সুচরিতা পর্ব-৩৬+৩৭

0
587

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-ছত্রিশ
মাহবুবা বিথী

সুচরিতা ড্রাইভার মতির কোলে তারিককে দিয়ে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের ভিতরে গিয়ে হিমেলকে দেখে আসলো। হিমেল অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ওখানে ডিউটিতে যে ওয়ার্ড বয় ছিলো তার কাছে ওর ফোন নাম্বার দিয়ে বললো,
—–আমি কিছু সময়ের জন্য বাসায় যাচ্ছি। আমার ফোন নাম্বারটা রাখুন। জরুরী কিছু ব্যাপার হলে আমাকে ফোন দিবেন।
—–আপু আপনার আত্মীয়রা থাকবে না?
——আমার শাশুড়ী মা আছেন। বাসায় বেশীক্ষণ থাকবো না। তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
সুচরিতা ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে শাশুড়ীকে বলে বাসার পথে রওয়ানা হলো।
সুচরিতা চলে যাবার পর ওর শাশুড়ী সোহেল আর জোহরার দিকে তাকিয়ে বললো,
——দেখলি তোরা, ঐ মেয়ে কি ধাতু দিয়ে গড়া? একদিকে বাবা অসুস্থ অন্যদিকে স্বামী অসুস্থ, তিনটা ছোটো বাচ্চা কিন্তু ভেঙ্গে পড়েনি। লড়াই করার কি দুর্দান্ত সাহস! সোহেল তোর বউ কিংবা বড় বউ কেউ ঐ মেয়ের ধারে কাছে নেই। ভিতরে ভিতরে সে শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাহির থেকে বুঝার উপায় নেই।
জোহরা রেগে গিয়ে বললো,
—-তুমি আর ওর পক্ষে সাফাই গেও না। এটা তো হবারই ছিলো। ও বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে, তার শাস্তি তো ওকে পেতে হবে তাই না?
মান্নান হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো,দুপুর বারোটা বাজে। জোহরাকে বললো,
——এখানে তো আমাদের তেমন কোনো কাজ নেই। চলো ভিতরে গিয়ে ভাইয়াকে দেখে বাসায় চলে যাই। অরিনের সামনে জেএসসি পরীক্ষা। বিকালে আবার টিচার আসবে। খালি বাসায় মেয়েকে পুরুষ টিচারের কাছে একা পড়তে দেওয়া ঠিক না।
মান্নানের কথাগুলো জোহরা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর হিমেলের সাথে দেখা করতে ও আর মান্নান ওয়ার্ডের ভিতরে গেল। জোহরাকে দেখে হিমেল বললো,
—–তোরা কখন এসেছিস? সুচরিতা কোথায়?
——ভাবি একটু বাসায় গেছে।
—–ও আমাকে ফেলে চলে গেল কেন?
—-এটা কেমন প্রশ্ন তোমার? বাসায় তোমার বাচ্চারা আছে। ভাবির তো বাসায় একটু যাওয়া দরকার।ভাবিকে ডাকছো কেন?
——ও আমাকে খাইয়ে দিবে।
—–আমি খাইয়ে দেই।
——না, আমি তোর হাতে খাবো না।
এমন সময় ওয়ার্ড বয় এসে জোহরাকে বললো,
—–কখন থেকে স্যারকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু উনি আমার হাতে কিছুতেই খাবেন না। ম্যাডামকে খঁুজছেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে মান্নান জোহরাকে বললো,
—–ভাবিকে একটা ফোন দাও। যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে।
ওয়ার্ড বয় জোহরাকে বললো,
—–আমি অলরেডী ম্যাডামকে ফোন দিয়েছি। উনি তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।
জোহরা আর মান্নান হিমেলের সাথে দেখা করে ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে আসলো। মান্নান জোহরাকে বললো,
—–মাকে বলো, ওয়ার্ডের ভিতরে গিয়ে ভাইয়াকে খাইয়ে দিতে? মা,বললে হয়ত উনি খাবেন।
—–বুড়ো বয়সে বউয়ের প্রতি পীরিত দেখলে গা জ্বলে যায়। ভাব দেখে মনে হয় টিনেজার।
জোহরা বিরক্ত হয়ে ওর মাকে বললো,
—–তোমার ছেলের ঘুম ভেঙ্গেছে। তুমি গিয়ে দেখা করে এসো। এই বয়সে তোমার ছেলের ঢং দেখে আর বাঁচি না। উনি গোঁ ধরে বসে আছেন বউয়ের হাতে খাবেন। দেখো তুমি গিয়ে যদি খাওয়াতে পারো।
——তুই এখন বললি কেন ও ঘুম থেকে উঠেছে। আরো আগে বলতে পারলি না? আমার ছেলেটাকে দেখার জন্য আমার চোখ দুটো কখন থেকে অস্থির হয়ে আছে।
—–আমি তো এই মাত্র দেখলাম।
মরিয়ম জোহরার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে হন্ত দন্ত হয়ে ওয়ার্ডের ভিতরে চলে গেল। মাকে দেখে হিমেলের চোখ দুটো আদ্র হয়ে গেল। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে মরিয়ম বললো,
—–এখন কেমন আছিস বাপ? খাবার নিয়ে বসে আছিস কেন? ওষুধ খেতে হবে তো। আমি খাইয়ে দিবো?
—–হুম দাও।
হিমেল ওর মায়ের হাতে খাওয়া শেষ করে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। মরিয়ম ছেলেকে খাইয়ে ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে এসে দেখলেন রোমেল চলে এসেছে।
রোমেলকে দেখে মরিয়ম বললেন,
—–তুই কার কাছে খবর পেলি?
—–সুচরিতা ফোন দিয়েছিলো। সুচরিতা কোথায়?
——একটু আগে বাসায় চলে গেছে।
—– বাচ্চাগুলোকে বাসায় একা রেখে ছেলেটাকে কোলে করে হিমেলকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। কাজটা তো ঠিক হয়নি। যদিও এছাড়া সুচরিতার কোনো উপায়ও ছিলো না। আল্লাহর রহমতে সময়মতো হাসপাতালে আসতে পেরেছে। আমি সখিনাকে সাথে করে এনেছি। ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে হাসপাতালে এসেছি।
—–ভালো করেছিস। অনেকদিন রাজনকে দেখিনা। ফোনে কথা বলে কি মন ভরে? চোখে দেখে ছুঁয়ে তবেই না মনে শান্তি লাগে।
—–মা আমি একটা কথা ভাবছি, যে কয়দিন সুচরিতা আর হিমেল হাসপাতালে আছে বাচ্চাগুলো কল্যানপুরে তোমার কাছে থাক।
সোহেল বিরক্ত হয়ে বললো,
—–অসম্ভব ও বাড়িতে সুচরিতাকে আমি কিছুতেই এলাও করবো না। হিমেল আর ওর বউ মায়ের অবাধ্য হয়েছে সেই পাপের শাস্তি ওদের পেতে হবে। সেখানে আমি বা আমার পরিবার হিমেলকে কোনো হেল্প করতে পারবো না।
——এখন কে কতো পাপ করেছে কার পুণ্য বেশি হয়েছে সে হিসেব করার সময় এটা নয়। ভুলে যাসনে হিমেল এখান থেকে চলে গেলেও প্রতিমাসে মায়ের খরচ বাবদ একটা মোটা টাকা দিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য তোর আর আমার উপর কোনো চাপ পড়ছে না। যে দুর্মূল্যের বাজার এখন, ও টাকা না পাঠালে না খেয়ে থাকতে হতো।
রোমেলের কথাগুলো শুনার পর সোহেল আপাতত মুখ বন্ধ রাখলেও মনে মনে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করছে। কারন সোহেল ভাবছে হিমেল হয়তো সহজে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। এতে সুচরিতার তেজটা কমবে। সোহেল প্লান করছে সুচরিতা আর হিমেল কল্যানপুরে আসলে এই সুযোগ ও কাজে লাগাবে। হিমেলের অফিসে বসার ওর অনেকদিনের ইচ্ছা। কেরানীর চাকরির যে আয় তাতে তো জীবন চালানো দায়। হিমেলের অফিসে বসার দাবিটা ও সবার কাজ থেকে এই সুযোগে আদায় করে নিবে। নয়তো ঐ সুচরিতা সব নিজের আয়ত্বে নিবে। যে ব্যবসা হিমেলের সেটা শুরুটা হয়েছে ওদের বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে। হিমেলের জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েটা হিমেলের সব কিছু নিজের আয়ত্বে নিবে আর সোহেল চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখবে সে বান্দা তো ও নয়।
একটু আগে যে সোহেল সুচরিতার ও বাড়িতে থাকা নিয়ে চিৎকার করছিলো তাকে এতোটা নিরব দেখে রোমেল বললো,
——কি ভাবছিস?
রোমেলের কথায় সোহেল সম্বিত ফিরে পেয়ে বললো,
——না,তেমন কিছু না। তবে হিমেলের সুস্থ হতে মনে হয় বেশকিছুদিন সময় লাগবে। এতে ওর ব্যবসার আবার ক্ষতি না হয়ে যায়। ভাবছি আমি ওর অফিসে বসলে কেমন হয়?
——এসব ঝামেলায় এখন যাসনে। যদি প্রয়োজন পরে হিমেলই তোকে বলবে।
——তোমার কি ধারনা ঐ সুচরিতা এটা মানবে। ঠিক হিমেলের মুন্ডুটা চটকে নিজে ঐ অফিসে বসার চেষ্টা করবে।
——সুচরিতার পক্ষে তিনটে ছোটো বাচ্চা সামলে অফিসে বসা কখনই সম্ভব না। তুই শুধু শুধু প্যারা নিস না।

ওদিকে বাসায় ফিরে সুচরিতা বাচ্চা তিনটাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। এতোক্ষণ হাসপাতালে সবার সামনে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলেও বাসায় এসে অঝোরে কাঁদলো। তাকিয়া আর তারিক মায়ের কান্না দেখে কাঁদতে শুরু করলেও তৈয়বা মায়ের কাছে বসে বললো,
——মা,তুমি কাঁদছো কেন? আব্বু অসুস্থ বলে তুমি কাঁদছো। কেঁদোনা। আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো। তখন আব্বুকে আমি ঠিক সুস্থ করে তুলবো।
মেয়ের কথায় চোখের জল মুছে সুচরিতা ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
——আমিও আল্লাহপাকের কাছে এই দোয়া করি। আমিন।
লাকি এর মাঝে খিচুড়ী রান্না করে সুচরিতাকে বললো,
—–খালাম্মা আমি খিচুড়ী রান্না করে ফেলেছি। আপু ভাইয়াকে খাইয়ে দেন।
সুচরিতা অবাক হয়ে বললো,
—–তুই কখন খিচুড়ী রান্না করা শিখলি?
——আপনি যখন রান্না করতেন আমি তাকিয়ে দেখতাম। এখন অনেকটা শিখে নিয়েছি। আজ তো আপনার মন খারাপ। আঙ্কেল অসুস্থ। তাই ভাবলাম আমি রান্না করে ফেলি।
—–তবে আমি বাসায় না থাকলে চুলা জ্বালাবি না। এতে আগুন ধরার সম্ভাবনা থাকে।
মাথা নেড়ে লাকি সুচরিতার কথায় সায় দিলো। বাচ্চাদের খাইয়ে দিয়ে লাকিকে খাবার বেড়ে দিলো। নিজেও কিছুটা মুখে দিয়ে তাকিয়া আর তারিককে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। শাশুড়ী মা হিমেলকে খাইয়ে দেওয়াতে সুচরিতা হাতে একটু সময় পেলো। ও ওয়ার্ড বয় এর মোবাইলে হিমেলের সাথে কথা বলেছে। ওকে খেয়ে নিতে বলেছে। এদিকে ওকে যে বাচ্চাদের ও দেখভাল করতে হচ্ছে।
যোহরের নামাজ পড়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য
সুচরিতা প্রস্ততি নিতে থাকলো। ডোরবেলটা হঠাৎ বেজে উঠলো। সুচরিতা ভাবলো,এখন আবার কে আসলো। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো সাবেরা দাঁড়িয়ে আছে।
——আপু আপনি এসময় কি মনে করে?
——তুমি কি হাসপাতালে যাবে?
——হুম,
——বাচ্চারা কার কাছে থাকবে?
——গতকাল যেভাবে ছিলো আজ সেভাবেই থাকবে।
—–এটা তো বুদ্ধিমানের মতো কথা হলো না। তুমি একটা ছোটো মেয়ের কাছে মেয়ে দুটোকে রেখে যাচ্ছো কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ওদিকে আবার তারিককে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছো সেটাও ঠিক নয়। হাসপাতালে এতো রোগের ছড়াছড়ি। ওকে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাই ভাবছি লাকিসহ ওদের সবাইকে মায়ের ওখানে নিয়ে যাই। অন্তত তুমি আর হিমেল যে কয়দিন হাসপাতালে থাকবে।
—–আপু আম্মা বরং এখানে এসে ওদের সাথে থাকুক।
——মা আসবে না। মায়ের আসা নিয়ে টানাহেঁচড়া না করে ওদের বরং মায়ের ওখানে রাখা তোমার বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে।
সুচরিতা চিন্তা করে দেখলো আসলেই লাকির উপর ভরসা করে ওদের রেখে যাওয়া বুদ্ধিমানের মতো কাজ হচ্ছে না। নিরাপত্তার কথা ভেবে সুচরিতা দরজায় তালা দিয়ে যায়। এটাও বিপদজনক।যদি কোনো বিপদ হয় তাহলে দরজা খুলে ওরা বের হতে পারবে না। তাই সবদিক বিবেচনা করে ও বললো,
—–মেজ ভাই আর ভাবি যদি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করে তাহলে আমি এক মুহুর্ত ও বাড়িতে থাকবো না। বিয়ের পর থেকে সেই যে শুরু হয়েছে এখন আমি এগুলো নিতে পারি না। আমি এখন আর আগের মানুষ নই যে সবকিছু সঁয়ে নিবো।
——আচ্ছা সেটা না হয় পরে ভাবা যাবে। এখন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলো। হিমেলকে মনে হয় কেবিনে দিয়ে দিবে।
চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব সাঁইত্রিশ
মাহবুবা বিথী

অগত্যা অনিচ্ছা সত্বেও সুচরিতাকে এই প্রস্তাবে রাজি হতে হলো। এই মুহুর্তে ওর সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। ওদিকে ওর বাবাকে নিয়ে ভাইবোনরা হাসপাতালে চরম সংকটে দিন পার করছে। অবশেষে সুচরিতা বাচ্চাদের ও লাকিকে নিয়ে সাবেরার সাথে কল্যানপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। সুচরিতা সবাইকে কল্যানপুরে নামিয়ে দিয়ে হাসপাতালে হিমেলের কাছে চলে গেল। ও সাতদিন একটানা হাসপাতালে থাকলো। মাঝে ঘন্টা দুয়েকের জন্য বাসায় এসে বাচ্চাদের দেখে যেতো। এ সময় ওর পাশে ওর বড় ভাসুর ছায়ার মতো ছিলো। হিমেলের এনজিওগ্রাম করানো হলো। দুটো ব্লক পাওয়া গেছে। ডাক্তার সাথে সাথে রিং পরিয়ে দিলো। এরপর হিমেল আর সুচরিতা কল্যানপুরে চলে আসলো। এর মাঝে ওর বাবাও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। বিপদগুলো খুব সুন্দরভাবে পার হওয়াতে বাসায় এসে সুচরিতা দু,রাকয়াত নফল নামাজ আদায় করে নিলো। এদিকে হিমেল আর সুচরিতা ফিরে আসাতে ওর শ্বশুর বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। হিমেলকে দেখতে তুশি আর তাপসী ও চলে আসলো। এই তিন বছরে দু,তিনবার তুশি আর তাপসী ওর বাবার সাথে হিমেল আর সুচরিতার বাসায় গিয়েছে। ও এখন এইচএসসি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ছাত্রী হিসাবে তাপসী বেশ তুখোর। তাই ওর মামা খালারা সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ও এক ঠ্যাং আকাশে আর এক ঠ্যাং পাতালে দিয়ে হাঁটে। তুশি এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। ও পড়াশোনায় বেশ ভালো। পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলামে ভালো দখল আছে। যেমন নাচ, গান, ডিবেট সবটাতেই ভালো পারফরমেন্স। জোহরার মেয়েটাও লেখাপড়ায় ভালো। পাশাপাশি ভালো গান করে। তাহেরার মেয়েটা এবার ও,লেভেল দিবে। রাজন এবার ক্লাস টেন এ উঠেছে। লেখাপড়ায় ওর ফুফাতো বোনদের মতো অতো তুখোর নয়। তবে ও ভালো করছে। এদিকে জেবা ক্লাস টুতে উঠেছে। ও ছাত্রী হিসাবে মোটামুটি। শাশুড়ী মা বেশ গাল করে মেয়ের ঘরের নাতনীদের প্রশংসা করেন। উনার মেয়েরা শিক্ষিত হওয়াতে নাতনীরাও লেখাপড়ায় ভালো। অপরদিকে ছেলের বউরা উনার মেয়েদের মতো বিদ্যাধারী নন। তাই তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার অবস্থা তথৈবচ। যদিও সুচরিতার ছেলেমেয়েরা এখনও লেখাপড়া শুরুই করেনি। তারপর ওর শ্বশুরবাড়ীর সবার ধারনা ও মনে হয় ওর জায়েদের মতোই হবে।
এদিকে সুচরিতার শাশুড়ী মা খুব খুশী। বাড়ির ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে। সাথে নাতি নাতনীরাও এসেছে। বিশেষ করে হিমেলের ছেলেটাকে উনার ভীষণ মায়া লাগে। তারিক দেখতে অনেকটা ওর দাদার মতো হয়েছে। শাশুড়ী মা খুশীতে ডগমগ হয়ে নিজের একমাত্র বোন আর ভাইকে এ বাড়িতে আসতে বললো।
সেদিন বেশ সকালেই হিমেল আর ওর ছেলেকে দেখতে উনারা চলে আসলেন। সুচরিতা খেয়াল করলো এ বাড়িতে যখন ও থাকতো তখন ওর মামাতো শ্বশুর আর খালা শাশুড়ী যে রকম আচরণ করতো এখন ওদের আচরণ অনেকটা বদলে গেছে। যদিও মামাতো শ্বশুরের হিমেলকে জামাই বানানোর খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু হিমেল রাজি ছিলো না বলে পরে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। কিন্তু এখন উনার ভাবটা এমন, উনার মেয়েকে বিয়ে করলে হিমেল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতো না। আর সুচরিতা এসে উনার বোনের সাজানো সংসারে ভাঙ্গন ধরিয়েছে। এজন্য এখন সুচরিতার সাথে উনারাও নেগেটিভ আচরণ করা শুরু করেছে। যেমন খালা শাশুড়ী বলে বসলেন,
—–এতো দৌড় ঝাপ করে যে লেখাপড়া করলে চাকরির কেনো ব্যবস্থা করতে পারলে? সবাই তো আর আমার মেয়ে আর আমার বোনের মেয়েদের মতো নয়। যে সংসার সামলে চাকরি করবে। আমাদের মেয়েরা শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছে সংসার ভাঙ্গতে নয়, সংসার গড়তে গিয়েছে। আমি আর আমার বোন ছোটোবেলা থেকে সে রকম শিক্ষা দিয়ে ওদের বড় করেছি।
সুচরিতা আসলে কথাগুলো শুনে গেল। ও এটা ভালোই বুঝলো খালা শাশুড়ী এই কথাগুলো ওকে ছুঁড়ে মেরেছেন। কিন্তু যুদ্ধে জিততে হলে কখনও দু,পা পেছাতে হয়। তাই সব কথার উত্তরও সবসময় দিতে হয় না। মাঝে মাঝে কিছু কথার উত্তর ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখতে হয়। যা পরবর্তীতে কর্মের মাধ্যমে মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হয়।
মামাশ্বশুর আর এক ধাপ এগিয়ে কথার খোঁচাটা অপমানের পর্যায় নিয়ে বললেন,
——তোমার মায়ের সংসার চলছে কিভাবে?দেখো হিমেলকে ওর মা অনেক কষ্ট করে বড় করে তুলেছে ওর মায়ের কিছু স্বপ্ন পূরণের জন্য সে কথাটা মনে রেখো।
——-মামা, আমার মায়ের সংসার কিভাবে চলে সেটা জানাতো আপনার দরকার নেই। অন্তত আপনার ছেলের টাকায় চলে না সেটা জেনে রাখুন। আর হিমেলকে তো আমার শাশুড়ী মায়ের একমাত্র সন্তান নয় যে উনার স্বপ্ন পূরণের দায় শুধু হিমেলের একার। উনার তো আরো সন্তান আছে। মামা, আমার এখন উঠতে হবে। হিমেলের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।

সুচরিতা চলে যাবার পর ওর মামা শ্বশুর মরিয়ম বিবিকে বললেন,
——তোমার বউয়ের মুখে তো বেশ কথা ফুটেছে। তোমার মনে আছে,বিয়ের সময় বলেছিলে হিমেলের জন্য এমন মেয়ে তুমি দেখেশুনে নিয়ে এসেছো যে নাকি ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। আজ বিয়ের এই কয় বছরে দেখছি, ভাজা মাছতো ভালোই উল্টাতে জানে পাশাপাশি কাঁটাও ছাড়াতে জানে।
রোমেল সেসময় ড্রইং রুমে এসে ওর মামাকে বললো,
—–মামা লেবু বেশি কছলাতে হয় না। বেশি কছলালে লেবুর রস তেতো হয়ে যায়। সোহেলের হীনম্মন্যতার কারনে সুচরিতার মুখে এতো বুলি ফুটেছে। সোহেল আর কারিমা ওদের হীনম্মন্যতা থেকে সবসময় সুচরিতার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো। আর সুচরিতাও নিজের পিঠ বাঁচাতে কথা শিখে নিয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সবাই তো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তাইনা?
তবে রোমেলের সুচরিতার দিকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে হিমেলের মামা খালা একটু অবাক হলো। উনারা আর কথা বাড়ালেন না। সুচরিতা যে আগের সুচরিতা নেই সেটা উনারা ভালোই বুঝতে পারলেন।
সেদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সুচরিতার খালা শাশুড়ি চলে গেলেন। ওর মামা শ্বশুর উনাকে বাড্ডায় উনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসলেন। ওর মামা শ্বশুর ক,দিনের জন্য এ বাড়িতে রয়ে গেলেন।

এদিকে হিমেল সুস্থ হওয়াতে রোমেল আর সখিনা যশোরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। যাওয়ার আগের দিন তিন বোন ও বাড়িতে চলে আসলো। হঠাৎ ওদের চলে আসাতে সুচরিতার সন্দেহ হলো। ও এ বাড়ির মানুষগুলোকে ভালই চিনে। এখানে আসার পর থেকে ও খেয়াল করেছে কারিমা ওকে এড়িয়ে চলছে। দশদিন হলো ও এ বাড়িতে এসেছে কিন্ত সুচরিতার বাচ্চাদের সাথে ও তেমন কথা বলেনি। এমনকি তারিককেও কোলে নেয়নি। অবশ্য সুচরিতাও হিমেলকে নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলো যে কারিমার ছোটো মেয়েটা রেবাকেও কোলে নেওয়ার সময় হয়নি। তবে সুচরিতা হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ওর বাচ্চাদের সখিনা খাইয়ে দিয়েছে। পটি বা গোসল করার জন্য তো লাকি আছে। খাওয়া বাদে বাকি সময়টা ওরা লাকির কাছে থাকতো। অথচ আজ দুপুরে খাওয়ার পর যখন ও আর হিমেল বিশ্রাম নিচ্ছিলো তখন কারিমা এসে দরজায় নক করলো। সুচরিতা দরজা খুলে দেওয়াতে খুব মধুর সুরে হিমেলকে বললো,
—– ছোটো ভাই একটু পরেই বড় ভাই আপনাকে ড্রইংরুমে যেতে বলেছে। আপুরা সবাই ড্রইংরুমে আছে।
সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
——,তারিক কি ঘুমিয়েছে? এই কয়দিন ছেলেটাকে কোলে নেওয়ার আমার একটুও সময় হয়নি।
——না,ঠিক আছে সমস্যা নাই।
——রেবাকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম। এখন ঘুম না পাড়ালে পরে আর ঘুমুতে চায় না। পরে তোমার সাথে গল্প করবো।
কারিমা চলে যাওয়ার পর সুচরিতা ভাবছে “something wrong”। বোবার মুখে কথা ফুটলো। নিশ্চয় কেনো ঘাপলা আছে। সুচরিতা হিমেলের কাছে এসে বিছানায় বসে বললো,
—–আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, মেজ ভাই কোনো ফন্দি এঁটেছে। তোমার অফিসে আবার বসতে চাইবে নাতো?
—–এটা তোমার কেন মনে হলো?
——এছাড়া এই মুহুর্তে তোমার কাছে মেজভাইয়ের কোনো স্বার্থ নাই। স্বার্থ ছাড়া মেজ ভাই আর মেজ ভাবির মুখে মিষ্টি কথা আসে না। আর যাই করো উনাকে অফিসে বসিও না। সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুবে।
——-অফিসে আমি কাউকে এলাও করবো না। অনেক কষ্টে আমি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি।

আসরের নামাজ পড়ে ড্রইংরুমে গিয়ে হিমেল বসলো। ওখানে হিমেলের মা,মামা থেকে শুরু করে ওরা ছয় ভাইবোন আছে। রোমেল হিমেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া অল্পের উপর দিয়ে তোর বিপদ কেটে গেছে। বেশ কিছুদিন তোর বিশ্রামের প্রয়োজন। তোর এই বিপদে আমরা ভাই হয়ে যদি তোর পাশে না দাঁড়াই তাহলে আল্লাহপাকের কাছে আমরা গুনাহ্গার হবো। তাই বলছিলাম তুই কিছুদিন রেস্টে থাক সোহেল তোর অফিসটা চালিয়ে নিক।
——না,এটা হয় না। মেজভাই হুট করে গিয়ে ওখানে কোনো তাল পাবে না। আর ডাক্তার বলেছে আমি হালকা পাতলা অফিস করতে পারবো। আপনারা এতো টেনশন নিয়েন না। এছাড়া ওর তো অফিস আছে।
সোহেল একটু জোর দিয়ে বললো,
—–আমি অফিসকে ম্যানেজ করেই তোর অফিসে বসতে পারবো। আমার কোনো সমস্যা হবে না।
——না,তার দরকার হবে না। প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে বলবে।
এ কথা বলে হিমেল উঠতে চাইলে তাহেরা বললো,
——মেজ ভাই তো তোমার ভালোর জন্যই এই প্রস্তাব দিলো। দেখো প্রস্তাবটা তুমি বিবেচনা করে দেখতে পারো?
——দেখ আপু আমি নাক দিয়া ভাত খাই না। তোদের মতো আমিও মুখ দিয়ে খাই। যা বলেছি ভেবে চিন্তে বলেছি।
হিমেলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে জোহরা কিছু বলার সাহস পেলো না। তবে সাবেরা হিমেলের দিকে ঝোল টেনে বললো,
——ও যখন চাইছে না তখন ওকে জোর করা ঠিক হবে না। ওর ব্যবসা ও ভালো বুঝবে।
হিমেল আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে আসলো। হিমেল চলে যাওয়ার পর সোহেল রাগে গজগজ করতে লাগলো। কিন্তু রোমেল ওর অবস্থা দেখে বললো,
——এ কথা মনে রাখিস,এই মুহুর্তে ওকে কোনো বিষয়ে মানসিক চাপ দেওয়া যাবে না। এতে শরীরের উপর ইফেক্ট পড়বে।
সোহেল মনে মনে সুচরিতা আর হিমেলের উপর প্রচন্ড ক্ষেপে গেল। পরদিন রোমেল সকালে সখিনা রাজনদের নিয়ে যশোরে রওয়ানা হলো। এদিকে হিমেলের ওষুধ শেষ হয়ে যাওয়াতে সুচরিতা এ বাড়ির ড্রাইভার সোবহান মিয়াকে ডেকে ওষুধ আনতে দিলো। তখন সোবহান মিয়ার ডিউটি ছিলো না। জেবাকে কেবল ইস্কুলে নামিয়ে দিয়ে এসেছে। সোহেলের অফিসে রওয়ানা দিতে এখনও আধঘন্টা দেরী আছে। এই ফাঁকে সোবহান মিয়া ওষুধ এনে সুচরিতার হাতে দেওয়ার সাথে সাথে সোহেল ড্রইংরুমে এসে ড্রাইভারকে বললো,
——তুমি কার পারমিশন নিয়ে ওষুধ আনতে গেলে?
—–ছোটোভাই আনতে বলেছিলো?
——তুমি কি ওর ড্রাইভার না আমার ড্রাইভার?যার তার কথা শুনে চললে আমার চাকরি তোমার করতে হবে না। কথাটা মনে রেখো।
সুচরিতা ভালোই বুঝতে পারলো। অফিসে বসতে না পারার রাগ উনি সুচরিতার উপর ঢালতে চাইছেন।তবে ড্রাইভারের সামনে সোহেল এরকম খারাপ ব্যবহার করাতে সুচরিতা হিমেলকে বললো,
—–আমি আর এক মূহুর্ত এ বাড়িতে থাকবো না। এ ছাড়া ও বাসাটা অনেকদিন খালি পরে আছে। তুমি মতিকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলো।
হিমেলও সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে চলে আসতে বলে ওর মায়ের কাছে গিয়ে বললো,
——মা,আমি আজ বাড়ি চলে যাচ্ছি।
——যেটা তোর ভালো মনে হয়। তবে আর দুটোদিন থেকে গেলেই পারতিস?
—–সম্ভব না।
ওদের যাওয়ার কথা শুনে সোহেল এসে বললো,
—–এখন তো স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেছে। উনি তো এখন চলে যাবেন।
হিমেলর মা রেগে সোহেলকে ধমক দিয়ে বললো,
—–তুই এখানে আর একটা কথা বলবি না। ওরা আসতে চায়নি। আমি ওদের জোর করে এনেছি।
মায়ের ধমক খেয়ে সোহেল নিজেকে সামলে নিলো।মরিয়ম বিবি হিমেলকে আর জোর করলেন না। সুচরিতা আর হিমেল বাচ্চাদের গুছিয়ে নিয়ে লাকিকে সাথে করে ওদের বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। সুচরিতা গাড়িতে বসে হিমেলকে বললো,
—–আমাদের আর কোনো সমস্যা হলে আমি আর কখনও এ বাড়ির সাহায্য নিবো না। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটানোর চেষ্টা করবো।
হিমেল সুচরিতার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো। সুচরিতাও ভাবলো অন্তত জীবনে যতদিন ও বেঁচে থাকবে নিজেকে আর কারো কাছে অসম্মানিতো হতে দেবে না।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে