#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-বত্রিশ
মাহবুবা বিথী
খবর পেয়ে সুচরিতার মা ও হাসপাতালে চলে এসেছে। বাচ্চাটাকে নিজের কোলে নিয়ে মেয়ের জন্য আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো।ওদিকে হিমেলের মা, বোন সাবেরাও মনে মনে দোয়া পড়ছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হিমেলের।ওর খুব অসহায় বোধ হলো। সুচরিতা ওর জীবনে কতটা জুড়ে আছে আজ এই অবস্থায় না আসলে হয়ত বুঝতেই পারতো না। ওর চারিদিক যেন অসীম শুন্যতায় ভরে আছে। এখানে সবাই আছে তবুও
ওর নিজেকে বড্ডো একা লাগছে।
মানুষের জীবন বড় অদ্ভূত। নতুন সম্পর্কের সাথে সাথে পুরোনো সম্পর্কগুলো বদলে যেতে থাকে।সেখানে স্বার্থ ক্ষোভ এসে জমা হয়। এই কারনে
হিমেল ওকে পরিপূর্ণ সুখী করতে পারেনি। আজ সুচরিতার জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে অনুশোচনায় হিমেলের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে। সুচরিতাকে ও যতটা ভালোবাসে সেভাবে কোনোদিন প্রকাশ করতে পারেনি। পারিপার্শ্বিকতার কারনে কখনও নিজের ভালোবাসাকে সুচরিতার কাছে মেলে ধরতে পারেনি। এইজন্য সুচরিতা মনে হয় ওকে ভুলই বুঝেছে। আর ওর কারনে শুধু কষ্টই পেয়ে গেছে। হিমেলের নিজেকে অপরাধি মনে হলো।
আল্লাহপাকের অসীম রহমতে ডাক্তারদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সুচরিতা অবশেষে সামলে উঠলো। চব্বিশঘন্টা পর সুচরিতার জ্ঞান ফিরে আসলো। ডাক্তার খবর দেওয়াতে হিমেল আইসিইউ এর ভিতরে গিয়ে চোখ ছলছল করে সুচরিতাকে দেখে বললো,
—-কেমন আছো তুমি?আল্লাহপাক তোমাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহপাকের কাছে অনেক শোকরিয়া।
সুচরিতা হিমেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
——আমার বাচ্চারা কেমন আছে? তৈয়বা আর তাকিয়ার খোঁজ নিয়েছো?
——আল্লাহ রহমতে ওরা সবাই অনেক ভালো আছে।
হিমেল আইসিইউ থেকে বের হয়ে ওর মা আর শাশুড়ীকে ভিতরে যেতে বললো।
বাচ্চাটাকে হিমেলের মা সুচরিতার মায়ের কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নিলেন। তারপর ভিতরে গিয়ে সুচরিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—–মা,এখন কেমন লাগছে?তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?আমরা এই চব্বিশ ঘন্টা হাসপাতাল থেকে কেউ বের হইনি। কি টেনশনে আমরা ছিলাম! আমার দাদাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখো এক লহমায় সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।
সুচরিতা শোয়া থেকে উঠে বসলো। তারপর শাশুড়ীর কোলে ছেলেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। ছেলেটা ঘুমুচ্ছে। ডাক্তার বললো ঘুম ভাঙ্গলে ওকে যেন দুধ খাইয়ে নিয়ে যায়। ওর খুব দুর্বল লাগছে।সুচরিতার মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
——খারাপ লাগলে শুয়ে পড়।জোর করে বসে থাকতে হবে না।
তাই সুচরিতাও পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। আসলে ডেলিভারী হতে যত কষ্টই হোক মা তার সন্তানকে দেখার পর সেই কষ্টের লেশমাত্র আর থাকে না। কিন্তু অনাগত দিনে শ্বশুরবাড়িতে ওকে যে পরিমান অপমান লাঞ্চনা সয়ে যেতে হয়েছে আজ শাশুড়ী মাকে দেখার পর সেই কষ্টের স্মৃতিগুলোর কথা যেন মনের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো। আর চোখের কোল বেয়ে নিজের অজান্তে জল গড়িয়ে সিথানের বালিশ ভিজতে লাগলো। কেউ যেন ওর চোখের পানি টুকু দেখতে না পায় তাই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। শাশুড়ীমায়ের এমন আদিখ্যেতা ওকে আজ একটুও স্পন্দিত করলো না। কারণ ওর সেই মনটা আজ মরে গেছে। বিয়ের পর যখন ও প্রচন্ড লড়াই করেছে উনার বাড়ির মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে তখন উনার এইটুকু স্নেহ ওর কাম্য ছিলো। অথচ সেদিন সুচরিতার ভাগ্যে এটা জোটেনি। বরং দিনদিন অত্যাচার বেড়ে যাওয়াতে ওর সেই প্রাণবন্ত মনটা মরে গেছে। আজ যে সুচরিতা বেঁচে আছে এটা একটা কঙ্কাল। তাই কঙ্কালের মতই ও শক্ত। যার কোনো আবেগ ইমোশন নেই। ইদানিং হিমেল একটা কথা প্রায় বলে, ওকে নাকি রোবটের মতো লাগে।সুচরিতা ওর নিস্প্রভ দৃষ্টি হিমেলের দিকে মেলে ধরে। হিমেল ওর সেই দৃষ্টির ভাষা বোঝে কিনা সেটা ওর বোধগম্য নয়। তবে সুচরিতা ওর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার কিছুটা প্রয়োজনীয়তা বোধ করে। মনে মনে সুচরিতার ওর শাশুড়ীর উপর আরোও রাগ হলো। ওর মেয়ে দুটোকে উনি দেখতে আসেননি। আজ নাতি হয়েছে বলে উনি ছুটে এসেছেন। তবে সুচরিতা এটাও জানে,এটা উনার রিয়েল ভালোবাসা নয়। উনি আবার যে কোনো মুহুর্তে পল্টি মারবেন। শাশুড়ী আর ওর মা কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এমন সময় সাবেরা ব্যাগ থেকে সোনার চেইন বের করে ছেলেটার গলায় পড়িয়ে দিতে চাইলে হিমেল বলে উঠলো,
—-আপু স্যানিটাইজ না করে ওর গলায় পড়িয়ে দিও না।
তখন হিমেলের মা বাচ্চাটাকে সুচরিতার মায়ের কোলে দিলেন। এরপর মেয়ের হাত থেকে চেইনটা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
—–এই চেইন আমার ছোটো বউমা পড়বে।
এ কথা বলে হিমেলের হাতে তুলে দিতে চাইলেন। হিমেল বললো,
——আরো কিছুক্ষণ থাকো। ওকে মনে হয় কেবিনে দিয়ে দিবে। তখন নিজের হাতে ওকে পড়িয়ে দিও। কয়েকঘন্টার মধ্যে সুচরিতাকে কেবিনে সিফট করে দিলো। শাশুড়ী মা এসে সুচরিতার গলায় সোনার চেইনটা পড়িয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সুচরিতা কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে গেল। হিমেল বুঝতে পেরে বললো,
——চেইনটা মা শখ করে বাবুর জন্য কিনেছে। কিন্তু আমি এই মুহুর্তে বাবুর গলায় চেইনটা পরাতে দিলাম না। তাই মা তোমাকে পড়িয়ে দিয়েছে।
কিছুটা ধাক্কা খেলেও পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে সুচরিতা বললো,
—–এটার কোনো প্রয়োজন ছিলো না মা। আমার মেয়ে হওয়ার সময় আমার মানসিক অবস্থা যেমন ছিলো আজ ছেলে হওয়ার সময় একই আছে। সেখানে কোনো বৈষম্য নেই। আমি যেন আমার ছেলেমেয়েদের প্রতি একই রকম আচরণ করতে পারি আল্লাহপাকের কাছে আমার জন্য এই দেয়া করবেন।
সাবেরা মনে হয় সুচরিতার আচরণে বিরক্ত বোধ করলো। তাই কথা ঘুরাতে ওর মাকে বললো,
——সন্ধে হয়ে আসছে মা। বাড়িতে ফিরতে হবে। তুমিও চব্বিশঘন্টা হাসপাতালে থেকেছো। এরপর আরো কন্টনিউ করলে তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে। তখন আবার তোমার সেবা কে করবে?
সাবেরা সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-রাত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এবার রওয়ানা হতে হবে। তুমি তোমার শরীরের দিকে যত্ন নিও। বাচ্চার দিকে খেয়াল রেখো।
শাশুড়ীও সুচরিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—–আজকের মতো আমরা আসি।
শাশুড়ী চলে যাবার পর ওর মা বাচ্চাটাকে ওর পাশে শুয়ে দিয়ে হিমেলকে বললো,
—–হিমেল, আমারও তো এবার বাসায় যেতে হবে। অসুস্থ মানুষটাকে রেখে এসেছি।
হিমেল উবার ডেকে ওর শাশুড়ীকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো।
সবাই চলে যাবার পর হিমেল এসে সুচরিতার মাথার কাছে বসলো। সুচরিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
——ভাবছি,একটা ছাগল কিনে সদকা দিয়ে দিবো।
——-সেসবের দরকার নেই। আল্লাহপাক আমাকে আমার সন্তানদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমার এই শোকরানার শেষ নেই।
——তুমি বাচ্চাদের কথা বললে,কিন্তু আমার কথা তো বললে না?
—–আমি মরলে তোমার তো সুদিন ফিরবে। আম্মা তার পছন্দের পাত্রীর সাথে তোমার বিয়ে দিবেন। সুখ আর স্বাচ্ছন্দে তোমার জীবন ভরে উঠবে। আর আমার বাচ্চারা তখন এতিম হয়ে যাবে। যাক আমি যখন এখনও বেঁচে আছি সে প্রসঙ্গে আর না যাই।
রুমের দরজা খোলার শব্দে সচকিত হয়ে ওরা দু,জন দরজার দিকে তাকালো। হাসপাতাল থেকে ওয়ার্ডবয় খাবার দিয়ে গেল। হিমেল সুচরিতাকে আজ খাইয়ে দিলো। সুচরিতাও বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলো। ওষুধ খেয়ে ছেলেটাকে ব্রেস্ট ফিডিং করাতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হিমেল হাসপাতালের ক্যান্টিনে গিয়ে রাতের ডিনার সেরে ফেললো।
কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে সুচরিতা আর বাচ্চাটাকে নিয়ে হিমেল বাসার পথে রওয়ানা দিলো। গাড়িতে ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর মা ফোন দিয়েছে।
—–হ্যালো আম্মু, কি বলবে বলো?
——বলছিলাম, কয়েকটা দিন সুচরিতাকে নিয়ে আমার এখানে থেকে গেলেই পারতি। একসাথে তিনটা ছোটো বাচ্চার দেখভাল করতে সুচরিতার কষ্ট হবে। তুই তো অফিসে থাকবি। আমি সাহায্য করতে পারতাম?
——তুমি চিন্তা করো না। ও ঠিক পারবে। হেল্পিং হ্যান্ড হিসাবে লাকি আছে।
——তোর ভালোর জন্যই বলেছিলাম। ভেবে দেখিস।
মা,ছেলের কথোপকথনে সুচরিতা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো। ওর একসাথে থাকার স্বাধ মিটে গেছে। তাই শাশুড়ী মা ফোন রাখার পর হিমেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–কি ভাবছো? ও বাড়িতে আবার যাবে নাকি?
—–প্রশ্নই আসে না।
হিমেলও আর একসাথে থাকতে চায় না। এতে শান্তির থেকে অশান্তি বেশী বাড়ে।
বাড়িতে ফিরে আসার পর তৈয়বা তাকিয়া লাকি আর সুসমিতা বাচ্চাটাকে প্রথম দেখলো। সুচরিতার তাকিয়া আর তৈয়বার দিকে তাকিয়ে খুব খারাপ লাগছে। ওদেরকে ফেলে ও কখনও কোথাও থাকেনি। একমুহুর্ত চোখের আড়াল কখনও করেনি। সুসমিতা বোনের মন বুঝতে পেরে বললো,
——তোমার বাচ্চারা আমার কাছে খুব যত্নেই থেকেছে। ওদেরকে নিয়ে এতো মন খারাপ করার কিছুই নাই।
তৈয়বা ওর খালামনির কথায় সুর মিলিয়ে বললো,
—–খালামনি আমাদের অনেক আদর করেছে। তুমি মন খারাপ করো না।
যাইহোক সুসমিতার এই কয়দিন অফিস কামাই গিয়েছে। আর অফিস কামাই দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ বেতন কেটে রাখে। তাই বোন দুলাভাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
সুসমিতা যাওয়ার পর হিমেল সুচরিতার হাতে সোনার চুড়ি পরিয়ে দিলো। এটা হিমেল সবসময় করে। তৈয়বা হওয়ার পর সুচরিতাকে সোনার চেইন গিফট করেছে। তাকিয়া হওয়ার পর কানের ঝুমকা দিয়েছে। আর ছেলেটা হওয়ার পর একজোড়া চুরি গিফট করলো। হিমেলের এই ফিলিংসটা সুচরিতার খুব ভালো লাগে। সোনার জিনিস যে দিতে হবে এমন কথা নয় কিন্তু ওর মা হওয়ার জার্ণির কষ্টটা যে হিমেল ফিল করেছে এটা ভেবেই সুচরিতার খুব ভালো লাগে। এমনিতেই হিমেল অনেক ভালো থাকে। কিন্তু যখনি ওর শ্বশুর বাড়িতে হিমেল খুব ঘনঘন যায় তখনি ওর মাথাটা বিগড়ে যায়। সুচরিতার সাথে তখন স্বাভাবিক আচরণ করে না। এই হিমেলকে সুচরিতা তখন খুঁজে পায় না। কি এমন টনিক দেওয়া হয় যে মানুষটা মুহুর্তে পাল্টে যায়। সুচরিতা বুঝে পায় না।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-তেত্রিশ
মাহবুবা বিথী
দেখতে দেখতে ছেলের জন্মের ছ,মাস পেরিয়ে গেল।সুচরিতার সংসার জীবনও চলছে তার নিজস্ব গতিতে। তিনটে ছোটো বাচ্চাকে সামলে সংসারের নানা জটিলতায় ওর মেজাজ যেন সবসময় বিগড়ে থাকে।
ইদানিং সুচরিতা আর রেখে ডেকে কথা বলে না। যা বলে একদম খোলাখুলি বলে। হিমেলের ও বাড়ি থেকে ফিরে আসতে সেদিন বেশ রাত হয়েছিলো। সারাদিন বাচ্চা সামলে সংসারের কাজকর্ম করে
সুচরিতার রাতে এভাবে অপেক্ষা করতে ভালো লাগে না। তাই দরজা খুলেই হিমেলকে বললো,
——-এতো দেরী করলে কেন? সারাদিন বাচ্চাদের সামলে রাতে এভাবে জেগে বসে থাকতে ভালো লাগে না।
——-কেন দেরী হলো সেই কৈফিয়ত তো তোমাকে দিবো না? তোমার তো চাকরি বাকরি নাই। সংসার ধর্ম পালন করাই তো এখন তোমার কাজ। ওদিকে দেখো আমার বোনেরা সংসার সামলে আবার টাকা ইনকাম করে সংসারে ঢালছে।
হিমেলের উল্টাপাল্টা কথা শুনে সুচরিতার মাথার চাঁদি গরম হয়ে গেল। ও তো ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। তাই তেতে এসে বললো
—–তোমার বোনেরা কিভাবে সংসার করে তা আমার ভালোই জানা আছে। যেই কাজের লোক চলে যাবে অমনি পার্মানেন্ট বুয়ার সার্ভিস নিতে বাপের বাড়িতে চলে আসে। কাপড় স্ত্রী থেকে শুরু করে বাচ্চাদেী টিফিন এভরিথিং ভাইয়ের বউদের দিয়ে করিয়ে নেয়। যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে খাটিয়ে মারে।আজ কি তোমার ব্রেনটা বেশী ওয়াশ হইছে?
হিমেল একটু বিরক্ত হয়। কারণ ও সুচরিতার থেকে দশ বছরের বড়। এভাবে মুখের উপর কথা বলা ওর আত্মসম্মানে লাগে। তাই রেগে গিয়ে বলে,
—–কি বলতে চাইছো? আর এ তোমার কেমন কথার ছিড়ি?
তৈয়বাটাও ইদানিং কথা ভালোই শিখেছে। পাঁচ বছর বয়সে কথায় বেশ পরিপক্কতা এসেছে। তাই মায়ের কথার রেশ ধরে বলে,
—–না,মানে আম্মু বলতে চাইছে তুমি দাদী বাড়ি যাওয়ার আগে খুব হাসিখুশী ছিলে। কিম্তু ওখান থেকে ঘুরে আসার পর মুখটা গোমড়া হয়েছে।
—–তৈয়বা বড়দের কথার মাঝে কথা বলো না। আর এতো রাত অব্দি জেগে আছো কেন? তারিক আর তাকিয়ার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
——-তুমি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে?
——তুমি শুয়ে পড়ো, আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।
তৈয়বা চলে যাবার পর হিমেল সুচরিতাকে বলে,
—–মেয়েকে এসব কি শেখাচ্ছো?
——আমি শেখাচ্ছি না। ও দেখে দেখে শিখছে। তুমি নিজেই জানো না ও বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর তুমি বাসায় কি রকম আচরণ করো? তুমি নিজেকে শুধরাও।
রাত অনেক হয়েছে। লাকিকে খাবার দিয়ে বাকি সব খাবার সুচরিতা ফ্রীজে তুলে রাখলো। নিজেও কিছু খেলো না। হিমেলকেও খেতে বললো না। এরপর বাচ্চাদের নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হিমেল জানে আজকে আর খাওয়া হবে না। ও এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লো।
এখন অক্টোবর মাস। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। সুচরিতা বিছানায় কুন্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মনে হলো কেউ যদি গায়ে একটু কাঁথাটা দিয়ে দেয়। হঠাৎ তন্দ্রার মধ্যে কে যেন গায়ে কাঁথাটা জড়িয়ে দিলো। সুচরিতার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। হিমেল খুব যত্ন করে ওর গায়ে বাচ্চাদের গায়ে কাঁথা দিয়ে দিলো। প্রথমে সুচরিতার হিমেলের মতলব বুঝার চেষ্টা করলো। না,ভদ্র আচরণ করছে। মানুষটা এমনিতেই ভালোই থাকে কিন্তু মাঝে মাঝে মাথায় যেন কিসের ভূত চাপে। ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। সুচরিতা আর ঘুমালো না। হিমেল মনে হয় আবারো ঘুমিয়ে পড়েছে। আযান শেষ হওয়ার পর ও বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ওজু করে আসলো। নিজে ফজরের নামাজ পড়ে হিমেলকে নামাজ পড়ার জন্য ডেকে দিলো। কিচেনে গিয়ে চায়ের হাড়িটা চুলায় চাঁপিয়ে দিলো। এমন সময় হিমেল এসে বললো,
——তোমার বেলকনিতে বেলী ফুল ফুটেছে। খুব সুন্দর সুবাস ছড়াচ্ছে। চা,টা নিয়ে এসো দুজনে একসাথে বসে বারান্দায় চা খাই। কতদিন আমরা একসাথে চা খাই না।
সুচরিতা বুঝতে পারছে কাল রাতের ঘটনায় হিমেল ওর মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে। সুচরিতা লাকিকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। ওকে হাতমুখ ধুয়ে পেপেটা একটু কেটে দিতে বললো। আজকে সকালের নাস্তা মিক্সড সবজি আর লুচি বানাবে।
চা,টা নিয়ে সুচরিতা বেলকনিতে হিমেলের হাতে এককাপ দিয়ে নিজে এককাপ নিয়ে বেতের চেয়ারটায় বসলো। হিমেল ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
—–মহারানীর রাগ কমেছে?
—–কবে আমার প্রমোশন হলো?
——মানে কি?
—–না,মানে আমি তে জানি আমি ঘুটেকুড়োনি। কবে মহারানী হলাম বুঝতে পারলাম না।
—–বুঝেছি এখনও মান ভাঙ্গেনি। ভোর রাতে দেখলাম শীতে ঠকঠক করে কাঁপছো। মনে হলো আদরের স্পর্শে তোমাকে উষ্ণ করে তুলি। পরে ভাবলাম যে পরিমান রেগে আছো এতে সাহস না দেখানোই ভালো।
——হুম,আমিও বুঝেছি বদ মতলবে এতো পিরিত দেখানো হচ্ছে। এজন্য আমিও চোখ কান খোলা রেখেছি।
—–ও–ও তুমি তাহলে জেগেই ছিলে।
—–না, সেই মুহুর্তে ঘুম ভেঙ্গেছে। তোমার সাথে প্যাঁচাল পারতে গেলে আমার কাজের দেরী হয়ে যাবে।
সুচরিতা কিচেনে গিয়ে একটু বেগুন,পটল,ধুন্দুল আর পেপে একসাথে কেটে নিলো। এরপর পাঁচফোড়নের ফোড়ন দিয়ে চুলায় সবজি চাঁপিয়ে লুচির ডো টা তৈরী করে দশমিনিটের জন্য রেখে দিলো। এই ফাঁকে আর এক চুলায় তাকিয়া আর তারিকের জন্য খিচুড়ী চাঁপিয়ে দিলো। এই ফাঁকে তাকিয়া ঘুম থেকে উঠে গেলে ওকে হিমেল ওকে ফ্রেস করে লাকির কোলে দেয়। কিছুক্ষণ পর তারিকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। হিমেল ওর ডায়াপার চেঞ্জ করে বিছানায় শুয়ে দেয়। তৈয়বাও ঘুম থেকে উঠে পড়ে। হিমেল অফিসে যাওয়ার জন্য রেডী হতে লাগলো। এর মাঝে সুচরিতার লুচি সবজি তৈরী হয়ে গেলে টেবিলে নাস্তা দিয়ে হিমেল আর তৈয়বাকে ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডেকে দেয়।
হিমেল নাস্তা করে অফিসে যাবার সময় সুচরিতাকে বলে,
—–আমার প্যান্ট দুটো চেক করে মেশিনে দিায়ে দিও।
সাথে সাথে সুচরিতার মুখটা ঝলমল করে উঠলো। হিমেলের প্যান্ট ধুতে গেলে সুচরিতার বেশ ইনকাম হয়। ও অবশ্য হিমেলকে ফেরত দিতে চায়। কিন্তু হিমেল বলে”যে টাকা তোমার হাতে পৌঁছেছে সেটাতো তোমার টাকা। কারন তোমার রিজিকে ছিলো বলে টাকাটা তোমার হাত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ও টাকা আমায় দিতে হবে না”।অথচ ওর ছোটো ননদের হাসব্যান্ড মান্নান ভাই একদিন তাচ্ছিল্যভরে ওকে বলেছিলো,
——তোমরা যারা হাউজ ওয়াইফ তারা তো টাকা পয়সা ইনকাম করতে পারো না। যা আয় করো তা আবার স্বামীর পকেট কেটে। আমার কাছে এটাকে চৌর্যবৃত্তি মনে হয়।
সুচরিতাও প্রতিবাদ করে বলেছিলো,
—–এটা আপনি আপত্তিকর কথা বললেন। কারণ কবুল বলার সাথে সাথে একজন স্ত্রী যেমন তার স্বামীর অধিকারে চলে যায় তেমনি স্বামীরও সবকিছুর উপর স্ত্রীর অধিকার বর্তায়। আপনি যে ভাষায় বললেন তাতে মনে হলো ঘরের বউ আর কাজের খালাকে আপনি এক কাতারে ফেলেছেন।
—–তুমি তো ভাবি তর্কবাগীশ। তোমার সাথে কথায় পারা যাবে না।
ও আর অপমানের কথাগুলো মনে করতে চায় না। এতে শুধু কষ্টই বাড়ে। সুচরিতা কিচেনে গিয়ে একটা প্লেটে খিচুড়ী আর ডিমপোজ নিয়ে এসে তাকিয়া আর তারিককে খাইয়ে দিলো। তৈয়বাকে লুচি আর সবজি দিয়ে টেবিলে বসিয়ে দিলো। খাওয়া শেষ হলে তাকিয়াকে লাকির কাছে দিয়ে তারিককে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। তারপর ময়লা কাপড়গুলো নিয়ে মেশিনে দিলো। হিমেলের প্যান্ট চেক করতে গিয়ে করকরে পাঁচটি একহাজার টাকার নোট ও হাতে পেলো। খুশীতে ওর মনটা ভরে গেল। এই সপ্তাহে ওর আট হাজার টাকা ইনকাম হলো। শোভন বলেছিলো,”ওর নাকি ইংরেজীর টিচার লাগবে। এই টাকাটা দিয়ে ওর কয়েক মাসের টিচারের কাছে পড়ার খরচ হয়ে যাবে। ফোনের শব্দে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর বড় জা ফোন দিয়েছে।
—–হ্যালো ভাবি, কেমন আছেন?
——ভালো, তুমি কেমন আছো?
——আলহামদুলিল্লাহ। ভালোই আছি। তোমার মেয়ে কেমন আছে?
—-হুম ভালো আছে। আজ তিনবছর পরে তোমার সাথে কথা বলছি।
—–নাম্বার পেলে কোথায়?
—–তোমার ভাইয়ের মোবাইল থেকে লুকিয়ে হিমেল ভাইয়ের নাম্বারটা যোগাড় করেছি। তারপর ভাইকে আজ ফোন দিয়ে তোমার নাম্বারটা নিয়ে ফোন দিলাম।
—–অনেক বুূ্দ্ধি খরচ করেছো।
——হুম, জানো, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার কারনে তোমার ভাই এখন অনেক কষ্ট পায়। সব শয়তানি যে কারিমা, সোহেল আর জোহরা বিবি করেছে এটা এখন সবাই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু যা ঘটার তাতো ঘটেই গেল।
—-ভাবি পুরোনো কথা বাদ দাও। রাজন কেমন আছে।
—–ভালো আছে। শোনো, কুত্তার লেজ হাজারো তেল মর্দন করলেও সোজা হয় না। কারিমা হচ্ছে সেই জাত। আমাকে সেদিন ফোন দিয়ে বলে,”তুমি নাকি কুচকুচে কালো ছেলের জন্ম দিয়েছে।
——উনি নিজে কি? আমার ছেলে কালো হোক ফর্সা হোক তাতে উনার কি?
—–কুত্তা দেখোনা গু দেখলেই খাইতে চায়। উনার অবস্থা হচ্ছে সেই রকম। কূটকচালী ছাড়া ও থাকতেই পারে না।
চলবে