#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-আটত্রিশ
মাহবুবা বিথী
বাড়িফিরেই সুচরিতা সবার আগে বেডরুমের চাদর পাল্টিয়ে দিলো। একটা বালতিতে পানির সাথে স্যাভলন মিশিয়ে একটা ছোটো টাওয়েল ভিজিয়ে ফার্ণিচার, জানালার গ্রিল সব পরিস্কার করে দিলো। ক,দিন আগে যেহেতু হিমেলের রিং পড়ানো হয়েছে ওর সেফটির জন্য এগুলো করতেই হবে। এ বিষয়টা সুচরিতার ভালোই জানা আছে। এরপর হিমেলকে গোসল করার জন্য ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের ড্রেস পাল্টে দিলো। সমস্ত নোংরা কাপড় গুলো মেশিনে দিয়ে লাকিকে ঘর মুছতে বললো। একচুলায় খিচুরী আর এক চুলায় মুরগীর মাংস চাপিয়ে দিলো। রান্নাটা হয়ে এলে নিজেও গোসল করে ফ্রেস হয়ে এসে যোহরের নামাজ পড়ে নিলো। এরপর টেবিলে খাবার বেড়ে হিমেল আর সুচরিতাকে ডাকলো। আর একটা প্লেটে খিচুড়ী আর মাংস নিয়ে তাকিয়া আর তারিককে খাইয়ে দিলো। ওদের খাওয়া শেষ করে নিজেও খেয়ে নিলো। অনেকদিন পর সুচরিতার হাতের রান্না খেয়ে হিমেল খুব তৃপ্তি পেলো। বেশ খুশিতে গদগদ হয়ে সুচরিতাকে বললো,
—–বাসায় এসে ঘন্টাখানিকের মধ্যে তুমি লাঞ্চ রেডী করে ফেললে। অনেকদিনপর বেশ তৃপ্তি করে লাঞ্চ করলাম। আসলে কি জানো,নিজের ঘরের মতো সুখ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
—–হুম,ম্যালা প্যাঁচাল পারা হলো। এবার ওষুধ খেয়ে একটু ঘুমাও। তোমার এখন নিয়ম মেনে চলতে হবে। আর অনিয়ম করার সুযোগ নেই। বাচ্চাদের কথা ভেবে জীবনটাকে গুছাতে হবে। আমি এখনও সেদিনের কথা ভুলতে পারছি না। আল্লাহপাকের অনেক বড় রহমত ছিলো আমাদের উপর। তাই মৃত্যুর মুখ থেকে উনি তোমাকে ফেরত পাঠিয়েছেন।
——তা অবশ্য ঠিক বলেছো।
হিমেলও সেদিনের কথা ভুলতে পারে না। সুচরিতার কতইবা বয়স। অথচ আল্লাহপাকের রহমতে বিপদে মাথা ঠান্ডা করে সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছে। ওর সাথে যখন বিয়ে হয় সুচরিতা তখন কেবল এইচএসসি পাশ করেছে। আজ আটবছরে এতো ঝক্কি ঝামেলার মধ্যেও এম,এ পাশ করলো। আর হিমেলের এতো বড় বিপদটা আল্লাহর রহমতে ও ঠিক সামলে নিলো। নাহ্ আল্লাহপাক ওকে যোগ্য জীবন সঙ্গিনী দান করেছেন।
এরপর বেশ সুখেই সুচরিতার জীবনের সময় পার হতে লাগলো। ওর বাসার কাছেই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সুচরিতা চাকরি নিলো। ওখানেই তৈয়বাকে কেজি ওয়ান এ ভর্তি করে দিয়েছে। আর তাকিয়াকে প্লেতে ভর্তি করেছে। স্কুলে ডে কেয়ার সেন্টার থাকাতে তারিককে ওখানেই রাখে। লাকিও এখন অনেকটা বড় হয়েছে। কিন্তু সুচরিতা তারিককে লাকির কাছে রাখে না। যদিও লাকি অনেক কেয়ারিং তবুও নিজের চোখের সামনে রাখার জন্য তারিককে স্কুলের ডে কেয়ার সেন্টারে দিয়েছে। তবে দুপুরের রান্নাটা লাকি করে। স্কুলে আসার আগে সুচরিতা মেইন তরকারি রান্না করে রেখে আসে। হিমেলেরও ব্যবসা তরতর করে এগিয়ে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে হিমেলের মা এসে বেড়িয়ে যায়। কখনও বা দুচারদিন থেকে যান। যে বউটা একসময় উনার দু,চোখের বিষ ছিলো তার প্রশংসায় উনি পঞ্চমুখ। সবার কাছে বড় মুখ করে সুচরিতার প্রশংসা করেন। বউ এম,এ পাশ করেছে। তার ছেলের যত্ন আত্তি করে, নাতি নাতনীদের সামলিয়ে চাকরিও করে। সুচরিতা মাঝে মাঝে অনলাইন সাহিত্যপেইজে গল্প উপন্যাস লেখালেখি করে। এর মাঝে একটা বইও বের হয়েছে। এটা নিয়েও উনি অনেক গল্প করেন। তার বউ ভালো লিখিয়ে। এ ক্ষেত্রে উনি প্রশংসা করেন বটে তবে সেই প্রশংসা যেন উনার মেয়েদের ছাপিয়ে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। সুচরিতা এ বিষয়টা ভালোই খেয়াল করেছে। ওর প্রশংসা করার আগে কায়দা করে এটাও বলে নেন, যে সুচরিতা এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেই দেখেছে তার ননস আর ননদেরা বেশ করিৎকর্মা। তাই ও ওদেরকে দেখেই নিজেকে এভাবে তৈরী করতে শিখেছে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ন ভিন্ন। আল্লাহপাক জানেন, ওকে লেখাপড়াটা চালিয়ে নিতে কতটা লড়াই করতে হয়েছে। যাক সেসব দিনের কথা সুচরিতা মনে করতে চায় না। কারণ পিছনের কথা সবসময় ভাবলে মানুষ সামনের দিকে আগাতে পারে না। রান্নার ক্ষেত্রে অবশ্য সুচরিতাকেই পুরো ক্রেডিট দেন। ওর রান্না সবার থেকে ভালো। যদিও সুচরিতা শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকে না কিন্তু শাশুড়ীর অনুরোধে ঈদ শ্বশুর বাড়িতে করে। এবং ঈদে রান্নার পুরো দায়িত্ব উনি সুচরিতার উপর ছেড়ে দেন। কারিমা আর সখিনা মশলা থেকে শুরু করে পেয়াজ কাটা মাংস ধুয়ে রাখা, এমনকি পোলাও এর চালও ধুয়ে রাখে। সুচরিতা এসে রান্নাটা বসায়। এ বিষয়টা কারিমা বা সখিনা কেউই স্বাভাবিক ভাবে নেয় না। কিন্তু সুচরিতা মনে মনে বেশ পুলকিত হয়। তবে সুচরিতার শাশুড়ী কেন ওকে এতো প্যাম্পার করছে এটা ও ভালোই বুঝতে পেরেছে। সেবার ওর বাসায় শাশুড়ী মা বেড়াতে এসে আকার ইঙ্গিতে সুচরিতাকে আবার ও বাড়িতে ফেরত যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সুচরিতা এবার বেশ স্পষ্ট ভাবে উনাকে বলেছে,
——মা,আমার পক্ষে আর কখনও ভাবির সাথে থাকা সম্ভব নয়। এতো কূটকচালী উনি জানেন সেখানে মাথা ঠান্ডা করে চলা মুশকিল। আর উনি প্রচন্ড মিথ্যা কথা বলেন। এখন আমার বাচ্চারা বড় হচ্ছে। ওরা এসব কূটকচালী শিখুক এটা আমি চাই না।
সুচরিতার কথা শুনে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি বললেন,
—–হুম,তোমাদের সবার চলে যাওয়ার জায়গা আছে। আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বড় বউ কয়েক বছর থেকে চলে গেল। তুমিও না থাকতে পেরে চলে আসলে। আর আমি পনেরো বছর ধরে ওকে হজম করে চলেছি। বুঝতে পারছো প্রতিদিন আমাকে কত কিছু সহ্য করতে হয়।
সুচরিতার শাশুড়ীর কথাগুলো শুনে সেদিন খারাপ লেগেছিলো। তবে ও যে ওর সমস্যার কথাটা শাশুড়ী বলতে পেরেছে সেটা ভেবে ভালো লেগেছে। কারণ নিজেকে ভালো রাখতে হলে নিজের ভালো মন্দ সবার আগে নিজেকেই ভেবে নিতে হবে। এই পৃথিবীতে অন্যকে ভালো রাখার কারো দায় নেই।
এরমাঝে সুচরিতার বাবার শরীরটা আরো খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তার বলে দিয়েছে উনি আর বেশিদিন সারভাইভ করবেন না। এদিকে সুসমিতার বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। ও বিয়েতে রাজি হতে চাইছে না। ওর যুক্তি হচ্ছে এমনিতেই ওকে চাকরি আর মায়ের সংসার নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তারউপর বিয়ে করে আর ঝামেলা ও বাড়াতে চাইছে না। বিয়ের পরে ওর জামাইয়ের আদর যত্নের ত্রুটি হলে শ্বশুরবাড়িতে কথা শুনতে হবে। আবার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ কম থাকায় হয়ত ঘটাপটা করে বিয়ে করা সম্ভব না। সেটা নিয়েও আরো কথা উঠবে। এমনিতেই জীবনে অনেক প্যারা নিয়ে বাঁচতে হয়। আর নতুন কোনো প্যারা ওর নিতে ইচ্ছা করছে না।
সুসমিতাকে সুচরিতা প্রায় কাউন্সেলিং করে যাতে ও বিয়ে করতে রাজি হয়। এদিকে খোকনটা জ্বালিয়ে মারছে। বি,কম পাশ করে চাকরি না করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। সে টাকাও সুচরিতাকে ম্যানেজ করে দিতে হয়েছে। যদিও সুচরিতা ওকে চাকরির জন্য প্রেসার দিয়েছিলো। কিন্তু খোকন রেগে গিয়ে সুচরিতাকে বললো,
——নিজের সন্তান হলে পারতেন পড়শোনা শেষ করার আগে চাকরিতে ঢুকার কথা বলতে, পারতেন না। আমি ভাই বলে অবলীলায় বলতে পারলেন।
সুচরিতা খোকনের কথা শুনে থ,হয়ে গেল। এখানে ওর সন্তানের কথা আসছে কেন? ওর তো নিজেই জবের জন্য চেষ্টা করা উচিত। যেখানে সুসমিতা এইচএসসি পাশ করেই জবে ঢুকেছে আবার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়েছে। সুচরিতা আরো অবাক হলো ওর মা ও খোকনের কথায় তাল দিলো।
এসব নানা টানাপোড়েনে সুচরিতার বাবার শরীর আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের চাকরি বাচ্চা সামলিয়ে বাবার বাড়িতে সুচরিতার তেমন একটা যাওয়া হয় না। তারউপর হিমেল অফিস নিয়ে বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়াতে সুচরিতা বাচ্চাদের নিয়ে একা যেতে সাহস পায় না। যাইহোক এ খবর পেয়ে হিমেল সময় বার করে সুচরিতা আর বাচ্চাদের নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা হলো। যাত্রাবাড়িতে ওর বাবার বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই ওর মা ওকে দেখে বললো,
—–এতো দেরী করে আসলি কেন? তোর বাবা এখন কাউকে চিনতে পারছে না।
সুচরিতার মনে হলো, ওর বাবা ওকে ঠিক চিনতে পারবে। সুচরিতা যখন ওর বাবার বিছানার পাশে বসলো ওকে দেখা মাত্রই ওর বাবার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এরপর ওর বাবা আস্তে করে ওর শাড়ির আঁচলের কোণাটা শক্ত করে ধরে রাখলো। যেন সুচরিতা উঠে না যায়। যতক্ষণ ও বাড়িতে ছিলো সুচরিতা ওর বাবার পাশেই বসেছিলো। সুচরিতা যাবে বলে সুসমিতা অফিস থেকে ছুটি নিলো। খোকন বাসায় ছিলো না। শোভন বাসায় থাকাতে হিমেলের সুবিধা হলো। ও শোভনকে সাথে নিয়ে বাজারে গেল। মুরগী মাছ কিনে নিয়ে আসলো। অনেকদিন পর যেন সুচরিতার বাবার বাড়িটা যেন আনন্দে মেতে উঠলো। সুচরিতার মা অনেক যত্ন করে রান্না করলো। হিমেল আবার শাশুড়ীর রান্না খুব পছন্দ করে। সুসমিতা বাচ্চাদের খাইয়ে দিলো। সবাই টেবিলে বসে লাঞ্চ করলো। কিন্তু সুচরিতা ওর বাবার কাছে বসেই খেলো। ওর মা ওর বাবাকে নল দিয়ে খাবার খাইয়ে দিলো। উনি মুখে খেতে পারেন না।
তবে সুচরিতার মুখের দিকে ওর বাবা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। যদিও চোখের দৃষ্টিটা অনেক ঘোলা ছিলো। তবুও সুচরিতার মনে হলো, ওর বাবার সেই দৃষ্টি যেন ওকে বলছিলো ও যেন ওর মা ভাইবোনের দিকে সবসময় খেয়াল রাখে। সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সুচরিতার চলে যাবার সময় হলো। কারণ ওর স্কুলের চাকরি আবার হিমেলের অফিস সবকিছুই বিবেচনায় রাখতে হয়। চলে যাবার সময় ওর বাবার হাতের মুঠো থেকে কিছুতেই আঁচলটা বের করতে পারছিলো না। একরকম জোর করেই বের করে নিয়ে চোখের পানির ধারা নিয়ে বাচ্চাদের সাথে করে ও গাড়িতে গিয়ে বসলো। ও এটুকু বুঝতে পারলো বাবাকে আজই ওর শেষ দেখা।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-ঊনচল্লিশ
মাহবুবা বিথী
সুচরিতা ঘুরে আসার দিন পনেরোর মধ্যেই ওর বাবা মারা গেল। মৃত্যুর খবর পেয়ে সুচরিতা আর হিমেল বাচ্চাদের সাথে নিয়ে যাত্রাবাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। এর মাঝে হিমেল ওর মা ভাই বোনের কাছে সুচরিতার বাবার মৃত্যুর খবর জানিয়ে দেয়। ওয়ার্কিং ডে থাকাতে যাত্রাবাড়িতে আসতে সবার সন্ধা হয়ে গেল। ঢাকায় সুচরিতার যে ফুফু আর চাচা ছিলো তারাও এসেছিলো। সুচরিতা ওর বাবার বাড়িতে পৌঁছা মাত্রই ভাইবোনেরা সবাই ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। সুচরিতার সবচেয়ে খারাপ লাগলো সুসমিতার জন্য। ও সুচরিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
——আপু আব্বা অসুস্থ হলেও বেঁচে তো ছিলো। সবাই ভাবতো আমার মাথার উপর ছায়া আছে। আজ থেকে যেন আমি এই পৃথিবীতে এতিম হয়ে গেলাম।
—–এভাবে বলিস না, আল্লাহপাক নারাজ হবেন। এই পৃথিবীতে কেউ কারো ছায়ায় বাঁচে না। সবাই আল্লাহপাকের রহমতের ছায়ায় বেঁচে থাকে। আর মানুষকে কিছুদিনের জন্য আল্লাহপাক তার বাবা মায়ের কাছে আমানত হিসাবে রাখেন। যখন সে শিশু থাকে। মাতৃজঠরে ও সে আল্লাহপাকের রহমতের ছায়ায় থাকে। তা,না হলে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। কিন্তু বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর প্রতিটি মানুষকে তার রবের কাছে আত্মসমর্পন করতে হয়। ইনশাআল্লাহ আল্লাহপাকের রহমতে আমরা ঠিক সামলে উঠবো।
তাহেরা জোহরা আর সাবেরা সুচরিতার বাবার মৃত্যুর খবরে ওর বাবার বাড়িতে চলে আসছে। তাহেরার হাসব্যান্ড আসেনি তবে মান্নান আর আতিক এসেছে।
সুচরিতার বাপের বাড়িটার চারপাশে একটু দৈন্যতার ছাপ আছে। আসলে ওর বাবা তো বাড়িটা ভালোভাবে কমপ্লিট করতে পারেনি। তার আগেই বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়লো। এদিকে সংসারের খরচ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ,ওষুধের খরচ সব সামলিয়ে বাড়িটার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। এমনকি বাড়িতে চুনকাম ও করতে পারেননি। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় নোনা ধরেছে। জোহরা আর সাবেরার হাসব্যান্ড নাক সিঁটকে চারপাশে তাকাচ্ছে। সোহেলের মাঝেও সিঁটকানো ভাব আছে। ইদানিং সুসমিতা মানুষের এসব দৃষ্টিভঙ্গি ইগনোর করা শিখে গেছে।
কিছু কিছু মানুষের অন্তর মনে হয় কয়লার থেকেও কালো থাকে। তাই শোকে কিংবা তাপে তাদের ব্যবহারের কোনো পরিবর্তন হয় না। এই শোকের বাড়িতে এসেও মান্নান তার নোংরা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো। সুসমিতাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো,
—— তোমাদের বাবার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করার জন্য পর্যাপ্ত টাকা আছে তো? না থাকলে আমার কাছে আছে।
ওর কথা শুনে সুসমিতা যারপরনাই অবাক হলো। কিছুটা অপমানিতবোধ করলো। ওখানে কয়েকজন প্রতিবেশী এবং সুচরিতাদের আত্মীয়স্বজন ছিলো।সুসমিতা ভাবছে মানুষ মৃতের বাড়িতে এসে কেমন করে এ ধরনের কথা বলতে পারে? যেখানে ওরা প্রতিবছর বারডেম থেকে ওর বাবার চিকিৎসা নিয়েছে। এটা ঠিক হিমেল ওদের কিছুটা সহযোগীতা করছে তার অর্থ এই নয় যে ওরা হিমেলের উপর ভরসা করে ওর বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। অথচ বারডেমের চিকিৎসা খরচ ও বেশ ব্যয়বহুল। সুসমিতার ইচ্ছে ছিলো মুখের উপর শক্ত দু,কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়েছে। আজ ওর বাবা মারা গিয়েছে। ওদের মতো স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ম মানুষের কথায় ও হয়তো আঘাত পেয়েছে তাই বলে জেনে বুঝে শোকের সময়ে কটুকথা বলতে ওর ইচ্ছে করলো না। তাই মাথা ঠান্ডা রেখে বললো,
—–আপনি এতোটা ভেবেছেন বলে ধন্যবাদ। তবে সে ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।
এ কথাটুকু বলো সুসমিতা ওদের সামনে থেকে চলে গেল।
সব ফর্মালিটিজগুলো মেইনটেইন করে সুচরিতার বাবাকে দাফন করার জন্য মসজিদের কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। ঐ সময় শোভন আর খোকন সুচরিতাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সুচরিতা ওদেরকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ভাবছে ওর বাবার মৃত্যুতে হয়ত খোকন পরিবর্তন হতে পারে। দেখা যাক সামনে কি দিন অপেক্ষা করছে?
এশার আযানের পর ওর বাবার দাফন সম্পন্ন হলো। এরপর আত্মীয়স্বজনরা চলে যেতে লাগলো। হিমেলও সুচরিতাকে এখানে রেখে ওর মা,ভাইবোনদের সাথে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। সুচরিতা লাকিকে তারিক আর তাকিয়াকে দেখে রাখতে বলে ওয়াশরুমে গোসল করতে চলে গেল। ওরা সবাই গোসল করে এসে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে বসলো। প্রতিবেশীরা বাসায় খাবার দিয়ে গেছে। সেই খাবার দিয়ে ওরা ডিনার করে নিলো। শুধু ওর মা কিছু খেতে পারলো না। ওর মায়ের দু,চোখে ঘুম নেমে এলো। সুচরিতার ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হলো। শেষেরদিকে ওর বাবা বিছানাতে টয়লেট করতো। সেগুলো ওর মাকেই সামলাতে হয়েছে। সারাদিন ওর মাকে বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। সকালে রাইস টিউবে খাওয়ানো থেকে সব কিছুই ওর মাকে দেখভাল করতে হয়েছে। আজ ওর মাকে ভীষণ পরিশ্রান্ত লাগছে। তারপরও ওর বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে। এখন দু,চোখ জুড়ে ঘুম আসাতে সুচরিতারা কেউ উনাকে জাগালো না। কারণ জেগে থাকলে অনবরতো কাঁদতে থাকে। তৈয়বা তাকিয়া আর তারিক আজকে খুব শান্ত হয়ে আছে। সুচরিতা ভাবছে আল্লাহপাক মানুষকে বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে দেন। সে কারনে ওরাও হয়ত এতো শান্ত হয়ে আছে। রাত গভীর হলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু সুসমিতা আর সুচরিতার চোখে ঘুম নেই। সুসমিতা বিছানায় শুয়েছিলো। সুচরিতা জেগে আছে বলে ও বিছানা থেকে উঠে বসে সুচরিতাকে বললো,
—–আপু তোমার কি ঘুম আচ্ছে?
——না,কিছু বলবি?
—-না,তেমন কিছু না। আজকে মান্নান ভাইয়ের কথা শুনে আমি যারপরনাই অবাক হয়েছি।
একথা শোনার সাথে সাথে সুচরিতার এন্টিনা সজাগ হয়ে গেল। কারণ ওরা কাউকে সম্মান করে কথা বলতে জানে না। মানুষকে অসম্মান করতে পারলেই মনে হয় ওরা খুব আনন্দ পায়। তাই ও বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে বসে সুসমিতাকে বললো,
—–কি বলেছে?
—–আমি তখন ড্রইংরুমে সবাইকে একটু শরবত দিচ্ছিলাম। প্রতিবেশী,আমাদের আত্মীয়স্বজন,তোমার শ্বশুর বাড়ির মানুষজন অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছেন। সবাইকে একটু লেবুর শরবত দিচ্ছিলাম। সমস্ত আত্মীয়স্বজনের মাঝখানে উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আব্বার দাফনের কাফনের টাকা আমাদের কাছে আছে কিনা? না থাকলে উনার কাজ থেকে নিতে বললেন। আমার খুব আত্মসম্মানে লেগেছে।
—–,তাতো লাগার ই কথা। কিছু মানুষের কখন কি কথা বলতে হবে সেই সেন্সটাই থাকে না।
সুচরিতা মনে মনে মান্নানের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলো। সুসমিতার সামনে নিজেকে খুব ছোটো লাগলো। হাজার হোক ওর শ্বশুরবাড়ির মানুষ বলে কথা। উনি নিজেও ছোটো হলেন এবং হিমেলকেও সবার সামনে ছোটো করলেন। এসব করে মানুষ যে কি লাভ পায় কে জানে? এই যে সোহেল আর কারিমা যে ওর পিছনে লেগে থাকতো এতে ওদের কি লাভ হয়েছে? বরং ও শুনতে পেরেছে ইদানিং সোহেলের দিন খুব খারাপ যাচ্ছে। চাকরিটাতো খুব বড় করে না। হিমেল টাকা পাঠায় বলে স্বাচ্ছন্দে সংসার চলে। কিন্তু উনার নিজের ছেলেমেয়ের খরচ তো উনাকে সামলাতে হবে। জেবা এখন ক্লাস ফোর এ উঠেছে। রেবা নার্সারীতে পড়ে। সংসারের টানাটানিতে গাড়িটা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। জোর করে গাড়িটা নিয়ে নিলো কিন্তু রাখতে তো পারলো না। জেবাকে ওরা এখনি সামলাতে পারে না। এতে মেয়েটার দোষ দিয়ে কি হবে। সারাক্ষণ ঘরে কূটকচাল দেখলে ওর তো কূটকচালি ভালো লাগবে। পড়াশোনা করতে তখন ভালো লাগে না। অন্যের জন্য কূপ খুঁড়লে সেই কূপে নিজেকে আগে পড়তে হয়। এ কথাটা মানুষ খুব সহজে ভুলে যায়। যাক প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে সুসমিতাকে সুচরিতা ঘুমাতে বললো।
বছরখানিক সময় পার হয়ে গেল। বাবা হারানোর শোকটা সুচরিতারা একটু একটু করে সামলে নিতে লাগলো। খোকন এবার জবে ঢুকাতে সুচরিতা একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ও ভাবলো, খোকন মনে হয় নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করছে। ও এখন সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতে লাগলো। এরমাঝে সুচরিতার সংসারে একটা ভালো খবর আসলো। তৈয়বা হলিক্রস স্কুলে চান্স পেয়েছে। রেজাল্ট হাতে পেয়ে সুচরিতার মনে হলো স্বপ্নদেখার প্রথম সিঁড়িটাতে ও পা রাখতে পেরেছে। সুচরিতারা এখন হেমায়েত পুর থেকে ঢাকার ফার্মগেটে আসার চেষ্টা করছে। সুচরিতা বিভিন্ন স্কুলে সিভি ড্রপ করতে লাগলো। জুনিয়র ল্যবরেটরী স্কুল থেকে ওকে কল করা হলো। ও ইন্টারভিউ বোর্ড ফেস করলো। আল্লাহর রহমতে ওর চাকরিটা হয়ে গেল। আল্লাহপাকের কাছে ওর শোকরিয়ার শেষ নাই। একটু একটু করে জীবনের সমস্যাগুলো যেন আল্লাহপাক সমাধান করে দিচ্ছেন। ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে ফ্লাট ভাড়া নিয়ে উনারা ঢাকায় চলে আসলো। তাকিয়াকে সুচরিতার স্কুলে নার্সারিতে আর তারিককে প্লেতে ভর্তি করে দিলো। এর মাঝে সুসমিতার জন্য একটা ম্যাজিস্টেট ছেলের প্রস্তাব আসে। ছেলেটা সুচরিতার এক কলিগের মামাতো ভাই।
চলবে