#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-আটাশ
মাহবুবা বিথী
সুচরিতা একক পরিবারে বড় হয়েছে। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারে বউ হয়ে মনে মনে খুশীই হয়েছিলো। অথচ যৌথ পরিবারে বৈরিতা ক্ষোভ,হিংসা,কূটকচাল আর বৈষম্যের যে টানাপোড়েন সর্বদাই চলতে থাকে এদিকটা ওর জানা ছিলো না। তবে বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতে এটুকু ও বুঝতে পেরেছে কেন সোহেল হিমেলকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। কারণ হিমেল ছিলো বাবা মায়ের বাধ্য সন্তান। সংসারের প্রতি প্রচন্ড দায়িত্ববান। সেই কারনে মায়ের ভালোবাসা বাপের আদর বড়ভাইয়ের স্নেহ সবই ও ছোটোবেলা থেকে সোহেলের থেকে বেশী পেয়ে আসছে। বিয়ের আগে যদিও সোহেল এই বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে কিন্তু বিয়ের পর কারিমার প্রতিনিয়ত কূটকচালীতে সোহেল হিমেলকে আর স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। নিজের ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে হিমেলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠে। হিমেলকে সর্বদাই অশান্তিতে রাখতে পারলে ওর ভিতর একধরনের পৈশাচিক আনন্দ অনুভব হয়। সুচরিতার কাছে মনে হয় এটা এক ধরনের মানসিক বৈকল্য। কারিমাও ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকেই সুচরিতার পিছনে লেগে থাকতো। সুচরিতা এটা বুঝতো বলেই কখনও হিমেল যে সবার থেকে বেশী আয় করে এই ভাবটা দেখায়নি। কিংবা হিমেলের টাকায় এই সংসারের সিংহভাগ খরচ বহন করা হয় সেটা নিয়েও কখনও সুচরিতা বড়াই করেনি।
কারণ যেদিন ও এবাড়িতে বউ হয়ে আসে শাশুড়ী মা বলেছিলেন,”ও যেন এই পরিবারটিকে একসাথে বেঁধে রাখে”। ও শাশুড়ী মাকে বলেছিলো,ও ওর সমস্তটা দিয়ে এই পরিবারটিকে আগলে রাখবে।
কিন্তু কূটকচালীর প্যাঁচে পরে শাশুড়ী মা আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগলেন। তারপরও মুখ বুঁজে সব অন্যায় মাথা পেতে নিয়ে এই সংসারের ভাঙ্গন সুচরিতা ঠেকাতে চেয়েছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলো না। সব যৌথপরিবারে হয়ত এরকমটা হয় না। অনেক যৌথ পরিবারে সহযোগিতা আর সহমর্মিতার বন্ধনে একই বিঁনি সুতায় নিজেদের বেঁধে রাখে। সুচরিতা ভাবে ওর ভাগ্যটা মনে হয় আসলেই খারাপ নয়তো ওর ভাগ্যে এ রকম ঘটবে কেন? হিমেলের ডাকে ভাবনার ডালপালা থেকে সুচরিতা বেরিয়ে আসলো।
——কি ব্যাপার মুর্তির মতো বসে আছো কেন? তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও। কোথায় উঠবো জানি না। আপাতত একটা আবাসিক হোটেলে উঠে যেতে চাই। অফিসের ম্যানেজারকে বলেছি। যে কোনো একটা আবাসিক হোটেলে রুম বুকিং দিতে।
হিমেল আর সুচরিতা তিনটে ট্রলি ব্যাগ আপাতত গুছিয়ে নিয়েছে। হিমেল ওর মায়ের রুমের দরজার কাছে যেতেই ওর মা মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর চিৎকার করে বলে,
——মনে রাখিস, বউয়ের তালে পরে আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে তুই চলে যাচ্ছিস। না,জানি এর জন্য তোকে কত বড় মাসুল গুনতে হয়।
শাশুড়ীর মুখে এ কথা শুনে সুচরিতার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। এরপর হিমেল
গাড়ির চাবিটা নিতে গেলে সোহেল এসে বলে,
——যৌথ পরিবারের আয় দিয়ে এই গাড়ি কেনা হয়েছে। সুতরাং এ গাড়ি নেওয়ার কোনো অধিকার তোমার নেই।
হিমেলও এ কথার কোন উত্তর দিলো না। অতঃপর নিজের স্ত্রী সন্তান আর কাজের সহকারী লাকিকে নিয়ে অজানা ভবিষ্যতের উদ্দেশ্য ছোটো থেকে বড় হওয়া,কত স্মৃতিতে ভরা, এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় রোমেল সুচরিতাকে ডেকে বললো,
——স্বেচ্ছায় এ বাড়ির চৌকাঠ যখন ডিঙ্গালে তখন কোনদিন আর ফেরার আশা করো না। আর যদি ফিরে আসতে চাও মাথা নিচু করে ফিরে আসতে হবে।
সোহেল আর কাঠি এগিয়ে এসে বললো,
——-সেদিন এ বাড়ির দরজায় জুতো টাঙ্গিয়ে দেওয়া হবে। তোমাকে সেই জুতোর তলা দিয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে।
সুচরিতা কথাগুলো শুনে অনেক অপমানিত বোধ করলো। নিরবে চোখের পানি ফেলে মনে মনে বললো,হয়ত এমনও একদিন আসবে ধরে বেঁধে ওকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। আজ সুচরিতা এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় পরমকরুনাময় আল্লাহপাকের কাছে এই প্রার্থনা করে বের হলো।
সুচরিতা হিমেলের মুখপানে চেয়ে দেখলো, চোখের কোণটা জলে চিকচিক করছে। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য সুচরিতার কোনো দায় নেই। তবু বিনা অপরাধে যে অপমান আজ ওকে সয়ে নিতে হলো এর ফয়সালা ও আল্লাহপাকের উপর ছেড়ে দিলো।
হিমেল উবার কল করলো। ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই সুচরিতার পায়ের সেন্ডেলটা ছিঁড়ে গেল। মনটা জানি কেমন করে উঠলো। উবার চলে আসাতে পায়ের সেন্ডেল জোড়া হাতে নিয়ে সুচরিতা তৈয়বাকে সাথে নিয়ে গাড়িতে বসলো। লাকি সুচরিতার পাশে বসলো। লাগেজগুলো গাড়ির বনেটে রেখে হিমেল ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলো। ওরা মতিঝিলে একটা আবাসিক হোটেলে আপাতত উঠে গেল। সাভারের হেমায়েতপুরে হিমেলের গার্মেন্টসের ফ্যাক্টরি আছে। ও ওর ম্যানেজারকে ফ্যাক্টরির পাশেই বাসা ভাড়া নিতে বললো। হিমেল ভাবছে মতিঝিলের অফিসটা ছেড়ে দিয়ে হেমায়েতপুরে অফিস ভাড়া নিবে। গাড়ি যেহেতু নেই তাই অফিস কারখানা আর বাসা কাছাকাছি থাকলে হিমেলের মুভ করতে সুবিধা হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে হিমেল সব গুছিয়ে বাসায় উঠে গেল। খরচের এক বিশাল ধাক্কা ওকে সামলাতে হলো। খাট, আলমারী,ফ্রীজ, একসেট সোফা,ডাইনিং টেবিল কিনতে হলো। মোটামুটি গুছিয়ে নিয়ে হিমেল অফিস শুরু করলো। এর মাঝে সুচরিতা মাকে ফোন দিয়ে ওর বৃত্তান্ত জানিয়ে দিলো। তখনই শুনতে পেলো খোকন এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিবে না। কারণ জানতে চাইলে ওর মা বললো,খোকনের অ্যাডমিট কার্ড আসে নাই। যদিও ওর মা খোকনের কথা বিশ্বাস করেছে। খোকন বলেছে ফরমফিলাপে ভুল থাকার কারনে অ্যাডমিট কার্ড আসে নাই। কিন্তু সুচরিতার মনে হলো,সামথিং রং। নিশ্চয় খোকন ফরমফিলাপের টাকাগুলো দিয়ে বন্ধু বান্ধব নিয়ে মাস্তি করে উড়িয়েছে। ওর মাকে এ কথা জানালে উনি এসব বিশ্বাস করতে চাইবেন না। উনার ধারণা খোকনের মতো ছেলে হয় না। তার ছেলে দুধে ধোওয়া তুলশি পাতা। সুচরিতার চিন্তা হয়, না জানি এই ছেলের জন্য ওর মাকে কি দিন দেখতে হয়?আবার হয়ত সুচরিতাকে হিমেলের কাছে ফরমফিলাপের টাকা চাইতে হবে। কোন মুখে সুচরিতা হিমেলের কাছে আবার টাকা চাইবে?
সুচরিতার আলাদা সংসার হলো ঠিক কিন্তু হিমেল কেন জানি বদলে যেতে লাগলো। আগে যখন যৌথ পরিবারে ছিলো তখন হিমেলের সুচরিতার জন্য একটা গিলটি কাজ করতো। কারণ হিমেলও জানতো সুচরিতাকে অনেক মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়। হিমেল ওকে তখন মায়াও করতো। কিন্তু এখন হিমেলের মাঝে সুচরিতা সেই জিনিসটা খুঁজে পায় না। যাক সুচরিতা ভাবছে এতো বড় ধাক্কাটা সামলে নিতে হিমেলকে একটু সময় দেওয়া উচিত।
সেদিন দুপুরে লাঞ্চ করে হিমেল অফিসে চলে যাবার পর সুচরিতাও বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ডোরবেলটা বেজে উঠলো। ও একটু অবাক হলো। এই অসময়ে আবার কে আসলো?সুচরিতা দরজার সিকিউরিটি মিরর দিয়ে দেখে অবাক হলো।
বুঝে পেলো না উনি ঠিকানা কোথা থেকে যোগাড় করলেন। দরজা খুলে সালাম দিয়ে সুচরিতা বললো,
——আপু আপনি? বাসার ঠিকানা পেলেন কোথায়?
——তোমার কি ধারণা আমি ঠিকানা যোগাড় করতে পারবো না? কতদিন আমার সাথে হিমেলের দেখা হয় না। তাই ভাবলাম কলেজ ছুটির পর তোমার বাসা হয়ে যাই।
——না,আমি তা বলিনি। আসলে একসপ্তাহের মধ্যে বাসা খুঁজে শিফট হওয়া বড্ডো কঠিন। তারপর এখন মাসের মাঝামাঝি। বাড়িওয়ালা সে হিসাবে দু,মাসের টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছে। যেখানে একমাসের নেওয়ার কথা। এইসব নানা ঝামেলায় আপনাদের কারো সাথে যোগাযোগ করা হয়ে উঠেনি। সে জন্যই কথাটা বলা।
——না,ঠিক আছে। আমি কিন্তু দুপুরে লাঞ্চ করিনি।
——ঠিক আছে সমস্যা নাই। আমি ব্যবস্থা করছি।
——-হিমেল অফিস থেকে কখন আসে?
——আসলে ওর টাইমের ঠিক নাই। কখনও সন্ধা ছ,টার সময় কখন বা মাগরিবের সময় বাসায় আসে। আমি কি ওকে ফোন দিয়ে আপনার আসার কথা জানাবো?
—–না,তার দরকার নেই। আমি হাতে সময় নিয়ে এসেছি।
সুচরিতা তাড়াহুড়ো করে চিংড়ি মাছ ভুনা করলো। ডিম ভাজি, বেগুন ভাজি আর পটল দিয়ে রুই মাছের ঝোল আগেই রান্না করা ছিলো। ঐ দিয়ে সাবেরা দুপুরের খাবার খেয়ে তৈয়বার পাশে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সুচরিতা ঠিকই বুঝেছে হিমেলকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিতে এসেছে। সুচরিতা সাবেরাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের বই নিয়ে পড়তে বসলো। দু,মাস পর ওর মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা। আজ হিমেল পাঁচটার মধ্যেই বাসায় চলে আসলো। সাবেরাকে দেখে হিমেল জিজ্ঞাসা করলো,
——বাসার ঠিকানা পেলে কোথায়?
——তোর ম্যানেজারের কাছে নিয়েছি।
——ভাত খেয়েছো?
——হুম,তোর এখানেই খেলাম।
এরপর হিমেল একদম নিরব হয়ে গেল। ঘরে পিনপতন নিস্তদ্ধতা নেমে এলো। হিমেল ওয়াশ রুম থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে এসে গম্ভীর হয়ে বিছানার এক পাশে বসে পড়লো। নিরবতা ভেঙ্গে সাবেরা জিজ্ঞাসা করলো,
——মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলি না?
——মা,তো তার পেয়ারের সন্তান নিয়ে ভালোই আছে। আমি তো তার কুলাঙ্গার সন্তান।
—–আমার কথা শোন,এসব ফাউল কথা রাখ। মায়ের কাছে তোরা দু,জন মাফ চেয়ে বিষয়টা মিটিয়ে ফেল।
—–তুমি তো সেদিন ছিলে না। আমাকে আর সুচরিতাকে ওরা সবাই মিলে যে অপমান করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মনে করো শুধু মারতে বাকি রেখেছে।
——একসাথে থাকতে গেলে ওরকম এক আধটু হয়। ওটা নিয়ে ধরে থাকলে চলবে না। ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেল।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-ঊনত্রিশ
মাহবুবা বিথী
——আপু এটা এক আধটু ছিলো না।
——-তুই যে এভাবে চলে আসলি তোর একবারও মনে হলো না মায়ের সংসারটা কিভাবে চলবে?
——ওরাও তো আমার কথা ভাবেনি। দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে গেছে। সারাদিন অফিস করে বাসায় এসে আমাকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে হয়েছে। অথচ মেজ ভাই এতোগুলো টাকা নষ্ট করে বিদেশে গিয়ে একটা পয়সা আনতে পারলো না বরং ওর বউ বাচ্চার সমস্ত আমি খরচ বহন করেছি। বিদেশে যাওয়ার দশ লক্ষ টাকাও আমি দিয়েছি। অথচ ওর ভিতরে কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। এভাবে তো চলতে পারে না। আর যে সব নোংরা কথা সেদিন সে ব্যবহার করলো এতে আমি সুচরিতার কাছে ছোটো হয়ে গিয়েছি। বলে কিনা ওর জুতোর তলা দিয়ে সুচরিতাকে ও বাড়িতে ঢুকতে হবে।
——বিদেশে যাওয়ার টাকা তো তোর টাকা থেকে দিসনি?
——এটা তুমি কি বললে আপু? ব্যবসা আমাকে চালাতে হয়। ব্যবসার জন্য দিনরাত এক করে আমি পরিশ্রম করে যাচ্ছি। তাহলে এই টাকাটা আসলো কোত্থেকে? ওকে কতবার বলেছি আমার ব্যবসায় সাহায্য করতে। কিন্তু সে আমার সাবডিনেট হয়ে কাজ করতে পারবেন না। উনাকে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদ দিতে হবে। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব না। অথচ বিদেশে যাওয়ার নাম করে কতগুলো টাকা নষ্ট করলো। আমি আসরের নামাজ পড়ে আসি।
হিমেলের আসলে সাবেরার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। ও সাবেরার সামনে থেকে উঠে গিয়ে ওজু করতে ওয়াশরুমে চলে গেল। সুচরিতা কিচেনে গিয়ে পাকোড়া আর চা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে সাবেরাকে ডাকলো। এরমধ্যে তৈয়বা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। লাকি তৈয়বাকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। হিমেল নামাজ শেষ করে সাবেরার সাথে টেবিলে নাস্তা করতে বসে একটা প্যাকেট ওর হাতে দিয়ে বললো,
——এটা মায়ের হাতে দিও। বাড়ির বিদ্যুৎ বিল গ্যাস বিল আর সংসারের খরচের টাকা দেওয়া আছে।
——তোর কি ধারণা তুই মায়ের কাছে মাফ না চাইলে মা তোর এই টাকা ছুঁয়ে দেখবে? আর সোহেলের এসব করার ব্যাপারে কারিমার ইন্ধন আছে।
—–আমি তোমার সাথে একমত না। কেউ আমাকে ইন্ধন দিলো আর আমি তার কথাতেই নেচে সেই কাজটা করে ফেললাম? কাজটা ভালো কি মন্দ সেটা বিচার করবো না। তাহলে প্রতিটি মানুষকে আল্লাহপাক যে বোধ বুদ্ধি দিয়েছে সেটা কিসের জন্য?
সুচরিতাও কিচেন থেকে ওদের ভাইবোনের সমস্ত কথাই শুনতে পেলো। ও মনে মনে ভাবছে এতো অপমানের পর ও বাড়িতে ওর ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। মাগরিবের আযান শোনা যায়। সুচরিতা ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো। হিমেলও নামাজ পড়ে সাবেরাকে উবার ডেকে গাড়িতে তুলে দিয়ে বাসায় চলে আসলো। বিছানায় শুয়ে আজ কিনে আনা বিমলমিত্রের “কড়ি দিয়ে কিনলাম” বইটা পড়া শুরু করলো। সুচরিতা হিমেলের পাশে এসে বসলো। বইয়ের দিকে তাকিয়ে হিমেল ওকে বললো,
——কিছু বলবে?
—–হুম।
——এতো হেজিট্যাট না করে বলে ফেলো।
——আমি ও বাড়িতে ফিরে যাবো না। মেজভাই যে অপমান আমায় করলো এরপর ও বাড়িতে ফিরে গেলে বেঁচে থাকাই আমার জন্য মুশকিল হয়ে যাবে। বলে কিনা আমি যদি কোনোদিন ফিরে যাই তাহলে জুতোর তলা দিয়ে ফিরতে হবে।
হিমেল ওর কথার কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। এটা দেখে সুচরিতা মনে মনে হিমেলের উপর রেগে গেল। এরপর একটু খোঁচা দিয়ে বললো,
——তুমি কি এই বইটা আগে পড়েছো?
—–বইটা পড়িনি। তবে সিনেমাটা দেখেছি। অপর্না সেন, মৌসুমি চ্যাটার্জি আর তাপসপাল দুর্দান্ত অভিনয় করেছে।
——হুম। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সইতে না পেরে সতীকে বের হয়ে যেতে হয়েছিলো। পরে যখন ফিরে এসেছিলো ওর স্বামীর জুতো জোড়া মাথায় করে ও বাড়ির দাস দাসী থেকে শুরু করে সবার সামনে দিয়ে হাঁটতে হয়েছিলো। কি অপমান! অথচ তখনও মানুষের ঘরে ঘরে এখনকার মতো এতোটা শিক্ষার আলো জ্বলেনি। অথচ আজ এতোদিন পরও সমাজের সেই চিত্রটা যেন এক জায়গাতে আঁটকে আছে। তাই মেজভাই গর্বভরে আমাকে বলতে পারলো, ও বাড়িতে ফিরতে হলে জুতোর তলা দিয়ে ফিরতে হবে। কি নোংরা মানসিকতার মানুষ মেজভাই!
——এখানে কারিমা ডাইনীর ইন্ধন আছে।
যদিও হিমেল এই মুহুর্তে কারিমার উপর দায় চাপাচ্ছে কিন্তু ও নিজেও জানে সোহেল সমান দোষে দোষী।
সোহেলের এসব কথা শুনে হিমেলেরও খারাপ লেগেছে। সুচরিতার অপমানে ওর কতটুকু খারাপ লেগেছে সেটা সময় বলে দিবে কিন্তু সোহেল এসব কথা বলে সুচরিতার কাছে নিজের সম্মান হারালো এই বিষয়টা হিমেলকে বেশ পীড়া দিচ্ছে। হিমেল সুচরিতাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
——তোমাকে অপমান করেছে বলেই তো আমার আপনজন সবাইকে ছেড়ে তোমার হাত ধরে বেড়িয়ে আসলাম।
সুচরিতা নিজেকে হিমেলের বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করে বললো,
—–আমার জন্য বের হয়ে এসেছো কিনা সেটা সময় বলবে। তবে এ ছাড়া তোমার অন্য কোনো পথও খোলা ছিলো না।
একথা বলে সুচরিতাকে তৈয়বাকে খাওয়াতে চলে গেল।
এরমাঝে ছ,মাস পার হয়ে গেল। মাঝে মাঝে সাবেরা আসে। এ ছাড়া ও বাড়ির কারো সাথে সুচরিতার যোগাযোগ নেই। খুব ভালোভাবেই মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলো। ছুটির দিনগুলোতে হিমেল সুচরিতা তৈয়বা আর লাকিকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। যদিও সুচরিতা ভালোভাবেই বুঝতে পারে হিমেল ও বাড়ির মানুষগুলোকে মিস করে। এর মধ্যে হিমেল দু,বার গিয়ে ওর মায়ের সাথে দেখা করে এসেছে। হিমেল যেদিন ও বাড়ি থেকে ঘুরে আসে ওর মুড খুব অফ থাকে। সুচরিতার সাথে তেমন কথা বলে না। তৈয়বাকেও কোলে নেয় না আদরও করে না। আজও হিমেল ও বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে সন্ধা হয়ে গেল। ঘরে এসে একই রকম আচরণ করা শুরু করলে সুচরিতার মেজাজ বিগড়ে যায়। তৈয়বা হিমেলের কোলে উঠার জন্য কাঁদতে থাকে। কিন্তু হিমেল ওকে কোলে না নিয়ে মটকা মেরে বিছানায় শুয়ে থাকে। এতে সুচরিতা রেগে গিয়ে হিমেলকে বলে,
——এতো অপমান আর অসম্মানের পর যদি ও বাড়ির মানুষগুলোর প্রতি তোমার এতো টান থাকে তাহলে ডং করে আমার হাত ধরে বেড়িয়ে এসেছো এ কথা বলার দরকার ছিলো না। তুমি ও বাড়িতেই থেকে যেতে। আমার মেয়ে আর আমাকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে।
——আমি একটু নিজের মতো শুয়েও থাকতে পারবো না?
—–শুয়ে থাকাতে দোষ নেই। কিন্তু তুমি আমার আর সুচরিতার সাথে এমন ভাব করছো এই পরিনতির জন্য আমি দায়ী। তবে আমি তোমায় বলে দিচ্ছি কটাদিন সময় দাও ও বাড়ির মানুষগুলো তোমাকে পায়ে সেঁধে নিয়ে যাবে।
——তুমি এখন আবার ও বাড়ির মানুষগুলোর পিছনে লেগে আছো কেন?
হিমেল রেগে গিয়ে সুচরিতাকে খোঁচা দিয়ে বললো,
—–দিন তো এখন তোমার। সোনার খাটে মাথা আর রুপোর খাটে পা দিয়ে ঘুমাতে পারবে।
——আল্লাহপাক যদি কপালে রাখেন তাহলে ঘুমাবো।
এরপর হিমেলকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তৈয়বাকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেল।
এভাবেই নানা টানাপোড়েনে সুচরিতা আর হিমেলের সংসার জীবন পার হতে লাগলো। সেদিন ছিলো ছুটির দিন। ছুটির দিনগুলোতে ওরা একটু দেরী করে ঘুম থেকে উঠে। সকাল সাতটায় বিকট শব্দে ডোর বেলটা বেজে উঠলো। হিমেল সুচরিতাকে সোহাগ দেখিয়ে বললো,
——একটু উঠে দেখোনা ডার্লিং এই সাতসকালে কোন মুখপোড়া এসে হাজির হয়েছে।
——তুমি গিয়ে দেখোনা,আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না।
——প্লিজ যাও না একটু।
অগত্যা সুচরিতা বিছানা থেকে উঠে দরজার মিরর দিয়ে আগুন্তককে দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। দরজা না খুলেই ঘরে এসে হিমেলকে বললো,
——ছোটো আপার চাচাতো দেবর রফিক এ বাড়ির ঠিকানা কিভাবে পেলো?
——তা আমি কি করে জানবো।
এ কথা বলে হিমেল বিরক্তভরে বিছানা থেকে উঠে গায়ে শার্ট জড়িয়ে দরজা খুলে বললো,
—–আপনি এখানকার ঠিকানা কোথায় পেলেন?
——কাল তোমার অফিসে গিয়েছিলাম। তোমার ম্যানেজারের কাছ থেকে যোগাড় করেছি।
——ফোন করলেই পারতেন?
——আসলে আমার আগের ফোনটা ছিনতাই হয়ে গেছে। এটা নতুন মোবাইল। এখানে তোমার নাম্বার সেইফ করা নেই। আসলে তুমি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছো। ছুটির দিয়ে বউ নিয়ে শুয়েছিলে আমার মতো উঠকো আপদ এসে পড়াতে তোমার বিরক্ত হওয়ার ই কথা। তারউপর তোমার বউ যে সুন্দরী।
সুচরিতার প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো। হিমেল ঐ আপদকে ড্রইং রুমে বসিয়ে সুচরিতাকে চা বানাতে বলে ওয়াশরুমে গেল। সুচরিতা চা বানিয়ে লাকির হাতে ড্রইংরুমে সাথে বিস্কিট দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। হিমেলও এসে উনার সাথে অংশ নিলো। উনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হিমেলকে বললো,
——আজ তোমার বউয়ের নরম হাতের পরোটা খাবো।
——এগুলো কি ধরনের কথা।
——আমরা তো বেয়াই। একটু ঠাট্টা মশকরা করি আর কি!
——না এভাবে কথা বলা সুচরিতা পছন্দ করে না।
——কি বেয়াই এখন কি বউয়ের পছন্দ অপছন্দ ছাড়া এক পা হাঁটা হয় না।
হিমেল বিরক্ত হয়ে উঠে এসে সুচরিতাকে বললো,
—–উনাকে একটু নাস্তা দেওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা করো। আপদ বিদেয় হোক।
—–তবে ঐ লোকেট স্বভাব চরিত্র সুবিধার মনে হচ্ছে না। তুমি উনাকে বলে দিবে তোমাকে ফোন না দিয়ে যেন এখানে না আসে। তুমি বাসায় না থাকলে আমি দরজা খুলবো না। আর তোমার ম্যামেজারকে বলবে এরপর তোমার অনুমতি ছাড়া কাউকে যেন বাড়ির ঠিকানা না দেয়।
হিমেল দ্রুত নাস্তা খাইয়ে দিলো। যাওয়ার সময় খ্যাক খ্যাক করে হেসে হিমেলকে বললো,
—–ভাবীকে ডাকো চাঁদ মুখ খানা একবার দেখে যাই।
হিমেল সুচরিতাকে ডাকলো। খুব কুৎসিতভাবে সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–আজ আসি তাহলে। মাঝে মাঝে এসে আপনার নরম হাতের নাস্তা খেয়ে যাবো।
এর মাঝে দু,দিনের জন্য ব্যবসার কাজে হিমেলকে সিঙ্গাপুর যেতে হবে। সেদিন অফিসে রফিক এসেছিলো। হিমেলের ব্যস্ততা দেখে বললো,
—–কোথাও যাচ্ছো নাকি?
——হুম একটু সিঙ্গাপুর যেতে হচ্ছে।
—–ভাবিও যাচ্ছে নাকি?
——নাহ,ওরা এখানেই থাকবে। তবে আপনি আবার এরমধ্যে আমার বাসায় যাবেন না। সুচরিতা কিন্তু দরজা খুলবে না।
রফিক মুখে কিছু বললো না। তারপর হিমেল বাড়িওয়ালাকে ওর দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়টা জানালো। আর দারোয়ানকে দুশো টাকা বখশিস দিয়ে সুচরিতার দিকে খেয়াল রাখতে বলে সিঙ্গাপুর পাড়ি জমালো। ওর ফ্লাইট ছিলো রাত দশটায়। তাই সন্ধা সাতটার মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। ঠিক রাত আটটায় সুচরিতার ডোরবেলটা বেজে উঠলো। দরজার ছিদ্র দিয়ে সুচরিতা তাকিয়ে দেখে দরজার সামনে রফিক এসে দাঁড়িয়ে আছে। বেল বাজাতে লাকি বলে উঠলো,
—–কে আপনি?
রফিক খেঁকিয়ে উঠে বললো,
—–কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি দরজা খুলছিস না কেন?
সুচরিতা লাকিকে কি বলতে হবে শিখিয়ে দিলো।
ও তখন আবারো বললো,
—–আপনাকে চিনি না তাই দরজা খোলা হবে না।
——ভালোই ভালোই দরজা খোল, নয়ত দরজা ভেঙ্গে ঢুকবো।
সুচরিতা ঐ লোকের সাহস দেখে অবাক হলো। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোক আসার পিছনে ওর শ্বশুরবাড়ির কেউ জড়িত আছে। সিনেমায় এসব ভিলেন ও দেখেছে। কিন্তু সত্যি সত্যি ওকে এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। ওর চরিত্রে মনে হয় কলঙ্ক লাগানোর চেষ্টা করছে কেউ। কে জানে,এর সাথে ওর মেজ ভাসুর আর ছোটো ননদ জড়িত আছে কিনা? লাকিকে বললো,”তুই বল আপনি যদি ভালোই ভালোই এখান থেকে না যান তাহলে আমি দারোয়ান ডাকতে বাধ্য হবো।
লাকিও সেইম উত্তর দেওয়াতে রফিক রেগে গিয়ে বললো,
——তোর এতো বড় সাহস দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।
এ,কথা বলে জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
চলবে