সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০১

0
191

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমে: মম সাহা (বিষাদিনী)

“কালো মাইয়া কোনোমতেই আমার বাড়ির বউ হইতে পারব না।’

কালো বলে বেলির বিয়ের দিন ঝামেলা হয় তার গায়ের রঙ নিয়ে। উপরোক্ত বাক্যটি বেলির হবু শ্বশুরের। বেলির গায়ের রঙ পছন্দ হয়নি ছেলের বাবার। ছেলের বিয়ের সকল দায়িত্ব দিয়েছিলেন ছেলের উপরই। ছেলে-ই জানিয়েছিল ওর মেয়ে পছন্দ হয়েছে। তাই জামাল ভূঁইয়া আর মেয়ে দেখতে আসেননি। তাছাড়া ব্যবসায়ের কাজে তিনি অন্য শহরে গিয়েছিলেন। অনুমতি দিয়ে গিয়েছিলেন বিয়ের কাজ আগানোর। কিন্তু এত বড়ো সর্বনাশ যে হবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
জামাল ভূঁইয়ার এই হম্বিতম্বি বিয়ে বাড়িটাকে নীরব করে দিল। সব হৈচৈ, আনন্দ নিমিষেই থেমে গেল। রঙ হারালো হাসিরা। জামাল ভূঁইয়ার কণ্ঠ তখন সর্বোচ্চে,
“কবীর আলী, এখানে আসুন।”

বেলির বাবা কবীর আলীর কানে এর আগেই হম্বিতম্বির কথা পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি কথাটা বাড়াতে দেননি। কিন্তু যখন ডাক ভেসে এলো তখন আর দূরে থাকলেন না। দ্রুতই ছুটে এলেন,
“হ্যাঁ, বেয়াই সাহেব, বলুন।”

“আমি চাচ্ছি বিয়ের কাজ এখানেই থামিয়ে দিতে। আপনারা আমাদের ঠকাচ্ছেন।”

কবীর আলীর বুকে ছ্যাঁত করে উঠল। বেলির মায়া-মায়া মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটার মুখটা এটুকুন হয়ে এসেছে। কবীর আলী হাত জোর করলেন,
“এসব কী বলছেন! আমরা কীভাবে ঠকালাম?”

“আপনাদের মেয়ের গায়ের রঙ এত ময়লাটে! আমার ছেলে যেখানে ধবধবে ফর্সা!”

“আপনার ছেলে তো দেখেছিল আমার মেয়েকে। না দেখিয়ে তো বিয়ে ঠিক হয়নি।”

জামাল ভূঁইয়া যুক্তিতে হেরে গেলেও থামলেন না, “আমার ছেলের কি সেই বুঝ আছে? বুঝলে তো এ কাজ করতো না।”

“তাই বলে বিয়ের আসরে এসে বিয়ে ভাঙবেন নাকি!”

তর্কাতর্কি তুমুল হলো ধীরে-ধীরে। এতক্ষণ যাবত মুনিব ঘরে ছিল বন্ধুদের সাথে হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। চেঁচামেচি শুনতেই বাহিরে এসে নিজের বাবাকে শুধাল,
‘কী করছেন, আব্বা!’

ছেলেকে দেখেই জামাল ভূঁইয়া চেঁচিয়ে বললেন,
“এই মেয়েরে তুমি দেইখ্যা বিয়াতে রাজি হইছো?”

মুনিব সহজ-সরল কণ্ঠে সম্মতি দিল, “হ্যাঁ। কেন?”

“এইরকম গায়ের রঙ আমাদের বাড়ির কাউরে দেখছো তুমি?”

“না, দেখিনি। দেখিনি বলেই এ রঙে আমার আকর্ষণ জন্মেছে।”

ছেলের মুখের বুলিতে তাজ্জব বনে গেলেন জামাল ভূঁইয়া। অবাক স্বরে শুধালেন, “আর্কষণ! তাও এ রঙে! পাগল হলে নাকি?”

“দেখেন আব্বা, বিয়ে করাইলে ওর সাথেই করান নাহয় চলেন, বাড়ি ফিরে যাই। এরপর আর কোনোদিন বিয়ের কথা মুখেও তুলবেন না।”

“মুনিব? তোর আব্বার লগে কেমনে কথা কছ? মাথা গেছে তোর?”

চাচার প্রশ্নে মুনিবের কোনো হেলদোল নেই। সে গা-ছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। জামাল ভূঁইয়া বুঝলেন তার কথার আর কোনো মূল্য নেই। অতঃপর না পারতে তিনি বিয়েতে সম্মতি দিলেন। হৈচৈ করা বিয়ে বাড়িটায় আবারও হৈচৈ শুরু হলো তবে আতঙ্ক নিয়ে। মেয়ের বাবা মুনিবের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হলেন। মেয়ের আত্মীয়রা তো এই জামাই এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু ছেলের প্রতি অরুচি ধরল জামাল ভূঁইয়ার। পারছেন না বিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে।

নতুন বউ ঘরে তুলতে গিয়ে হোঁচট খেলেন বাড়ির মেয়েলোকেরা। মুনিব বলেছিল বউ সুন্দর ভীষণ! কিন্তু কই সুন্দর? কালো শরীরে লাল রঙের বিয়ের শাড়িটা যেন কৌতুক করছে গায়ের রঙকে। বাড়ি ভর্তি মানুষের ফিসফিস শুরু হয় বউ দেখার পরই। এত সুন্দর মুনিব, পড়াশোনা জানা ছেলেটা কি-না বিয়ে করল এমন একটা মেয়েকে? ঝুমুরপাড়া গ্রাম অন্যান্য গ্রাম থেকে গরীব ভীষণ। তার উপর মেয়ে না দেখতে সুন্দর আর না মেয়ের বাপ কোনো টাকাকড়ি দিয়েছে তাহলে কী দেখে মুনিব এ-মেয়ে বিয়ে করল?
আত্মীয়-স্বজনের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুরে ভরে গেল বাড়ি। সব কথাই কানে পৌঁছাল বেলির।

বাড়ির বড়ো বউ চামেলি নতুন বউকে তৈরী করাতে এসে তাজ্জব বনে গেল। বেলির বিয়ের সাজ নেই গায়ে। একটা ক্যাটকেটে হলুদ রঙের শাড়ি জড়ানো শরীরে। চামেলি হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
“আল্লাহ্ গো আল্লাহ্, ছুডু বউ, তুমি একলা একলা তৈরী হইয়া গেছো নাকি?”

বেলি তখন চোখে কাজল লেপছিল। এক ধ্যানে কাজল লাগাতে লাগাতে উত্তর দিল, “তৈরী হইতে কি আবার চৌদ্দজন লাগে নাকি? কী যে কথা কন!”

বেলির ঝটপট উত্তরে চামেলি আরও দ্বিগুণ অবাক হলো। গলা উঠলো তার তুঙ্গে। তার হৈহল্লা শুনে তার শাশুড়ি, চাচিশাশুড়ি, ফুপু শাশুড়ি, ননদ-ননাস হতে সব মেয়ে লোক উপস্থিত হলেন। ঘরে প্রবেশ করেই বেলির শাশুড়ি প্রথমে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“কী হইছে, বড়ো বউ? আক্কেল-জ্ঞান কী খাইছো? এমনেই মানুষ কত কী কইতাছে, অহন আবার তুমিও ঢোল পিডাইতাছ যে?”

শাশুড়ির কথায় দুঃখী দুঃখী স্বরে সব বলল চামেলি। বেলি কীভাবে উত্তর দিয়েছে তা খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বলল। বেলির আচরণের কথা শুনতেই ঘরভর্তি সকলে হেসে দিল। ফুপু শাশুড়ি তো মুখ ঝামটে বেলির শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললেন,
“বাপরে জামাইল্যার বউ, তোর পোলার বউ দেহি দারোগা। তুই মাইনষেরে এত শাসন করছ আর তোর ঘরেই কি-না আসছে দজ্জাল?”

নিজের ননাসের এমন টিটকারিতে লজ্জায় যেন মাথা কাটা গেল মুক্তা ভূঁইয়ার। তিনি তার পুত্রবধূর দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেললেন। হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
“বাড়িতে আইছো একটা দিনও তো কাটাইলা না, তার আগে এমন কথা কও কোন সাহসে?”

বেলির ভেতর তেমন ভাবাবেগ দেখা গেল না। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজতে-গুঁজতে বলল, “কী আজব কাহিনি! এই সামাইন্য কথা কইতে সাহস লাগে নাকি? আপনারা এমন ভাব করতাছেন যেন কোনোদিন কাউরে কথা কইতে শুনেন নাই! না শুইন্যা থাকলে এহন শুনবেন। কোনো সমস্যা নাই। এহন চাইরড্যা খানা দেন তো। সারাদিন কিছু খাই নাই।”

নতুন বউয়ের এমন আকপটে কথা বলার ভঙ্গি, খাবার চাওয়ার ধরন দেখে ঘরভর্তি মানুষ এবার চরম বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। মুক্তা ভুঁইয়া হলেন বুদ্ধিমতী নারী। তিনি বুঝলেন, বেলির মনে ‘কে কী ভাবল’— এর ভয় নেই। তাই তাকে খোঁচা দেওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। তাই তিনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন,
“খিদা লাগছে ভালো কথা। সারাদিন না খাইলে তো খিদা লাগবোই। তুমি বও, বড়ো বউরে দিয়া তোমার খাওন পাডামু। তুমি তো নতুন বউ, তাই ঘর ছাইড়া বাইর হইও না।”

রণচণ্ডী মুক্তা ভুঁইয়ার এমন নরম আচরণে খ্যাপে উঠল বড়ো বউ,
“আম্মা, আপনি ছুডু বউরে কিছু কন না যে? হেরনি এমন আচরণ সাজে!”

বড়ো বউয়ের বুদ্ধির করুন দশার কথা জানেন মুক্তা ভুঁইয়া। তাই চোখ রাঙিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন,
“হেয় হইল ছুডু বউ। বয়সেও ছুডু। হের বুদ্ধি থাকলে কী আর এমনে কথা কইতো। যাও খাওন নিয়া আহো।”

বড়ো বউ চামেলি শাশুড়ির উপর অসন্তুষ্ট হলো। চলে গেল তাই গটগট করে। মুক্তা ভুঁইয়ার ধমকে বাকিরাও এক-এক করে বিদায় নিল। পুরো ঘর জুড়ে রইলেন কেবল তিনি এবং নতুন বউ।

‘তুমি এমন আচরণ কেমনে করলা কও তো? তুমি কি জানো না এমনেই তোমারে লইয়া পুরা বাড়ির মানুষ হাসিহাসি করতাছে?’

বেলি ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছিল। শাশুড়ির কথায় তার হাত থেমে গেল। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, ‘তো হাসলে আমি কী করমু? সবার মুখ ধইরা রাখমু?’

তাজ্জব মুক্তা ভূঁইয়া বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘তুমি কী বুঝতাছো না তোমার শরীরের রঙ লইয়া সবাই তামাশা করতাছে? তার উপর তোমার এমর জঘন্য আচরণ যদি মানুষ শুনতে পারে তাইলে কী হইবো বুঝতে পারো?’

শাশুড়ির চেয়েও দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে বেলি শুধাল, ‘আমার গায়ের রঙ নিয়া হাসার কী আছে? আমার রঙ হলুদ, সবুজ নাকি নীল যে দেখলেই হাসি পাইবো! ভাব এমন করেন যেন কোনোদিন কালা মানুষ দেহেন নাই চোখে। যান তো এইখান থেইকা এখন। একটু সাজতে দেন। বিয়ার প্রথম দিনেই এমন ঝগড়াঝাটি ভালো লাগে না। আর কয়েকটা দিন পর থেইকা করমুনে। যান এহন।’

বেলির গলার স্বর যথেষ্ট উঁচুতে ছিল বিধায় মোটামুটি যারা কান খাঁড়া করে রেখেছিল তারা সকলেই সবকিছু শুনেছে। মুক্তা ভূঁইয়া নিজের রাগ সংবরণ করতে দ্রুত পায়ে নতুন বউয়ের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এ মেয়ের মান ইজ্জত নাই সেটা তো তার আচরণেই পরিষ্কার। শুধু শুধু এ মেয়ের সাথে লেগে নিজেরও মান সম্মান নষ্ট করার ইচ্ছে হলো না উনার।

শাশুড়ি বেরিয়ে যেতেই বেলি গলা ছেড়ে গান ধরল,
‘তুমি দিও না গো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া,
আমি অন্ধকারে বন্ধ হয়ে যাব মরিয়া….’

যেতে যেতে মুক্তা ভূঁইয়া অবাক হলেন। বাড়ি ভর্তি মেহমান অথচ নতুন বউ কি-না এসব গান গাচ্ছে? ছি! তার ছেলেটার কী চোখে সমস্যা ছিল? নাহলে এমন মেয়েরে কীভাবে বউ করে?

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে