সুচরিতা পর্ব-৪০+৪১

0
614

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-চল্লিশ
মাহবুবা বিথী

সুসমিতা প্রথমে বিয়েতে রাজি হচ্ছিলো না। আসলে বিয়েতে তো প্রচুর খরচ। ওদের বাবা অসুস্থ থাকার কারনে চিকিৎসার পিছনে প্রচুর অর্থ খরচ হয়েছিলো। আবার এখন এই বিয়ে সামাল দিতে ও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এই মুহুর্তে এতো টাকা ও কিভাবে ম্যানেজ করবে। যদিও হাতের বালা, গলার হার,বানানো আছে। তারপর ও তো আরো কিছু লাগবে। কানের দুল, ছেলের আংটি,ঘড়ি, বিয়ের পোশাক এ বাদেও কত আনুষঙ্গিক খরচ থাকে। এসব নানা চিন্তায় ওর বিয়ে করতে মন চাইছে না। সুচরিতা ওকে বোঝানোর জন্য অফিস ফেরত আজ ওর বাসায় আসতে বললো। ওর কলিগ খুব তাগাদা দিচ্ছে। ক্যারিয়ার, চাকরি আর সংসারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমনিতেই ছেলের বয়স অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। পাত্রের বয়স এখন ছত্রিশ। তাই খুব দ্রুত বিয়ে সারতে চাইছেন ছেলের মা। নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বেড়ে উঠে ছেলেটি নিজেকে আজ প্রতিষ্ঠিত করেছে। মা আর এক ভাই এক বোন এই নিয়ে ছেলের সংসার। সুচরিতার কলিগ অর্পার সাথে একদিন স্কুলে এসেছিলো। ছেলেটি পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ। এক হারা গড়ন। শুধু অর্পার কাছে শুনেছে ছেলে খুব মা ভক্ত। সুচরিতা এই কথাটি সুসমিতার কাছে গোপন রেখেছে। এমনিতেই ও বিয়ে করতে চায় না তারপর এই কথা কানে গেলে সাথে সাথে রিজেক্ট করে দিবে। কিন্তু সুচরিতা এই ছেলেকে হাতছাড়া করতে চায় না। সুসমিতাকে না জানিয়ে সুচরিতা অর্পার কাছে সুসমিতার অফিসের ঠিকানা আর ছবি দিয়েছিলো। ছেলে ও এক ফাঁকে সুসমিতাকে দেখে নিয়েছে। সুসমিতাকে ছেলের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এখন ওর সাথে ছেলে কথা বলতে চায়। আসলে এটা ছাড়া সুচরিতার আর কোনো উপায় ছিলো না। যতদিন ওর বাবা বেঁচে ছিলো সুসমিতার তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছিলো না। কিন্তু ওদের বাবা মারা যাবার পর সুসমিতাকে অফিসে বেশ কিছু ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ ওর বসের দৃষ্টি পড়েছে ওর উপর। যেমন প্রায় দুপুরে লাঞ্চের সময় সুসমিতাকে ডেকে পাঠায়। আবার অফিস ছুটির পর ওকে নিয়ে বিভিন্ন রেস্ট্রুরেন্টে খেতে যায়। সুসমিতা বাসায় তাড়াতাড়ি ফেরার তাগিদ দিলে বস বলে,
—–আপনার তো আর সংসার নেই। কিছুটা সময় আমার সাথে কাটাতেই পারেন।
——না,স্যার বাসায় ফিরতে রাত হলে আম্মু তো আমার জন্য টেনশন করে। আমি না ফেরা অবদি পথ পানে চেয়ে বসে থাকে।
—–বলবেন অফিসের কাজ ছিলো। আপনি আগে তো এ সমস্যার কথা বলেননি। তাহলে আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিতাম।
সুসমিতা যতই শয়তানটাকে এড়াতে চায় ঐ শয়তান ততই যেন জড়াতে চায়। সুসমিতা ওর কাছে এসব কথা শেয়ার করার পর ওর মনে হয়েছে বিয়েটা তাড়াতাড়ি দেওয়া দরকার। চাকরিটা ছাড়তেও পারছে না। এই দুর্মূল্যের বাজারে আর একটা চাকরি না পেয়ে কি করে এই চাকরিটা ছাড়বে?
এই সব নানা কারনে আজ সুসমিতাকে সুচরিতা বাসায় ডেকেছে। আজ বৃহস্পতিবার থাকায় সুচরিতা স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে পেরেছে। বৃহস্পতিবার বারোটা পর্যন্ত ক্লাস হয়। এরপর দুঘন্টা প্লে ক্লাস হয়। বাচ্চারা মনের আনন্দে নানা ধরনের ইনডোর গেইম খেলে। এদিকে আর এক সমস্যা। লাকি এক সপ্তাহের জন্য ওর দেশের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। কবে আসবে তার ঠিক নেই। আবার নাও আসতে পারে।স্কুল থেকে বাসায় এসেই পোশাকটা চেইঞ্জ করে চুলায় ভাত চাপিয়ে দিলো। আর একচুলায় ডাল বসিয়ে তারিক আর তাকিয়ার স্কুলের ড্রেস চেইঞ্জ করে দিলো। ভাত আর ডাল হয়ে গেলে ডিমভাজি আর বেগুন ভাজি করে টেবিলে খাবার দিয়ে দিলো। এর মাঝে হিমেলও তৈয়বাকে নিয়ে চলে আসে। ওরাও ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়লো। সুচরিতা একটা প্লেটে ভাত ডাল আর ডিম ভাজি নিয়ে তাকিয়া আর তারিককে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। হিমেল লাঞ্চ করে অফিসে চলে যাওয়ার পর সুচরিতাও খেয়ে নিয়ে রান্না ঘরে এঁটো বাসনগুলো ক্লিন করে রাখলো। ডোরবেলটা বেজে উঠলো। তৈয়বা দরজা খুলে চিৎকার জরে বললো,
—–আম্মু খালামনি এসেছে।
সুচরিতা কিচেন থেকে বের হয়ে এসে সুসমিতাকে জিজ্ঞাসা করলো,
——লাঞ্চ করে এসেছিস?
——না,
——ফ্রেস হয়ে আয়। টেবিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
সুচরিতা কিচেনে গিয়ে ভাত ডাল, বেগুনভাজি, ডিমভাজি, আর দু,পিচ ইলিশমাছ ভেজে সুসমিতাকে খেতে ডাকলো। ফ্রেস হয়ে সুসমিতা টেবিলে এসে খেতে বসলো।
—–লাকি চলে যাওয়াতে বেশ সমস্যায় পড়েছি। তেমন কিছু রান্না করতে পারলাম না। আজকে এই দিয়েই খেয়ে নে।
—–কি যে বলো আপু? আমার তো এগুলো খেতেই মজা লাগে।
খাওয়া শেষ করে দু,বোন এসে বিছানায় বসলো। সুচরিতা একটু ইতস্তত করে সুসমিতাকে বললো,
—–আমি তোকে না জানিয়ে কিছু কাজ করে ফেলেছি।
——কি করেছো?
——আগে বল তুই রাগ করবি না?
—-ওমা,এটা কি বললে তুমি? রাগ করার মতো হলেও আমি রাগ করতে পারবো না?
——না, পারবি না।
—–ঠিক আছে বলো শুনি।
——আমি তোকে না জানিয়ে ঐ ম্যাজিস্টেট ছেলেটাকে তোর অফিসের ঠিকানা দিয়েছি। ছেলে তোকে পছন্দ করেছে। এখন তোর সাথে কথা বলতে চায়।
—–সবই যখন করে ফেলেছো তখন আর এটা জিজ্ঞাসা করার দরকার কি? ছেলের সাথে দেখা করতে কখন কোথায় যেতে হবে সেটা বললেই পারতে?
——রাগ করিস না বোন। দেখনা তোর অফিসের বস তোর সাথে কি শয়তানি শুরু করেছে। ওদিকে খোকনের মতি গতিও ঠিক লাগে না। এছাড়াও বিয়ে করার একটা সঠিক বয়স আছে। সুযোগ থাকলে সেই বয়সেই বিয়ে করা উচিত।এসব নানা দিক বিবেচনা করে তোর ও এখনি বিয়ে করা উচিত।
সুসমিতাও আর কিছু বললো না। পরদিন শুক্রবার থাকায় একটা রেস্টুরেন্টে সুসমিতা আর সারোয়ার নিজেদের মধ্যে দেখাশোনা সেরে নেয়। সারোয়ারকে সুসমিতার ভালোই লেগেছে। ছেলে মেয়ের পছন্দ হয়ে যাওয়াতে দুই পরিবারের সম্মতিতে সুসমিতা আর সারোয়ারের বিয়ে হয়ে যায়। খোকন সুসমিতার বিয়েতে এক জোড়া কানের দুল গিফট দেয়। সবাই খোকনের উপর খুব খুশি। সুসমিতার মাতো আর এক ধাপ এগিয়ে এসে সবাইকে বললো,তার ছেলে কতটা দায়িত্বশীল হয়েছে এই দুর্মূল্যের বাজারে বোনকে সোনার জিনিস গড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সুসমিতা আর সুচরিতা খোকনের এতো ভালোমানুষিটা নিতে পারছে না। ওদের কেবলি মনে হতে লাগলো খোকন মনে মনে নিশ্চয় কোনো ফন্দি আঁটছে। যাক ভালোভাবেই সুসমিতার বিয়ে হয়ে গেলো।
আরো বছরখানিক সময় পার হয়ে গেল। শোভনও এইচএসসি পাশ করে জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। খোকন ও এম,কম পাশ করে ফেলেছে। তৈয়বা ক্লাস টুতে টপার হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে সুচরিতার জীবনের সময়গুলো এগিয়ে যেতে লাগলো। সুচরিতার খুব চিন্তা ছিলো সুসমিতার শ্বশুর বাড়ি নিয়ে। আল্লাহর রহমতে ওর শাশুড়ী মা বেশ ভালো মনের মানুষ। তাইতো ও চাকরিটা করে যেতে পারছে। সুসমিতাকে ভীষণ আদর করে। বিয়ের আগেই কক্সবাজারে মারমেইড বীচটা বুকিং করে রেখেছিলেন। বৌভাতের পরদিন ছেলে আর বৌমাকে ঐ রিসোর্টে পাঠিয়ে দেন। সুচরিতার বেশ ভালো লাগে। এইচএসসি পাশের পর থেকে টানা আট বছর ওর বোনটা স্ট্রাগল করে গেছে। জীবনের এই সুখটা ওর প্রাপ্য বলে আল্লাহপাক ওকে দান করেছে। সুসমিতার বিয়ের পর থেকে ওর শাশুড়ী মা ওকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। সে জন্য সুসমিতা ঘর সংসার আর চাকরি দুটোই সামলাতে পারছে। ওর দেবর আনোয়ার ঢাকা ভার্সিটির আইবিএ থেকে বের হয়ে ইউনিলিভারে জয়েন করেছে। ননদ ঢাকা ভার্সিটিতে নৃবিজ্ঞানে অনার্স পড়ছে। সুসমিতা ভালো আছে দেখে সুচরিতার খুব ভালো লাগছে।
কিছু কিছু মানুষের জীবনের রাস্তাটা সমতল হয় না। কখনও সমতল কখনও বা খানা খন্দে ভরা থাকে। সুচরিতার জীবনটাও অনেকটা সেরকম। সেদিন ছিলো শুক্রবার। ছুটির দিন থাকাতে দুপুরে খেয়ে একটু ভাতঘুম দেওয়ার চেষ্টা করছিলো। হিমেল ওর শাশুড়ীর সাথে দেখা করতে কল্যানপুরে গিয়েছে। এর মাঝে সুচরিতার ফোনটা বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসাতে ও রিসিভ করলো না। দ্বিতীয়বার আবার ফোনটা বেজে উঠলো। হ্যালো বলাতে ওপাশ থেকে এক নারী কণ্ঠ বলে উঠলো,
—–+আপনি কি সুচরিতা আপু বলছেন?
—–হুম,আপনি কে বলছেন?
——আমি এলিন বলছি।
——আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
—–না পারারই কথা। তবে আমি আপনাকে চিনতে পারছি। খোকনের মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি।
——খোকনকে আপনি কিভাবে চিনেন?
——সে কথায় পরে আসছি। যে খবরটা জানানোর জন্য আপনাকে ফোন করা সেটা আগে বলে নেই। খোকন একজন ননমুসলিম মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আপনি কি সেটা জানেন?
এ কথা শুনার পর সুচরিতার মনে হলো ওর মাথায় যেন বাঁজ পড়লো।

চলব

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-একচল্লিশ
মাহবুবা বিথী

সুচরিতা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ওকে তুমি করেই বললো,
—–তুমি কি সেই মেয়ে?
ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ নিরবতা নেমে এলো। সুচরিতা আবারো বললো,
—–কথা বলছো না কেন? যা জানতে চাইছি তার উত্তর দাও।
সুচরিতা আরো কিছু বলতে চাইছিলো তার আগেই মেয়েটি বললো,
—–হুম,আমি সেই মেয়ে। আমি খৃীষ্টান ধর্মের অনুসারী।
—–তুমি জানতে না খোকন যে মুসলিম?
—–জানতাম। আমি বহুবার ফিরে আসতে চেয়েছি। আপনার ভাইয়ের জন্য পারিনি।
—–খোকন যদি এক্ষেত্রে দোষী হয় তাহলে তুমিও সমান দোষে দোষী। তুমি কি মুসলিম হবে?যদি মুসলিম হও তাহলে আমি তোমার পাশে থাকবো।

যদিও আবেগের বসে সুচরিতা কথাটা বলেছিলো কিন্তু পরে মনে হলো এটা বলা ওর ঠিক হয়নি। নানারকম কোটকাছারীর ঝামেলা হতে পারে। ওর পাশে তো দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। সুচরিতা বরাবর নিজের পরিবারের ঝামেলা হিমেলের উপর কখনও চাপায়নি। যেমন সুসমিতার জন্য ছেলে দেখা বিয়ের ঘটকালী করা এগুলো নিজেই করার চেষ্টা করেছে।ও আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে নিজের সমস্যাগুলো নিজেই সলভ করার চেষ্টা করেছে। আর খোকনের এই ঝামেলা তো অনেক জটিল।
—–না আমার পক্ষে আমার ধর্মকে ছাড়া সম্ভব নয়। আর আমার পরিবার তা মেনেও নিবে না। আমার বড় বোন ও একজন মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছিলো।
—–তারপর কি হয়েছিলো?
—–বিয়ের তিনবছর পর ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে আমার বাবা মা খৃীষ্টান ছেলের কাছে বিয়ে দিয়েছে।
—–এটা জেনেও তুমি খোকনের সাথে সম্পর্কে জড়ালে কেন?তোমাদের রিলেশন কতদিন?
—–আমি ওকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওকে মানাতে পারিনি। আপনি ওর বড় বোন বলে আপনাকে আমার জানানো দরকার। তাই জানালাম। দেখেন আপনি যদি ওকে বুঝাতে পারেন?আমরা পাঁচবছর ধরে সম্পর্কে আছি।
এ কথা বলে মেয়েটি ফোনের লাইন কেটে দিলো। সুচরিতার খুব অসহায় ফিল হলো। ওর পরিবারের এই ধাক্কা ও কিভাবে সামলাবে? ওর শ্বশুরবাড়ির এতো ঝামেলা সত্বেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে খোকনের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে এই ভেবে একদিন ওর মায়ের দায়িত্ব ও পালন করবে। সেদিকে কোনো চিন্তা না করে আরো যেন ঝামেলা টেনে আনলো। খোকনের উপর ওর প্রচন্ড রাগ হলো। এ ধরনের একটা কাজ করার আগে খোকনের ওর মায়ের কথা ভাবা উচিত ছিলো। মায়ের জন্য সুচরিতার টেনশন হচ্ছে। এমনিতেই ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেসার আছে। যদি খোকন সত্যিই ঐ মেয়েকে বিয়ে করে ওর মাতো অসুস্থ হয়ে যাবে। এদিকে সুচরিতা আর সুসমিতার শ্বশুরবাড়িতে এসব নিয়ে নানা কথা উঠবে।
সুচরিতার এখন মাথা খারাপ হবার যোগাড়। কোনো উপায়ন্তর না দেখে সুসমিতাকে ফোন দিলো।
—–হ্যালো আপু কেমন আছো?
——ভালো।
—–তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? হিমেল ভাইয়ার শরীর ভালো আছে তো?
—-ও ভালো আছে।
—–তুমি?
——আমিও ভালো আছি। তোর ফোনের পাশে কেউ আছে? একটা বিশাল ঝামেলা হয়েছে।
—–না কেউ নেই। তুমি বলতে পারো।
—–খোকন তো একটা খৃীষ্টান মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে।
—–তুমি কিভাবে জানলে?
—–ঐ মেয়ে ফোন দিয়েছিলো।
—–মেয়ে কি বলেছে?
—-ও বলেছে ওর ধর্ম ও ছাড়তে পারবে না। সেক্ষেত্রে আমরা যেন খোকনকে সামলাই।
——আপু আমার মনে হচ্ছে ঘটনা অনেকদূর গড়িয়েছে। সেই জায়গা থেকে খোকন এবং ঐ মেয়ে কারোর ফিরে আসা আর সম্ভব নয়। তাই তোমাকে ফোন দিয়ে ওরা দায় সারতে চেয়েছে। হয়তো খোকনের বুদ্ধিতেই ঐ মেয়ে তোমাকে ফোন দিয়েছে। ওদের সম্পর্ক কতদিনের?
——পাঁচ বছর
——এতোদিন ধরে ওরা রিলেশনে আছে আর এখন মনে হলো তোমাকে জানানো দরকার। যতসব ফালতু কথা। আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম।
—–তাতো বলেছিলি। আমি ভাবলাম আব্বার মৃত্যুতে হয়তো ওর ভিতরে চেইঞ্জ এসেছে। তোর বিয়েতে সোনার দুল বানিয়ে দিলো। যদিও তুমি আমি টাকা দিয়েছিলাম তবুও নিজ উদ্যেগে পুরো বাড়িটা মেরামত করলো। চুনকাম ও করলো।
—–এগুলো ওর ভাঁড়ামি। নিজের অপকর্ম ঢাকতে ওসব করেছে। আমরা যেন ওর উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেই। আর কি কি যে করেছে আল্লাহপাক জানে।
—–তুই কি কাল ফিরি আছিস। আমি খুব সকালেই আম্মার ওখানে যাবো। তুই ও আমার সাথে চল। ছুটির দিন বলে খোকন বাসায় থাকবে। ওকে সামনাসামনি সব জিজ্ঞাসা করবো।

সুচরিতা হিমেলকে কিছুই জানালো না। যদিও হিমেল কল্যানপুর থেকে ফিরে সুচরিতার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—–তোমার মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
শরীর ঠিক আছে তো।
——না, আমি ঠিক আছি।
—–আমার মন বলছে তুমি ঠিক নাই। লাকি চলে যাওয়াতে তোমার উপর লোড বেশী পড়ছে। ওর উপর ভরসা না করে একজন ফুলটাইম বুয়া রেখে দাও।
—–তাতো রাখাই যায়। কিন্তু আমি তো বাসায় থাকি না। বুয়াকে কখন আসতে বলবো।
—–তা ঠিক। তবে তুমি স্কুল থেকে যখন বাসায় আসবে তখন আসতে বলো। তখন থেকে সন্ধা পর্যন্ত থাকবে। লাকির আশা করে লাভ নেই। ওকে মনে হয় এবার বিয়ে দিবে। ওর বাবা ফোন দিয়ে টাকা চেয়েছে।
—–ঠিক আছে। ও না আসলে বুয়ার খোঁজ তো করতেই হবে। আমি কাল একটু যাত্রাবাড়িতে যাবো। বেশিক্ষণ থাকবো না। সকালে তোমাদের নাস্তা বানিয়ে দিয়ে চলে যাবো। বারোটার দিকে আবার চলে আসবো। দুপুরের রান্না আমিই করবো। তুমি মতিকে সকাল সাতটায় আসতে বলো।
—-হঠাৎ যেতে চাইলে? কোনো সমস্যা?
—–অনেকদিন আম্মাকে দেখি না তাই যেতে চাচ্ছি।
—–ঠিক আছে যাও।
পরদিন খুব ভোরে উঠে সুচরিতা নাস্তা বানিয়ে দিয়ে সকাল সাতটার মধ্যে ড্রাইভার মতির সাথে গাড়ি নিয়ে বের হলো। জিগাতলা থেকে সুসমিতাকে উঠিয়ে নিলো। ছুটির দিন বলে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই যাত্রাবাড়ি পৌঁছে গেল। এতো সকালে ওদের দু,বোনকে দেখে ওর মা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
——কি ব্যাপার এতো সকালে তোমরা দুবোন একসাথে? কোনো সমস্যা?
সুসমিতা একটু ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
—–সমস্যা আমাদের না। সমস্যা তোমার। তোমার ছেলে কি সব কাহিনী করে বেড়াচ্ছে তার খোঁজ রাখো?
একথা বলে দুবোন মায়ের সাথে ড্রইংরুমে বসলো।
—–কার কথা বলছিস তোরা?
—–কার কথা আবার। তোমার দুই ছেলেই তো শয়তানের চ্যালা। বড়টার দেখাদেখি ছোটোটাও বদ হচ্ছে। ওকে কত বললাম একটা টিউশনি যোগাড় করতে। না সে কথা কানে গেল না। টিউশনি করলে নাকি পড়াশেনার ডিস্টার্ব হবে।
সুচরিতা একটু বিরক্ত হয়ে সুসমিতাকে বললো,
——শোভনের প্রসঙ্গ এখন থাক। যে প্রসঙ্গে কথা বলতে আসছি সেটা আগে বলি। আমার আবার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
সুচরিতার মা একটু রেগে গিয়ে বললেন,
—–কি বলতে আসছিস সেটা আগে বল?
সুচরিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–খোকন কোথায়?
——ওর ঘরে ঘুমাচ্ছে।
——আপনি কি জানেন, ও নাকি একটা খৃষ্টান মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে?
——আমি বিশ্বাস করি না।
—–আম্মা ঐ মেয়ে নিজেই ফোন করে আমাকে জানিয়েছে।
——খোকন কে ট্রাপে ফেলতে জানাতেই পারে?
এমন সময় খোকন ড্রইংরুমে এসে সুচরিতাকে বললো,
——তুমি কখন এলে?
—–কিছুক্ষণ হলো। তুই কি এলিন নামে কাউকে চিনিস?
—–হুম, ও আমার ফ্রেন্ড।
সুসমিতা একটু ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
——আসলেই ফ্রেন্ড নাকি বন্ধুর থেকেও আরো বেশী কিছু?
——কি বলতে চাইছো তুমি?
——আমি কি বলতে চাইছি তা তুমি ভালোই বুঝতে পারছো।
সুচরিতা সুসমিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–তুই থাম, আমি বলছি।
——তোমার সাথে কি ঐ মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক আছে?
——যদি থেকেও থাকে তাতে কি সমস্যা? ও বলেছে আমি যদি ওকে বিয়ে করি তাহলে ও মুসলিম হবে।
——কিন্তু ওতো বলেছে
সুচরিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মা খোকনকে বললো,
——ওরা যা বলছে তা কি সত্যি খোকন?
—–হ্যা সত্যি। তবে ও বলেছে ও মুসলিম হবে। আমি এখনি ওকে ফোন দিচ্ছি। ফোন লাউডস্পিকারে দিচ্ছি। তোমরা সবাই শোনো।
খোকন সাথে সাথে এলিন কে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে ফোন তুলতেই খোকন বললো,
—–এলিন কেমন আছো?
—-ভালো। তুমি কি কাল আপার সাথে কথা বলেছো?
—–হুম, আপুকে বলেছি। আমি মুসলিম হবো।
সুচরিতা এ কথা শুনে সুসমিতার দিকে তাকালো। সুসমিতাও সুচরিতার সাথে আই কন্ট্রাক করলো। ফোনটা রেখে খোকন বললো,
—–শুনলে তো তোমরা ও কি বললো,
সুচরিতা রেগে গিয়ে বললো,
—–হ্যা শুনলাম। শুনে এটুকু মনে হলো ঐ মেয়ে একটা আস্ত ফ্রড। কাল ও আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে কখনই মুসলিম হবে না। তোকে ওর জীবন থেকে সরে যেতে বলেছে।
—–আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করি না।
——তোমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে আমার কিছু যায় আসে না। তবে তুমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করলে তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আমি বুঝে পাই না যেঁচে তুমি এমন ঝামেলায় কেন জড়ালে। এখানে কি মুসলিম মেয়ের আকাল পড়েছে।
সুচরিতার কথা শুনে সুসমিতাও বললো,
—–আমি তো সম্পর্ক রাখবোই না। আমার নতুন বিয়ে হয়েছে। তোমার জন্য শ্বশুর বাড়িতে আমি কোনো কথা শুনতে পারবে না।
খোকনের এই কাহিনীতে সুচরিতার মনে হলো এই জীবনে ওকে আর কতো ধকল সইতে হবে কে জানে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে