#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী
সাবেরা আর সোহেলকে ড্রপ করে হিমেল হাসপাতালে পৌঁছে যায়। কিন্তু সুচরিতার মা হিমেল আর সুচরিতার উপর বিরক্ত হয়। সুচরিতাকে বলেছিলো হিমেল যেন একটু আগে আসে। এদিকে সুচরিতার ভাইগুলো ছোটো। একটা এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। আর ছোটোটা ক্লাস টেন এ পড়ে।সুসমিতা এবছর জগন্নাথ ভার্সিটিতে মার্কেটিং এ অনার্সে ভর্তি হয়। সুচরিতার ভাই দুটো বাসায় ছিলো।সুসমিতার পক্ষে সিট ম্যানেজ করা সহজ হচ্ছিলো না।কারণ বারডেম হাসপাতালে সহজে সিট পাওয়া যায় না। একটু দৌড়ঝাপ করা লাগে। সুচরিতার ছোটো বোন সুসমিতা ফোনে হিমেলের দেরী করে আসার জন্য সুচরিতার উপর উষ্মা প্রকাশ করে। আসলে স্ট্রোকের পেশেন্ট যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে ততই রোগীর জন্য মঙ্গল। যাক হিমেল ওর এক পরিচিত ডাক্তারের মাধ্যমে একটা কেবিন যোগাড় করতে পারে। যদিও হিমেলের শাশুড়ী চাইছিলো সেমি কেবিনে সুচরিতার বাবাকে ভর্তি করতে। কেবিনের বিল তো অনেক হবে। রিটায়ার মানুষ এতো টাকা কোথায় পাবেন। কিন্তু এই মুহুর্তে সেমি কেবিন খালি নেই। যাইহোক হিমেল বিশ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তির প্রাথমিক ফর্মালিটিসগুলো মেইনটেন করে ওর শালি আর শাশুড়ীর জন্য কিছু খাবার কিনে দিয়ে অফিসের পথে রওয়ানা হয়। যাওয়ার আগে শাশুড়ী মাকে হিমেল বললো,
——বিকালে সুচরিতা চলে আসবে। যদিও ওর শরীরটাও খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।
—–তুমি আরো কিছুক্ষণ থাকলে পারতে। ডাক্তারের
সাথে কথা বলে তারপর যেও।
—–মা আপনি আর সুসমিতা তো আছেন। আমার আসলে অফিসে যেতেই হবে। জরুরী কিছু কাছ পেইডিং আছে। সেগুলো সারতে হবে।
হিমেল রওয়ানা দেওয়ার পর সুচরিতার মা সুসমিতাকে বললো,
——নিজের বাপ হলে হিমেল পারতো এভাবে রেখে চলে যেতে।
—–পরের ছেলের দোষ আর খুঁজো না। তোমার দুটো ছেলের একটাও তো আসলো না।
—–রাতে তো শোভন থাকবে বলেছে।
—–কিন্তু খোকন ওতো তোমার বড় ছেলে। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। একদম ছোটো তো নয়। ওতো তোমার সাথে আসতে পারতো।
সুচরিতার মা আর কিছু বললেন না।উনি চাইছিলেন হিমেল আর একটু ওদের সাথে থাকুক। কিন্তু হিমেলের তো সে উপায় নেই। ওর অফিসে একগাদা কাজ জমে আছে। ডিলটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে একটু লসের মাঝে পড়েছে। ওকে তো সেটাও সামলে নিতে হবে।
হিমেলের আজ অফিস থেকে ফিরতে সন্ধে হলো। ততক্ষণে সাবেরাও বাড়ি ফিরে এসেছে। মাগরিবের নামাজ পড়ে সবাই চা খেতে বসলো। হিমেলের বড় ভাবি সখিনা মুড়ি মেখে টেবিলে দিলো।কারিমা চা বানিয়ে আনলো। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সাবেরা হিমেলকে বললো,
——তোর শ্বশুর এখন কেমন আছে? উনাকে কি ওয়ার্ডে ভর্তি করেছিস?
——না, কেবিনে ভর্তি করেছি।
—–সেতো অনেক টাকার ধাক্কা।
——সেই চিন্তাতো তোকে করতে হবে না।
—–না, তবে দেখিস তোর উপর আবার এসে না পরে।
——পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের পার্সোনাল স্পেস থাকে। সেখানে আচমকা ঢুকে পড়া অভদ্রতা।
——তুই কি আমাকে অভদ্র বললি?
——সেটা তুুই বুঝে দেখ।
—— মা দেখলে, বিয়ে করে তোমার ছেলের ভালো উন্নতি হয়েছে। এক্কেবারে বৌয়ের গাঢ়ল হয়েছে।
সুচরিতা নিজের রুমে বসে সবই শুনতে পারছে। এসব শুনতে শুনতে ও এই সংসারটার উপর ধীরে ধীরে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। ওর মনে হতে লাগলো ও পা দুটো যেন সংসার নামক চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে হয়তো কোনোদিন ওর উত্তরণ ঘটবে না।
কথার প্রসঙ্গ ঘুরাতে হিমেলের মা ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–তোর শ্বশুর কেমন আছে?
——ভালো না।
মায়ের কথার উত্তর দিয়ে হিমেল আবারও রাগত স্বরে বললো,
——ধন্যবাদ দাও আপু, আমি যে বৌয়ের গাঢ়ল হয়েছি। পরনারীতে তো আর আসক্ত হই নাই।
——তোর মুখের ও কোনো লাগাম নেই।
এরপর হিমেল আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে আসলো। সুচরিতাকে নিয়ে আবার এখুনি বের হতে হবে।
সাবেরা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
——তোমার বাড়িতে আর আসা যাবে না দেখছি?
——আসলে ওর মাথাটা ঠিক নেই। সংসারের বড়বড় দায়িত্বগুলো তো ওকেই পালন করতে হয়। সোহেল বিদেশে যেতে চাইছে সে খরচ তো ওকেই বহন করতে হবে। আবার কারিমা আর জেবারও খরচ চালাতে হবে। এদিকে হুট করে ওর শ্বশুরটা অসুস্থ হয়ে পড়লো। সোহেল তো ওখানে গিয়ে সাথে সাথে চাকরি পাবে না।
——কষ্ট করে ছেলে মানুষ করেছো। বাবার পেনশনের টাকাতো সব ওর হাতে তুলে দিয়েছো। তাই দায়িত্ব তো ওকেই সবচেয়ে বেশী পালন করতে হবে। দেখো শ্বশুর বাড়ির দায়িত্ব তোমার ছেলের উপর এসে না পরে? হাজারও হোক বড় জামাই বলে কথা।
——ওর ব্যবসাটাতো ভালো যাচ্ছে না। শ্বশুর বাড়ির দায়িত্ব নেবে কিভাবে? দায়িত্ব পালন করতে গেলে টাকা লাগে। একটা ডিল তো হাতছাড়া হয়ে গেল।
——যাই বলো মা,তোমাকে আরোও শক্ত হতে হবে। তোমার ছোটো বউমা কিন্তু একটু অন্য ধাঁচের। তাই লাটাইটা নিজের হাতে শক্ত করে ধরে রেখো।
হিমেলের আসলে কিছুই ভালো লাগছে না। জগতের সব দায়িত্ব যেন ওর। অথচ সবাই ওর দোষটাই খুঁজে বেড়ায়। রুমে এসে সুচরিতাকে তাড়াতাড়ি রেডী হতে বললো। সুচরিতা হিমেলকে বললো,
—–আম্মা আর সুসমিতার জন্য কিছু খাবার নিয়ে যেতে চাই।
—–হুম,পথ থেকে কিনে নিবো। এখন তাড়াতাড়ি চলো।
শাশুড়ী আর ননসকে বলে সুচরিতা হিমেলের সাথে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো।
বাবাকে দেখে সুচরিতার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। শরীরের বাঁপাশটা অবশ হয়ে আছে। মুখটা একটু বেঁকে আছে। কথা বলতে পারছে না। ওকে দেখে ওর বাবার দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ডাক্তার পেশেন্টের কাছে বেশী ভীড় জমাতে নিষেধ করেছে। হিমেল ওর শ্বশুর পাশে কিছুক্ষণ বসলো। সুচরিতা আর সুসমিতা ওদের মা সহ কেবিনের বাইরে চলে আসলো। সুচরিতার দিকে তাকিয়ে ওর মা বললো,
—–তোর শরীরের এই হাল হয়েছে কেন?মনে হচ্ছে সোমালিয়া থেকে উঠে এসেছিস।
—–আম্মা আমি যা খাই সব বমি হয়ে বের হয়ে যায়। আর সব খাবার খেতেও পারি না। গন্ধ লাগে। রাতে কি তোমরা দু,জন থাকবে?
——না, শোভন আসবে।
সুসমিতার মুখটা খুব মলিন দেখাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে সুচরিতা বললো,
——তোর লেখাপড়া কেমন চলছে?
——চলছে কোনোরকম।
একটা গুমোট পরিবেশ। হবে নাই বা কেন? পরিবারের কর্তা ব্যাক্তিটি যখন এভাবে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন পুরো পরিবারটাই মুখ থুবড়ে পড়ে। সুচরিতা বুঝতে পারছে ওর মায়ের সংসারে একটা অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ভাই দুটো মানুষ হয়ে কবে এই সংসারের হাল ধরবে তা একমাত্র আল্লাহপাক ভালো জানেন। এদিকে সুসমিতার লেখাপড়া বিয়ে শাদির ব্যাপার আছে। এসবভেবে সুচরিতার খুব অস্থির লাগছে।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সুচরিতা আর হিমেল বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। পুরো পথ সুচরিতা গাড়িতে বসে কোনো কথা বললো না। মনে মনে ভাবলো ওর মায়ের পরিবারে হেল্প করতে গেলে হিমেলের সাহায্য ওকে নিতে হবে।ওর সাহায্য নিতে গেলে শ্বশুরবাড়ির অনেক কিছুই ওকে সয়ে নিতে হবে। মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরি খুঁজে নিতে হবে।তাহলে মা ভাইবোনকে হেল্প করা একটু সহজ হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। এখন পর্যন্ত হিমেলের কাছে ও টাকা চেয়ে বাবা মাকে সাহায্য করেনি তারপরও শ্বশুর বাড়িতে এসব নিয়ে ওকে কথা শুনতে হয়। এছাড়া নানাবিষয় নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নিত্য ক্যাচাল ওকে সহ্য করতে হয়। আর সহ্য না করেই বা করবে কি? বাবা মায়ের সংসারে তো ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। আর ও ওর শ্বশুর বাড়ির এসব কথা মায়ের বাড়িতে বলে না। বলেই বা কি হবে। শুধু কথার ডালপালা ছড়াবে।ওদেরও সামর্থ নেই ওকে সাপোর্ট দেওয়ার। শেষমেষ ওকেই সবকিছু হজম করে নিতে হবে। দুই পরিবারের চাপে হয়ত একদিন সুচরিতার নিজের আমিটা হারিয়ে যাবে।
হিমেল দেরী করে হাসপাতাল যাওয়াতে ওর বাবার ভর্তি হতে একটু দেরী হলো। এই ব্যাপারটা নিয়ে ওর মাকেও একটু বিরক্ত মনে হলো। সুচরিতা মনে মনে নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করতে লাগলো। ও,কি আসলে বোকা নাকি একজন সংবেদনশীল মানুষ। ওর অপরাধ ও আপন মানুষগুলোকে খুব ভালোবাসে। অন্যায় হিপোক্রেসি সহ্য করতে পারে না। রাতে এক কথা দিনে আর এক কথা এসব মানুষদের ও এড়িয়ে চলতে ভালোবাসে। সংসার আসলেই এক রঙ্গ মঞ্চ। প্রতিদিন এখানে কতো রঙ্গের নাটক মঞ্চস্থ হয়। আহারে জীবন! ভাবতে ভাবতে গাড়িটা কল্যানপুরে ওর শ্বশুরবাড়ির দরজার সামনে পৌঁছে গেল।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-এগারো
মাহবুবা বিথী
।রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সুচরিতার চোখে একদম ঘুম আসছে না। হিমেল শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। বেচারা খুব টায়ার্ড। সারাদিন আজ অফিস হাসপাতাল মিলিয়ে অনেক ছোটাছুটি করতে হয়েছে। কিন্তু সুচরিতার চোখে আজ যেন কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না। বুকের ভিতর কষ্টের লাভা স্রোত বইছে। বাবাকে দেখে আসার পর ওর কিছুই ভালো লাগছে না। ওর বাবাকে সুস্থ করতে অনেক টাকার দরকার।
ওর মা কেমন করে ম্যানেজ করবে কে জানে? ও অনার্স কমপ্লিট করে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। বাবা মা রাজি হলেন না। সুচরিতা ভাবছে উনাদের দোষ দিয়েই বা কি হবে। বাসার সামনে সবসময় বখাটে ছেলেদের আড্ডা লেগেই থাকতো। ওর বাবা একদিন ওদের উপর চড়াও হওয়াতে শোভনকে ধরে রাস্তায় পেটালো। আবার ফোনে হুমকি দিলো যদি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে তাহলে সুচরিতাকে তুলে নিয়ে যাবে নয়ত মুখে এসিড মারবে। বাবা মা রিক্স নিতে চাইলেন না। অগত্যা বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। সবই সুচরিতার ভাগ্য। বিয়ের পরে বেশ কিছুদিন ভালোই ছিলো। এখন এখানে আবার শনির দশা লেগেছে। ও ভালো করেই জানে ওর বাবা অসুস্থ হওয়াতে শ্বশুরবাড়ির সামনের দিনগুলিতে না জানি ওকে কতোকিছু সহ্য করতে হয়। সুচরিতা ভাবছে হিমেলের কাছে হাজার বিশেক টাকা চেয়ে ওর মায়ের হাতে দিবে। কিন্তু কিভাবে চাইবে? কেমন যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকছে। লজ্জা করেই বা কি হবে। ও নিজেকে এই বলে সান্তনা দেয় ওর স্বামীর টাকার উপরে ওর ও তো অধিকার আছে। সুতরাং ওর প্রয়োজনে ও টাকা চাইতেই পারে। কিন্তু এ বাড়িতে এ কথা জানাজানি হলে ওকে যে কতো অপমান হজম করতে হবে। নাহ্ ওকে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করতেই হবে। তাহলে ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। যদিও শাশুড়ী মা আর পড়াতে চাইছেন না। সুচরিতা জানে না সামনে ওর কি দিন অপেক্ষা করছে?
এরমাঝে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। আজ শুক্রবার। আজকে সুচরিতার বাবার হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার কথা। সন্ধায় হিমেল আর সুচরিতা হাসপাতালে যাবে। রিলিজ হওয়ার পর সুচরিতা ওর বাবাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। ও শেষ পর্যন্ত হিমেলের কাছে টাকা চাইতে পারেনি। সুচরিতা ভাবছে ওর কাছে জমানো যে দশহাজার টাকা আছে সেটাই আপাতত মায়ের হাতে তুলে দিবে। চাইবে বা কিভাবে? ওর মেজ ভাসুর বিদেশে যাবে বলে দশ লক্ষ টাকা খরচ করতে হলো। আপাতত ইটালী যাচ্ছে। সেখান থেকে ইউকে তে যাওয়ার চেষ্টা করবে। পুরো টাকাটাই হিমেলকে দিতে হয়েছে। ডোরবেলটা বেজে উঠলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল সাতটা বাজে। এতো সকালে কে আসলো? সুচরিতা দরজা খুলে দেখে আতিক এসেছে।
——কেমন আছেন দুলাভাই?এতোদিনপর আমাদের কথা মনে পড়লো। তাও কপাল ভালো আপু এখানে আছে বলে আপনার চেহারাটা দেখতে পেলাম।
——আর বলো না। অফিসের ব্যস্ততায় কোথাও একটু যাওয়ার উপায় নেই। কর্পোরেট সেক্টরের জব মানেই খাটিয়ে মারবে। যে টাকাটা দেয় সেটা পুরো উসুল করে নেয়। তা তোমার আপু কই।
—–মায়ের রুমে। আপনি বসেন। আপুকে ডাকছি।
আতিক আসাতে সুচরিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রবলেমেটিক পারসনটা আজ বিদেয় হবে। অথচ সুচরিতার আদর আপ্যায়ন করতে ভালোই লাগে। কিন্তু এতো আপ্যায়িত হওয়ার পরেও সুচরিতার পিছনে লেগে থাকবে। সুচরিতা শাশুড়ীর রুমের দরজা নক করে বললো,
——আপু দুলাভাই এসেছে।
দরজা খুলে হাই তুলে সাবেরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
—–দিলে তো আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে।
—–দুলাভাই আপনার খোঁজ করছিলো। এজন্য ডাকতে আসলাম।
—–তা তোমার দুলাভাই কোন রাজকার্য করে এসেছেন যে ডাকলেই আমাকে ছুটতে হবে। সারা সপ্তাহ অফিস করে ঘুমানোর জন্য ছুটির দিনটায় একটু সময় পাই। নিজে তো চাকরি করো না বুঝবে কি করে চাকরি করার কতো জ্বালা।
এমন সময় দুলাভাই হা হা করে ছুটে এসে বললো,
—–আহ্ সাবেরা করছো কি? তোমাকে ডাকতে আমি তো ওকে পাঠালাম।
—–আজ তো যাবোই বলেছিলাম। তর সইছে না তোমার। সাতসকালে এসে হাজির হয়েছো। বাড়িতে তো কুটোটি নেড়ে দুটো করো না। শুধু চাকরিটা করে এমন ভাব দেখাও যেন আমায় উদ্ধার করে ফেলেছো। আরে বাবা চাকরি তো আমিও করি।
——তুমি এটা কিভাবে বললে,বিয়ের পর তুমি কোনোদিন বাথরুম ধুয়েছো? রান্না ঘর পরিস্কার করেছো?
এমন সময় রোমেল রুম থেকে বের হয়ে এসে বললো,
——আরে,আতিক ভাই তুমি কখন এলে?
সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–চা,নাস্তা কিছু দিয়েছো?
সুচরিতা মাথা নাড়ালো। আর মনে মনে ভাবলো কাহিনীকার ঘুম থেকে উঠেই যে কাহিনী রচনা শুরু করলো চা পানি আর কখন দিবো।
——এখুনি দিচ্ছি ভাইয়া।
সুচরিতা কিচেনে এসে দেখল বড় ভাবি অলরেডী চা আর পাপড়ভাজা রেডী করেছে। সুচরিতাকে দেখে বললো,
——-আমি তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর এগুলো আমাকেও ফেস করতে হয়েছে। শাশুড়ী মায়ের ভাব দেখে মনে হয় উনার মেয়েরা রাজরানি আর ছেলের বউয়েরা ঘুটে কুড়ানি। তবে কারিমার সাথে পেরে উঠে না। তুমি সবজিটা চাপিয়ে দাও। চা,টা দিয়ে আসছি।
সুচরিতার এখন আর মনখারাপ হয় না।তবে ও একদিন না একদিন এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাবে।পাঁচফোড়নের ফোড়ন দিয়ে সবজি চাপিয়ে দিলো। লুচির ডোটা তৈরী করলো। ও আর এই মুহুর্তে এ বাড়ির কারো সামনে পড়তে চায় না। এমনিতেই আজ সন্ধায় হাসপাতালে যেতে হবে। ওর মা টাকা ম্যানেজ করতে পারলো কিনা ও জানে না। সুতরাং ওকে নিয়ে যদি কোনো অশান্তির শুরু হয় হাসপাতালে যাওয়াটা ভেস্তে যাবে।
আপন মনে নানা ভাবনায় সুচরিতা একটা একটা করে লুচি বানিয়ে রাখছে। শাশুড়ী কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিলো সুচরিতা যেন টের পায়নি। হয়তো সুচরিতাকে তার কাছে অন্যমনস্ক লাগছিলো। কাশি দেওয়াতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে শাশুড়ী এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সাথে আই কন্টাক হওয়াতে বললেন,
—–দশটা বেজে যাচ্ছে। এখনও নাস্তা বানানো হলো না। দাও লুচিগুলো আমি ভেজে দিচ্ছি।
লুচি ভাজতে গিয়ে সুচরিতাকে বললেন,
——সাবেরার কথায় কিছু মনে করো না। শ্বশুর বাড়িতে এ রকম হালকা পাতলা কথা শুনতে হয়। আমিও শুনেছি। শোনো স্বামীকে ভালোবাসতে হলে সংসারকে ভালোবাসতে হয়। শ্বশুরবাড়ির নিয়ম কানুনের সাথে মানিয়ে নিতে হয়। স্বামীতো তার স্ত্রী পুত্র কন্যার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করে তেমনি স্ত্রীকে সংসারের সব জ্বালা সঁয়ে সংসারটাকে পরম যত্নে আগলে রাখতে হয়। এই আমাকে দেখ বাবার ঘর ছেড়ে স্বামীর ঘরে এসেছি। স্বামী চলে যাওয়ার পর ছেলেরা আমার দেখাশোনা করছে। মান অভিমান রাগ তাপ পুষে রাখলে তো সংসার হয় না।
সুচরিতার লুচি বানানো শেষ হয়ে গেল। ও সন্ধায় হাসপাতালে যাবে। শাশুড়ীর মুড দেখে ও বললো,
—–মা আমাকে সন্ধায় একটু হাসপাতালে যেতে হবে।
—–ঠিক আছে যাবে। এখন নাস্তাটা টেবিলে দাও।
এমন সময় কারিমা এসে বললো,
—–মা আমি টেবিলে নাস্তা দিয়ে দিচ্ছি। সুচরিতা একটু রেস্ট করুক। সুচরিতা ছোটো ভাইকে ডেকে দাও।
সুচরিতা হিমেলকে ডেকে দিতে নিজের রুমে চলে আসলো। হিমেল অলরেডী ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে ফ্রেস হচ্ছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
—–মনটা এতো বিমর্ষ কেন? ইদানিং খেয়াল করছি তুমি খুব মনমরা হয়ে থাকো। তারপর একটা খাম বের করে সুচরিতার হাতে দিয়ে বলে আজ বাবাকে রিলিজ করবে। এখানে দশ হাজার টাকা আছে মাকে দিয়ে দিও।
হিমেল সবার সাথে নাস্তা করতে ডাইনিং এ চলে গেল। হিমেলের উপর পুষে থাকা সুচরিতার অভিমানের অনলে যেন হঠাৎ এক ঝটকা বৃষ্টি এসে শীতল করে দিলো। ওর বাবাকে যে হিমেল ফিল করেছে এটা ভাবতেই সুচরিতার বেশ ভালো লাগছে।
আতিক লুচি মুখে পুড়ে বললো,
—–কারিমা তোমার হাতে যাদু আছে। এতো সুন্দর লুচি বানিয়েছো মুখে দেওয়ার সাথে সাথে যেন অমৃতের মতো লাগছে।
সোহেল গদ গদ হয়ে বললো,
—–সব আমার মায়ের ট্রেনিং।
তুশিও ওর বাবার সাথে সুর মিলিয়ে বললো,
—–আম্মুকে তো বলেছি মামীদের কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে নিতে। আম্মুর রান্না তো মুখে দেওয়া যায় না।
তাপসী বোনের উপর রেগে গিয়ে বললো,
—–তুশি তোমার বুঝতে হবে আম্মু জব করে।
আতিকের শাশুড়ী সখিনাকে ডেকে বললো,
—–বড় বউ মা সুজিটা নিয়ে এসো।
সখিনা সুজি নিয়ে এসে সামনে দিলো। আতিক সুজি মুখে দিয়ে বললো,
—–কোনটা রেখে যে কোনটা খাই। যেমনি লুচি তেমনি সবজি তেমনি হয়েছে সুজি। মা কি ট্রেনিং যে আপনি বউদের দিয়েছেন তা ওদের রান্না খেলে যে কেউ বুঝবে রাঁধুনি হিসাবে আপনার যোগ্যতা ওয়াল্ড সেরা শেফদের মতোন।
সুচরিতা নিজের রুমে বসে আপনমনে ভাবতে লাগলো সবজি আর লুচিটা যে ও বানালো কেউ একবার মুখ ফুটে বললো না। এখন ও ভাবছে এই পলিটিক্স করার জন্য কারিমা ওকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। এ এমন একজন মানুষ সারাক্ষণ পলিটিক্স করবে। মানুষের পিছনে লেগে থাকার এতো শক্তি ও কোথায় পায়? আতিক হিমেলকে দেখে বললো,
——সুচরিতাকে দেখছি না যে?ওর কি শরীর খারাপ?
হিমেল কিছু বলার আগেই কারিমা বললো,
—–এই সময় শরীরের তো কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। এই ভালো তো এই খারাপ।
এমন সময় সুচরিতা এসে বললো,
——না, দুলাভাই শরীর ভালোই আছে। খারাপ থাকলে কি লুচি আর সবজি বানাতে পারি?দুলাভাই আর এক কাপ চা দিবো?
——তা মন্দ হয় না।
সুচরিতার কিচেনে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো ওর কথা শুনে সবার যেন মুড অফ হয়ে গেল।
চলবে