#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
যে মেয়েগুলো ওখানে বসেছিলো তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি টিংকুর চোখের ইশারায় হিমেলের কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে গলায় চুমু খেলো। হিমেল পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে মেয়েটার বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে নিকোটিনের ধোয়া জ্বালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তারপর টিংকুর দিকে তাকিয়ে বললো,
——তুমি তো জানো এসবে আমার অভ্যেস নেই। তাহলে এখানে কেন নিয়ে এলে?
—–ইয়াংম্যান শরীর আর মনের চাহিদা বলে কথা। কেন হেজিটেট করছো। তোমার বউ কিচ্ছু জানতে পারবে না।
—— তোমার সাথে পাঁচ বছর ধরে বিজনেস করছি কখনও আমাকে এসব জায়গায় যাতায়াত করতে দেখেছো? কিংবা এক দিনের জন্য মদকে ছুঁতে দেখেছো? আমি খুব সংযমী পুরুষ। আর তাছাড়াও ওদেরকে দেখে আমার কোনো আগ্রহ তৈরী হয় না।
মেয়েটি মনে হয় একটু অপমানিত বোধ করলো। এই প্রথম কোনো পুরুষ ওকে রিফিউজ করলো। টিংকু ওর চেহারা দেখে মনে হয় কিছু বুঝতে পারলো। তাই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে হিমেলকে খুব মোলায়েম স্বরে বললো,
——-তুমি তো ওকে সুযোগই দিলে না। একটু সুযোগ দিয়ে দেখো ওর কারিশমা। গ্রীক দেবী আফ্রোদিতীর নাম শুনেছো নিশ্চয়। এই মেয়ে দেখতে আফ্রোদিতীর থেকেও সুন্দর। কতজন এর সাথে রাত কাটানোর জন্য মুখিয়ে থাকে। তোমার স্ত্রী নিশ্চয় এতো সুন্দরী নয়?
—–যে বয়সটাতে পদস্খলনের সুযোগ ছিলো সেটা যখন পার হয়ে এসেছি তখন নতুন করে এসবে জড়াতে চাই না। হা ও হয়তো তোমাদের চোখে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতীর থেকেও সুন্দর। কিন্তু আমার স্ত্রী আমার চোখে ওদের সবার থেকে সুন্দরী। যাকে দেখলে আমার চক্ষু শীতল হয়। যার স্পর্শে আমার শরীর আর মনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।আর তাছাড়াও এখন আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রীর বিশ্বাসের অমর্যাদা আমি করতে চাই না। আমার মতে একজন স্ত্রী যদি তার স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকে তেমনি একজন স্বামীরও উচিত তার স্ত্রীর প্রতি বিশস্ত থাকা।
——আহারে! আমার সতীসাদ্ধী পুরুষ। তুমি কি আসলে পুরুষ সন্দেহ হয়। আমার তো এদের দেখলে শরীরের রক্ত গরম হয়ে যায়। শরীরের যন্ত্রপাতিগুলো নড়াচড়া শুরু করে।
——এখানেই তোমার সাথে আমার পার্থক্য। আর আমাকে যতই উস্কাও এসব বিষয়ে আমার কখনও আগ্রহ ছিলো না। আর ভবিষ্যতে যেন এমন থাকতে পারি আমার জন্য এই প্রার্থনা করো। চলি। বেস্ট অফ লাক।
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে হিমেল হোটেল থেকে বেরিয়ে আসলো। মনে মনে ঠিক করলো এই লোকের সাথে কাজ না করাই ভালো হবে। কি জানি কোথায় কোন বেনোজলে ডুবিয়ে দিবে তার কোনো ঠিক নাই। সবার আগে মান সম্মান। টাকা জীবনে দরকার। কিন্তু অর্থের জন্য মান সম্মান খোয়ানো যাবে না। মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো। মনে হয় সুচরিতা মেসেজ পাঠিয়েছে। হিমেল ভাবছে হোটেলে ফিরেই সুচরিতাকে কল করবে। অন্তত এই মুহুর্তে ওকে কাছে না পেলেও ওর গলার স্বর শুনতে পেলেও মনটা ঠান্ডা হবে।
হোটেলে ফিরে হিমেল বাথরুমে গিয়ে একটু ফ্রেস হয়ে নিলো। আসার পথে ডিনার করে এসেছে। এখন অনেকটা সময় সুচরিতার সাথে কথা বলতে পারবে। তার আগে এশার নামাজ পড়ে নিতে হবে। নয়ত সুচরিতা ফোন দিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করে জানবে হিমেলের নামাজ পড়া হয় নাই তখন ওর মনটা খারাপ হয়ে যাবে। হিমেল তাড়াতাড়ি এশার নামাজ পড়ে নিলো। তারপর কাঁচঘেরা বারান্দায় এসে বসলো। একটা সিগারেট ধরিয়ে এক মগ কফি নিয়ে তিরিশ তলা ভবনের উপর থেকে শহরটাকে দেখতে লাগলো। বেশ গোছানো শহর ছবির মতো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত বারোটা বাজে। বাংলাদেশে নিশ্চয় রাত দুটো বাজে। হিমেল জানে ওর মন পাখিটা এখনও জেগে আছে। ওর সাথে কথা না বলে সুচরিতা ঘুমায়না। হিমেল মোবাইল হাতে নিয়ে কল করলো। একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ওর মনপাখিটা ফোন রিসিভ করলো।
——কেমন আছো মন পাখি?
——থাক আর ডং করতে হবে না(অভিমান করে বললো)। কথায় আছে চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়ে যায়। আমি স্বপ্নে যা দেখেছি বাস্তবে মনে হয় তাই ঘটছে কিনা কে জানে? তা,না হলে তোমার ফোন করতে এতো দেরী হলো কেন? এমনকি আমার মেসেজের উত্তর দাওনি।
হিমেল থতমত খেলো। কারণ সুচরিতা মাঝে মাঝে এমন কিছু স্বপ্নে দেখে যা বাস্তবে খেটে যায়। তাই আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলো,
——-কি দেখেছো আগে শুনি। তারপর না হয় বলা যাবে বাস্তবে ওটা ঘটেছে কিনা?
—–স্বপ্নে দেখলাম তোমার চারপাশে অনেকগুলো সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছে।
—-তারপর
——তারপর আর কি?ঘুম ভেঙ্গে গেল। কেন আরো কিছু দেখা বাকি ছিলো নাকি?
——আমাকে কি তোমার সেরকম মনে হয়?
——অবশ্যই না। তোমার ভালোবাসায় আমি পবিত্রতা খুঁজে পাই। তাইতো তোমাকে আমি চোখে হারাই। আর এ—তো ভালোবাসি।
—–আমিও তোমার ভালোবাসার মাঝে শান্তি খুঁজে পাই। এ যেন জান্নাতের সুখ। এখন ঘুমিয়ে পড়ো লক্ষীটি। সকালে উঠে আবার সংসারের কাজে হাত লাগাতে হবে।
——তুমি কবে আসছো?
——কাজ শেষ হলেই চলে আসবো। রাখছি মাই সুইট হার্ট।
——ফোনের মধ্যে দিলে না।
—–দিলাম তো। তুমি শব্দ শুনতে পেলে না।
হিমেল ফোনে শব্দ করে ওর চুম্বন সুচরিতার কাছে পৌঁছে দিয়ে ফোনটা রেখে দিয়ে ও ভাবতে লাগলো সুচরিতা ঠিক স্বপ্নে যা দেখলো তাইতো আজ ওর লাইফে ঘটলো। ওর কাছে মনে হয় সুচরিতার মন আর শরীর যেহেতু পবিত্র তাই হয়তো আল্লাহপাক স্বপ্নে ওকে জানিয়ে দেয়। এটা একান্তই হিমেলের ধারণা।
সুচরিতার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে তিন বছর। অথচ প্রতিটি রাতেই সুচরিতাকে আনকোরা লাগে। পারফিউমের প্রতি হিমেলের বরাবর অনেক দুর্বলতা। কিম্তু সুচরিতার গায়ের সুবাস পৃথিবীর তাবৎ পারফিউমকে হার মানিয়ে দেয়। সুচরিতার শরীরের সুবাসে বুঁদ হয়ে যুগ থেকে যুগান্তর পার করে দিতে মন চায়। অথচ সুচরিতা বয়সে ওর থেকে প্রায় দশ বছরের ছোটো। বিয়ের সময় মনে হয়েছিলো এতো ছোটো মেয়ের সাথে ও মানিয়ে নিবে কিভাবে?অথচ মেয়েটা ওর সাথে এতো সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছে যে ওকে ভালো না বেসে পারা যায় না। ওর মতো বোহেমিয়ান পুরুষকে যে নারী আঁচলে বাঁধতে পেরেছে বলতেই হবে ওর ভালোবাসায় জোর আছে।
নাহ্ কালই হিমেল দেশে ফিরে যাবে। সুচরিতার শুন্যতা ওকে বন্য করে তুলছে। ওর আর তর সইছে না। এমন সময় ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিপশনের ছেলেটা ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করে ও বললো,
——মিঃ হিমেল বলছি
——স্যার এতো রাতে আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখিত। তবে আপনার সাথে দেখা করার জন্য একজন গেস্ট নিচে লবিতে অপেক্ষা করছে।
—–ওকে আসছি।
ফোনটা রেখে হিমেল ভাবছে এতো রাতে কে এলো ওর সাথে দেখা করতে?ঘুমের পোশাকটা পাল্টে শার্ট প্যান্ট পড়ে ও নিচে নেমে আসলো। যাকে দেখতে পেলো ওর চক্ষু চড়কগাছ। টিংকু ওকে যে মেয়েটার কাছে নিয়ে গিয়েছিলো ঐ মেয়েটা এখন ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
——আপনি এসময়? আর ঠিকানা পেলেন কোথায়?
——কেন এই লাসভেগাস হোটেলটায় কি আমার আসতে বারণ?
——না,তা হবে কেন? তবে আমি তো আপনাকে কল করিনি।
—–হুম,কল করলে তো আর এখানে বসে কথা বলতাম না। সোজা তোমার রুমে চলে যেতাম।
—–তা হঠাৎ কি উপলক্ষে আমার কাছে আসা?
—–আসলে এই প্রথম আমি আমার লাইফে তোমার মতো একজন প্রেমিক পুরুষ দেখতে পেলাম। টিংকুর সামনে তোমার সাথে ভালো করে কথা বলতে পারিনি। তাই কৌশলে ওর কাছ থেকে হোটেলের ঠিকানাটা নিয়ে এলাম। এখন মুখোমুখি বসে এক বউ পাগল আশিককে আমি দুচোখ ভরে দেখবো। বড় ভাগ্যবতী তোমার বউ। তোমার বউ মনে হয় খুব সুন্দরী তাই না?অবশ্য তুমিও খুব হ্যান্ডসাম। জিম করা পেটানো বলিষ্ট শরীর ছ,ফিটের মতো লম্বা। মাথায় এক ঝাঁক কোকড়ানো চুল। বলতে পারো আমিও প্রথম দেখায় তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। তুমি আমাকে তুমি করে বলতে পারো। ভয় নেই তোমার গলায় ঝুলে পড়বো না। অবশ্য আমি ঝুলতে চাইলেও তুমি যে ধরা দিবে না তা আমি ভালই জানি।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
শর্টস্কার্ট তার সাথে ছোটো টপস স্তনের ভাঁজগুলো দেখা যাচ্ছে। যে কোনো পুরুষের রক্ত উষ্ণ করে দেওয়ার মতো মেয়েটার গঠনশৈলী। কিন্তু
হিমেলের কেন জানি মেয়েটাকে বিরক্ত লাগছে। হাজারো হোক টিংকুর বান্ধবী বলে কথা। যতই বিরক্ত লাগুক প্রকাশ করা যাবে না। ভদ্রতা বজায় রেখে হিমেল মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–তা আমার এখানে তোমার কি মনে করে আসা?
—–আমি একটা বিষয়ে অবাক হচ্ছি জানো,তুমি এখন পর্যন্ত আমার নামটাই জানতে চাইলে না। আমাকে তোমার ভালো নাই লাগতে পারে কিন্তু নামটা জানতে তো অসুবিধা নাই। আমি কিন্তু তোমার নামটা ঠিক জেনে নিয়েছি।
—–ওহ্ সরি। আসলে তোমার নামটাই তো আমার জানা হয়নি। কি নাম তোমার?
——মোনালিসা
—–হুম ভিঞ্চির মোনালিসার মতই তুমি সুন্দর।
——তোমার বউ তো আরো বেশি সুন্দর, তাই না?
—–হুম, আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী।
——ছবি দেখতে পারি?
——কেন নয়?
হিমেল মোবাইল থেকে সুচরিতার ছবিটা বের করে দেখালো। মোনালিসা ছবিটার পানে তাকিয়ে বললো,
——খুব সুন্দর। একদম নিঁখুত। তোমার বউ অনেক ভাগ্যবতী। জীবনে বহু পুরুষের সাথে মেলামেশা করেছি। কিন্তু তোমার মতো কাউকে নিজের বউকে এতো ভালোবাসতে দেখিনি। আজ উঠি। ভালো থেকো।
—–কি জন্য এসেছিলে সেটাতো বললে না।
—–তোমার বউকে দেখতে এসেছিলাম। কারণ আজ অবধি কোনো পুরুষ আমায় রিফিউজ করেনি। তুমিই প্রথম করলে। তাই খুব ইচ্ছে হলো তোমার বউটাকে দেখতে। গুড বাই।
হিমেল খেয়াল করেছে মোনালিসার চোখে সুচরিতার প্রতি ঈর্ষার দৃষ্টি। সুচরিতার মতো সাধারণ নারীর কাছে ওর পরাজয়টা মোনালিসা মেনে নিতে পারেনি। যেখানে ও পৃথিবীর অনেক ধনী ব্যক্তিদের মক্ষী রানি। রুমে এসে হিমেল অনলাইনে টিকিট কিনে ফেললো। এখানে ওর মনটা আর বসছে না। টিংকুকে ইদানিং ওর কেমন যেন লাগে।
কল্যানপুরে সুচরিতার শ্বশুরবাড়িটা বাংলোটাইপের। পাঁচটা বেডরুম, ড্রইং, ডাইনিং,কিচেন সহ পাঁচ কাঠা জমির উপর বেশ বড় বাড়ি। দূর থেকে হিমেল বাড়িটার পানে তাকিয়ে প্রশান্তিতে মনটা ভরে উঠলো। ছোটোবেলায় দেখা সারেং বউ সিনেমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। নিজেকে নায়ক ফারুকের মতো সারেং মনে হচ্ছে। আর কয়েক কদম হাঁটলে ওর বউটাকে ও ছুঁতে পারবে। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো দুপুর বারোটা বাজে। হিমেল ইচ্ছে করেই ড্রাইভার মতিকে খবর দেয়নি। সুচরিতাকে চমকে দিবে বলে। উবার এসে বাড়ির গেটের সামনে থামলো। দারোয়ান শুক্কুর মিয়া গেট খুলে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
——সাহেব আপনার না কয়দিন পরে আসার কতা। শরীলডা ভালা আছে তো?
—–আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। তবে বাড়িটা এতো চুপচাপ কেন?
——বাড়িত কেউ নাই। শুধু ছোটো ম্যাডাম আছে।
——বাকিরা কই গেছে?
——কুমিল্লা গেছে। মেজ সাহেবের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে।
হিমেল যেন মনে মনে খুশি হলো। আজ খালি বাড়িতে ও সুচরিতাকে একলা পাবে। এটা ভাবতেই মনটা শিহরিত হলো। ডোরবেলটা বাজালো।দরজা খুলে মর্জিনাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
——তুই এখানে?
——বমি করি বইলা খালাম্মা আমারে থুইয়া গেছে।
——মেজ আপাও কি কুমিল্লা গেছে? তোর ছোটো মামী কই?
——হুম, মামী গোসল করতাছে।
মর্জিনাকে দেখে হিমেলের বিরক্ত অনুভব হলো। ও ভাবলো এ আপদটা আবার রয়ে গেল কেন? রুমে ঢুকে দরজাটা লক করে দিলো। পথ থেকে কিনে আনা বেলীফুলের মালাগুলো টেবিলে রেখে দিলো। সুচরিতার বেলী ফুল খুব পছন্দের। সুচরিতা ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে পিছনদিক থেকে হিমেল ওকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো। প্রাণভরে সুচরিতার শরীরের সুবাসটা অনুভব করলো। সুচরিতাও চমকে উঠে বললো,
——তুমি কখন এলে?আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
—–ভয় পাওয়ার কিছু নাই ডার্লিং। আমার বউয়ের কাছে আমি আসবো নাতো কে আসবে?
হিমেল আলতো করে সুচরিতাকে বিছানায় শুয়ে দিলো। সুচরিতা তড়াৎ করে বিছানা থেকে উঠে হিমেলকে বললো,
——উহু,কোনো দুষ্টোমি চলবে না। আজ শুক্রবার। তুমি গোসলে যাও। নামাজে যেতে হবে।
—–আজ শুক্রবার নামাজে যাবো বলে বউকে আদর করা যাবে না এটা কোন হাদিসে লেখা আছে আমার হুজুর বউ।
হিমেলের কথাশুনে সুচরিতা হেসে ফেললো। তারপর হিমেল ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করলো। আসলে ভালোবাসায় এতো সুখ বলে মানুষ এটা পাওয়ার জন্য কতো কষ্ট সহ্য করে নেয়। হিমেলকে ভালোবাসে বলেই হয়তো এ বাড়িতে এতো কটু কথা সুচরিতা হজম করতে পারে। সুচরিতার একটু টেনশন হচ্ছে। ওখানে কোনো সমস্যা হয়নিতো? সেটা জানার জন্য ও হিমেলকে বললো,
—–ডিলটা হয়েছে?
—–সব ডিল যে হতে হবে তার কোনো মানে নেই। মানুষ ডিল করে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু ডিলের জন্য তো মানুষ তাদের মান সম্মান বিকিয়ে দিতে পারে না। তার থেকে বড় কথা এবার দেশের বাইরে গিয়ে কেন যেন কাজে মন বসাতে পারিনি। তোমার জন্য খুব অস্থির লেগেছে। তাই চলে এসেছি।
হিমেলের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে টেবিল থেকে বেলীফুলের মালাটা হাতে নিয়ে বললো,
—–আমারও তোমার জন্য খুব খারাপ লেগেছে। এবার উঠো। নামাজের প্রস্তুতি নাও।
সুচরিতা জানে,এটা নিয়ে ওকে অশান্তি পোহাতে হবে। হয়ত এ বাড়ির মানুষগুলো ভেবেই নিবে সুচরিতাই ফোন করে হিমেলকে ডেকে এনেছে।
সন্ধেবেলা ডোরবেলটা বেজে উঠলো। হিমেল দরজা খুলে দিলো। ওকে দেখে ওর মা বললো,
—–কিরে, তোর না সাতদিন পরে আসার কথা?
—-কেন মা, আমারকি আগে আসতে নেই?(ও মজা করে বললো)
——এভাবে কথা বলছিস কেন?আমি জানলে মেজবউয়ের বাপের বাড়ি বেড়াতে যেতাম না। আমাদের সাথে যেতে সুচরিতাকে কতো বললাম। ওতো যেতে চাইলো না। আমিও আর জোর করিনি। ভাবলাম তোকে ছাড়া যেতে ও হয়ত স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে না।
এমন সময় হিমেলের মেজভাবি একটু খোঁচা দিয়ে বললো,
——মা, সুচরিতা জানতো বলে আমাদের সাথে যেতে চায়নি।
সুচরিতা একটু রেগে গিয়ে বললো,
—–আমি জানতে পারলে তোমাদের বুঝি জানাতাম না?
——নাই জানাতে পারো, এটা তোমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার।
হিমেলের মা একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
——কথা চালাচালি না করে ছোটো বউ চায়ের ব্যবস্থা করো। তোমার আপা এখুনি চলে যাবে।
সুচরিতার মেজ জা ওর শাশুড়ীর মনে বিষ ঢুকিয়ে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। শাশুড়ীমা মনে মনে সুচরিতার উপর রেগে গেলেন। ছেলে উনার কাজে গিয়েছে। কাজ ফেলে তো এতো জলদি চলে আসার কথা না। নিশ্চয় সুচরিতা ওকে ডেকে এনেছে। তা,না হলে কাজ ফেলে এতো তাড়াতাড়ি ছেলে ফিরে আসতো না। এরকম করলে তো দু,দিনে এই সংসার লাটে উঠবে।
হিমেলের বড় ভাইয়ের ছেলেটা ওর কোলে বসে আহ্লাদ করে বললো,
—–চাচা, তুমি আমার জন্য সিঙ্গাপুর থেকে কিছুই আনলে না কেন?
——বাবারে, এবার আমি কারো জন্য কোনো শপিং করতে পারিনি।
ওদের চাচা ভাতিজার কথা শুনে সুচরিতার বড় জা খোঁচা দিয়ে বললো,
——হুম, তোর চাচার বাচ্চা হলে তোদেরকে তো ভুলেই যাবে। শপিং তো দূরের কথা।
—–এসব ট্রিপিকাল কথা বাদ দিয়ে বলো বড়ভাই আর মেজভাই কোথায়?
——গাড়িটাতে একটু সমস্যা হয়েছে। গ্যারেজে নিয়ে গেছে।
একথা বলে ওর বড়ভাবি ফ্রেস হতে রুমে চলে গেল।
এতোক্ষণ পরে ওয়াশরুম থেকে জুলেখা বের হয়ে হিমেলকে বললো,
——তোর কাজ হয়েছে?
——না,হয়নি।
——কাজ না করে চলে আসলি কেন?
——মেজ আপা, আমি বুঝতে পারছি না। তোমরা সবাই জিজ্ঞাসা করছো আমি কেন আগে চলে আসলাম। মনে হচ্ছে আমার আসাটা অন্যায় হয়েছে।
——বলাটা স্বাভাবিক না। যে মানুষ এতো কাজ পাগল ছিলো সে মানুষ কাজ ফেলে এখন ঘরে চলে আসে এই পরিবর্তনটা তো চোখে লাগে। শোন তোর উপর কিন্তু মায়ের অনেক আশা ভরসা। মায়ের এই বাড়িটাকে ছ,তলা বানাতে হবে। সুতরাং বউয়ের আঁচলবন্দী তোকে হওয়া যাবে না।
এমনসময় চা নিয়ে সুচরিতা ড্রইং রুমে আসার সময় ওর মেজননসের সব কথাই শুনতে পেলো। ওর মেজ ননস চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে। একথা শুনেছো নিশ্চয়।
সুচরিতাও হাসতে হাসতে বললো,
——আপা এর পরের লাইনটাতো বললেন না। উপযুক্তপতি যদি মেলে তার সনে।
——সেইজন্য তো তোমাদের দুজনকে বলছি নিজেদের আবেগ ইমোশনকে এতো বেশী গুরুত্ব দিও না। বাস্তবতাকে মানতে শিখো।
ও জানতো হিমেলের আসা নিয়ে এ বাড়িতে ভালোই নাটক হবে।
চলবে