সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০২

0
158

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমে: মম সাহা

২.

মুনিব বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল বাড়ির পেছনে। সুবিশাল জায়গাটুকু আড্ডা দেওয়ার জন্য বেশি উপযুক্ত। একটা কাঠের বেঞ্চি, সাথে কাঠের টেবিল, চারপাশে সুবাসিত ফুল গাছ। এ যেন স্বর্গের নন্দনকাননের একাংশ।
বাড়ির কাজের মেয়ে মিনু চা, মুড়িমাখা দিতে এলো। মুনিবরা তখন গভীর আড্ডায় নিমজ্জিত। নতুন বিয়ের কত কথা নিয়ে হাসি-ঠাট্টাই করছে তারা। মিনু সেই জমে উঠা আড্ডায় বড়ো বিরক্তের কারণ হয়ে ডাকল মুনিবকে,
‘ভাইয়া, আম্মা ডাকে আপনেরে।’

মুনিব হাসতে হাসতে ভ্রু কুঁচকে মিনার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কেন ডাকে? কিছু লাগবে?’
‘আপনে গেলেই তো কইবো। আহেন একটু।’

মুনিব আড্ডা রেখেই মিনার পেছন পেছন এলো। ঘরের ভেতর ঢুকতেই মুক্তা ভূঁইয়া ছেলেকে জেঁকে ধরলেন, ‘কেমন বউ আনলি এইডা, মুনিব? মুখে মুখে এখনই তো চোপা করে।’

মায়ের কথার অর্থ মুনিবের কাছে অস্বচ্ছ। তাই কিছুটা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
‘বেলি? কী করেছে ও?’

মুক্তা ভূঁইয়া এবার আরও খানিকটা বিরক্ত সহকারে বললেন, ‘কী করে নাই সেটা ক।’
মুনিব যদিও জানে না বেলি কী করেছে তবুও মায়ের আচরণ দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারছে। মা রাগী তবে সহজে এতটা রেগে যাওয়ার পাত্রী নন। যেহেতু বিচার দিচ্ছেন তবে কিছু একটাতো হয়েছেই। তাই সে আবার জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে না বললে বুঝব কীভাবে বলো!’

মুক্তা ভূঁইয়া এবার ছেলেকে সবটুকু ঘটনা খুলে বললেন একেক করে। নতুন বউয়ের রঙ তামাশায় তিনি কতটুকু অবাক হয়েছেন সেটাও বললেন। আত্মীয় স্বজনরা কতটুকু হাসি-তামাশা করছে তা বলতেও বাদ রাখেননি।
সবটা শোনার পর কপালের মাঝে গাঢ় ভাঁজ পড়তে দেখা গেল মুনিবের। সে যতটুকু জেনেছিল, বেলি কিছুটা চঞ্চল কিন্তু এমন উড়নচণ্ডী তো না। কিছু সময় নীরবে সাত-পাঁচ ভেবে অবশেষে বলল, ‘আমি দেখছি।’

ছেলেকে কাছে পেয়ে মুক্তা ভূঁইয়া আরও খানিক আশকারা পেলেন যেন। মুখ-চোখ কুঁচকে বললেন,
‘তোর আব্বা নাকি বিয়াডা করতে না করছিলো। সেডা শুনলে আজ এমন দিন কি দেখতে হইতো?’

মুনিব মায়ের কথাটাকে প্রশ্রয় দিল না বরং বড়োই বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘আব্বার এসব কাজকে প্রশ্রয় দিও না তো, আম্মা। একটা মেয়েরে ওভাবে মহা ধুমধাম করে অপমান করার অধিকার কারো নেই। অমন ভরা মজলিসে মেয়েটাকে শুনতে হয়েছে তার গায়ের রঙ কালো বলে তার বিয়েটা হবে না। বুঝতে পারছো মেয়েটার মনের অবস্থা তখন কি হয়েছিল? অপমানে ও কতটুকু নিজেকে অসহায় ভেবেছিল? প্রকৃতপক্ষে ওর এমন ব্যবহারের জন্য আমাদের পরিবারই দায়ী। কেউ হুট করেই খারাপ হয়ে যায় না। আমরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করি যে সে খারাপ হতে বাধ্য হয়।’

ছেলের এত সুন্দর কথাটা মুক্তা ভূঁইয়ার কাছে বাড়াবাড়ি রকমের বউ পাগলামি মনে হলো। যার ফলস্বরূপ তিনি অবাক নয়নে তাকিয়ে কিছুটা মুখ ঝামটি মেরেই বললেন,
‘বিয়া হইতে না হইতে এমন বউ পাগল হইয়া গেছত? ছি!’

মুনিব আর কিছু বলল না। যেখানে তার এত বড়ো যুক্তি কেবল বউ পাগল নামি স্বীকৃতি পেয়েছে সেখানে কিছু বলা মানেই ওলু বনে মুক্তা ছিটানোর মতন।

বেলি নিজের রুমে বসে ভাত খাচ্ছে। চারদিকে তখন মাত্র সন্ধ্যা পেরুনো আবহাওয়া। মৃদু বাতাসে ভরে আছে সবটুকু ঘর।
মুনিব ঘরে ঢুকতেই দেখল নতুন ভাঁজ ভাঙা লাল রঙের সুতির শাড়ি পরে বেলি ভাত খাচ্ছে। বিয়ের সাজ শরীরে নেই। চোখ ভর্তি কাজল দেখা যাচ্ছে বড়োই উজ্জ্বল। ঠোঁটে বোধহয় লিপস্টিক দিয়েছিল মেয়েটা, যা ভাতের সাথে অর্ধেক গিলে নিয়েছে। আর অর্ধেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে রয়েছে চারপাশে। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এ মেয়েটির চেয়ে সুন্দর, সরল মানুষ দুনিয়াতে নেই। নীরবতার উপমা যেন সে। অথচ কিছুক্ষণ আগেই নাকি মেয়েটা কত রকমের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে।

বেলির ধ্যান তখনো খাবারের দিকে। ঘরে কেউ এসেছে যে সেদিকে তার খেয়াল নেই। মনের সুখে খেয়ে যাচ্ছে। মুনিব কিছুটা এগিয়ে এসে ডাকল,
‘আমার উড়নচণ্ডী কী করে?’

বেলির মুখ ভর্তি ভাত মুখেই রয়ে গেল। চমকে তাকাল গমগমে স্বরে কথা বলা মানুষটার দিকে। গোল গোল করে তাকানোর ভঙ্গিমা, মুখ ভর্তি ভাতে বেলিকে মনে হচ্ছে ছোট্টো খুকি। যাকে মা আদর যত্ন করে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। আহ্লাদের খাবারে ভরে আছে মুখ।

এবার বেলি মুখের ভাত চিবুতে চিবুতে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘খাইতেছি।’
বেলির জড়তা বিহীন উত্তরে হাসল মুনিব।
‘আমারে রেখেই খেয়ে ফেলছ? ভারি অন্যায় করেছ তো!’

বেলি লাজুক হাসল। সত্যিই তো, স্বামীকে রেখে এমন গপাগপ করে খাওয়াটাতো অন্যায়ই বটে। মাথাটা খানিক নিচু করে বলল, ‘মনে আছিল না। খিদা লাগছিল অনেক।’
কী অকপটে স্বীকারোক্তি! কোনো দম্ভ নেই, অহংকার নেই। অথচ এই মাত্রই মা এ মেয়েটার নামে কতকিছুই বলে গেলেন। ইশারা ইঙ্গিতে ভাবিও বললেন কত কী!

মুনিবকে চুপ থাকতে দেখে বেলির অপরাধবোধ বাড়ল। কী জানি মানুষটা রাগ করল কি-না ভেবেই বুকের ভেতর চলল দেদার বুঝাপড়া। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘আপনে কি রাগ করলেন?’

বেলির প্রশ্নে হেসে দিল মুনিব। এগিয়ে এসে খাটে বসল ঠিক বেলির পাশাপাশি। ডান হাতে বেলির গালে আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
‘না, রাগ করিনি।’

এই আহ্লাদে বেলির আড়ষ্টতা বাড়ল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘খাইবেন আপনে? আমি কি খাওন নিয়া আসমু?’

বেলির নিকটে আসতেই মুনিবের দুষ্টুমি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল, ‘উম, না। খাবার আনতে হবে না। তোমার প্লেট থেকে খাইয়ে দেও।’

মুনিবের এহেন কথায় বেলি চমকে গেল। আঁতকে উঠে বলল, ‘এডা তো এঁটো। আপনে খাইবেন কী কইরা?’

‘এঁটো আবার কী? স্বামী স্ত্রীর মাঝে এঁটো বলতে কিছু হয় না। তুমি কি দিবে খাইয়ে? নাহলে চলে যাচ্ছি।’

মুনিবের চলে যাওয়ার কথা শুনে বেলি ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘না, না, যাইবেন না। দিতাছি।’
কথা শেষ করেই এক লোকমা ভাত ধরল মুনিবের মুখের সামনে। মুনিব ভাত মুখে নিল। সাথে আলতো কামড় লাগাল বেলির আঙুলে। লজ্জায় বেলি আরও মিইয়ে গেল। মাথা এতটাই নামাল যে থুতনির সাথে লেগে গেল বুক। মুনিব হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, ‘কী হলো? মাথা নামাচ্ছ কেন? আমার দিকে তাকাও।’

বেলি তাকাল না। বরং মাথা নামিয়েই বিড়বিড় করে জবাব দিল, ‘না, তাকামু না। আমার শরম লাগে।’
নির্দ্বিধায় লজ্জা পাওয়ার এমন স্বীকারোক্তিতে মুনিব ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। এমন একটা অসম্ভব মিষ্টি মেয়েকে বিয়ে করেছে ভেবেই তার ভেতর ভেতর আনন্দ হলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে