কাজল দেওয়া তোমাকে যে আমার কী ভীষণ সুন্দর লেগেছিল! মনে হয়েছিল এ পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতেই পারে না। তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম, বিয়ে করলে তোমাকেই করব।’

বেলি স্তব্ধ নয়নে সামনের দিঘিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুনিব তাকে যেভাবে ভালোবাসছে সেভাবে আদৌ কেউ তাকে কখনো ভালোবাসবে বলে তার মনে হয় না।
এত ভালোবাসা পেয়েও বেলির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

মুনিবদের বাড়িতে সমস্যা হয়েছে। বিশাল বড়ো রকমের সমস্যা নাকি।
মুনিব আর বেলি নিয়মানুযায়ী আজ বেলির বাবার বাড়ি গিয়েছিল। বিকেলেই মুনিবের বাড়ি থেকে সংবাদ আসে বিপদ হয়েছে বাড়িতে ।
উঠোনে মাদুর পেতে বসে আড্ডা দিচ্ছিল বেলির কাজিন ভাইবোন, মুনিব সকলে। বেলি মায়ের সাথে রান্নাঘরে ছিল। তার মাঝেই মুনিবের কাছে কল আসে। মুনিব এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই বাড়ির দিকে রওনা হয়। পাশের গ্রামেই বাড়ি হওয়ায় যেতে তেমন অসুবিধা নেই। কিন্তু সে বেলিকে নিল না। বলল দু’দিন থাকতে। এমনেতেই বাবা-মা ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকতে মেয়েটার ভীষণ মন খারাপ হয়। আর কেউ না জানলেও মুনিব সেটা জানে, বুঝে। মুনিবকে এত হন্তদন্ত হয়ে যেতে দেখে বেলির বাড়ির সকলেই জানতে চায় কী হয়েছে কিন্তু মুনিব কিছু বলে না। পাছে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা চিন্তা করবে সেই ভেবে।

মুনিব ঘর থেকে তৈরি হয়ে বেরুতেই বেলির মা বেলিকে রান্নাঘর থেকে ঠেলে বের করেন। জামাইকে এগিয়ে দিয়ে আসতে বলেন।
কালো রঙের পাঞ্জাবিতে মুনিবকে মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন লাগছে। পৃথিবীতে সুন্দর আর মায়াবী মানুষ একসাথে দেখা যায় না। কারো গায়ের রঙ ফর্সা অথচ চেহারায় মায়া নেই। আবার কারো-বা চেহারায় মায়া অথচ গায়ের রঙ ফর্সা নয়। অথচ মুনিবের এই দু’টো বৈশিষ্ট্যই আছে। দেখতে যেমন সুন্দর সে, তেমন গায়ের রঙও ফর্সা। রাজপুত্রের মতন লাগে তাকে। কোথাও কোনো খুঁত নেই মানুষটার।
বেলিদের বাড়ি থেকে বের হলেই কাঁচা রাস্তা। মাটির তৈরি রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। বেলির শাড়ি পরে সে-ই রাস্তায় হাঁটতে কিছুটা অসুবিধে হচ্ছিল। হুট করেই মুনিব প্রকাশ্যে বেলির হাত জড়িয়ে ধরে। সাবধানে নিজের কাছাকাছি মেয়েটাকে এনে ফিসফিস করে বলল,
‘আমি আছি, পড়বে না। সাবধানে হাঁটো।’

রাস্তায় সামান্য মাত্র লোক আসা-যাওয়া করছে। সকলের চোখ ঘুরে ঘুরে এই হাতের বাঁধনে, এই নৈকট্যের দিকে এসে আটকাচ্ছে। তাতে হেলদোল নেই মুনিবের কিন্তু অস্বস্তি হলো বেলির। সে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘হাত ছাড়েন। মানুষ দেখতাছে।’

মুনিবের যেন কথাটা গায়ে লাগল না। সে মুঠো আরও শক্ত করে বলল, ‘দেখুক মানুষ। আমি তো পরনারীর হাত ধরিনি। পাপও করিনি। আমার মানুষরে আমি ধরেছি। মানুষ কী বলবে শুনি?’

বেলি নাছোড়বান্দা। হাতটা টানতে টানতে বলল, ‘মানুষ বেশরম কইবো।’

‘বলুক। বউকে ধরলে যদি বেশরম হতে হয়। তবে আমি তাতেই রাজি।’

বেলি আর কিছু বলল। লোকটার সাথে শক্তি কিংবা কথা কোনোটাতেই পারবে না জেনে সে চুপ হয়ে গেল। কিছু রাস্তা যেতেই রিকশায় উঠল মুনিব। বেলিকে ছেড়ে যেতে যেন তার মন টানছে না। তবুও যেতে তো হবেই।
রিকশায় উঠে মন খারাপ করে বলল, ‘তুমি চিন্তা করো না। কাল সকালেই আমি আসার চেষ্টা করব। আর সমস্যা মিটে যদি যায় তবে আজ রাতেই আসব। তুমি ভালো মতো খাওয়া-দাওয়া করো। আর রাতে কল দিবোনে তোমার আব্বুর ফোনে, মোবাইলটা সাথে রেখো। বাড়ি গেলে তোমাকে একটা মোবাইল কিনে দিবো কেমন? যা-ও বাড়ি ফিরে। আমি আসছি কেমন?’

বেলি ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিল। মুনিবের যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও অনিচ্ছা নিয়েই রিকশাচালককে বলল গন্তব্য ধরতে। বেলি দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। রিকশা চোখের দৃষ্টিসীমানা পার না হওয়া অব্দি দাঁড়িয়েই রইল।
মুনিবের রিকশা চলে যেতেই সে বাড়ির দিকে হাঁটা আরম্ভ করল। দু’কদম গিয়ে উষ্ঠাও খেলো। বাড়ির সামনে আসতেই দেখল তার মা দাঁড়িয়ে আছেন। ঠোঁটে হাসি। মেয়েকে দেখেই ভদ্রমহিলা বললেন,
‘দেখলি তো বেলি, কত ভালা পোলার লগে তোরে বিয়া দিলাম? এমন জামাই কয়জনের কপালে থাকে ক?’
মায়ের কথায় হাসল বেলি। বিদ্রুপ করে বলল, ‘হ, অনেক ভালা বিয়া দিছো তোমরা। তাই তো শাশুড়ি নতুন বউয়ের হাতের রান্ধা খাইয়া গয়না দিতে গেলে শ্বশুর তামাশা কইরা কয়— ফকিন্নিগো গলায় সোনা মানায় না। আমার মতন কালা মানুষের শইলে সেই সোনার হার নাকি বান্দরের গলায় মুক্তার মালার মতন লাগে! কী ভাইগ্য আমার ভাবো! এত ভালা কপাল কারো হয় না-কি! মাগ্গো মা, সোনায় বাইন্ধা রাখা কপাল।’
কথা শেষ করেই মা’কে কিছু না বলতে দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল বেলি। ভদ্রমহিলা মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন নির্নিমেষ।

বেলির শ্বশুর বাড়ির গয়না চুরির ঘটনা আর গোপন রইল না। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেল বিকেল পেরুতে পেরুতেই। বেলির বাবা করিম হাসান বাজারে একজনের মুখে খবরটা শুনেই হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এলেন। বেলিরা তখন সে-ই উঠোনের মাদুরেই বসে আছে। কথা বলছিল কিছু একটা নিয়ে।
করিম হাসান বাড়িতে ঢুকেই মেয়েকে বললেন, ‘বেলি, জামাই বাড়িতে গেছে কেন জানছ কিছু? জিগাইছিলি?’

কথায় ব্যস্ত থাকা সকলের ধ্যান ঘুরে করিম হাসানের দিকে এসে নিবদ্ধ হলো। বেলি ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, ‘না তো, জানি না। কয় নাই তো কিছু।’

করিম হাসান এগিয়ে এসে বললেন, ‘তোর শ্বশুর বাড়িতে নাকি বিরাট চুরি হইছে। তোগো যত গয়নাপত্র আছে সব নাকি চুরি হইয়া গেছে। ভরি ভরি গয়নার টিকিটাও নাই। তোর শ্বশুর তো শোকে কয়েকবার জ্ঞান হারায় লাইছে।’

মাদুরে বসা সকলে তাজ্জব বনে যায়। বেলি তো বিচলিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল। করিম হাসান মেয়েকে তাড়া দিয়ে বলেন, ‘আইজ তোর ঐখানে থাকা উচিত মা। উঠ, তৈরি হইয়া নে। আমি নিয়া যামু তোরে এখনই। জামাই তোরে যে কেন নিল না! তুই ঐ বাড়ির বউ। এই বিপদে তো তোর ঐখানে থাকা উচিত।’

বেলি বাবার কথায় সম্মতি দিল। ব্যতিব্যস্ত পায়ে ছুটল ঘরে তৈরি হতে। পেছন পেছন এলেন বেলির মা-ও। মেয়ের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মাকে দেখে বেলি শুধাল, ‘কী হইছে?’

মানসুরা বেগম বেলির কাছে এসে বহু সাবধানে বললেন, ‘গয়নাডি কই রাখছত, বেলি?’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে