সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০৪

0
204

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমে: মম সাহা

৪.

ভূঁইয়া বাড়ির খাবার টেবিল বিশাল বড়ো। আত্মীয় স্বজন বেশি বিধায় প্রথম থেকেই সবকিছু একটু বিশাল বিশাল করে তৈরি করা হয়েছে। এখন বিয়ের অনুষ্ঠান বিধায় মানুষ তাদের বাড়িতে বেশি আসলে তেমনটা নয়। বাড়িতে অনুষ্ঠান না থাকলেও মানুষে ভরে থাকে। বেলির ফুপু শাশুড়ি তো বেশিরভাগ সময়ই এ বাড়িতেই থাকেন। নাম মাত্র নিজের বাড়ি যান। বড়ো জা-এর বাপ-মাও উছিলা পেলেই এ বাড়িতে হানা দেয়। এরপর আছো ফুপু শাশুড়ির ঘরের ননদ, ননস, চাচাতো দেবর, জা, ননদরা। সকলেই অপেক্ষায় থাকে, অজুহাত খুঁজে এ বাড়িতে পাত পেরে বসে খাওয়ার।

বিশাল খাবার টেবিলের খাবার দেওয়ার দায়িত্ব প্রথা অনুসারে নতুন বউয়ের ঘাড়েই পড়ল। এতে নাকি নতুন বউয়ের আত্মা কতটুকু তা বুঝা যাবে। নতুন বউ মানুষকে খাওয়াতে পারে মন উজাড় করে না-কি কৃপণতা করে তা-ই বুঝা যায় এই নিয়মের মাধ্যমে। সকলেই খেতে বসেছে। জামাল ভূঁইয়া মুখ-চোখ অন্ধকার করে রেখেছেন বরাবরের মতন। নিজের অত্যন্ত অপছন্দের মেয়েটির হাতের রান্না খেতেও তার রুচিতে কুলোচ্ছে না। তবুও নিয়ম যা তা তো করতেই হবে। বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে তো আর তামাশা করা যায় না! সকলে খাবার খেতে বসলেও খাবার টেবিলে মুনিবকে পাওয়া গেল না। সে বসে রইলো কিছুটা দূরে একটা মোড়ায়। তার নাকি পেট ব্যথা করছে তাই এখন খেতে পারবে না। সকলে জোড়াজুড়ি করলেও সে উঠে এলো না। বরং ঠাই বসে রইল সেখানেই। সকলে বিশ্রামও করতে বলল অথচ বিশ্রাম করতেও গেল না সে। অবাধ্য ছেলের উপর জামাল ভূঁইয়া আরেকটু রাগলেন। বিয়ে তো করেনি যেন হাতির পাঁচ পা দেখে ফেলেছে ছেলেটা। কারো কোনো কথাকে তোয়াক্কাই করছে না যেন!

‘নতুন বউ, মাছ ভাজার পর তো মাছের তরকারি দিবা। তুমি ডাইল দিতাছো কেন তোমার ফুপারে?’
ফুপু শাশুড়ি কথায় বেলি ডাল দিতে গিয়েও থামল। ঘাড় ঘুরিয়ে ফুপু শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে একদম সহজ-সরল স্বরে বলল, ‘তরকারি তো ঝাল হইছে।’

বেলির কথার আগা মাথা না বুঝায় ফুপুর মুখ-চোখে বিব্রতবোধটা ফুটে উঠল। তারস্বরে বললেন, ‘তো? ঝাল হইছে তো কী হইছে? হেয় কী পোলাপাইন?’
বেলিও ফুপুর মতন নাটকীয় ভঙ্গিতে মুখ-চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
‘রান্ধনের সময় না আপনে কইলেন ফুপা ঝাল খাইতে পারেন না দেইখ্যা মাছ ভাজতে? ভাজলাম তো মাছ। এছাড়া তরকারি, মাংস সবডিই ঝাল হইছে ডাইল বাদে। এর লাইগ্যাই তো ফুপারে ডাইল দিতাছি। যেন ঝাল না লাগে।’

খাবার টেবিলে এক লহমায় স্রোতের মতন নিরবতা বয়ে গেল। বেলির কথাটা এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে মিনিট এক সবাই চুপ করেই রইল। মুনিব হা করে দূর হতেই বেলির দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা চালাক নাকি বোকা তা ভাবতে লাগল অবাক চোখে। এরপর নিরবতা ভেঙে প্রথম হাসিটা সে-ই দিল। বেশ জোরে শব্দ করেই হেসে উঠল। তার সাথে তাল মিলিয়ে রীতিমতো একটা হাসির ঝড় উঠে গেল টেবিলে। হাসলেন ফুপা শ্বশুর পাভেল ভূঁইয়াও। ফুপু শাশুড়ি তো কতক্ষণ এতই তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন মূর্তি হয়ে গিয়েছেন। হাসির শব্দ দাপুটে ভাবে বাড়তেই তিনি রেগে-মেগে আগুন। চোখের রাগে যেন ভস্ম করে ফেলবেন বেলিকে।
পাভেল ভূঁইয়া বেলির শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ভাইসাহেব, বউ একটা আনছেন মনের মতন। এমন বুদ্ধি ক’জনারই বা থাকে? ক’জনই বা এমন করে হাসাইতে জানে?’

জামাল ভূঁইয়া এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। বোনের জামাইয়ের প্রশংসায় এক, দু’বার একটু মাথা নাড়িয়ে খেতে লাগলেন।
‘তুমি সব জায়গায় এমন সবাইরে মাথায় উডাইবা না তো। এই মাইয়া অহন তোমার লগে যে-ই অশ্রদ্ধার কামডা করল তারপরেও তুমি কেমনে অর সুনাম গাও? সবাই কী ঠাট্টার পাত্র লাগে অর?’

বেলি ডাগর ডাগর নেত্র যুগল মেলে মুখ ভেংচিয়ে বলল, ‘ঠাট্টা করলাম কই? আপনে কইছেন দেইখ্যাই তো আমি কইলাম। আপনের কথা অক্ষরে অক্ষরে হুনলাম তা-ও আপনে রাগ করেন। আর কী করলে আপনার মন পামু কন তো?’

পাভেল ভূঁইয়া স্ত্রীকে তর্ক আর বাড়াতে না দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য নিজের স্ত্রীকে বললেন, ‘চুপ থাকোতো, তানু।’
এরপর থেমে বেলিকে বললেন, ‘দেন আম্মা, ডাইলই দেন। ঝাল খাইতে যেহেতু পারি না সেহেতু ডাইল দিয়েই নাহয় খাইলাম।’

ডাল দেওয়ার অনুমতি পেলেও বেলি ডাল দিল না। বরং রান্নাঘর থেকে দু’টো সিরামিকের বাটি নিয়ে এলো ঢাকনা দেওয়া। সুন্দর বাটি গুলো ফুপা শ্বশুরের প্লেটের সামনে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল,
‘আইজকা নাহয় একটু ঝাল খাইলেনই। নতুন বউয়ের হাতের ঝাল খাইয়া দোয়া কইরা দিয়া যাইবেন, ফুপা।’

সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেলি সিরামিকের ঢাকনা খুলতেই সুন্দর মুরগীর মাংস আর রুই মাছের তরকারি দেখা গেল। কী সুন্দর করে বাটিতে রাখা! বেলির শাশুড়ি এতক্ষণ পর মুখ খুললেন, অবাক কণ্ঠে বললেন,
‘এগুলা আলাদা কেন? আর আলাদা কইরা পাকের ঘরেই কেন রাখছিলা?’

বেলি মাছের তরকারি ফুপা শ্বশুরের পাতে দিতে দিতে বলল,
‘এগুলা ঝাল কম দিয়া আলাদা রাঁধছি। এর জইন্যই আলাদা কইরা রাখছিলাম। আর আপনেরা নতুন বউয়ের মন পরীক্ষা করতে পারেন আর নতুন বউ শ্বশুর বাড়ির মানুষের মন পরীক্ষা করতে পারব না? আমার ফুপা শ্বশুরের মন পরীক্ষা করার লাইগাই এগুলা রান্নাঘরে রাখছিলাম। দেখতাম উনি কী কন।’

বেলির কথায় তাজ্জব বনে গেল সকলে। জামাল ভূঁইয়া তো নিজের পুত্রবধূর একের পর এক গুণ দেখে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন। পাভেল ভূঁইয়া ভালো মানুষ। তাই হাসতে হাসতে বললেন,
‘মন পরীক্ষা কইরা কী বুঝলা বউ?’

বেলি নরম কণ্ঠে বলল, ‘আপনি ফুপুর মতন না। অনেক ভালা।’

পাভেল ভূঁইয়া আরেকটু মজা করতে বললেন, ‘আর যদি তোমার ফুপুর মতন হইতাম?’

বেলি এবার অকপটে বলল, ‘তাইলে এই তরকারির বাটি রান্ধা ঘরেই থাকত। খারাপ মানুষ হওয়ার শাস্তি আরকি।’

বেলির এমন অকপটে স্বীকারোক্তিতে খাবার টেবিলে আবারও হাসির বন্যা বয়ে গেল। এবার খুব গোপন একটা হাসি দেখা গেল মুক্তা ভূঁইয়ার মুখেও। তবে তা মুহুর্তেই আঁচল দিয়ে লুকিয়ে ফেললেন। মুনিবের তো হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হওয়ার জোগাড়। ভাগ্যিস! এমন একটা মেয়েকে সে বিয়ে করেছে। নাহয় কে এভাবে প্রাণ খুলে কথা বলে হাসাতো?

খাবার টেবিল ফাঁকা প্রায়। বাড়ির সকলেই খেয়েদেয়ে যার যার জায়গায় চলে গিয়েছে। কেবল বিশাল টেবিল জুড়ে রয়ে গিয়েছেন মুনিব আর মুক্তা ভূঁইয়া। দু’জনেই খেতে বসেছে। বেলি এঁটো থালাবাসন গুছিয়ে রাখছে। মুনিব ভাত মেখে প্রথম লোকমাটা বেলির মুখের সামনেই ধরল। আচমকা বেলি নিজের মুখের সামনে ভাতের লোকমা দেখতেই কিছুটা অবাক হলো। তারপর তাকাল শাশুড়ির দিকে। মুক্তা ভূঁইয়া তখন মুখ নামিয়ে খাচ্ছেন। দৃষ্টি প্লেটের দিকে। বেলি মুনিবকে চোখ দিয়ে ইশারা করে শাশুড়িকে দেখাল। মুনিব মাথা নাড়িয়ে বুঝাল কিছু হবে না, খাবারটা মুখে নিতে।
বেলি কিছুক্ষণ এধার ওধার তাকিয়ে খাবারটা মুখে নিল। অতিরিক্ত চঞ্চলতা আর উত্তেজনার জন্য খাবারটা উঠে গেল নাকে মুখে। চু রি করে খেতে গিয়েও শেষমেশ হাতে নাতে ধরার পড়ার জোগাড়। মুনিব পানির গ্লাসের জন্য হাত বাড়ানোর আগেই মুক্তা ভূঁইয়া নিজের সামনের পানির গ্লাসটা বেলির দিকে ঠেলে দিলেন। ভাতের দিকে এক ধ্যানেই তাকিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন,
‘খাবার দাঁড়ায় খাওনের নিয়ম নাই। বইস্যা খাইতে হয়। আগে অরে বইতে দে, মুনিব।’

মুক্তা ভূঁইয়ার কাছে এমন প্রকাশ্যে ধরা খেয়ে কিছুটা লজ্জায় মুখ নামাল বেলি। মুনিব সত্যি সত্যি তাকে হাত ধরে বসিয়ে দিল। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে আরেক লোকমা ভাত আবার মুখের সামনে তুলে ধরল। কিন্তু বেলি অস্বস্তিতে একসার। বসে রইল মূর্তির মতন। মুক্তা ভূঁইয়া প্লেটের ভাতটুকু শেষ করেই এঁটো থালাবাসন গুলো গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। রান্নাঘরে যেতে যেতে বললেন,
‘খাবার শেষ কইরা আমার ঘরে আইসো। নতুন বউরে জিনিস দিতে হয় খাবার খাইয়া।’
কথা শেষ করেই হনহনিয়ে চলে গেলেন। বেলি অবাক। হতভম্ব। যে শাশুড়ি এত রাগি মানুষ, সেই শাশুড়ি এমন একটা দৃশ্য দেখেও কোনো হৈ-হল্লা করলেন না কেন?

মুনিব বেলির মুখের সামনে ভাতের লোকমা ধরে রেখেই বলল, ‘হা করো না কেন? কতক্ষণ ধরে বসে থাকব?’

‘আপনে খান।’

‘আমি খাবো না। তুমি খাও।’

‘না খাইলে বইছেন কেন খাইতে?’

‘খেতে বসছি কে বলল তোমাকে? আমি খাওয়াতে বসছি। এত রান্নাবান্না করে নিজে মেখে খেতে গেলে বেশি খেতে পারতে না। তাই আমি খাওয়াতে এলাম।’

মুনিবের কথায় বেলি বিস্মিত হল। ভাত মুখে পুরে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘তাই বলে আম্মার সামনে এমন করবেন? আম্মা যদি বকা দিতো?’

মুনিব গা-ছাড়া ভাবে বলল, ‘আম্মারে তুমি চিনো না। ধীরে ধীরে চিনবে। ধৈর্য রাখো।’

বেলি ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল। মুনিব তাকে খাইয়ে দিল ছোটো বাচ্চাটির মতন যত্ন করে। যেন এত আদুরে মানুষ এই পৃথিবীতে আগে কেউ কখনো পায়নি।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে