# গল্প
#সুচরি ধারাবাহিকতা
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
পরদিন হিমেল আর সুচরিতা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো। ফজরের নামাজ পড়ে সুচরিতা হিমেলের জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিলো। নীটওয়্যারের ডিলটা হাত ছাড়া হয়ে যাওয়াতে ব্যবসার কিছু ক্ষতি তো হবে। সেটা পুষিয়ে উঠতে হয়তো একটু সময় লাগবে। হিমেল রেডী হয়ে নাস্তা করে অফিসে চলে গেল। এরপর সুচরিতা সবার জন্য রুটি আর সবজি করে টেবিলে দিয়ে দিলো। ওর বড় ভাসুর রোমেল আর মেজ ভাসুর সোহেল ও নাস্তা করে নিলো। ওর বড় জা ছেলেকে নাস্তা খাইয়ে নিজে নাস্তা করে স্কুলে রওয়ানা দিলো। ওর মেজ জায়ের মেয়েটার জ্বর এসেছে। তাই কারিমা এখন ও রুম থেকে বের হয়নি। শাশুড়ীমাও নাস্তা করার জন্য টেবিলে এসে বসলেন। মেজ ভাসুর তখন বড় ভাসুরকে বললো,
—–ভাইয়া বাড়ির বিলগুলো জমে আছে। দিতে হবে। তুমি কিছু টাকা দাও।
—–কেন হিমেল দেয়নি?
——না,মানে ওর কাছে এখনও চাইনি।
কিচেন থেকে সুচরিতা এ কথা শুনে ডাইনিং এ এসে সহজ সরলভাবে মেজ ভাসুরকে বললো,
—–ভাইয়া আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন। কালতো আপনাকে বিলের জন্য হিমেল দশ হাজার টাকা দিলো? আমার কাছ থেকে আলমারীর চাবি নিয়ে হিমেল টাকা বার করে আপনার হাতে দিয়েছে।
এ কথা শুনে মেজ ভাসুর যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। রেগে গিয়ে চড়া গলায় সুচরিতাকে বললো,
——কখন দিয়েছে? তুমি কিচেনের কাজ ফেলে আমাদের কথার মাঝে ঢুকছো কেন?
—–না,মানে আমি ভাবলাম আপনি হয়তো ভুলে গেছেন। আমার জন্য ডাক্তার আনতে যাওয়ার সময় আপনার হাতে টাকাটা দিয়ে গেছে।
এ কথা বলে সুচরিতা আবার কিচেনে চলে গেল। আজকে সুচরিতা বলতে বাধ্য হলো। কারণ ওর মেজ ভাসুর প্রায় এই কাজটা করে থাকেন। একই পারপাসে দুই ভাইয়ের কাছে টাকা নেন। সুচরিতা চলে আসার পর ওর বড় ভাসুর রোমেল সোহেলকে বললো,
—–তুই ওর উপর রাগ করছিস কেন? তোর তো ভুল হতেই পারে?
—–বিলের টাকা দেওয়া হলো কি না হলো এসব বিষয়ে তাকে কে বলেছে মাথা ঘামাতে? ঘরের বউ সে রান্না বাড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। এতোদিকে তার খেয়াল না রাখলেও চলবে।
এদিকে সোহেলের হাঁক ডাক শুনে কারিমা ডাইনিং রুমে চলে আসলো। শাশুড়ীমা বুঝতে পারছেন না সোহেল কেন রেগে যাচ্ছে? সুচরিতা ঠিকই বুঝতে পারছে। দেখা যায় একই বিলের টাকা ও বার বার নেয়। সেটাকা দিয়ে বউয়ের জন্য দামী শাড়ি মেয়ের জন্য খেলনা অথবা শাশুড়ীর মনের মতো বাজার করে দিয়ে ক্রেডিট নেয়। হিমেল তো ব্যবসার কারনে সময় পায় না। কিন্তু টাকাটা দিয়ে দেয়। তারপরও হিমেলের কোনো গুরুত্ব হয় না। কারিমাও মুখ ভার করে কিচেনে আসলো। সুচরিতা কারিমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ভাবি জেবার জ্বর এখন কেমন?
কারিমা কোনো জবাব না দিয়ে মেয়ের জন্য দুধ বানিয়ে নিয়ে চলে গেল। বড় ভাসুর অফিসে রওয়ানা দিলো। শাশুড়ী মা নাস্তা করে নিজের রুমে চলে গেল। সোহেলও মায়ের রুমে গিয়ে বসলো। সুচরিতা শাশুড়ী মায়ের জন্য চা বানিয়ে উনার রুমে যাওয়ার সময় শুনতে পেলো,সোহেল তার মাকে বলছে,
——মা, অনার্স কমপ্লিট হয়ে গেল সুচরিতাকে আর পড়ানোর দরকার নেই। এখন মন দিয়ে সংসার করুক। দেখোনা এখনি কতদিকে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। আমাদের ভাইদের টাকা পয়সার ব্যাপারে ও নাক গলানোর কে? এ বাড়িতে এসেছে তো মাত্র তিনবছর। আমাদের বাকি বউদের তো এসব বিষয়ে কথা বলার আজো সাহস হয়নি। মা ওকে তুমি সাবধান করে দিবে যেন সংসারের এসব বিষয়ে মাথা না ঘামায়। তখন কিন্তু আমি খারাপ হতে বাধ্য হবো।
—–আমিও ভাবছি মাস্টার্সে আর ভর্তি করাবো না। তুই ওর বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দে। তুই এখন অফিসে যা। আমি বাকিটা দেখছি।
বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা নক করে সুচরিতা শাশুড়ীর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে দুপুরে কি রান্না হবে জিজ্ঞাসা করলো। শাশুড়ী মা সুচরিতার কথার কোনো জবাব দিলেন না। তখন সোহেল খেঁকিয়ে উঠে সুচরিতাকে বললো,
—–দেখতে পারছো না আমি আর মা এখানে জরুরী কথা বলছি। এসময় তোমাকে এখানে কে আসতে বললো? আড়ি পেতে আমাদের কথা শোনা হচ্ছে তাইনা?
—–না,ভাইয়া আমি মাকে চা,টা দিতে আসছিলাম।
—–তুমি কি ভাবো আমরা সবাই বোকা আর তুমি একাই খুব চালাক।
সোহেলের খেঁকিয়ে উঠা দেখে সুচরিতা কিছু না বলে নিজের রুমে চলে আসলো। আসলে এ বিষয়গুলো ও হিমেলকে কিভাবে বলবে। হিমেল ও ভাবতে পারে সুচরিতা মনে হয় মায়ের রুমে আড়ি পেতেছে। হিমেল ওকে ভালবাসে কিন্তু ও ওর মা ভাইবোনের প্রতিও অসম্ভব দুর্বল। আর এরা এই বিষয়টা দিয়ে হিমেলকে ব্লাকমেইল করে। যেমন ওর বিয়ের মাস খানিক পরে জেবার জন্ম হয়। ওর মেজ ভাসুরের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তখন উনার হাতে টাকা না থাকার কারনে সিজার হওয়ার সমস্ত খরচ হিমেল বহন করে। তখনও হিমেলের ব্যবসাটা গুছিয়ে উঠেনি। যার ফলে হিমেল আর সুচরিতার কক্সবাজারে হানিমুনের প্রোগ্রামটা ক্যান্সেল করতে হয়েছে।এ বাদে শাশুড়ীমাও বায়না ধরেছিলেন উনিও উনার মেজ মেয়েকে সাথে নিয়ে কক্সবাজার যাবেন। একথা শুনে সুচরিতা হানিমুনে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়া সুচরিতার সন্দেহ সোহেলের মনে হয় জুয়া খেলার বদঅভ্যাস আছে। কারণ মাঝে মাঝে রাত করে বাড়ি ফিরে। এটা নিয়ে শাশুড়ী মা আর বড় ভাসুর সোহেলকে বকাঝকা করে। যাই হোক সন্দেহ করে কিছু বলা উচিত নয়। তবে কিছু একটা গড়বড় আছে এটা সুচরিতা ভালোই বুঝতে পারে। ছেলের সমস্যা আছে বলে শাশুড়ী মাও কারিমাকে একটু সামঝে চলেন। কারণ ওযে মুখরা। হয়তো এই সংসার ছেড়েই চলে যাবে। ওর বাড়ি নারায়নগঞ্জ। ছয় ভাইয়ের একবোন। ওর বাবা মেম্বার। মাঝে মাঝে কারিমাকে সুচরিতা ওর ভাসুরকে বলতে শুনে
—–সাবধান, আমার সাথে তেড়িবেড়ি করলে বাপজানরে কইয়া দিমু। তখন বুঝবেন কত ধানে কত চাল।
ডোর বেলটা বেজে উঠলো। সুচরিতা দরজাটা খুলে দিলো। কাজের ছুটা বুয়া চলে এসেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দশটা বাজে। কাজের খালা এঁটো বাসন কোসন ধুয়ে কিচেনটা পরিস্কার করুক এ ফাঁকে সুচরিতা বিছানায় গা টা এলিয়ে দিলো। ক্লান্ত শরীরে একটু তন্দ্রামতো এসেছে। কাজের খালার ডাকে ওর ঘুমটা ছুটে গেল।
——খালা আমার কাজ শেষ হইয়া গেছে। আমি গেলাম। দরজাটা লাগাইয়া দেন।
ও মেইন দরজা লাগিয়ে রুমে আসলো। এমন সময় শাশুড়ী মা এসে বললেন,
—–সোহেল যে তোমাকে বকাঝকা দিয়েছে এটা আবার হিমেলের কাছে লাগিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাতের সৃষ্ট করো না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমি এই সংসার গড়েছি। তোমাদের ভুলের জন্য আমি আমার সংসারকে ভাঙ্গতে দিবো না।
—–মা এটা তো শুধু আমার একার দায় নয়। সংসারের প্রতিটা মানুষকে এটা বুঝতে হবে।
—–কিন্তু তোমারতো আগ বাড়িয়ে টাকার কথাটা বলার দরকার ছিলো না। তুমি টাকার কথা বলেছো বলে সোহেলের রাগ উঠে গেল। যাই হোক কথায় কথা বাড়ে। রান্নাটা সেরে ফেলো।
এদিকে ও দুদিন কলেজে যেতে পারেনি। তাই শাশুড়ীমাকে বললো,
—-মা আমি তো কদিন কলেজে যেতে পারিনি। পড়াগুলো টুকে আনতে হবে। আজকে আমাকে দুপুরের পর কলেজে যেতে হবে।
——ঠিক আছে যাও।
সুচরিতা হিমেলের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে ওর প্রোগ্রামটার কথা জানিয়ে দেয়। এরপর রান্না শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ওখানে সজল শফিক রিমা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কল্যানপুর থেকে মিরপুর বাংলা কলেজে যেতে সুচরিতার খুব একটা সময় লাগেনি। তারপর ওরা সবাই মিলে প্রিন্সরেস্টুরেন্টে যায়। আসলে অনেকদিন থেকেই সুচরিতার বন্ধুদের এটা দাবি ছিলো। ওখানে সুচরিতা ওদের খাওয়ায়। সবাই মিলে একটু আড্ডা দেয়। সুচরিতার বাড়ির কূটকচাল থেকে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ওর নিজেরও বেশ ভালো লাগে। কখন যে সময় গড়িয়ে যায় টের পায় না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধা ছ,টা বাজে। ও শফিকের কাছে নোটসগুলো নিয়ে ব্যাগে ভরে নেয়। এমন সময় ওখানে আর একটা টেবিলে ওর মেজ ভাসুরকে দেখতে পায়। মেজ ভাসুরের সাথে সুচরিতার আই কন্ট্রাক হয়। উনার সাথেও সুচরিতা দু,জন লোক দেখতে পায়। সুচরিতা একটু ঘাবড়ে যায়। এটা নিয়ে ওর ভাসুর বাড়িতে কি কাহিনী করবে কে, জানে।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী
সুচরিতা যেই উঠতে যাবে অমনি মোবাইলে হিমেলের একটা মেসেজ আসলো।
“ডার্লিং তুমি কি এখনও রেস্টুরেন্টে আছো না চলে গেছো”?
“এখনও আছি”
“আমি আসছি। একটু অপেক্ষা করো”
এ যেন সুচরিতার কাছে মেঘ না চাইতে জল। তাই এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ও মেসেজ দিলো,
“ওকে”
সুচরিতা ওর ফ্রেন্ডদের একটু অপেক্ষা করতে বললো। কিছুক্ষণ পর ও ভাসুরও ওখান থেকে চলে গেল। আসলে সুচরিতা এটা ভালো করেই জানতো ওর ভাসুর যেহেতু ওকে এখানে দেখেছে তাই আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে ওর শাশুড়ীমায়ের কান ভারী করবে। তারপর এটা নিয়ে অশান্তি শুরু হবে। হিমেল সাথে থাকলে অশান্তির মাত্রাটা একটু কম হবে। যাক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হিমেল চলে আসলো। সুচরিতার ফ্রেন্ডদের হিমেল আগে থেকেই চিনতো। তাই ওদের সাথে কুশল বিনিময় করে হিমেল সুচরিতাকে নিয়ে বাড়ীর পথে রওয়ানা হলো।
হিমেল সুচরিতাকে বাড়ীর গেটের সামনে নামিয়ে একটু বাজারের দিকে গেল। সুচরিতা ডোরবেলটা বাজালো। ওর মেজ জা এসে মুখ গম্ভীর করে দরজাটা খুলে দিলো। সুচরিতা বাসায় ঢুকতে গিয়ে শুনতে পেলো ওর ভাসুর ওর শাশুড়ীকে বলছে
—–ঐ যে মক্ষীরানি আসলেন।
শাশুড়ী সুচরিতাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–তোমার তো কলেজে যাওয়ার কথা ছিলো। তুমি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলে কেন?
—–মা ঐ সময় তো কলেজ বন্ধ হয়ে যায় তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা না বলে ওদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসেছিলাম।
ওর কথা শুনে মেজভাসুর রেগে গিয়ে বললো,
—–কলা বেচা আর রথ দেখা একসাথে চললো। বাকি বউরা সংসারের কাজ করে দিশা পায় না আর উনি বন্ধুবান্ধব নিয়ে রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিয়ে বেরান। সংসারের শান্তি রক্ষার্থে মা তুমি এসব বন্ধ করো।
শাশুড়ীমা ভাসুরের কথা শুনে রেগে গিয়ে বললেন,
—–শোনো মেয়ে, গ্রাজুয়েশন হয়ে গেলে আর পড়াশোনা করতে হবে না। সংসার করার জন্য এটুকু পড়াশোনা যথেস্ট।
—–মা, আমি মাস্টার্সটা করতে চাই।
—–তুমি তো জজ ব্যারিস্টার হচ্ছো না। বা দেশ উদ্ধারও করছো না যে তুমি পড়াশোনা না করলে সব গোল্লায় যাবে। আর আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস তুমি পাও কই? যা বলেছি তাই হবে। তোমার জন্য আমার সংসারে অশান্তি ডেকে আনতে পারবো না। আর আমিও ভাবতে পারি না আমার বাড়ির বউ পরপুরুষের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে হাসিঠাট্টা করবে। এ পাড়ায় আমাদের একটা সম্মান আছে। তোমার এ ধরনের আচরণ যদি পাড়ার লোকদের চোখে পড়ে তাহলে আমার মান সম্মান তো ধুলোয় লুটোবে?না বাপু আমি তোমার জন্য আমার বাড়ির মানসম্মান খোয়াতে পারবো না।
ওর ভাসুরও রেগে গিয়ে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে মারমুখী হয়ে বললো,
—–সেদিকে কি উনার খেয়াল আছে। তুমি যদি দেখতে মা বাজারের মেয়েদের মতো ও কিভাবে হাসছিলো ঐ ফটকা ছেলেগুলোর সাথে তাহলে তোমার মাথার চান্দি গরম হয়ে যেতো। এতোই যদি লেখা পড়ার শখ ছিলো তাহলে ড্যাং ড্যাং করে বিয়ের পিঁড়িতে বসলে কেন? নিজের মা বাপকে বলতে পারোনি তুমি পড়ালেখা করতে চাও?
—–সোহেল তুই এতো মাথা গরম করিস না। বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দে।
সুচরিতা ওর ভাসুরের মারমুখী ভাব দেখে একটুভয় পেয়ে গেল। পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলো এদের সামনে ভয় পেলে এরা আরো পেয়ে বসবে। তাই ও নির্লিপ্ত ভাব দেখালো। এমনসময় ডোরবেলটা বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখে হিমেল এসেছে। হিমেল ওর চোখে পানি দেখে একটু অবাক হলো। ড্রইংরুমে ওর মা আর ভাইকে বসে থাকতে দেখে এটুকু বুঝেছে কিছু একটা ঘাপলা হয়েছে। সুচরিতা দরজা খুলে দিয়ে ওর রুমে চলে গেল। হিমেল ড্রইংরুমে উনাদের বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
—–কি কোনো সমস্যা?
সোহেল রাগত স্বরে বললো,
—–বউকে এতো বিশ্বাস করিস না।
—- কেন কি সমস্যা?
—–তোর বউকে দেখলাম কিছু ফটকা টাইপের পোলাপানের সাথে প্রিন্স রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতে।
——তোমার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। ওরা ফটকা টাইপের না। ওরা সুচরিতার ফ্রেন্ড। আমি ওদের খুব ভালোভাবে চিনি। আমিই তো ওকে রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে আসলাম।
এ কথা শুনে সোহেল গলার স্বরটা একটু নামিয়ে বললো,
—–আমার সাবধান করার কথা সাবধান করেছি এখন বাকিটা তোর বুঝার ব্যাপার। স্ত্রৈন হয়ে থাকলে সে তো পুরুষ হলো না। পুরুষ হতে হলে বৌয়ের উপর কন্ট্রোল থাকতে হয়। আর একটা কথা তোর বউ ইদানিং মায়ের মুখে মুখে কথা বলে। এ বিষয়টা আমার ভালো লাগে না। ওকে নিষেধ করবি ও যেন কখনও আমাদের মায়ের মুখের উপর কথা না বলে।
এ কথা বলে সোহেল ওর রুমে চলে গেল।
সুচরিতা নিজের রুম থেকেই সোহেলের এই কথাগুলো শুনতে পেলো। হিমেলও রুমে এসে দেখলো সুচরিতার চোখমুখ অনেকটা ফোলা।মানে ও যে কেঁদেছে এটা ভালোই বুঝা যাচ্ছে। সুচরিতাও হিমেলের দিকে তাকিয়ে বুঝলো ওর মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।
ওর ভাসুরের কথাগুলো ওর গায়ে খুব লেগেছে। হিমেল সুচরিতার সাথে কোনো কথা বললো না। এটা সুচরিতাকে খুব কষ্ট দিলো। দোষ না করেও সবার কাছে ওকে কথা শুনতে হলো। হিমেলও মনে হয় সুচরিতার এই কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারলো না। তারপরও সুচরিতা হিমেলকে কিছু একটা বলতে চাইছিলো তার আগেই হিমেল ওকে বললো,
—–সুচরিতা আমি তোমার সবকিছু মানতে পারবো কিন্তু আমার মাকে যদি তুমি অসম্মান করো তাহলে তোমার কোনোকিছুই আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। আমার সাথে সংসার করতে গেলে এ কথাটা সারাজীবন মনে রেখো।
—–আমি মাস্টার্স করতে চাইছিলাম।
—–করবে। আমি তোমার কোনো আশাই অপূর্ণ রাখবো না। পারি কি না পারি আমি অন্তত চেষ্টা করবো। কিন্তু মাকে অসম্মান করলে আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না। তুমি মায়ের কাছে মাফ চেয়ে নিও।
—–আমি তো মাকে তেমন কিছুই বলিনি।
——তোমার দৃষ্টিতে হয়তো বলো নাই কিন্তু আমার মা কষ্ট পেয়েছে।
এ কথাগুলো বলে হিমেল রুম থেকে বের হয়ে গেল।
সুচরিতা কি করে বুঝাবে ওকে বিনা দোষে এই পরিবারে দন্ড পেতে হয়। মাঝে মাঝে হিমেলকে ওর পর মনে হয়। বাবা মায়ের উপরও অনেক অভিমান হয়। সুচরিতা পড়শোনা করতে চেয়েছিলো। উনারা একটু সাপোর্ট দিলেই পারতেন। আবার কোনো কিছু না ভেবেই বিশাল জয়েন্ট পরিবারে বিয়ে দিলেন। কতইবা বয়স সুচরিতার। এ বাড়িতে ওর বর সবার ছোটো। ও যদি সুচরিতার থেকে দশ বছরের বড় হয় তাহলে বাকি মানুষগুলোও তো ওর থেকে অনেক বড়। কিভাবে সুচরিতা ওদের সাথে পেরে উঠবে। ওদিকে ওর বাবা মায়ের কথা হচ্ছে হিমেল খুব ভালো ছেলে। কোনো রকম বদঅভ্যাস নাই। ঘরমুখী ছেলে। নিজের মা,ভাইবোনকে ভালোবাসে এটা এমন দোষের কিছু নয়। মা আরোও একধাপ এগিয়ে এসে বলে
—–তোর দাদার কত রাগছিলো। মাঝে মাঝে আমাকে বাপ মা তুলে গাল দিতো। আমি তাও হজম করে তোর বাপের সাথে সংসার করে গিয়েছি। তোর বাবা সংসারের বড় ছেলে। ওরা আট ভাইবোন ছিলো। সংসারের বেশীরভাগ দায়িত্ব তোর বাবাকেই পালন করতে হয়েছে। আমি তো ঠিক মানিয়ে নিয়েছি। মেয়েদের একটু মানিয়ে নিতে হয়।
তাই সুচরিতাকেই মানিয়ে খেতে হবে। কিন্তু সুচরিতা ওর মায়ের সাথে একমত নয়। মেয়েদের কেন সয়ে যেতে হবে। দোষ না করেও কেন দোষী হতে হবে। ওর যদি মেয়ে হয় তাহলে সুচরিতা ওকে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবে। যাতে ও মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে। মেয়ে মানুষ হিসাবে নয়।
খুব কষ্ট হয় সুচরিতার। লাইট অফ করে সুচরিতা বিছানায় শুয়ে আছে। বুকের কোথায় যেন কষ্টের পাহাড় জমছে। কি জানি এই পাহাড় হয়তো একদিন এতো বড় হবে যেটা ওর আর হিমেলের মাঝে দুরত্বের সৃষ্টি হবে। কিন্তু সুচরিতা তো এমন জীবন চায়নি। প্রথম থেকেই এখানে ও মানিয়ে চলার চেষ্টা করছে। অথচ আজ ভাসুর হয়ে ওকে মক্ষীরানি বাজারের মেয়েছেলে কত কিছু বলে গেল। হিমেল তো একবার এসে ওর কাছে জানতে চাইতে পারতো ঘটনাটা আসলে কি হয়েছে? তবে এবার সুচরিতাও ছাড়বে না। ও জানে হিমেল ওর উপর রাগ করে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না। হিমেলের রাগটা পড়ে গেলেই ওর ভাসুরের ওকে এইভাবে গালিগালাজ করার প্রসঙ্গটা ও তুলবে। ও দেখতে চায় হিমেল ওর ভাইয়ের এসব কথার কি উত্তর দেয়। দরজায় কে যেন নক করছে। ও দরজা খুলে দেখে ওর বড় জা দাঁড়িয়ে আছে।
—–রাত দশটা বাজে। ডিনার করবে না। মা তোমাকে ডাকছে?
চলবে