সুচরিতা পর্ব-৩৪+৩৫

0
631

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-চৌত্রিশ
মাহবুবা বিথী

সুচরিতা সখিনার সাথে বেশীক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। দ্রুত ফোনটা রেখে দিলো। এমনিতেই ওর জীবনটা হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। তারউপর এসব গীবতে অংশ নিয়ে গুনাহ্ র বোঝা ভারী করতে ইচ্ছে হলো না। আসলে ওর কূটকচালী করতে ভালো লাগে না। নিজে একদিকে যেমন করতেও পারে না তেমনি অন্যেরটা শুনতে ইচ্ছে হয় না। এতো সুন্দর পৃথিবীতে এসব নোংরা পলিটিক্সের কারনে অনেক সময় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। এর জলন্ত উদাহরণ সুচরিতা নিজে। তাই এসব থেকে দূরে থাকতে ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।
মাথা থেকে সখিনার কথা ঝেড়ে ফেলে নিজের সংসারে সুচরিতা মনোনিবেশ করলো। হিমেলের পকেটে এতো টাকা পেয়ে ও অবাক হলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো হিমেল নিশ্চয় ওর মন ভালো করার জন্য আজকে ইচ্ছে করেই হয়তো টাকাগুলো পকেটে রেখেছে। সুচরিতা নিজের গোপন ব্যাগটা খুলে সবগুলো টাকা হাতে গুনতে লাগলো। এমন সময় তৈয়বা খাওয়া শেষ করে এসে বললো,
—–আম্মু এগুলো কি তোমার টাকা?
—–হুম
——তাহলে তো এগুলো আমারও টাকা।
——তাই?
—–আমি তোমার মেয়ে না?
——হুম,
—–তাই এই টাকাগুলো আমাদের টাকা। তবে আমি বড় হয়ে চাকরি করে তোমাকে অ_নে_ক টাকা দিবো।
——ইনশাআল্লাহ মামনি। আল্লাহপাক যেন তোমার আশা পূরণ করেন। আমিন। তুমি আবার এই টাকাগুলোর কথা বাবাকে বলো না।
—–ঠিক আছে।
জোহরের আযান শোনা যায়। সুচরিতা একচুলায় ভাত আর এক চুলায় ডাল বসিয়ে দিলো। ফ্রীজ থেকে ইলিশমাছ বের করে ভিজিয়ে রাখলো। আজ দুপুরে ইলিশমাছ ভাজি,বেগুন ভাজি, আর ডাল রান্না করবে। চুলায় হালকা গরম পানি করে নিয়ে তাকিয়াকে গোসল করিয়ে দিয়ে সকালে রান্না করা খিচুড়ী ওভেনে গরম করে ওকে খাইয়ে দিলো। এরমাঝে আবার তারিকের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তারিকের ডায়াপার চেঞ্জ করে লাকির কোলে দিয়ে কিচেনে চলে গেল। ভাত হয়ে যাওয়াতে নামিয়ে ফেললো। ডালও সিদ্ধ হয়ে গেছে। ডালে ফোড়ন দিয়ে রুমে এসে তাকিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। এরপর তৈয়বাকে গোসল করিয়ে ইলিশ মাছ আর বেগুন ভেজে খাইয়ে দিয়ে ওকে বিছানায় ঘুমাতে বললো। তারিককে কোলে নিয়ে একটু অলিভওয়েল মাখিয়ে দিয়ে ওকেও গোসল করিয়ে ডাল আর ভাত নিয়ে খাওয়াতে বসলো। লাকিকে এই ফাঁকে ঘর মুছে ফেলতে বললো। মোবাইলটা আবারও বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে সুসমিতা ফোন দিয়েছে। বুকটা কেন যেন ধ্বক করে উঠলো। এসময় সচরাচর সুসমিতা ফোন দেয় না। অফিসে থাকে। অফিসে থাকা অবস্থায় ও কথা বলতে চায় না। এতে নাকি ওর কাজের ব্যাঘাত ঘটে। ফোনটা তুলে কানে দিতেই ওপাশ থেকে সুসমিতা বললো,
——আপু তুমি কি ব্যস্ত?
—–না,এসময় ফোন দিলি কেন?
—–আব্বা আবারও স্ট্রোক করেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আম্মা আর শোভনও সাথে আছে। বাচ্চাদের ফেলে হাসপাতালে আসতে হবে না। শুধু তোকে জানিয়ে রাখলাম। তুই আবার টেনশন করিস না। আমি রাখছি।
ফোনটা রেখে সুচরিতার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। তারিককে তাড়াতাড়ি খাইয়ে ব্রেস্টফিডিং করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে হিমেলকে ফোন করে ওর বাবার অসুস্থতার খবর জানিয়ে দিলো।
ফোনটা রেখে সুচরিতার মনটা বিষাদে ঢেকে গেল। নিজের সংসারের নানা টানাপোড়েন তো লেগেই আছে সেই সাথে মায়ের সংসারের দুর্ভাবনায় ও খুব অস্থিরতা অনুভব করলো। যাদের বড় ভাই নাই বাবাই সেই পরিবারের কর্তা। অথচ সেই মানুষটা যখন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন সেই পরিবারের মানুষগুলো যেন মাঝি ছাড়া এক নৌকার যাত্রী। সেই নৌকাটি জীবন সমুদ্দুরে টালমাটাল অবস্থায় ভেসে চলছে। কবে তীরে ভীড়তে পারবে সেই পরিবারের মানুষগুলো জানে না। আদৌ ভীড়তে পারবে নাকি মাঝ দরিয়ায় ওরা ডুবে যাবে সেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে থাকে। ঐ পরিবারের বড় সন্তান হিসাবে সেই ঢেউয়ের আঘাতে সুচরিতাও ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে।
সুচরিতা তারিককে ঘুম পাড়িয়ে গোসল করে এসে যোহরের নামাজ আদায় করলো। তারপর কোরআন শরীফ নিয়ে পড়তে বসলো। সুচরিতা যখনি কোনো ক্রাইসিস মোমেন্ট পার করে তখনি বসে বসে কোরআন তেলাওয়াত করে। মনের বিষাদের মেঘটা তখন কেটে গিয়ে সেখানে একটু একটু করে আশার সুর্যটা উদিত হতে থাকে। মনে হয় ভয় কি ওর! মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক ওর সাথে আছেন। সুচরিতা ভাবে মানুষ কত স্বার্থপর। ও নিজেই বিপদে যখন পড়ে তখনি কোরআন পড়ে আর নিবিড় করে আল্লাহপাককে ডাকে। অথচ এটা সবসময় পড়ার কথা। ও ওর বাবার সুস্থতার জন্য যেমন আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করে তেমনি নিজের হেদায়াত ও চেয়ে নেয়।
হাসপাতালে সুসমিতার কাছে সুচরিতা বারবার ফোন দিচ্ছে। কিন্তু ও কিছুতেই রেসপন্স করছিলো না। ওর টেনশন বেড়ে যায়। পরে একসময় হিমেলকে ফোন দিয়ে জেনে নেয় ওর বাবা কেমন আছে। হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছে কিনা?কারণ সুচরিতার ফোন পেয়ে হিমেল সাথে সাথে তখনি হাসপাতালে চলে যায়। অনেক চেষ্টা তদবির করে বারডেমে একটা সেমি কেবিন ম্যানেজ করে।

হিমেলের সেদিন অফিস থেকে ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। সুচরিতার হাসপাতালে ওর বাবাকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু হিমেল রাত করে আসাতে ও আর যেতে পারেনি। পরদিন শুক্রবার ছুটির দিন থাকাতে হিমেল বললো,
—–আজ তো অনেক রাত হয়ে গেছে। আর আমি তো হাসপাতাল থেকেই আসলাম। বাবার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। তুমি আর এতো টেনশন নিও না। কাল ছুটির দিন। আমি বাচ্চাদের সামলে রাখবো। তুমি বরং কাল সকাল সকাল হাসপাতালে চলে যেও।

সুচরিতাও তাই ভাবলো। পরদিন খুব ভোরে উঠে সংসারের কাজকর্ম গুছিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা দিলো। যাওয়ার সময় জমানো টাকাগুলো নিতে ভুললো না। এই সময় ওর বাবার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার। হাসপাতালে পৌছে বাবাকে দেখে ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। স্ট্রোকটা সিভিয়ার হওয়াতে পুরো খাদ্যনালীটা অবশ হয়ে গেছে। খাবার গিলতে পারে না। তাই নাকে নল ঢুকিয়ে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ও ওর বাবার কাছে বসে সুসমিতা আর ওর মাকে কেন্টিন থেকে খেয়ে আসতে বললো। বাবা ওর মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। স্ট্রোকের কারনে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। হঠাৎ জোহরা আর সাবেরা হাসপাতালে ওর বাবাকে দেখতে চলে আসছে। যদিও সুচরিতা এই মুহুর্তে ওদের আশা করেনি। সুচরিতা একটু অবাক হয়ে সাবেরাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–আব্বার অসুস্থতার খবর কোথায় পেলেন?
—–+ছুটির দিন থাকায় আমি আর জোহরা তারিককে দেখার জন্য তোমার বাসায় গিয়ে হিমেলের কাছে শুনি খালু অসুস্থ। তুমি হাসপাতালে। তাই আমরাও খালুকে দেখতে চলে আসলাম।
লাঞ্চ শেষ করে ততক্ষণে সুসমিতা আর ওর মা চলে এসেছে। সুচরিতার মাকে সালাম দিয়ে
জোহরা বললো,
——খালুর নাকে হাতীর শুরের মতো ঐ নল ডাক্তার কেন লাগিয়েছে?
সুচরিতা জোহরার ভাষা শুনে অবাক না হয়ে পারলো না। এমনকি সুসমিতা আর ওর মা ও জোহরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সুচরিতার মেজাজটাও প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। যেহেতু বাবা অসুস্থ তাই রাগ চেপে বললো,
—–আব্বার খাদ্য নালী অবশ হয়ে গেছে। তাই ডাক্তার নাক দিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে।
সাবেরা আবার সুসমিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–খালাম্মা ওর তো বিয়ের বয়স পার হতে চললো। বিয়ে দিবেন না।
—–এখন কি তোমার এ কথা বলার সময়? দেখতেই তো পারছো তোমার খালু অসুস্থ।
——তাতো বুঝলাম। পাশাপাশি ওর বিয়েটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে। যদিও হিমেলের মতো ছেলে আপনি পাবেন না তবে আপনার পরিবারের যে অবস্থা এতো বাছাবাছি করা ঠিক হবে না।
ওদের নির্বোদের মতো কথা বলতে দেখে সুচরিতা বললো,
—–সুসমিতার ভরণপোষনের ভার যেহেতু আপনার বা আমার উপর দেওয়া হয়নি সেটা নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে। ও যেহেতু নিজের খরচ নিজে চালায় সেই ভাবনা ঐ ভাবুক।
ওরা রোগী দেখে চলে যাবার পর সুচরিতা ওর মায়ের হাতে টাকাগুলো তুলে দিয়ে সন্ধার আগেই বাসার পথে রওয়ানা দিলো।
সারাটা পথ ওর খুব মন খারাপ ছিলো। একদিকে বাবার অসুস্থতা অন্যদিকে ননদদের উল্টাপাল্টা কথায় মনটা বড় বিষন্ন হয়ে আছে। ও ভাবছে বাসায় গিয়ে হিমেলকে ওদের বিষয়ে আজকে খুব শক্তকরে কিছু কথা বলবে।
বাসায় ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। কিন্তু হিমেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ও আঁতকে উঠে। ওর চোখ খুব লাল হয়ে আছে ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–তোমার কি শরীর খুব খারাপ লাগছে?
——হুম,প্রেসারটা একটু মেপে দেখবে।
প্রেসার মেপে সুচরিতার ঘাবড়ে গেল। ওর সিস্টোলিক ১৮০আর ডায়াস্টোলিক ১০০। তাড়াতাড়ি হিমেলকে ডিনার করে প্রেসারের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ঘুমাতে বললো। বাচ্চাদের ও খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করে নিজে জেগেই থাকলো। সেদিন রাত দুটোর সময় হঠাৎ হিমেলের বুকে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হলো। হিমেলের হাই প্রেসার ছিলো কিন্তু এর আগে কখনও বুকে ব্যথা অনুভব হয়নি। সুচরিতার কেন যেন মনে হলো ওর হার্টের পেইন শুরু হয়েছে। ফোন দিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে আনলো। তাকিয়া আর তৈয়বাকে লাকির কাছে রেখে দরজায় তালা দিয়ে আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে তারিককে বুকে নিয়ে হিমেলকে সাথে করে সোহরাওয়ার্দি হৃদরোগ হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো। যাওয়ার সময় ওর ছোটো দুইটা মেয়ে আর তারিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আর ও ভাবতে লাগলো ওর কপালে কি লেখা আছে তা একমাত্র আল্লাহপাক ভালো জানেন। আজ আল্লাহপাক ওকে যে পরীক্ষায় ফেলেছেন এই পরীক্ষায় পাশ করে দেবার ভার আল্লাহপাকের উপরেই ও ছেড়ে দিলো।
একদিকে বাবা অসুস্থ অন্যদিকে ও ওর স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালের পথে রওয়ানা হয়েছে। মাঝখানে সুচরিতার নাবালক তিনটে সন্তান। ওর মনে হলো ওর পৃথিবীটা যেন এক বিরাট ভুমিকম্পে কেঁপে উঠলো।

চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-পঁয়ত্রিশ
মাহবুবা বিথী

হাসপাতাল অব্দি পুরো রাস্তা সুচরিতা আয়াতুল কুরছি পড়লো। আর হিমেলের বুকে ফুঁ দিলো। হিমেলের দিকে তাকিয়ে ওর প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। মুখটা ব্যথায় যেন ধুসর বর্ন ধারণ করেছে। চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তারিক এমনিতেই খুব চঞ্চল থাকে। আজ কেন যেন খুব শান্ত হয়ে ঝুল ঝুল করে ওর বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি জানি ও কিছু বুঝেছে কিনা। হয়তো বুঝেছে। ওর সন্তানরা যেন এতিম না হয় আল্লাহপাকের কাছে সুচরিতা মনে মনে এই প্রার্থনা করতে লাগলো। ওর দু,চোখের কোল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। ওর সামনে যেন এক উত্তাল সমুদ্র। কিভাবে ও এইসমুদ্র পাড়ি দিবে জানে না।ওর নিয়তি ওকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে তা জানেন শুধু সৃষ্টিকর্তা। হেমায়েতপুর থেকে সোহরাওয়ার্দি খুব বেশী দুরত্ব নয় অথচ সুচরিতার কাছে মনে হচ্ছে এই পথ যেন শেষ হবার নয়। জ্যাম পেরিয়ে অবশেষে গাড়িটা হাসপাতালে পৌঁছালো। ড্রাইভার মতি হাসপাতালের ভিতরে গিয়ে হুইল চেয়ার নিয়ে আসলো। হিমেলকে হুইল চেয়ারে যত্ন করে বসিয়ে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল। তারিককে কোলে নিয়ে সুচরিতাও হিমেলের সাথে ইমার্জেন্সিতে গেল। বেশ কয়েকজন ডাক্তার বসে আছেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন মহিলা ডাক্তার উঠে এসে হিমেলের সমস্যা জানতে চাইলো। মহিলা ডাক্তারটার বয়স সুচরিতার মতো। কিন্তু চেহারায় কি দৃঢ়তার ছাপ!যেটা ওর মাঝে নেই। ওর চেহারায় একটা অসহায়ের ভাব সবসময় ফুটে উঠে। নাহ্ নিজের মেয়েদের ক্ষেত্রে ও এই ভুল করবে না। আল্লাহপাক যদি ওকে আর ওর বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখে তাহলে মেয়ে দুটোকে স্বাবলম্বি করে তবেই বিয়ে দিবে।
অবশেষে ডাক্তারকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বললো। ডাক্তার সুচরিতার কাছ থেকে হিমেলের শরীরের ব্যাপারে ডিটেইল জেনে নিলো। সুচরিতা ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে আসার সময় হিমেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। হিমেল চোখ খুলে ইশারায় ওর বড় ভাই আর মাকে ফোন দিতে বললো। সুচরিতাও মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বের হয়ে আসলো।
সুচরিতার মাথা কাজ করছে না। ওর এই মুহুর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারছে না। ওর মন বলছে ইনশাআল্লাহ আল্লাহপাক ওর এই বিপদ পার করে দিবেন। ওর কেন যেন শ্বশুর বাড়ির কাউকে জানাতে ইচ্ছা করছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে ওরা সাহায্য তো করবেই না বরং হিমেলের অসুস্থতার সুযোগে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে। কিন্তু হিমেল তো আবার ওর বড় ভাসুর আর শাশুড়ীকে জানাতে বলেছে। সুচরিতা হাসপাতালের বারান্দায় তারিককে নিয়ে বসে রইলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত চারটা বাজে। পুরো হাসপাতাল নিরব হয়ে আছে। ও বার বার ইর্মাজেন্সি কেবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওখান থেকে হিমেলের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে ডাক্তার কি খবর জানাবে কে জানে। মনে মনে কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। বিপদে আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্য ধারণ করাকে আল্লাহপাক পছন্দ করেন। করিডোরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে পুরো পৃথিবীটা যেন অন্ধকারে ঢেকে আছে। বাইরে রাস্তার এতো আলো তারপরও সুচরিতার কাছে মনে হলো এ যেন অমাবশ্যার অন্ধকার। হয়তো ওর জীবনের আকাশটা আচমকা চলে আসা মেঘের অন্ধকার ছেয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে পুরোপৃথিবীটা অন্ধকারে ঢেকে আছে। ওর একবার মা আর সুসমিতাকে ফোন দেওয়ার কথা মনে হলো। কিন্তু গভীর রাত বলে দিলো না। সারাদিন হাসপাতালে ছুটাছুটি করে রাতে বাসায় হয়তো ঘুমিয়েছে। শোভন রাতে হাসপাতালে থাকবে। এতো রাতে ফোন দিলে উনারা টেনশন করবে সেটা চিন্তা করেই সুচরিতা সকালে ফোন দিয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো।
ইর্মাজেন্সি রুম থেকে ডাক্তারকে বের হয়ে আসতে দেখে সুচরিতা সচকিত হলো। ছুটে গিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–ম্যাম ও এখন কেমন আছে?
——এতো ছোটো বাচ্চাকে হাসপাতালে আনা আপনার ঠিক হয়নি। ওকে বাসায় কোনো রিলেটিভের কাছে রেখে আসতে পারতেন?
——স্যরি ম্যাম বাসায় বাচ্চাকে রেখে আসার মতো কেউ ছিলো না। তাই সাথে করেই আনতে হয়েছে। ম্যাম ও কেমন আছে?
—–আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। উনার একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছে। আপনার এবং আপনার হাসবেন্ডের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। অ্যাটাক যখন হয় সেটা সিভিয়ার ভাবেই হয়। ভাগ্য ভালো ছিলো বলেই উনার অ্যাটাক মাইল্ড হয়েছে। ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। পেশেন্ট এখন ঘুমুচ্ছে। তবে একটা অ্যাটাকে পর আর একটা অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখনি রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল হয়ে যায়। এ জন্য পেশেন্টকে খুব কেয়ারে রাখতে হয়। কোনো রকম মানসিক চাপ দেওয়া উচিত নয়। এইজন্য কয়েকটা দিন হাসপাতালে থাকলে ভালো হয়। সুস্থ হয়ে গেলে একটা এনজিওগ্রাম করিয়ে নিবেন।
কথাগুলো বলে ডাক্তার চলে যাওয়ার পর মনে মনে আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া জানালো। ডাক্তারের একটা কথা ওর মাথায় ভালোভাবে নক করলো। ডাক্তার বলেছিলো হিমেলকে যেন কোনো প্রকার মানসিক চাপ দেওয়া না হয়। ওর মা, ভাইবোন যতই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করুক কিন্তু ওরা তো হিমেলের আপনজন। রক্তের সম্পর্কের বন্ধন রয়েছে ওদের সাথে। সেটাতো ও কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে না। ওর এই অসুস্থতার সময় আপন মানুষদের দেখতে ইচ্ছে হতেই পারে। আবার ওকে যদি হাসপাতালে থাকতে হয় তাহলে বাচ্চাদের লাকির উপর ভরসা করে রাখা ঠিক হবে না। তারিক হওয়ার সময় সুসমিতা বাসায় ছিলো এবার তো সেই উপায়ও নাই। ওদিকে ওর বাবা হাসপাতালে। তাকেও দেখভালের জন্য সুসমিতাকে দরকার। অগত্যা ও শাশুড়ীকে ফোন দিয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো।

একটু পরেই ফজরের আযান শোনা গেল। একটু একটু করে আলো এসে পৃথিবীর অন্ধকারকে দূর করে দিতে লাগলো। ও তারিককে ড্রাইভার মতির কাছে রেখে একটু আড়ালে গিয়ে ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো। হিমেল আর বাচ্চাদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলো। নামাজ শেষ করে প্রথমে ওর বড় ভাসুরকে ফোন দিলো। উনি ফোন ধরে গম্ভীর হয়ে বললেন,
—– কি ব্যাপার কি মনে করে এতো ভোরে ফোন দিয়েছো? হিমেল বাচ্চারা কেমন আছে?
——ভাইয়া হিমেলকে নিয়ে রাত দুইটার সময় সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। ওর একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছে।
সাথে সাথে হিমেলের বড়ভাই রোমেলের গলার স্বর চেইঞ্জ হয়ে গেল। গলায় ছোটো ভাইয়ের জন্য টেনশন ঝরে পড়লো। প্রচন্ড আকুতি নিয়ে বললো,
——তুমি এতো পরে কেন জানালে? তোমারতো সাথে সাথে জানানো উচিত ছিলো। যতই মন কষাকষি হোক আমরাতো হিমেলের আপনজন। ঢাকায় মাকে জানিয়েছো? বাচ্চাদের কার কাছে রেখেছো।
——না, এখনও কাউকে জানায়নি। সবার আগে আপনাকে জানালাম। তাকিয়া আর তৈয়বা লাকির কাছে বাসায় আছে। তারিককে নিয়ে আমি হাসপাতালে এসেছি।
—– কাজটা ঠিক হলো না। লাকি নিজেই তো ছোটো।ওদের সামলাবে কিভাবে? ঠিক আছে আমি এয়ারে করে চলে আসার চেষ্টা করছি। তুমি মাকে জানিয়ে দাও।
সুচরিতা ওর শাশুড়ী মাকে ফোন দিয়ে হিমেলের অসুস্থতার কথা জানালে উনি কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। সুচরিতা দ্রুত ফোনটা রেখে দিলো। ঘন্টাখানিকের মধ্যে সোহেল আর জোহরা, ওর হাসব্যান্ড মান্নান আর হিমেলের মা হাসপাতালে চলে আসলো। জোহরা হাসপাতালে এসে সুচরিতাকে যেন পুলিশের মতো চার্জ করতে লাগলো।
——ভাবি কাল ছোটো ভাইকে কি খাইয়েছিলে?
——এটা কেমন প্রশ্ন করলেন আপনি?
——-আমার ভাইটা কিভাবে অসুস্থ হলো এটা আমি জানতে চাইতে পারি না?
মান্নান আর একটু খোঁচা দিয়ে সুচরিতাকে বললো,
—–ও বাড়ি থেকে বের হয়েছেন তো হিমেলকে ভালো রাখার জন্য? তাহলে ও অসুস্থ হলো কেন?
সুচরিতা মুখটা কালো করে বললো,
——মানুষের অসুস্থতার উপর কারো হাত থাকে না। আর আমি আপনাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।
এমনসময় সোহেল আর একটু খোঁচা দিয়ে বললো,
——দেখেন মান্নান ভাই এখনও ওর অহঙ্কার একটুও কমেনি। পাপের শাস্তি পাচ্ছে তাও গলাবাজি কমে না। তোমার স্বামী যদি মরে যায় কি করে তোমার সংসার চলবে সে খেয়াল আছে তোমার?শুধু জানো মুখে মুখে তর্ক করতে। আস্ত বেয়াদব কোথাকার!
সুচরিতা অবাক হয়ে ভাবলো কি রকম ভাই হিমেলের! মানুষটা এখন বেঁচে আছে অথচ কি অবলীলায় ভাইটার মৃত্যুর কথা ভাবছে?
সুচরিতা ভাবলো একটা জুতসই উত্তর দেওয়া দরকার। তাই ও সোহেলে মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টি ফেলে বললো,
—–মৃত্যুর কথা সবারই ভাবা উচিত। এই যে আপনি এখন আমাকে তিক্ত কথা শুনাচ্ছেন আপনিও তো এখনি মরে যেতে পারেন। ভাবিকে বলে এসেছেন তো চিন্তা করতে আপনি মরে গেলে বাচ্চাদের কি করে মানুষ করবে? আর কি যেন বললেন, “পাপ করেছি আমি”?তো কি পাপ করেছি?বলেন দেখি?
——দেখো মা তাকিয়ে দেখো একা থেকে আস্ত একটা বেয়াদব হয়েছে। মায়ের বুকের থেকে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে এসে বলছো কি পাপ করেছি? লজ্জা হয় না তোমার?
সুচরিতার শাশুড়ী ওদের দু,জনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
——আমার ছেলেটা অসুস্থ। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো ও যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। সেটা না করে ঝগড়া করে যাচ্ছো। এটা কি ঝগড়া করার সময়?
এমন সময় ওয়ার্ডবয় এসে বললো,
——এখানে আপনারা হট্টগোল করবেন না। এই টুকু কমনসেন্স আপনাদের নাই যে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে বেশি কথা বলা যায় না। এই আপনাদের শিক্ষা?
সোহেল আর মান্নানের দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে ও কেবিনে চলে গেল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে