#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী
সুচরিতা ওর শাশুড়ি মায়ের ঘরে গিয়ে বললো,
—–মা আমাকে ডেকেছেন?
—–ভাত খেয়ে নাও।
——আমার ক্ষিদে নেই।
——শোনো মেয়ে এটাই হচ্ছে শ্বশুর বাড়ি। দুটো কটু কথা শুনতেও হবে আবার এ বাড়ির ভাতও গিলতে হবে। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের বাপের বাড়িতে কোনো গুরুত্ব থাকে না। দু,দিনের মেহমান হিসাবে তোমাকে বরণ করবে কিন্তু চিরদিনের জন্য থাকার জায়গা তোমার ও বাড়িতে জুটবে না। এখানে তুমি দু,কথা শুনবেও আবার নিজের দাবীও আদায় করতে পারবে।
সুচরিতা মনে মনে ভাবলো জুতো মেরে গরু দান আজ আর নিতে ইচ্ছে করছে না। তাই ও ওর রুমে আসার উদ্যেগ নিলো। শাশুড়ি তাই দেখে আবারও বললেন,
—–তাহলে তুমি রাতে উপােষ দিবে।
—–মা, আমার রুচি নেই। আর আমি যদি আপনার মনে কষ্ট দিয়ে থাকি আমাকে মাফ করে দিয়েন।
এ কথা বলে সুচরিতা ঘরে চলে আসলো। লাইট অফ করে সুচরিতা শুয়ে আছে। দুচোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বাবা মায়ের উপরও প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে। এইচএসসির রেজাল্ট ভালো না হওয়াতে বাবা বিয়ে দিলেন। সুচরিতা পড়তে চেয়েছিলো। কিন্তু বাবা মা রাজি হলেন না। আসলে আর একটা বিষয় নিয়েও ওর বাবা মা চিন্তায় থাকতো। ও দেখতে সুন্দরী ছিলো বিধায় ছেলেরা ওর পিছনে লেগেই থাকতো। এটা নিয়ে সুচরিতাদের পাড়ার অতিউৎসাহী কিছু খালাম্মাদের গল্পের খোরাক হতো। এসব কারনেও বাবা মা সুচরিতাকে ঘরে রাখতে চাইলেন না। অথচ আজ সুচরিতার মনে হচ্ছে বাবা মা চাইলে তাকে সাপোর্ট দিয়ে পড়াশোনা করাতে পারতেন।
নিজেকে আজ এই পৃথিবীতে বড্ড একা মনে হচ্ছে। এটা ভাবতেই তলপেটটা আলতো করে কেঁপে উঠলো। সুচরিতার শরীরে যেন অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। যে আসছে সুচরিতার জীবনে ও হয়তো বলছে মা, তুমি আর একা নও, আমি আসছি তো। সুচরিতা আপন মনেই হেসে উঠলো। এটাকেই মনে হয় মায়ের সাথে সন্তান বন্ডিং বলে। দরজাটা কে যেন নক করছে। হিমেল যে নয় তা বুঝতে পারছে। যে দিন ওর মন খারাপ থাকে ও স্টাডি রুমে অনেকটা সময় কাটায়। এক্সারসাইজ করে। সুচরিতা উঠে দরজাটা খুলে দেয়। ওর বড় জা এসে বলে,
—–শোনো অভিমান করে না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো। তার সাথে তোমার পেটেরটাও কষ্ট পাচ্ছে। এটা শ্বশুর বাড়ি। এখানে তোমাকে কেউ সেধে খাওয়াবে না। শরীর খারাপ হলে কারো যায় আসবে না। শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব সংসারের কাজকর্ম কোনোটা থেকেও রেহাই পাবে না। তাই এখানে তোমাকে যুদ্ধও করতে হবে আবার নিজেকে সুস্থ সবলও রাখতে হবে। দুধটা রেখে গেলাম। মন চাইলে খেয়ে নিও।
ওর জা চলে যাবার পর সারাদিনের কাজকর্ম সংসারের কূটকচালে সুচরিতার খুব ক্লান্ত লাগছিলো। কখন যে দুচোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে সুচরিতা টের পায়নি। মাঝরাতে ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। পাশ ফিরতে গেলে হিমেলের শরীরের সাথে ছোঁয়া লাগে। হিমেলকে দেখে আবারো যেন অভিমান দলা পাঁকিয়ে গলার কাছে আটকে রইলো। দোষ না করেও হিমেল ওকে দোষী সাব্যস্ত করলো। খুব সপ্তপর্নে বিছানা থেকে নেমে টেবিলে রাখা দুধটা খেয়ে নিলো। জগ থেকে পানি ঢেলে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিলো। টেবিলের একপাশে দেখতে পারছে কি যেন ঢাকা দেওয়া আছে। ও ঢাকনা খুলে দেখে আপেল আর আম রয়েছে। মনে হয় হিমেল এনে রেখেছে। ও আমটা খেয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে হিমেলের পাশে শুয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে উঠে সুচরিতা হিমেলকে চা বানিয়ে দিলো। তারপর পরোটা বানানোর জন্য ময়দাটা ময়ান করে রাখলো। এমন সময় ওর বড় জা এসে সবজি কুটে দিলো। সুচরিতা চুলায় তরকারি চাপিয়ে পরোটা বানানো শুরু করলো। এখন যেহেতু মান অভিমানের পালা চলছে তাই ওদের দুজনের মাঝে কোনো কথা নেই। এটা দেখে বাড়ির সবাই মনে হয় স্বস্তিতে আছে। শাশুড়ী মাও কোনো বাহানা ছাড়াই টেবিলে বসে হিমেলের সাথে নাস্তা করে নিলো। সুচরিতার মেজ জাকেও খুব ফুরফুরে আছে। সুচরিতাকে দেখে আদিখ্যেতা করে বললো,
—–কি দরকার ছিলো তোমার অসুস্থ অবস্থায় সবার জন্য পরোটা বানানো।
—–না সমস্যা নেই। আমার হচ্ছে কই মাছের প্রাণ। আমাকে নিয়ে এতো ভেবো না।
টেবিলে সবাই বসে নাস্তা করলো। ওর বড় জা ছেলেকে খাইয়ে ওকে নিয়ে স্কুলে রওয়ানা হলো।যাওয়ার আগে সুচরিতাকে বললো,
—–আজকের দুপুরের রান্নাটা আমি রাঁধবো। রাজনকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।
খাবার টেবিলে সুচরিতার বড় ভাসুর হিমেলকে বললো,
—–তুমি সিঙ্গাপুরে যার সাথে ব্যবসা করছিস সেতো মাদকচোরাকারবারী আর নারী পাচারের অভিযোগে সে দেশের পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।
——হুম আমি জানি। সেজন্য আমি ওর সাথে ডিল না করেই সিঙ্গাপুর থেকে চলে এসেছি।
এ কথা শুনে সোহেল বললো,
—–তাহলে তো ব্যবসায় অনেকটা লস হয়ে যাবে।
—–তা একটু হবে। তবে আমি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
সোহেল একটু ইতস্তত করে বললো,
—–হিমেল তোকে কিছু কথা বলতে চাই।
—–বলে ফেলো এতো হেজিটেট করছো কেন?
—–না মানে, তুই কথাটা কিভাবে নিবি বুঝতে পারছি না।
সুচরিতার শাশুড়ী একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—–এতো আমতা আমতা করার কি আছে? আমি বুঝতে পারছি না।
—–সোহেল আমাকে আজ ব্যাংকে একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। বলতে চাইলে বলে ফেল। একটু পরেই আমাকে বেরুতে হবে।
—–বলছি, বসো খুব বেশী সময় নিবো না। তুমি আর আমি তো চাকরিতে ঢুকলাম। হিমেল তুই তো ঠিক করলি যে চাকরি করবি না ব্যবসা করবি। সেই কারনে বাবা তার পেনশনের সিক্সটি পারসেন্ট টাকা তোকে দিয়ে দিলো। আর বাকি টাকাটা দিয়ে এই বাড়িটা করলো। তোকে বাবা টাকাগুলো দিয়েছে বলে পেনশনের ঐ টাকাগুলোর মালিক তো তুই একা নোস। ওখানে আমাদেরও ভাগ আছে।
——সেটাতো আমি কখনও বলিনি যে ঐ টাকাগুলো সব আমার।
——না, তা বলিসনি। কিন্তু সেই হিসাবে তোর ব্যবসায় আমাদেরও অংশীদার আছে।
—–সোহেল আমি তো বুঝতে পারছি না তুই হঠাৎ ভাগ,অংশীদার এসব কথা কেন তুলছিস? হিমেলতো সংসারের সিংহভাগ দায়িত্ব একাই পালন করে যাচ্ছে।
——ভাইয়া, মানে আমাদের সংসার বড় হচ্ছে। আজ হয়ত টাকার প্রয়োজন পড়ছে না। তাই বলে কোনোদিন পড়বে না এ কথা তো বলতে পারছি না। তাই আমি বলছিলাম হিমেল যদি প্রতিমাসে ব্যবসা থেকে আমাদের ভাগ অনুযায়ী লভ্যংশের যে টাকাগুলাে আমরা পাই সেটা আমাদের হাতে দিয়ে দিলে ভালো হয়।
হিমেল ওর মেজভাইয়ের এ ধরণের কথায় মনে হয় একটু আহত হলো। কষ্টটা লুকিয়ে রেখে হিমেল বললো,
—–তুমি চাইলে তোমার শেয়ারটা উঠিয়ে নিতে পারো?
এ কথা শুনে হিমেলের বড়ভাই বললো,
——শেয়ার কেন উঠাবে?সোহেল এসব কি বলছিস তোর মাথা ঠিক আছে?
—–শেয়ারটা না হয় উঠালাম না তবে কাগজে কলমে লিখে রাখা দরকার।
শাশুড়ী মা পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য সোহেলকে বললেন,
—–সেটা ভাবার প্রচুর সময় আছে। তোদের দুভাইয়ের অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। তোরা রওয়ানা দে।
সুচরিতা নিজের রুমে বসে ওদের সব কথাই শুনতে পেলো। সুচরিতার বয়স কম হতে পারে কিন্তু মানুষ চিনতে ওর এতোটুকু ভুল হয় না। ওর মেজ ভাসুর যে প্রচন্ড স্বার্থপর এটা সুচরিতা আগেই বুঝেছে। এখন শুধু হিমেলের বুঝা বাকি। ওরা দু,ভাই অফিসে যাওয়ার পর সুচরিতার শাশুড়ী হিমেলের ব্রেনটা ওয়াশ করার জন্য নিজের রুমে ডেকে নিয়ে গেল। এটা সুচরিতা ভালোই বুঝে। হিমেল ঘন্টাখানিক মায়ের রুমে থেকে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে রুমে আসলো। তখন সুচরিতা হিমেলকে বললো,
—–তুমি একা কষ্ট করে ব্যবসাটা এগিয়ে নিচ্ছো আর ওদিকে মেজভাই তোমার ব্যবসার ভাগ চাচ্ছে। তুমি উনার ভাগের টাকাটা উনাকে দিয়ে দিলেই তো পারতে। ল্যাটা চুকে যেতো। সেটাই মনে হয় তোমার ব্যবসার জন্য ভালো হতো।। মেজভাইকে আমার একটু স্বার্থপর মনে হয়।
হিমেল একটু গম্ভীর হয়ে বললো,
——না, জেনে কারো সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করা উচিত নয়। আর তুমি আমাদের এসবের মধ্যে ঢুকো না। ঘরে বসে সব কথা শুনতে পেয়েছো দেখছি? তোমার তো শ্রবনশক্তি বেশ প্রখর।
সুচরিতাকে খোঁচা দিয়ে হিমেল অফিসে রওয়ানা হলো। সুচরিতাও মনে মনে বললো তোমার এই মেজভাই একদিন তোমার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙ্গে দিবে। সেদিন আমার কথা মিলিয়ে নিও।
কলিংবেলটা বেজে উঠলো। সুচরিতা রুম থেকে বের হয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে দেখে ওর বড় ননস দাঁড়িয়ে আছে। সাথে উনার দুইপিচ্চি। বড় মেয়েটা ফাইভে পড়ে। আর ছোটোটা থ্রীতে। ঘরে ঢুকে সুচরিতাকে বললো,
—–ওরা কি সবাই অফিসে গিয়েছে?
——হ্যা আপু।
—–আমাদের মা মেয়েকে একটু তাড়াতাড়ি নাস্তা বানিয়ে দাও। আমার কাজের বুয়াটা দু,দিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছে। এদিকে আমার অফিস ওদের স্কুল তোমার দুলাভাইয়ের অফিস সব মিলিয়ে হিমসিম খাবার যোগাড়। অনেকদিন মাকে দেখতে আসতে পারি না। তাই ভাবলাম দু,দিন তোমাদের এখানে থাকি মায়ের সাথে একটু সময় কাটাই। মায়ের তো বয়স হয়েছে বলো। আর ক,দিনেই বা বাঁচবেন।
—–আপু তা বেশ ভালো করেছেন। আমি নাস্তা বানিয়ে আনছি।
বড় মেয়ে সাবেরার গলার আওয়াজ শুনে সুচরিতার শাশুড়ী নিজের রুম থেকে বের হয়ে এসে বললো,
——ভালোই করেছিস।
তারপর দুই নাতনীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
—–আমার দিদিভাইয়েরা কেমন আছো? এতোদিন পর নানুভাইয়ের কথা মনে পড়লো।
সাবেরার ছোটো মেয়ে তুশি বললো,
—–আমরাতো আসতে চাই। আম্মু তো সময় পায় না। তবে আজ আমাদের কাজের হেলপার না থাকাতে আম্মু আসতে বাধ্য হলো। এখানে তো কাজ করার জন্য মামীরা আছে। আম্মুর তো কাজ করতে হবে না।
সাবেরা মেয়ের উপর রেগে গিয়ে বললো,
——ছোটো মানুষ ছোটো মানুষের মতো থাকো এতো বেশী কথা বলো কেন? মা কারিমা কোথায়? ওকে তো দেখছি না।
এই সময় কারিমা নিজের রুম থেকে বের হয়ে এসে বললো,
—–আপু কেমন আছেন?
—–ভালো। তোমার শরীর ভালো তো। অনেকক্ষণ হয় এসেছি তোমাকে দেখছি না?
—–আমার মেয়েটাকে খাওয়াচ্ছিলাম।
——আমার থ্রীপিছটা ইস্ত্রি করে দাওতো? সময়ের অভাবে ইস্ত্রি করতে পারিনি। আর এখানে তুশি আর তাপসীর কিছু জামা কাপড় আছে। মেশিনে ধুয়ে একটু মেলে দিও।
কারিমা মুখ কালো করে কাপড়গুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। ততক্ষণে সুচরিতা পাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিলো। তুশি আর তাপসীর জন্য টিফিনবক্সে পাস্তা ভরে দিলো। নাস্তা খেতে গিয়ে তুশি ওর মাকে বললো,
——তুমি এমন রান্না করো খাবার মুখে দেওয়া যায় না। মামীমার কাছে রেসিপিটা জেনে নিলেই তো পারো।
——হুম তোমার মামীমা তো আমার মতো অফিসে চাকরি করে না। তাই ঘরে বসে যদি রান্নাটা ঠিক মতো না করতে পারে তাহলে করবেটা কি?
সুচরিতা মনে মনে ভাবলো আজকাল মানুষের ভদ্রতা জ্ঞানের খুব অভাব। উনি এক ভাইয়ের বউয়ের কাছে নাস্তা টিফিন বানিয়ে নিলেন আর এক ভাইয়ের বউ জামা ইস্ত্রি করে দিলো সেটা উনি পরে অফিসে যাচ্ছেন অথচ ভাইয়ের বউদের খোঁচা দিতে ছাড়েন না। উনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে এ বাড়ির বউয়েরা মনে হয় বসে বসে খায়। আর ওতো প্রেগনেন্ট। তারউপর এখনও পড়াশোনা করতে হচ্ছে। একেই মনে হয় বলে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী
সুচরিতার সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। খুব মনোযোগ দিয়ে রাত জেগে পড়াশোনা করেছে। সকালে ঘুম ভাঙ্গাতে হিমেলের ইচ্ছে করলো না । তাই ও আর ঘুম থেকে সুচরিতাকে ডেকে তুলেনি। যেহেতু ও দেখেছে অসুস্থ শরীর নিয়ে রাত জেগে সুচরিতা পড়াশোনা করেছে। এদিকে খুব ভোরে তাপসী এসে সুচরিতার রুমের দরজাটা জোরে জোরে নক করতে লাগলো। হিমেল শোয়া থেকে উঠে দরজা খুলে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। তাপসী এসে সুচরিতাকে ঘুম থেকে ডেকে বললো,
—–মামীমা, মা বলেছে আমার আর তুশির জামাটা ইস্ত্রি করে দিতে।
এভাবে ডাকাতে সুচরিতার মাথাটা ঘুরে উঠলো।একটু বিরক্ত হলো। অতঃপর বিরক্তি চেপে রেখে বললো,
—–মাকে গিয়ে বলো মামীমার শরীর খারাপ। শোয়া থেকে উঠতে পারছে না।
এ কথা বলে সুচরিতা আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
হিমেল ওয়াশরুম থেকে তাপসী আর সুচরিতার কথপোকথন শুনে নিজের বোনের উপর বিরক্ত হলো। আর মনে মনে ভাবলো আপুটার এই পরের ঘাড়ে কাঁঠাল ভাঙ্গার স্বভাবটা আজো গেল না।
তাপসী ওর মায়ের কাছে গিয়ে বললো,
——মা,মামীমা বলেছে এখন ইস্ত্রি করতে পারবে না। উনার শরীর খারাপ।
এ কথা শুনে সাবেরা রেগে গিয়ে সুচরিতার শাশুড়ীকে বললো,
—–কাল রাতেই দেখলাম সুচরিতা সুস্থ সকাল হতে না হতেই অসুস্থ হয়ে গেল। মা, তোমার কিন্তু এসব প্রশ্রয় দেওয়া উচিত না।
এমনসময় কারিমা বত্রিশপাটি দাঁত বের করে সাবেরাকে বললো,
—–আপু তুশি আর তাপসীর জামা দুটো আমাকে দেন আমি ইস্ত্রি করে দিচ্ছি।
সাবেরাও গদগদ হয়ে তুশি তাপসীর স্কুল ড্রেসের সাথে নিজের একটা সুতি শাড়ি দিয়ে বললো,
——তুমি যখন ইস্ত্রি করে দিতেই চাইছো তাহলে আমার শাড়িটাও একটু ইস্ত্রি করে দাও। আজ অফিসে মিটিং আছে। মিটিং থাকলে আমি শাড়ি পরে যাই।
কারিমার বত্রিশপাটি দাঁতের বিজ্ঞাপন সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল। ও ভেবেছিলো দুটো জামা ইস্ত্রি করতে কি আর সমস্যা। এতে করে সুচরিতাকে ননসের হাতে একটু বাঁশ দেওয়া যাবে। কিন্তু ওকে বাঁশ দেওয়ার আগে শাড়িটা ধরিয়ে দিয়ে সাবেরা যে কারিমাকে আগে বাঁশ দিলো এটা ও ঠিক বুঝতে পারলো। নিজ থেকেই যখন দায়িত্ব নিয়েছে তখনতো আর অস্বীকার করতে পারবে না। অগত্যা মুখ কালো করে কাপড়গুলো নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আজ সুচরিতার বড় জা সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে দিলো। রাজনের টিফিন বক্সের সাথে তুশি আর তাপসীরও টিফিন বক্স রেডী করে দিলো। সবাই নাস্তা করতে টেবিলে এসে বসা মাত্রই সাবেরা হিমেলকে বললো,
—কিরে, তোর বউ সত্যি অসুস্থ হলো নাকি আমাকে দেখে অসুস্থ হওয়ার ভান করলো?
—–বড়আপা এটা তুমি কি বললে? ও যে পিরিয়ড এখন পার করছে এই পিরিয়ড তো তুমিও একসময় পার করেছো। পুরোটা সময় তুমি আমাদের কাছে ছিলে। কি করেছো সবই তো আমার মনে আছে।
হিমেলের মা একটু গম্ভীর হয়ে হিমেলকে বললো,
——সুচরিতা একটু বেশীই করে। বুঝলাম শরীর খারাপ তাও একটু কষ্ট করে উঠে করে দিলে কি হতো?
—–মা, ও ভোর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তারউপর ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে পারে না। বমি হয়ে যায়। ওর অবস্থা তো আমাদের বুঝতে হবে।
সাবেরা আবারও খোঁচা দিয়ে বললো,
—–বাচ্চাতো আর কেউ পয়দা করে নাই। তোর বউ একলা পয়দা করছে।
এমনসময় রোমেল রেগে গিয়ে সাবেরাকে বললো,
—–তোর এই খোঁচা মেরে কথা বলার অভ্যাসটা গেল না। আসলে সবার শরীর একরকম না। আবার সবার সহ্য ক্ষমতাও এক নয়।
সখিনা রাজনকে নিয়ে নাস্তা করে স্কুলে যেতে চাইলে হিমেল সখিনাকে বললো,
—–ভাবি তুমি তুশি আর তাপসীকে সাথে নিয়ে যাও। ড্রাইভারকে বলো তোমাদের সবাইকে স্কুলে নামিয়ে দিতে। তারপর আমি অফিসে যাবো।
সখিনা তুশি আর তাপসীর পানির ফ্লাক্স নিতে ভুলে গিয়েছিলো। কারিমা আদিখ্যেতা করে দৌড়ে এসে তুশি আর তাপসীর হাতে ফ্লাক্স ধরিয়ে দিলো। সখিনা ওদেরকে নিয়ে বের হয়ে গেল।
কারিমা ইস্ত্রির প্যাঁচালটা আবার শুরু করার জন্য মোক্ষম সময়ে শাড়ি নিয়ে হাজির হলো।
—–আপু আপনার শাড়িটা ইস্ত্রি হয়ে গেছে।
——বাহ্ একদম দোকানের মতো ইস্ত্রি করেছো। মায়ের ঘরে রেখে এসো।
সাবেরা তখন আবার পুরোনো প্যাঁচাল শুরু করলো।
—–কারিমাকে দেখে তোর বউকে কিছু শিখতে বলিস। ওর বাবার বাড়ি গ্রামে ছিলো বলে তোরা সবাই বলেছিলি ও নাকি আমাদের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না। কোনো কাজ করতে দিলে আজ অবদি কারিমা মুখের উপর না বলে নাই। কিন্তু তোর বউ আজ করে দেখালো। তুশি আর তাপসীর সামনে আমার মানসম্মানের হালুয়া বাজিয়ে দিলো।
সুচরিতাকে নিয়ে এই কূটকচালে সোহেল বেশ মজা পাচ্ছে। এদিকে রোমেল সাবেরাকে বললো,
——তুই কি প্যাঁচাল পেড়েই যাবি। তোর তো অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। তুই চাইলে আমার সাথে যেতে পারিস।
এমন সময় সোহেল বললো,
——ভাইয়া তুমি তোমার মতো অফিসে যাও। আমি আপুকে নামিয়ে দিবো।
রোমেল অফিসের দিকে রওয়ানা হলো। সাবেরা ওর মাকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
—–মা, তোমার সরলতার সুযোগ কাউকে নিতে দিও না। সংসারের হালটা শক্তভাবে ধরো।
এদিকে সুচরিতার ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়াতে আর ঘুম আসলো না। যারফলে নিজের রুমে শুয়ে ও ওদের সব কথাই শুনতে পেলো। আর মনে মনে ভাবলো কাল সাবেরার জন্য রান্না করলো বাচ্চাদের টিফিন বানিয়ো দিলো। অথচ আজ যেই বললো ও পারছে না অমনি ওর নিন্দে করতে এক মুহুর্ত লাগলো না। মানুষ আসলেই বড় স্বার্থপর। বুকের ভিতর জায়গা দিলে যতন কইরা ভাঙ্গেরে অন্তর। গানটা যেন এসব মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
হিমেলের প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। একদিকে ব্যবসা নিয়ে ও চিন্তায় আছে তারউপর এসব সাংসারিক কূটকচাল। সোহেল এর মাঝে আবার বোমা ফাটিয়ে বললো,
—–হিমেল, আমি চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছি।
—–কেন?
——ভাবছি সৌদি যাবো। আমার শালা সমন্ধিরা তো সৌদি গিয়ে ভালোই ইনকাম করেছে। গ্রামের মধ্যে দোতলা বাড়ি করেছে।
——সবই বুঝলাম। তুমি এসব অড জব করতে পারবে তো?আমি তো শুনেছি ভাবির ভাইয়েরা বাগানের মালি নয়তো শ্রমিক এসব কাজ করছে।
সবার সামনে হিমেলের এই কথায় সোহেলের মনে হয় একটু খোঁচা লাগলো। তাই একটু ঝাঁঝের স্বরে বললো,
—- সবসময় এসব কাজ ওরা করে না। যখন ভালো চাকরি পায় না তখন পার্টটাইম হিসাবে এই কাজগুলো করে। এছাড়া সবাইতো আর অড জব করে না। কেউ কেউ অফিস আদালতেও জব করছে।
সাবেরা অবশ্য সোহেলকে একটা ভালো পরামর্শ দিয়ে বললো,
——তোর চাকরিটা ছাড়ার দরকার নেই। লিয়েন নিয়ে আগে যা। তারপর যদি সুবিধা করতে পারিস তখন এসে চাকরিটা ছেড়ে দিস।
এ কথা শুনে হিমেলের মা বললো,
—–না, অত বিদেশ যেতে হবে না। যা হোক ডালভাত যাই খাই দেশেই থাক। আর বিদেশে যাওয়া বললে তো যাওয়া না। অনেক খরচের ব্যাপার।
——খরচ নিয়ে ভেবো না। হিমেল একটু সহযোগিতা করলেই আমার হয়ে যাবে।
হিমেল একটু চমকে উঠলো। কিভাবে এসব সামাল দিবে ও বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে সোহেলের যেহেতু নানারকম বদঅভ্যাস আছে তাই ওর মাও মত দিতে চাইছে না। সুচরিতাকে।। নিয়ে নানা ঝামেলা তারউপর সোহেলের বিদেশে যাওয়ার চিন্তা এসব নিয়ে সুচরিতার শাশুড়ি ভীষণ বিরক্ত। ঝালটা যে কখন কার উপরে উঠাবেন সেটাই দেখার বিষয়।
এদিকে সুচরিতার মোবাইলে ওর বাপের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। ওর বাবা স্ট্রোক করেছে। হাসপাতালে নিতে হবে। সুচরিতার মা ওর বাবাকে নিয়ে বার্ডেম হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হয়েছে। ও কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে এসে হিমেলকে বললো,
—–হিমেল আমি তোমার সাথে বের হবো। আমার বাবা স্ট্রোক করেছেন। আম্মা আব্বাকে নিয়ে বার্ডেম হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হয়েছে।
——তোমার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি।
সাবেরাও এই সুযোগে ফোড়ণ কেটে বললো,
—–সকালে দুটো জামা ইস্ত্রি করার শক্তি তোমার ছিলো না। আর এখন হাসপাতালের যাওয়ার শক্তি পাচ্ছো কোথা থেকে।
—–আপু আমার বাবা অসুস্থ। আমি যদি শক্তি নাও পাই তাও যাবো। যেতে আমাকে হবেই।
শাশুড়ী মাও বিরক্ত হয়ে বললেন,
—–তুমি কি ডাক্তার যে গেলেই তোমার বাবা ভালো হয়ে যাবেন। বরং মাথা ঘুরে পড়ে গেলে আর এক ক্যাচাল। তখন তোমাকে সামলাবে নাকি তোমার মা তোমার বাবার দেখভাল করবে?
হিমেল সুচরিতাকে নিয়ে রুমে আসলো। তারপর ওকে বুঝিয়ে বললো,
—–মাথা ঠান্ডা করে আমার কথাটা আগে শোনো। আমি গিয়ে আগে বাবার ভর্তির ব্যবস্থা করি। তারপর তোমাকে নিয়ে যাবো। যত ডাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে বাবার জন্য ততই মঙ্গল।
ড্রাইভার চলে আসাতে হিমেল হাসপাতালের পথে রওয়ানা দিতেই সোহেল বললো,
—–হিমেল, আজ আমাকে আর আপুকে অফিসে নামিয়ে দে।
সাবেরাও সাথে সাথে বলে উঠলো,
—–এখন দশটা বাজে। এগারোটায় মিটিং আছে। এখন বাসে গেলে আমার দেরী হয়ে যাবে।
হিমেল একটু রেগে গিয়ে বললো,
—–মিটিং থাকলে তুমি এতোক্ষণ আজাইরা প্যাচাল পাড়লে কেন?
—–সেই কৈফিয়ত তোর কাছে দেবো না। নামিয়ে দিতে বলেছি নামিয়ে দে।
সাবেরার সাথে সুর মিলিয়ে ওর মা বললো,
—–ওর অফিস তো মতিজিল। শাহবাগের পথেই তো পড়বে। এটা নিয়ে হিমেল তুই এতো কথা কেন বলছিস?
—-তোমাদের ঐ এক সমস্যা ইমারজেন্সি বুঝো না।
চলবে