#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-ছাব্বিশ
মাহবুবা বিথী
সুচরিতা সোহেলকে দেখে সালাম দিয়ে বললো,
—–ভাইয়া আপনি কোনো খবর না দিয়ে আসলেন। আগে জানলে আপনার ভাই এয়ারপোর্টে গিয়ে আপনাকে আনতে পারতো?
একথা বলে সুচরিতা তাকিয়ে দেখে সোহেলের হাতে একটা মাত্র ট্রলি ব্যাগ। সুচরিতা একটু অবাক হয়। এতোদিন পর বিদেশ থেকে ফিরলো কারো জন্য কি কিছুই আনেনি? উনার তো আবার চাকরি নাকি ছিলো না। অবশ্য যাদের অন্যের ঘাড়ে বসে খাওয়ার অভ্যাস তাদের নিজের গতর খাটিয়ে আয় করা পোষায় না। সুচরিতার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে পেরে সোহেল বলে
——-আমার যখন ইচ্ছা আমি আসবো এতে খবর দেওয়ার কি আছে?তোমার ভাবি কোথায়?
——জেবাকে নিয়ে স্কুলে গেছে।
ওদের দুজনের কথপোকথন শুনে সোহেলের মা রুম থেকে চিৎকার করে বললো,
——কে আসছে? আমার সোহেল নাকি?
——হ্যা মা।
ঘরে ঢুকে লাকির দিকে তাকিয়ে বললো,
—–এটা আবার কে?
—–আপনার ভাইয়ের অফিসের পিয়ন কামালের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। জেবা আর তৈয়বাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ওকে আনা হয়েছে।
সোহেলের মুখের পেশী যেন শক্ত হয়ে গেল। মায়ের ঘরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
——-তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারলাম না মা। তাই চলে আসছি।
—–ভালোই করছিস বাবা। বেঁচে থাকলে বহুত টাকা আয় করা যাবে। তুই যে আসবি কারিমা জানে না?
——না,মা বলিনি। তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছি।
সোহেলের ন্যাকামি দেখে সুচরিতার শরীর জ্বলতে লাগলো। নতুন করে কি যন্ত্রণা শুরু করবে কে জানে? সুচরিতা শাশুড়ী মায়ের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো
——-মা আমি আসছি।
সোহেলের মুখের মানচিত্র যেন মুহুর্তে বদলে গেল। সুচরিতা জানে, উনার কানে ওর ভর্তি হওয়ার খবর পৌঁছে গেছে। তাই ও একটু ড্যামকেয়ার ভাবে দাঁড়িয়ে সোহেলকে বললো
—–ভাইয়া আসছি।
——কোথাও বেরোচ্ছো নাকি?
—–হুম,আমার ক্লাস আছে।
এ কথা বলে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সুচরিতা বেরিয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দশটা বাজে। ওর দেরী হয়ে গেল। দশটার ক্লাসটা ধরতে পারবে না। সোহেল এমন ভাব করছে যেন সুচরিতার ভর্তির খবরটা মনে হয় জানেই না। বাড়ির সব খবরই জানে অথচ এখন না জানার ভান করছে।
সুচরিতা চলে যাবার পর মায়ের দিকে তাকিয়ে সোহেল বললো,
—–ওর কলেজে যাওয়াটা বন্ধ করতে পারলে না? তোমাকে এতো করে বলে গেলাম তবুও তুমি কাজটা ঠিকঠাকভাবে করতে পারলে না।
—–চেষ্টা তো কম করিনি। কারিমাকে জিজ্ঞাসা করে দেখিস। এযে কি ধাতু দিয়ে গড়া ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না।
——মা তুমি যদি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য গালে তুলে মিষ্টি খাইয়ে দাও তাহলে ওর কলেজে ভর্তি হতে দোষ কোথায়?
মরিয়ম বেগম মনে মনে ভাবে কারিমা ঠিক সোহেলের কাছে কথা লাগিয়েছে। বিরক্তিভাব চেপে রেখে বললো,
—–মাথায় হাত বুলিয়ে চেষ্টা করেছিলাম যদি সে ঐ পথ থেকে ফিরে আসে।
——-কিন্তু উনি তো সে বান্দা নন। ওর পরীক্ষা কবে?
——মনে হয় মাস ছ,য়েক বাকী আছে।
—–ওকে পরীক্ষা দিতে দিবো না আর কলেজেও যাবে না।দেখোনা কি করি?
—–দেখ যদি কিছু করতে পারিস।
ডোরবেলটা বেজে উঠলো।
——ঐ দেখ কারিমা আর জেবা মনে হয় স্কুল থেকে ফিরলো।
——কাজের মেয়েটা কই?
——-তৈয়বার কাছে বসে আছে।
দরজা খুলে দেওয়া মাত্রই জেবা ওর বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়লো।
——বাবা তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে?
——অফিসের কাজে ইটালী গিয়েছিলাম।
কারিমা সোহেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
——তোমার শরীর বেশ শুকিয়ে গেছে।
——ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর শরীরটা শুকাতে শুরু করেছে।
ওরা তিনজনেই মরিয়মবেগমের রুমে গেল। মরিয়ম কারিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
——-সোহেলকে নাস্তা দাও। ফ্রীজ থেকে মুরগীর মাংস বের করে ভেজাও।
—-দুপুরের তরকারী তো রান্না হয়েছে মা?
——এতোদিন পর ছেলেটা বাড়ি ফিরলো বাটা ঝাল দিয়ে মাংসটা রান্না করো। ওখানে তো খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক ছিলো না।ত ব্যাটাছেলেদের কি হাত পুড়িয়ে রান্নার অভ্যেস আছে যে নিজে রান্না করে খাবে?
সোহেল দুবছরের লিয়েন নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলো। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় বাড়ি ফিরে আসাতে বাকি ছ,মাস সময় ঘরে বসে পার করতে লাগলো। কয়েক মাস পার হয়ে গেল। নিজের কূটকচাল বুদ্ধিতে সুচরিতাকে দমানোর চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু পেরে উঠছে না। এদিকে দশ লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে সোহেল ঠুঠো জগন্নাথ হয়ে দেশে এসেছে এটা নিয়ে হিমেলের মেজাজটা এমনিতেই বেশ খারাপ হয়ে আছে। দু,ভাইয়ের সাথে তেমন কথাবার্তা নেই। হিমেলের মা মরিয়ম বেগম অনবরত বলেই যাচ্ছেন,”ছেলে বেঁচে থাকলে জীবনে অনেক টাকা কামাই করতে পারবে। বিদেশে গিয়ে ছেলেরে ডায়াবেটিস রোগ ধরে ফেলেছে। ছেলেযে বাড়ি ফিরে এসেছে এতেই উনি খুশী”।
কিন্তু হিমেল ওর এক পরিচিত মানুষের কাছে শুনেছে, সোহেল কোনো অড জব করতে চাইতো না। তাও যেটুকু ইনকাম করতো জুয়াড় আড্ডায় উড়িয়ে দিয়ে আসতো। অথচ এই ব্যাপারটা হিমেল বাসায় প্রকাশ করতে পারবে না। সোহেল এমন কাহিনী করা শুরু করবে বাসায় টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে। সবাই তখন প্রুফ দেখতে চাইবে। দশ লক্ষ টাকা পুরোটাই জলে গেল।
সুচরিতা অন্যান্য দিনের মতো আজও অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠলো। ফজরের নামাজ পড়ে কিচেনে গিয়ে নাস্তার যোগাড় করতে লাগলো। হিমেলও নাস্তা করে অফিসে চলে গেল। এর মাঝে তৈয়বাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ফ্রেস করে নাস্তা খাইয়ে লাকির কাছে রেখে দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ওর আবার আজকে সকাল এগারোটায় ক্লাস আছে। পুটি মাছ দিয়ে বেগুনের ঝোল,করল্লার চচ্চড়ি রান্না করলো। ইলিশ মাছটা ধুয়ে লবন হলুদ,ঝাল দিয়ে মাখিয়ে রেখে দিলো। টেবিলে নাস্তা বেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। আজ আবার কারিমা জেবাকে নিয়ে কেন যেন স্কুলে যায়নি। সুচরিতার শাশুড়ী ড্রইংরুমে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। ঝড়ের আগে প্রকৃতিতে যেমন গুমোট পরিবেশ হয় এ বাড়ির পরিবশ এই মুহুর্তে অনেকটা তেমন। সুচরিতা তৈয়বাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে লাকিকে বললো ওর দিকে যেন খেয়াল রাখে। পরীক্ষার আর দু,মাস বাকি। সুচরিতা শাশুড়ী মরিয়ম বেগম কে বলে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাওয়ার সময় সোহেল বললো,
—–দাঁড়াও।
—–আমার দাঁড়ানোর সময় নেই। এগারোটায় একটা ক্লাস আছে। আর একটু দেরী হলে ক্লাসটা ধরতে পারবো না।
——-আজ থেকে তোমার কলেজ যাওয়া বন্ধ।
——কারণটা জানতে পারি কি?
——-মা,চাইছে না। তাই তুমি যাবে না।
——আম্মা তো চাননি আপনি বিদেশে গিয়ে চাকরি করেন। তারপরও দশ লক্ষ টাকা জলে ফেলে ঠিক আপনি বিদেশে গিয়েছেন। আর ঠুঠো জগন্নাথ হয়ে ফিরেও আসলেন। আমার পিছনে আপনার ভাইয়ের তেমন কোনো পয়সা খরচ হয় না। আমার বেতন মাত্র বিশ টাকা। আমি সংসারে আমার কোনো দায়িত্ব
অবহেলা আজ পর্যন্ত করিনি। সুতরাং পড়াশোনা আমি ছাড়তে পারবো না।
সুচরিতার কথা শুনে ওর শাশুড়ী মা তেলেবেগুনে জ্বলে বললো,
—–আমার ছেলে পয়সা জলে ফেলুক আর আকাশে উড়িয়ে দিক এটা তুমি বলার কে? তোমার বাপের পয়সা তো আর উড়িয়ে দেয়নি।
——মা, আপনারাও তো আমার প্রতিটা বিষয়ে নাক গলান। তখন আমার কেমন লাগে। আমার দায়িত্ব তো আমার স্বামী পালন করে তাহলে মেজভাইয়ের কি এখানে কথা বলা উচিত?
সোহেল মারমুখী হয়ে সুচরিতার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে সুচরিতার শাশুড়ী পদ রোধ করে দাঁড়ায়। সোহেল রেগে গিয়ে বলে,
——তোমার মুখে মুখে কথা বলার এতো বড় সাহস হয় কি করে?
——তুই আর ওর সাথে কথা বলে মুখ নষ্ট করিস না। হিমেল আসুক ওকেই আজ ওর বউয়ের বিচার করতে হবে।
——ও কি বিচার করবে আমি জানি না। তবে ওর আর কলেজে যাওয়া হবে না।
এরকম চিৎকার চেঁচামেচিঁতে তৈয়বার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সুচরিতা রুমে গিয়ে তৈয়বার কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সুচরিতার আজ আর কলেজে যাওয়া হলো না। সুচরিতা তৈয়বাকে বেস্টফিডিং করাতে লাগলো। দুপুরে সুচরিতা লাঞ্চ করলো না।এমন কি বাড়ির কোনো সদস্য ওকে খেতে ডাকেনি।
আজ হিমেল একটু আগে অফিস থেকে বের হলো। বাসায় ফিরতে পাঁচটা বেজে যায়। ডোরবেলটা বাজালো। সোহেল দরজা খুলে হিমেলকে বললো,
——এদিকে আয় তোর সাথে কথা আছে।
হিমেল সোহেলের পিছু পিছু ড্রইং রুমে গিয়ে বসলো।
——তোর বউয়ের এতোবড়ো সাহস হয় কি করে?আজ ও মায়ের মুখে মুখে তর্ক করেছে। শাস্তিস্বরুপ আজ থেকে ও কলেজে যেতে পারবে না।
—–এটা কেমন কথা। মায়ের মুখে তর্ক করেছে সেটা একটা বিষয়। তবে ওটার সাথে কলেজ যাওয়ার প্রসঙ্গ মিশিয়ে ফেলছো কেন? আর ও তর্ক করবে না কেন? তোমরা সবাই মিলে ওকে মানসিক অত্যাচার করছো। এভাবে প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হতে গিয়ে ওর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। তাই আজ ও প্রতিবাদ করতে শিখে গেছে।
সোহেল আর মরিয়ম হোঁচট খেয়ে হিমেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সোহেল গলা চড়িয়ে বললো,
——তুমি তো পুরাই স্ত্রৈন হয়ে গেছো দেখছি। আমি কাল বিচার বসাবো। বড় ভাইয়াকে ফোন দিয়ে ডেকে আনবো। আপা তাহেরা আর জোহরাকেও ডেকে আনবো। এখানে থাকতে গেলে এ বাড়ির নিয়ম মেনে চলতে হবে।
—–যা পারো করো। আমিও আর পারছি না। একদিকে ব্যবসার চাপ অন্যদিকে সংসারের এই অশান্তি আমিও আর নিতে পারছি না। আমি এই অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছি।
একথা বলে হিমেল নিজের রুমে চলে গেল।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-সাতাশ
মাহবুবা বিথী
সুচরিতা ঘরে বসে হিমেল আর সোহেলের কথাগুলো শুনছিলো। ভালো লাগছিলো না এই অশান্তির ভার বইতে। তৈয়বার দিকে তাকিয়ে ভাবলো ওকে নিজের পায়ে দাঁড় না করিয়ে কখনও বিয়ে দিবে না। বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
পড়ন্ত বিকেলের রোদ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগলো। রক্তিম আভা আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। সুচরিতা জানালা দিয়ে আকাশের পানে ওর শুন্য দৃষ্টিখানি মেলে ধরে ভাবতে লাগলো, সব সন্ধা রাত্রির অন্ধকার নামিয়ে দেয় না। কিছু কিছু সন্ধার পর যে রাত্রি নেমে আসে তাতে জোৎস্নার রুপালী আলো ঝলমল করে। সুচরিতা জানে না ওর জীবনের সন্ধা কবে জোৎস্নার আলোয় ঝলমল করবে। সুচরিতা ভাবে যদি ও লেখাপড়া করতে না চাইতো কিংবা ওদের অন্যায়ের কাছে মাথা নত হয়ে চলতো তাহলে হয়ত এতোটা অশান্তি ওর কপালে জুটতো না। ও সবই মানতে পারছে কিন্তু লেখাপড়াটা ছাড়তে পারছে না। যদি কোনোদিন এমন দিন আসে যেদিন ওর সাথে এই পৃথিবীর কেউ থাকবে না সেদিন হয়ত লেখাপড়াটা কাজে লাগিয়ে ওর জীবনের চাকাটা সচল রাখবে।এই টুকুই ওর চাওয়া। এতেও এতো বাঁধা। ও তো জানে না কবে ওর প্রহরগুলো হিমেল আর ওর ভালোবাসায় ভরে উঠবে। হিমেলকেও মাঝে মাঝে ওর বিশ্বাস করতে মন চায় না। কিবা বয়স সুচরিতার। অথচ এটুকু বয়সে কি কঠিন জীবন যুদ্ধে ওর সময়গুলো পার হয়ে যাচ্ছে। অথচ ওর বয়সি মেয়েরা এখনও দু,চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন মেখে পাখনা মেলে উড়ে বেড়ায়।আর ও যন্ত্রণার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। বিয়ের আগে কোনোদিন ও ভাবতে পারেনি জীবনের এইরকম একটা দিক আছে। যেখানে কষ্ট আর বেদনা ছাড়া আর কিছু জমা হয় না। মাঝে মাঝে নিজেকে বড় একলা মনে হয়। আর ওর একলা মনের কষ্টের কথাগুলো একমাত্র আল্লাহপাক ছাড়া ও কাউকে বলতে পারে না। সুচরিতা সাথে সাথে এটাও ভাবে একতরফা কষ্ট পেতে ওর জন্ম হয় নাই। ইনশাআল্লাহ একদিন ওর দিন ফিরবে। মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিছানায় চোখ ফেরাতে দেখতে পেলো হিমেল বিছানায় শুয়ে আছে।
——তুমি রুমে কখন আসলে আমি টের পেলাম না।
হিমেল কোনো কথা বললো না। সুচরিতা বুঝতে পারছে হিমেলের এই মুহুর্তে হয়তো কথা বলার মুড নেই। তারপরও সুচরিতা হিমেলের কপালে আলতো করে হাত রেখে বললো,
—–একটু জুস বানিয়ে দিবো?
——তুমি তো দুপুরে লাঞ্চ করোনি। আমি খাবার অর্ডার করবো।
—–না,সেটা করতে যেও না। অশান্তির আগুনটাকে আরও উস্কে দেওয়া হবে। একটু পরেই ডিনারের সময় হবে। তখন একবারেই খাবো।
——নুডুলস রান্না করো। আমারও খিদে পেয়েছে।
সুচরিতা নামাজ শেষ করে কিচেনে গিয়ে নুডুলস রান্না করে খাবার টেবিলে বেড়ে দিয়ে শাশুড়ীমাকে ডেকে দিলো। কারিমাকেও বললো সোহেলকে নাস্তা দিতে। টেবিলে হিমেলের জন্য বেড়ে দিয়ে নিজের জন্য একটু বেশী করে নিয়ে রুমে চলে আসলো। তৈয়বাকে কিছুটা খাইয়ে দিলো। নিজেও কিছুটা মুখে দিলো। কাল তৈয়বার জন্মদিন। খুব ইচ্ছে ছিলো ঘটা করে জন্মদিন পালন করার। সেটা এই পরিবেশে মনে হয় না সম্ভব হবে। সারাদিনের অশান্তির ঝক্কিঝামেলায় সুচরিতার বড্ডো ক্লান্ত লাগছে। দীর্ঘসময় অভুক্ত থাকার পর নুডুলসটা খাওয়ার পর খুব খারাপ লাগছে। চোখ দুটোতে জগতের ঘুম নেমে আসছে। তৈয়বাকে হিমেলের কাছে দিয়ে নিজেকে বিছানার বাহুবন্ধনে সঁপে দিলো।
রাত দশটার দিকে হিমেল সুচরিতাকে ডেকে দিয়ে বললো,
—–ওঠ,ডিনার করে নাও।
—–তুমি ডিনার করেছো?
—–আমাকে টেবিলে খেতে কেউ ডাকেনি। মা, মেজভাই আর ভাবি ডিনার করে নিয়েছে। অবশ্য তখন আমি তৈয়বাকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম।
সুচরিতা বুঝতে পেরেছে কি ঘটেছে? কারণ দুপুরে লাঞ্চ করার সময় ওকেও কেউ ডাকেনি। তৈয়বাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হিমেল আর সুচরিতা ডিনার করে নিলো। লাকির ও খাওয়া হয়নি। ওকেও সুচরিতা খেতে দিলো। তারপর এঁটোবাসন সব গুছিয়ে সুচরিতা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। কিন্তু দু,চোখে যেন ঘুম নামতে চাইছে না। কত এলোমেলা ভাবনায় আধোঘুম আধোজাগরণে রাতটা পার হয়ে গেল।
পরদিন খুব ভোরে কলিংবেলের শব্দে সুচরিতার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ছ,টা বাজে। এতো সকালে আবার কে আসলো? দরজা খুলে ও অবাক হয়ে গেল।
——আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আপনারা এতো সকালে?
রোমেল সুচরিতার কথার কোনো উত্তর দিলো না। ওর বুঝতে বাকি রইলো না সোহেল ওর নামে রোমেলের কাছে হয়ত সত্যি মিথ্যা বানিয়ে বলেছে।রোমেল সুচরিতাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সখিনা তখন সুচরিতাকে বললো,
—–তোমার ভাইয়ার একটা জরুরী কাজ আছে ঢাকার হেড অফিসে।
রোমেল চলে যাওয়ার পর সখিনা ফিস ফিস করে সুচরিতাকে বললো,
——আজ নাকি তোমার আর ছোটোভাইয়ের বিচারসভা হবে। মেজ ভাই ফোন দিয়ে তো এটাই বললো।
সুচরিতার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না। সকাল দশটার মধ্যে জোহরা আর সাবেরাও চলে আসলো। ড্রইংরুমে রোমেল, হিমেল আর সুচরিতাকে ডেকে পাঠালো। সোহেল, সাবেরা আর জোহরাও চলে আসলো। মা মরিয়ম বিবি এসে হিমেলের পাশে বসলো। রোমেল গম্ভীর হয়ে সুচরিতাকে বললো,
——একটা যৌথ পরিবারে অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। অনেক কিছুই নিজের ইচ্ছেমতো করা যায় না। সবার মন যুগিয়ে চলতে হয়। তাহলে সেই পরিবারে শান্তি থাকে। তাই মা যখন চাইছে না তখন তোমার আর কলেজে যাওয়া হবে না। আর এমনতো নয় তোমাকে চাকরি করে সংসার চালাতে হবে। গ্রাজুয়েশন করেছো। ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য এই টুকুই যথেস্ট। আর তোমাকে তো আমি নম্র ভদ্র মেয়ে বলেই জানতাম। মায়ের মুখে মুখে তর্ক করার শিক্ষা তুমি কোথায় পেলে?
—–স্যরি ভাইয়া,আমার পক্ষে এই কথা মানা সম্ভব নয়। আর মাত্র দু,মাস পরে আমার পরীক্ষা। আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করবো। আর এমন তো নয় আমি কারো ঘাড়ে আমার সংসারের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে কলেজে যাই। আমার সব দায়িত্ব পালন করে আমি কলেজে যাই। ভাইয়া, আমি তো আম্মার মুখে মুখে কথা বলি নাই। জাস্ট আমার অবস্থা ওনাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম।
সোহেল চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
—–দেখো কেমন বেয়াদব। আমাকে তো মানেই না মাকেও মানে না এখন তোমার ও মুখের উপর কথা বলে যাচ্ছে।
সোহেলের উস্কানিতে রোমেল রাগের তাপমাত্রা তরতর করে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। একসময় প্রচন্ড রেগে রোমেল সুচরিতাকে বললো,
——তোমার বাবা মাকে ভালোমানুষ বলেই জানি। তুমি এতো অভদ্র এটা তো জানা ছিলো না। শোনো এ বাড়িতে থাকতে হলে এ বাড়ির নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। এতোদিন এটাই হয়ে আসছে।
——ভাইয়া ও আমাদের বোনদের সাথে কম্পিটিশন দিতে চায়। (সোহেল বললো)..
মরিয়ম বিবি রেগে বললো,
—– আমার মেয়েদের পায়ের নখের সমান যোগ্যতা ওর নাই।
হিমেল রেগে গিয়ে বললো,
——সুচরিতা কলেজে যাবে এবং মাস্টার্সের পরীক্ষাটা দিবে। এটাই আমার সিদ্ধান্ত।
সোহেল মারমুখী হয়ে হিমেলের দিকে তেড়ে আসতে চাইলো। হিমেলও রেগে গিয়ে বললো,
—–দশ লক্ষ টাকা খরচ করে আমার ব্যবসার লালবাতি জ্বালিয়ে বিদেশ গিয়ে ঠুঠো জগন্নাথ হয়ে ফিরে এসে সংসারে অশান্তি করতে তোমার লজ্জা করে না। এমনকি বউ বাচ্চার খরচও দিতে পারো নাই। জুয়ার আড্ডায় পয়সা উড়িয়ে নিজের অকাম ঢাকতে এখন আসছো কূটকচালী করতে। আমি সবই বুঝি। শুধু সংসারের শান্তির জন্য চুপ করে থাকি।
সোহেল চিৎকার করে বললো,
—–মা,ওকে চুপ করতে বলো। না,হয় ভীষণ খারাপ হবে।
জোহরা তখন হিমেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-ঐ পরের বাড়ির মেয়ের জন্য তুমি তোমার মা ভাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করছো, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
——ঐ পরের বাড়ির মেয়েটাকে মা পছন্দ করে নিয়ে এসেছে। এমনকি মা ওকে গ্রাজুয়েশনে ভর্তি করিয়েছে। ও এতো ভালো রেজাল্ট করলো তাহলে মাস্টার্সটা পড়াতে সমস্যা কোথায়? উনি ড্যাংড্যাং করে উনার সংসারের সব দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে ফুর্তি করতে বিদেশে গেল। আমি ওর বাচ্চার দুধের খরচ থেকে শুরু করে এইতো সেদিন পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করে স্কুলে ভর্তি করালাম। সেখানে সুচরিতা যদি মাস্টার্সটা পড়তে চায় এতে সমস্যাটা কোথায় আমি বুঝতে পারছি না।
হিমেলের কথা শেষ হবার পর সুচরিতা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—–আমাকে প্রতিনিয়ত অপমান হজম করতে হয়।
কিন্তু সুচরিতাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাবেরা বললো,
——এই মেয়ে আমাদের ভাইবোনদের মাঝখানে তুমি কোনো কথা বলবে না। তুমিই হচ্ছো আসল শয়তান। তোমার কারনেই আমার মায়ের এতো সুন্দর সংসারটা আজ ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। ছোটোলোক একটা জুটেছে আমাদের সংসারে। আসল কথা হচ্ছে তোমার মায়ের তো সংসার চলছে না তাই আমার ভাইটাকে এই সংসার থেকে বের করে নিয়ে তোমার মায়ের সংসারের ঘানি টানাতে চাইছো। বুদ্ধিটা কি তোমার মায়ের?
এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠলো। কারিমা দরজা খুলে দেখে সুসমিতা আর খোকন এসেছে। সুসমিতা ছালাম দিয়ে বললো,
——ভাবি কেমন আছেন? আজ তো তৈয়বার জন্মদিন। তাই ওকে সারপ্রাইজ দিতে চলে আসলাম। আপা দুলাভাই কেউ তো আমাদের ইনভাইট করলো না।
ওদেরকে দেখে সোহেল চিৎকার করে হিমেলকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
——কিরে এতোটা স্ত্রৈন করে হলি। ঠিক শালাশালীরে খবর দিয়ে এনেছিস?
——দেখ তুমি আমার বড়। এমন কোনো আচরণ করো না যাতে তুমি অসম্মানিত হও।
এমন সময় রোমেল সুসমিতা আর খোকনকে বললো,
——তোমরা এসেছো যখন ভালোই হলো। তোমার বোনকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। যেদিন তোমাদের বোন আমাদের সংসারে মানিয়ে নেওয়া শিখতে পারবে সেদিন যেন ও এ বাড়িতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে। নয়ত কোনোদিন যেন এ বাড়িমুখো না হয়।
সুসমিতাও বললো,
——আজকে আপনাদের বাড়িতে আমার বোনের যে অবস্থা দেখলাম তাতে এ বাড়িতে রাখাটাও আমরা নিরাপদ মনে করি না।
এরপর সুচরিতার দিকে তাকিয়ে সুসমিতা বললো,
——আপু তুমি তৈয়বাকে নিয়ে চলো আমাদের সাথে। তুমি লেখাপড়া জানো, চাকরি করে তৈয়বাকে ঠিক বড় করে নিতে পারবে। কিন্তু এই অসুস্থ পরিবেশে থেকে তুমি আর তোমার মেয়ে দুজনেই অসুস্থ হয়ে যাবে।
হিমেল এসময় চিৎকার করে বললো,
——সুসমিতা তুমি আর খোকন বাড়ি চলে যাও। আমি আজই এ বাড়ি থেকে তৈয়বা আর সুচরিতাকে নিয়ে বের হয়ে যাবো।
সুসমিতা আর খোকন চলে যাবার পর হিমেলের মা ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
——বাবা তুই আমাকে ছেড়ে যাসনে। ওকে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দে। আমি তোকে ওর থেকেও সুন্দর সংসারী মেয়ে দেখে আবার বিয়ে দিবো।
জোহরা রেগে গিয়ে বললো,
——মা,তুমি ওকে যেতে দাও। যে ওর বউয়ের চরিত্রের অবস্থা ক,দিন ওর সাথে এখন থাকে সেটাই দেখার বিষয়। কলেজে তো পড়তে যায় না মক্ষীরানি হতে যায়।
—–মুখ সামলে কথা বল জোহরা। সম্মানে ও তোর বড়। কথাটা মনে রাখিস।
এরপর হিমেল সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
——তুমি রেডী হয়ে নাও। তৈয়বা আর লাকিকেও রেডী করো। এ বাড়িতে আর এক মুহুর্ত নয়।
চলবে