#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-ত্রিশ
মাহবুবা বিথী
সুচরিতা প্রচন্ড ধর্মভীরু একজন মানুষ। ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আল্লাহপাক ওর পাশে আছেন। সুতরাং ওর ভয় কিসের। আজ এই সময়ে ওর হৃদয়ে ভয় নয় প্রবল সাহস যেন সঞ্চারিত হতে থাকে। এই সমাজে ও কারো কাছে এই প্রমান দিতে চায় না যে ও ওর নিজের নিরাপত্তা দিতে পারে না। এমন কি হিমেলের কাছে ও না। হিমেলও বুঝবে বিপদে কি পরিমান দুর্দান্ত সাহস সুচরিতা বুকে ধারণ করতে পারে। আর এটা যদি ওর শ্বশুর বাড়ির কেউ বদমায়েশি করে থাকে তাহলে আজ ও এমন শিক্ষা দিবে কোনোদিন এ ধরনের নোংরা আচরণ ওর সাথে করার সাহস দেখাবে না। ওর আজকাল কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায় না। স্বার্থের কারনে মানুষ অনেক নিচে নামতে পারে। এমনকি মনুষ্যত্ব বোধ ও হারিয়ে ফেলতে পারে। সুচরিতার ওর মেজ ভাসুর সোহেল আর ছোটো ননদ জোহরাকে সন্দেহ হয়। কারণ ওরা যদি প্রমান করতে পারে সুচরিতা চরিত্রহীনা তাহলে ওর সাথে হিমেলের সম্পর্ক ভেঙ্গে দেওয়া সহজ হবে।
সুচরিতা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। প্রথম ইচ্ছা হলো থানায় ফোন দিবে। পরে ভাবলো না। কারণ এই সামান্য ব্যাপারে ও পুলিশের সাহায্য নিবে না। বরং এতে ওর পুলিশের কাছে হ্যারাজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর হিমেলও দেশে নাই। ইনশাআল্লাহ এই শয়তানকে অপদস্ত করতে ও একাই যথেস্ট। ওদিকে বদমায়েশ রফিক সমানে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। এরপর সুচরিতা দারোয়ানকে ফোন দিয়ে বললো,
——আপনি কোথায় চাচা?
—–মসজিদে নামাজ পড়তে এসে একটু চা খাচ্ছিলাম।
——একটু তাড়াতাড়ি বাসার দিকে আসেন।
এরপর সুচরিতা হাতে শলার ঝাড়ুটা নিয়ে দরজা খুলে রফিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
——কি সমস্যা আপনার? আমি কি পুলিশ ডাকবো নাকি চিৎকার করে লোক জড় করবো?
——কি বলছেন ভাবি আমি আপনার খোঁজ নিতে আসছিলাম।
এমন সময় দারোয়ানও চলে এসেছে। তখন সুচরিতা বুদ্ধি করে বললো,
—–আপনি ভাবি কাকে বলছেন? আমি তো আপনাকে চিনিই না। দেখেন তো দারোয়ান চাচা উনাকে কি করবেন? পুলিশে দিবেন নাকি গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন।
—–ভাবি, আমি আপনার ছোটো ননদের চাচাতো দেবর। আপনি আমার সাথে এরকম আচরণ করতে পারেন না।
—–আত্মীয় হলে আপনি কি আমার সাথে এ ধরনের আচরণ করতে পারতেন?.
দারোয়ানও রফিকের কথায় তেতে উঠে বললো,
—–আপনার কানে কথা যায় না? খালাম্মা তো কইলো হে আপনারে চিনে না। দেহেন ভালোই ভালোই এহান থেকে কাইটা পড়েন। নয়ত চারদেয়ালের শিকের মধ্যে আপনারে ভইরা ফেলমু। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকা কইরা ঘি উঠাইতে আমি জানি।
রফিক সুচরিতার দিকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে বের হয়ে গেল। রফিক চলে যাবার পর সুচরিতার বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটা প্রশমিত হলো।
দু,দিন পর হিমেল সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসলো। এরপর সুচরিতা হিমেলের কাছে রফিকের ঘটনা তুলে ধরলো। হিমেলও রফিকের উপর রেগে গিয়ে সুচরিতাকে বললো,
—–আমি তো উনাকে আসতে নিষেধ করেছিলাম।
——তাহলে বুঝে দেখো উনি কেমন মাল? তবে এমন ছেঁচা দিয়েছি সারাজীবন মনে থাকবে। আর একটু হলে পুলিশের হাতে তুলে দিতাম। শুধু ছোটো আপার সংসারের শান্তির কথা চিন্তা করে এই কাজটা করিনি।
হিমেল সুচরিতার বডিল্যাঙ্গুয়েজের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না। তবে মনে মনে ভাবলো সুচরিতা এতোটা না করলেও পারতো। ভদ্রভাবে বললেই হতো। হাজারো হোক জোহরার চাচাতো দেবর হয়। তবে মানসম্মান থাকলে রফিক এই ঘটনা কাউকে জানাবে না।সুচরিতা হিমেলের ভাব গতিক বুঝতে পেরে বললো,
—–আমি জানি,তোমার মনে হচ্ছে আমি এতোটা না করলেও পারতাম। কিন্তু আমার ধারণা উনি এতোটা সাহস কোথা থেকে পেলেন? তুমি নিষেধ করা সত্বেও আবার আসলো? যদি উনি ভেবে থাকেন আমার বয়স কম কিংবা আমি আবাল বলে ও বাড়ির এতো যন্ত্রণা সহ্য করেছি। এছাড়া কেউ যদি শত্রুতা করে উনাকে দিয়ে কোনো বদমায়েশি করার ইচ্ছা পোষণ করে থাকে তাহলে উনারা ভুল ভেবেছেন। ও বাড়িতে সয়েছি এটা আমার ভদ্রতা। আমি আমার শাশুড়ী মায়ের কথা রাখার চেষ্টা করেছি। শেষ রক্ষা হয়নি তবুও এটুকু সান্তনা আমি চেষ্টা করেছিলাম। ব্যাটাকে এমন শায়েস্তা করেছি নেক্সটে বদমায়েশি করার চিন্তা করলে অনেক ভেবে চিন্তে আগাতে হবে।
এদিকে একদিন সুচরিতার বাসায় খোকন এসে ওর ফরমফিলাপের টাকা চাইলো। ও আবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। সুচরিতাও রেগে গিয়ে বললো পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা থাকলে যেন ফরমফিলাপ করে। নয়ত ও হিমেলের কাছে টাকা চাইতে পারবে না। খোকন ওকে জানালো ওকে দুটো বিষয়ে একটু সমস্যা আছে। এ জন্য টিচার লাগবে। সুচরিতাও ওকে জানিয়ে দিয়েছে সে টাকাও ম্যানেজ করে দিবে কিন্তু ওকে পড়াশোনা করতে হবে। সুচরিতার মেজাজ মর্জি দেখে খোকনও কোনো উচ্চবাচ্য করলো না কিন্তু মনে মনে সুচরিতার এই আচরণ মেনে নিতে পারলো না। বাড়ি ফিরে গিয়ে ওর মাকে বললো,
—–আমাদের আর্থিক সমস্যার জন্য তোমার মেয়ের কাছে টাকা চাইতে হয় বলে সুযোগ পেলেই অপমান করতে ছাড়ে না। আমি গতবার পরীক্ষা দেইনি বলে আমাকে যা ইচ্ছা তাই বললো।
সুচরিতার মা মনে মনে ওর উপর বিরক্ত হলো। ফোন দিয়ে ওকে বললো,
—–তোর বাবার আর্থিক অবস্থার কারনে ছোটো ভাইকে না হয় একটু সাহায্য করলি তাই বলে তুই ওকে কথা শোনাবি?
——আম্মা আপনি ওর বিষয়ে আমাকে কিছু বলতে আসবেন না। ওর কপাল ভালো ও আপনার সন্তান। কিন্তু ও যদি আমার সন্তান হতো তাহলে চাপকে আমি ওর পিঠের ছাল চামড়া উঠিয়ে ফেলতাম। দু,দনেই বদমায়েশি ভুত ওর ঘাড় থেকে নেমে যেতো।
সুচরিতার কথা শুনে ওর মা আর কোনো কথা বাড়ালো না। তবে খোকনকে ভালো করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে বললো। যাতে রেজাল্ট খুব ভালো হয়।
এভাবেই নানা টানাপোড়েনে হিমেল আর সুচরিতার জীবনের সময়গুলো পার হতে লাগলো। দু,বছর সময়ও পার হয়ে গেল। মাঝে মাঝে সুচরিতার মনে হয় যদি এই পৃথিবীতে হিংসা বিদ্বেষ না থাকতো তাহলে মনে হয় পৃথিবীটা খুব সুন্দর হতো। হিমেল মাঝে মাঝে ওর মায়ের কাছে যায়। সংসারের কিছু খরচ বহন করে। সুচরিতা ইদানিং খেয়াল করেছে ছুটির দিনগুলো হিমেল ও বাড়িতে কাটায়। কখনও কখনও তৈয়বাকে সাথে করে নিয়ে যায়। সুচরিতার আর হিমেলকে কাছে পাওয়া হয় না। ছুটির দিন বাদে বাকি দিনগুলোতে হিমেল অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর ছুটির দিনে ওর শাশুড়ীর কাছে চলে যায়।এতে সুচরিতার হিমেলের উপর প্রচন্ড অভিমান জমতে থাকে। তবে মুখে কিছু বলে না। সুচরিতার বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো না। সে ক্ষেত্রে হিমেলের সাহায্য ওকে নিতে হয়। হিমেল আবার এই ব্যাপারটায় উদার। কখনও ওর বাপের বাড়ির এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলে না। সুসমিতা এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে। সুচরিতা ওর জন্য পাত্র খএঁজতে লাগলো। যদিও এখন বিয়ে করতে চাইছে না। খোকনের এইচ এস সির রেজাল্ট খুব ভালো হয়নি। সিজিপিএ ৩.৫ পেয়েছে। ও তিতুমীর কলেজে বি,কম ভর্তি হয়েছে।
এর মাঝে সুচরিতা তৈয়বার কাছে শুনলো ও বাড়িতে নাকি আরিফা নামে এক ফুফু আসছে। সম্পর্কে হিমেলের মামাতো বোন হয়। উনি নাকি তৈয়বাকে অনেক আদর করেন। আবার হিমেলকেও নাকি অনেক যত্নআত্তি করে। সুচরিতার বিয়ের পর উনারা কেউ এ বাড়িতে আসেননি। কারণ উনার বাবা সুচরিতার শাশুড়ীর একমাত্র ভাই। হিমেলকে জামাই বানানোর ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু বিয়েটা না হওয়ায় উনারা এ বাড়ির সাথে আর সম্পর্ক রাখেননি। সুচরিতাকে এই বিষয়টা হিমেল বলেছে। কিন্তু সুচরিতা ও বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর সম্পর্কটা এই কয়দিনে এতোটাই ঘনিষ্ট হলো যে ওকে আবার এ বাড়িতে আনা হয়েছে। বিষয়টা সুচরিতার কাছে কেমন যেন খটকা লাগে। তাই সেদিন হিমেল অফিস থেকে বাসায় ফিরে লাঞ্চ করার পর সুচরিতা জিজ্ঞাসা করলো,
——ও বাড়িতে কে আসছে? তৈয়বা বলছিলো?
——আরিফা আসছে। মেজভাই আর ভাবি যশোরে বেড়াতে গিয়েছিলো। উনারা আসার সময় আরিফাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে।
——আরিফার সাথে না তোমার বিয়ের কথা ছিলো?
——হুম, মামা চেয়েছিলো কিন্তু মা রাজি হয় নাই। আমিও রাজি ছিলাম না।
——তাই এখনকি পুরান সম্পর্ক জোড়া লাগাতে ওকে মেজভাই সাথে করে নিয়ে এসেছে?ওর তো বিয়ে হয় নাই?
——কি বলছো এসব? আমার তো কখনও ওকে বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলো না। ছোটোবেলা থেকে ওকে বোনের দৃষ্টিতে দেখেছি। তবে এটা ঠিক বিয়ের চেষ্টা করতেই মেজভাই আর ভাবি ওকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে।
——তাহলে শুধু শুধু আমার উপর রাগছো কেন? আমি তো ভুল কিছু বলিনি? আমি এখন কাউকে বিশ্বাস করি না। হয়ত তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্য ঐ শয়তান রফিককে কেউ ব্যবহার করেছে। আমি যদি বুদ্ধি না খাটাতাম তাহলে ওখানে এক নোংরা কাহিনী তৈরী করে হয়ত তোমার সাথে আরিফার আবার বিয়ের ব্যবস্থা করতো?
—–না জেনে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয়।
হিমেলের নিজের পরিবারের প্রতি ডিফেন করা দেখে সুচরিতার মাথার চাঁদি যেন গরম হয়ে গেল। ও রেগে মেগে আরোও কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে লাগলে হিমেল ওকে জড়িয়ে ধরে। তারপর আলতো করে বিছানায় শুয়ে দেয়। সুচরিতা ঐ মুহুর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। হিমেল চিৎকার করে লাকিকে ডেকে এক গ্লাস পানি আনতে বললো। চিৎকার শুনে তৈয়বা এসে দেখে হিমেল সুচরিতাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় বসে আছে। ও এই দৃশ্য দেখে হিমেলকে বললো,
——আব্বু তুমি আর আম্মু কি ভালোবাসাবাসি করছো?
তৈয়বার কথা শুনে হিমেল এতো টেনশনের মধ্যেও হেসে ফেললো। ততক্ষণে লাকি পানি নিয়ে এসেছে। হিমেল সুচরিতার মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বললো,
——তোর মা যে রকম রেগে থাকে এতে আর ভালোবাসার সাহস থাকে না। ইদানিং তোর মায়ের মেজাজ বুঝে চলতে হয়।
পানির ঝাপটা দেওয়াতে সুচরিতার জ্ঞান ফিরে আসলো। হিমেল সুচরিতার মুখের উপর ঝুঁকে বললো,
—–এখন কেমন ফিল করছো?
সুচরিতা ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তারপর বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,
—–অত ন্যাঁকামী করতে হবে না। যাও তোমার মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে আর একটা বিয়ে করো।
——সুচরিতা সবার ভালোবাসার প্রকাশ এক হয় না। আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি এটা তোমায় বুঝাতে পারি না। এটা আমার ব্যর্থতা। বাদ দাও ওসব কথা।
মুচকি মুচকি হেসে বললো,
——মনে হয় কোনো সুসংবাদ আছে?
সুচরিতা ঝাঁঝ মেরে বললো
—–জানি না।
—–থাক তোমার জানতে হবে না। এখন থেকে রান্নার দায়িত্ব আমার। এই শরীরে তোমাকে কিচেনে ঢুকতে হবে না। আমি কিচেনে গিয়ে তোমার জন্য স্যুপ বানিয়ে আনছি?
একথা বলে হিমেল বিছানা থেকে নেমে লাকিকে নয়ে কিচেনে গিয়ে স্যুপ বানাতে গেল। সুচরিতার সেদিন ঐ কথাগুলো বলার পর যতদিন আরিফা ছিলো হিমেল আর ও বাড়িতে যায়নি। তিনমাস পর আরিফা যশোরে চলে যায়। এতে হিমেলর মামা আরোও রেগে যায়। এতো বড় মুখ করে সোহেল নিয়ে গেল। অথচ বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারলোনা এতে মামা মামী দুজনেই সোহেলের উপর রেগে গেল।
যাক এবার কনসিভ করার পর সুচরিতাকে আগের মতো এতো প্যারা সইতে হয় নাই। হিমেল পুরোটা সময় সুচরিতার যত্ন নিয়েছে। মাঝে মাঝে সাবেরা এসে দেখা করে যেতো। হিমেল ও বাড়িতে যেতে না পারলেও সাবেরার হাতে ওর মায়ের জন্য টাকা দিয়ে পাঠাতো। কখনও আবার সুসমিতা আর ওর মা এসে সুচরিতাকে দেখে যেতো। এদিকে ডেলিভারীর সময় ঘনিয়ে আসলো। সুসমিতা এসে তৈয়বার সাথে থাকলো। হিমেল সুচরিতাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করলো। এবারও সুচরিতার মেয়ে হয়। এখবর তৈয়বার দাদীর বাড়িতে পৌঁছে গেলে সাবেরা আর জোহরা এসে সুচরিতা আর ওর বাচ্চাকে দেখে যায়। কিন্তু ওর দাদী চাচা চাচী কেউ বাচ্চাটাকে দেখতে আসেনি।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-একত্রিশ
মাহবুবা বিথী
সুচরিতা এখন আর আগের সুচরিতা নেই। তাই ওর এবারও মেয়ে হওয়াতে এটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। আর কে খুশী হলো আর রাগ করলো এটা নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই। এই জন্য কে দেখতে আসলো না আর আসলো এটা ওর কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। মানসিকভাবে ও এখন খুব শক্ত ধাঁচের মেয়ে। অথচ ও খুব নরম প্রকৃতির মেয়ে ছিলো। বিয়ের পর থেকে চারপাশে বসবাস করা স্বার্থপর মানুষগুলোর আঘাতে নিজেকে যেন আস্তে আস্তে ইস্পাতের মতো কঠিন করে তুলেছে।বরংআল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করে একদিন এমন দিন যেন ওর ভাগ্যে আসে ওর মেয়েদের চেহারা যেন ওর শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলো বার বার দেখতে চায়। ওর মেয়েদের যেন ও সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে পারে। দুটো মেয়ে সুচরিতার সংসারে আল্লাহপাকের দেওয়া রহমত। শুধু আল্লাহপাকের কাছে ওর এইটুকু প্রার্থনা ওর মেয়েদের ভাগ্য যেন ওর মতো না হয়। তবে আল্লাহপাকের কাছে ও একটা ছেলে সন্তান চায়।তবে সেটা শাশুড়ী বা অন্য কারো চাওয়া নয়। এটা ওর নিজের চাওয়া। আল্লাহপাক ওকে যেমন মেয়ে সন্তান দিয়েছে তেমনি যেন ছেলে সন্তানও দান করে। অবশ্য ওদের মেয়ে দুটো নিয়ে হিমেলেরও কোনো আক্ষেপ ওর নজরে পড়েনি। হিমেল খুব খুশী। হিমেল বাচ্চা খুব পছন্দ করে। যেমন তৈয়বাকে খাওয়াতে, গোসল করাতে বা ওকে সময় দেওয়াতে হিমেলের কোনো ক্লান্তি নেই। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে ও খুব পছন্দ করে।
সুচরিতা মাস্টার্সের রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে। বাচ্চা ছোটো সে কারনে অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা না করে গাইড কিনে বিসিএসের পড়াশোনা করতে লাগলো। ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। হিমেলও ওর ব্যবসায়িক ক্ষতি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। একটা টয়োটা করোল্লা গাড়িও কিনেছে। যদিও সুচরিতা এই মুহুর্তে গাড়ি না কেনার জন্য নিষেধ করেছিলো। কিন্তু হিমেল শোনেনি। কারণ কিছুদিন পর তৈয়বাকে স্কুলে দিতে হবে। ওর কথা চিন্তা করেই হিমেল গাড়ি কিনেছে। সবই ঠিকঠাক মতোই চলছে। শুধু ছুটির দিনগুলোতে মাঝে মাঝে হিমেল ওর শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে সময় কাটায় এটাই সুচরিতার বিরক্ত লাগে। সারাসপ্তাহে হিমেল অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারপর ছুটির দিনগুলো যদি ও বাইরে থাকে তাহলে সংসারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আটকে থাকে। সুচরিতা ছোটোমেয়েটার নাম রেখেছে তাকিয়া।
এদিকে হিমেলকে আবার এক সপ্তাহের জন্য থাইল্যান্ড যেতে হবে। এবার হিমেল সুচরিতাকে ওর বাপের বাড়িতে রেখে যায়। সুচরিতাও কয়েকটা দিন ওর ভাইবোন গুলোর সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পায়। যদিও জানে এবারও মেয়ে হওয়াতে ওর মা আবারও ওকে বলবে সুচরিতার সাত মেয়ে হবে তারপর ছেলে হলে হতে পারে। ওর মা নাকি সদ্যজাত বাচ্চার নাড়ি দেখে বলতে পারে এরপর ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে। তৈয়বার নাড়ি দেখে ওর মায়ের মনে হয়েছে এরপরে সুচরিতার মেয়ে হবে। এবারও সুচরিতার মেয়ে হওয়াতে ওর মা বললো সাত মেয়ে হওয়ার পর সুচরিতার ছেলে হতে পারে। যদিও সুচরিতা এগুলো বিশ্বাস করে না। কারণ এগুলো বিশ্বাস করা প্রচন্ড গুনাহ্ র কাজ।
বাপের বাড়িতে এসে ওকে যা শুনতে হলো সে জন্য মানসিকভাবে ও একদম প্রস্তুত ছিলো না। সুসমিতার কাছে জানতে পারলো ভিন্ন ধর্মমতালম্বি মেয়ের সাথে খোকনের সম্পর্ক হয়েছে। এই বিষয়টা সুচরিতা ওর মায়ের কানে তুললে ওর মা বলে,
——-ঐ মেয়ের সাথে খোকনের শুধুই বন্ধুত্ব হয়েছে। এর বেশি কিছু নয়।
বরং ওর মা গর্বভরে সুচরিতাকে বলে,
—–আমার ছেলে আমার পারমিশন ছাড়া কাউকে পছন্দ করবে না। এটা আমি জানি। আর তোরা আমার কেউ খেয়াল না রাখলেও খোকন আমার খেয়াল ঠিক রাখবে।
এ কথা শুনে সুসমিতা আর সুচরিতার মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। কারণ সংসারের চাকাটা সচল রাখতে সুসমিতাকে অনার্স ফাস্টইয়ারে চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে। সুচরিতাও চেষ্টা করে বাবার অসুখে যতটা পারে সাহায্য করে। আবার খোকনের লেখাপড়ার খরচও ওকে অনেকটা বহন করতে হয়। খোকনের এতো অবাধ্যতা সহ্য করেও দায়িত্ব পালন করতে হয় যখন মায়ের মুখে শুনতে হয় সুচরিতা খুব স্বার্থপর। বিয়ে করে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছে।অথচ বিয়ে করে কতটা সুখে আছে তা একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। সুচরিতা ওর সংসার জীবনের সুখ দুঃখের কথা কখনও কারো কাছে এমনকি নিজের মা ভাইবোনের কাছে শেয়ার করে না। বরং ওর মনে হয় কষ্টের কথাগুলো জানলে সুযোগ পেলেই ওর আপনজনেরা ওকে খোঁটা দিয়ে সবার আগে রক্তাক্ত করবে। পাশে এসে দাঁড়ানোর প্রশ্নই আসবে না। এর থেকে নিজের কষ্ট যন্ত্রণাগুলো নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখা ভালো।
আর ও এও জানে ওর বাবা অসুস্থ হওয়ার কারনে ওর মায়ের সংসারে তেমন সচ্ছলতা নেই। এই কারনে ওর শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলোর পর্যাপ্ত আদর আপ্যায়ন ওর মা ঠিকমতো করতে পারে না। যতদিন ওর বাবা সুস্থ ছিলো ঈদ পার্বনে আনুষ্ঠানিকতা করতে পেরেছে ততদিন শাশুড়ী মায়ের ভালোবাসাও পেয়েছে। এখন ওর বাবা এসব আনুষ্টানিকতা করতে পারে না তাই শ্বশুরবাড়িতে ওর তেমন কদর হয় না। এটা ও বুঝতে পারে। যদিও এই মতাদর্শের সাথে ও একমত নয়। তাই সুচরিতাও ওর জীবনের এই ভবিতব্যকে মেনে নিয়েছে। ওর বাকি দুজনের জায়ের বাপের বাড়ি থেকে যে খুব মন্ডা মিঠাই আসে তা নয়। কিন্তু তারা শ্বশুরবাড়ির সব সিদ্ধান্তকে সানন্দে মেনে নেয়। পাশাপাশি কূটকচালীতে ওরা সিদ্ধহস্ত। তাই ওদের তেমন ঝামেলা হয় না। এদিকে কারিমার বাবা দুচারমাস পরপর এসে মেয়েকে দেখে যায়। কায়দা করে বেয়াইনকে শুনিয়ে যান। মেয়ের জন্য উনি ষোলশতক জমি লিখে দিবেন। এসব শুনে সুচরিতার শাশুড়ীও গলে যান। আর সোহেল এক ঠ্যাং আকাশে আর এক ঠ্যাং পাতালে দিয়ে হাঁটতে থাকে। সুচরিতা জানে এগুলো সবই মিথ্যাকথা। জাস্ট মেয়ে জামাইকে হাতে রাখার জন্য উনি এই কাজগুলো করেন। সুচরিতার বিয়ের পর থেকে হাতে করে কারিমার বাবাকে তেমন কিছু আনতে ও দেখেনি।
সামনে সুসমিতার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। একদিকে চাকরি অন্যদিকে পড়াশোনা সব মিলিয়ে ভীষণ চাপে থাকতে হয়। সুচরিতা খুব তোড়জোড় দিয়ে ওর জন্য ছেলে খুঁজছে। যদি ওর বিয়ে হয়ে যায় তাহলে মায়ের সংসারের দায়িত্ব তো খোকনকে নিতে হবে। অথচ বিকম ভর্তি হয়ে ও নিশ্চিন্তে সময় কাটায়। সংসারের এসব বিষয় নিয়ে খোকনের কোনো হেলদোল নেই। এরমাঝে সুসমিতার একজন পরিচিত খোকন আর ঐ মেয়েকে খুব ঘনিষ্ট অবস্থায় রমনা পার্কে দেখেছে। এই বিষয়টা সুসমিতা সুচরিতাকে জানালো। কিন্তু সুচরিতা চুপ থেকে গেল।
যেহেতু খোকনের উপর মায়ের আত্মবিশ্বাস অনেক বেশী। এই কারনে এসব কথা তুলে অশান্তি করতে মন চাইলো না। বরং সুসমিতাকে শোভনের দিকে খেয়াল রাখতে বললো। যদিও সুচরিতা জানে ওর মায়ের ছেলে প্রীতির কারনে ওর ভাইয়েরা ওদের বোনদের কথা মাথায় নেয় না। শুধু প্রয়োজনের সময় বোনদের খুব দরকার লাগে। ওদের মা তখনও ছেলেদের পক্ষেই কথা বলে।
সাতদিন পর হিমেল থাইল্যান্ড থেকে ফিরে সুচরিতা তৈয়বা, তাকিয়া আর লাকিকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। এরমাঝে সুচরিতা খবর পায় কারিমার আর একটা মেয়ে হয়েছে। এমনকি ওর বড় জা সখিনারও মেয়ে হয়েছে। সুচরিতা ওর শাশুড়ীর চেহারাটা মনে করে খুব হাসি পেলো। একেতো উনি মেয়ে পছন্দ করেন না কিন্তু আল্লাহপাক উনার কপালজুড়ে মেয়েই রেখেছেন। সুচরিতা এখন মোটামুটি ভালোই আছে। এর মাঝে বছরখানিক সময় পেরিয়ে গেলো।
এরমধ্যে সুচরিতা আবারও কনসিভ করলো। এটা এক্সিডেন্টলি হয়ে গেছে। হিমেল বেবিটাকে রাখতে চাইছে না। কারণ ডাক্তার বলেছে এতে সুচরিতার জীবনহানির শঙ্কা আছে। প্রেগনেন্সি পিরিয়ডে সুচরিতার শরীরে প্রচন্ড পানি আসে। এছাড়া ওর যেহেতু সিজার করে বাচ্চা হয় সেই কারনে একবার এনাসথেসিয়া দেওয়ার পর তিনবছর না হলে আবার এনাসথেসিয়া দিলে অনেক সময় স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু সুচরিতা এবরশন করতে চায় না। একদিকে তাকিয়ার বয়স তখন সবে মাত্র একবছর। আর তৈয়বার বয়স চার বছর। এবার খুব কষ্ট হয় সুচরিতার। তবে আল্লাহর রহমতে সময়টা ভালোভাবেই পার হয়ে যায়। যথাসময়ে ডেলিভারীর সময় হয়। সুসমিতার কাছে তৈয়বা আর তাকিয়াকে রেখে সুচরিতা হাসপাতালে ভর্তি হয়। শরীরে প্রচন্ড পানি আসাতে আর তৃতীয় সিজার হবে বলে ডাক্তার দুই সপ্তাহ আগেই অপারেশন করে ফেলে। এবার সুচরিতার ছেলে হয়। এখবর ওর শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথে শাশুড়ী মা বিশ কেজি মিষ্টি কিনে মহল্লায় বিলিয়ে দেন। তারপর সাবেরাকে নিয়ে নাতী দেখার জন্য হাসপাতালে রওয়ানা দেন। বারো বছর পর উনি আবার নাতীর মুখ দেখলেন। এদিকে সুচরিতার শারীরিক কন্ডিশন একটু খারাপ। একলাম্পশিয়ার লক্ষণ দেখা যায়। বাচ্চা হওয়ার পরে ওর শরীরে খিঁচুনী শুরু হয়।
চলবে