সুচরিতা পর্ব-০১

0
1434

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

সুচরিতা যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে তখন কেবল এইচএসসি পাশ করেছে। একান্নবর্তী পরিবারে ওর বিয়ে হয়েছে। ওর দুজন ননাস আর একজন ননদ। সবার তখন বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা সবাই চাকরিজীবি। যে যার চাকরি সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তবে সময় পেলে বাপের বাড়ির হাড়ির খবর নাড়াচাড়া করতেও ছাড়ে না। আবার কূটকচালীতেও অংশ নেয়। সে কথায় পরে আসছি।
আর ভাসুর দু,জন। সুচরিতা ছিলো এবাড়ির ছোটো বউ। কিন্তু ওর বর সবচেয়ে বেশী আয় রোজগার করতো। সংসারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশী পালন করতো। ওর বরের এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা ছিলো। সুচরিতার বিয়ের দু,বছর আগে শ্বশুর মারা যান। শাশুড়ীমা এখন এই সংসারের কত্রী। বড় আদর করে ওকে বউ করে নিয়ে আসেন। এটাই ওর জীবনের সবচেয়ে বড় কাল হয়। সুচরিতার দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি মেধাবী ছাত্রী। ওর পড়াশোনার ইচ্ছে দেখে শাশুড়ী মা ওকে অনার্সে ভর্তি করে দেন। বাকি দুই,জা এটাকে ভালোভাবে নিলো না। উনারা মেট্রিক পাশ করে এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে। শাশুড়ী মা ওদের কলেজে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু উনারা পড়াশোনা করলেন না। তাই সুচরিতার পড়াশোনাটা উনারা মেনে নিতে পারলো না। তারা শাশুড়ির কানে সুচরিতার বিরুদ্ধে বিষ ঢালার সুযোগ খুঁজতে লাগলো। শাশুড়ী মা ওর পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস ছিলেন। বাকী জায়েদের সাথে সুচরিতার গল্প করা, আড্ডা দেওয়া শাশুড়ী মা পছন্দ করতেন না। সে সময়টা ওকে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বলতেন। আবার কলেজ থেকে সুচরিতার ফিরতে দেরী হলে ওর জন্য আলাদা করে ভাত তরকারী বেড়ে রাখতেন। উনার ছোটো ছেলেকে যেহেতু ব্যবসার কাজে প্রায় দেশের বাইরে যেতে হতো সে জন্য ছোটো বউমার উনি ভালোই খেয়াল রাখতেন। এগুলো দেখে বাকী দুই জায়ের চোখ টাটাতে লাগলো। তারা প্রথমে নিজেদের স্বামীর কাছে সুচরিতার নামে কানভারী করতে লাগলো।

সুচরিতার বিয়ের সময় ওর বাবার বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো ছিলো। বাবা সরকারি চাকরিজীবি ছিলেন। ওরা দু,বোন দু,ভাই। সুচরিতা সবার বড়। ওর বাবার যতদিন চাকরি ছিলো ফলের সময় ঝুড়ি ভর্তি ফল শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। আবার মাঝে মাঝে বাজার থেকে বড় মাছ কিনে পাঠিয়ে দিতেন। ঈদ পার্বনে সুচরিতার জন্য শাড়ি আর ওর স্বামীর জন্য
শার্ট প্যান্ট পাঠিয়ে দিতেন। সুচরিতার তখন শ্বশুর বাড়িতে খুব কদর। কিন্তু ওর বড় দুই,জা মুখে কিছু না বললে সুচরিতার আদর দেখে হিংসায় জ্বলতো।
ওর বিয়ের তিন বছরের মাথায় ওর বাবা অবসরে যান। তখন আর আগের মতো ওর শ্বশুর বাড়িতে তেমন কিছু পাঠাতে পারেন না। সুচরিতার তখন একটু একটু করে কদর কমতে থাকে। পড়াশোনাটাও বাধাগ্রস্ত হয়। জায়েরা সুচরিতার পড়াশোনাতে বাধা দিতে লাগলো। ওর মেজ জা রাশিদা একদিন ওর শাশুড়ীকে বললো,
——মা, এ আপনার কেমন বিচার? আমরা দুই জা সারাদিন কাজ করবো আর সুচরিতা ড্যাং ড্যাং করে কলেজে যায়। ওকি আদৌ কলেজে যায় নাকি আড্ডা মারতে যায় কে জানে?
এদিকে সুচরিতা কলেজে যাওয়ার পর ওর বড় জা এসে শাশুড়ীকে বলে,
——মা আপনিতো জানেন না সুচরিতা কেমন অপচয় করে। তরকারীতে যখন তেল ঢালে মনে হয় তেল না উনি পানি ঢালছেন। আবার কাপড় ধোয়ার সময় পানির মতো সাফ এক্সেল খরচ করে। দু,দিনেই আপনার এতো যত্নে গড়া সংসার লাটে উঠবে।
ওদের দুই জায়ের ষড়যন্ত্রে শাশুড়ী মা কলেজে যাওয়ার উপর প্রথমে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। সপ্তাহে তিনদিন সুচরিতা কলেজে যেতে পারবে এই আইন আরোপ করলেন। সুচরিতাও দমে যাবার পাত্রী নয়। তাই বাকি দু,দিনের পড়াটা বন্ধু বান্ধবীদের কাছে থেকে টুকে নিতো। তাও পড়াশোনাটা সুচরিতা চালিয়ে গেল। তবে ও খুব অবাক হলো। যে শাশুড়ী মা ওর পড়াশোনার ব্যাপারে এতোই সিরিয়াস ছিলেন কি এমন মন্ত্রনা ওর জায়েরা দিলো যে উনি আস্তে আস্তে ভোল পাল্টাতে শুরু করলেন। এটাকি শাশুড়ী মায়ের অভিনয় ছিলো ও বুঝে উঠতে পারলো না।

সুচরিতার বাবা অবসরে গেলেও আমের সিজনে আগের মতো ঝুড়ি ভর্তি আম পাঠাতে না পারলে ও আট দশ কেজি আম নিয়ে উনি একদিন সকাল বেলা সুচরিতাকে দেখতে যান। বাবাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে রেখে সুচরিতা আমের ব্যাগটা ভিতরের রুমে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর মেজ জায়ের কথা শুনতে পেলো। মেজ জা ওর শাশুড়ীকে বলছে,
——মা এই যে আমগুলো যে সুচরিতার বাবা এনেছে এর টাকাটা মনে হয় ছোটো ভাই দিয়েছে।
ওর শাশুড়ী চিন্তিত হয়ে বললো,
——তুমি কিভাবে জানলে?
——আমি সেদিন সুচরিতাকে ছোটো ভাইয়ের কাছে টাকা চাইতে দেখেছি। ও মনে হয় সেদিন টাকাগুলো নিয়ে কলেজ যাওয়ার সময় ওর বাবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছে। আপনি বোঝেন না মা রিটায়ার মানুষ ফল কেনার টাকা কোথায় পাবে? সংসার চালাতেই তো উনি হিমশিম খাচ্ছেন।
সুচরিতা কাশি দিয়ে ঐ রুমে আমগুলো রাখতে গেল। ওর দুই জায়ের কূটনামিতে ওর শাশুড়ীর মেজাজটা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। আমের থলি সহ সুচরিতাকে দেখে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন,
——টাকা ধার করে তোমার বাবার ফকিরের ভিক্ষে আনার কি দরকার ছিলো? আর শোনো তোমার বাবা আসার আগে তো খবর দিয়ে আসেননি। সুতরাং অত আদর আপ্যায়ন করতে পারবো না। বাপের আদর না খেয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করো। সংসারে ম্যালা কাজ পরে আছে।
সুচরিতা অপমানে যেন মাটির সাথে মিশে যেতে চাইলো। শাশুড়ীর মুখের উপর শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ও জানে শাশুড়ী মায়ের কান ভাঙ্গিয়েছে ওর বড় দুই জা। তাই আর কথা বাড়ালো না। তবুও কষ্টে বুকটা ফেটে গেল। শাশুড়ীমা অন্যের কথা শুনে ওকে অপমান না করে যাচাই করে নিতে পারতেন। অথচ ওর বাপের যখন চাকরি ছিলো এই সুচরিতাই সুয়োরানি হয়ে ছিলো শ্বশুর বাড়িতে। আর রিটায়ার করার ছ,মাস হতে না হতে দুয়োরানিতে পরিনিত হলো। অথচ ওর স্বামীর আয়ে পুরো সংসার চলে। মেজভাসুর সরকারী অফিসের কেরানী। আর বড় ভাসুর ব্যাংকের ক্যাশিয়ার।
ও বাবাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ড্রইংরুমে বাবার কাছে মা ভাই বোনের খোঁজ নিলো। এমন সময় ওর বড় জা এসে নাস্তা দিয়ে বললো,
—–খালু কেমন আছেন? আসলে আপনি আসার আগে তো খবর দিয়ে আসেননি। ঘরে তেমন কিছুই ছিলো না। আর দোকানে পাঠানোর মতো বাসায় কেউ নাই।
নাস্তার আয়োজন দেখে সুচরিতার বাবা বললো,
——কোনো সমস্যা নাই। আমি ডায়াবেটিস রুগী। আমার এক কাপ চিনি ছাড়া চা হলেই হয়ে যায়।
——খালু আপনি মেয়ের সাথে গল্প করেন। আমার অনেক কাজ পরে আছে। আমি আসছি।
বড় জা চলে যাবার পর সুচরিতার নাস্তার আয়োজনের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো নোনা জলে সিক্ত হলো। এক কাপ চিনি ছাড়া চা,আর এক পিরিচ চানাচুর দিয়েছে। ওর বাবার কিডনির সমস্যার কারনে চানাচুর খাওয়া ডাক্তারের নিষেধ আছে। অথচ ওর বাবার যখন চাকরি ছিলো উনি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে দুহাত ভরে খরচ করতে পারতেন আর ওর শাশুড়ীও আদর আপ্যায়নের কমতি করতেন না। সুচরিতার বাবাও বুঝলেন এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। যাত্রাবাড়ি থেকে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কল্যানপুরে আসছেন। ভেবেছিলেন মেয়ের বাড়িতে দুপুরবেলাটা কাটিয়ে বিকালে বাড়ির পথে রওয়ানা হবেন। কিন্তু এখন তো সে উপায় নেই। যাই হোক চা খেয়ে সুচরিতাকে বললেন,
—–তোর শাশুড়িকে ডাক মা,আমার এখুনি বেরুতে হবে। দেখা করে চলে যাই।
——বাবা দুপুরে খেয়ে যাও।
——না,রে কাজের কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়লো। আজকের মধ্যেই শেষ করতে হবে। নইলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।
সুচরিতা আর কিছু বললো না। তারপর ঘরের ভিতরে গিয়ে শাশুড়িকে ডেকে আনলেন। শাশুড়ীকে দেখে ওর বাবা বললেন,
—–বিয়াইন আসসালামালাইকুম। ভালো আছেন?
—–ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আল্লাহপাক ভালোই রাখছেন। আপনার এখন চাকরি বাকরি নাই। কষ্ট করে ধার দেনা করে এগুলো আনার দরকার ছিলো না।
—–বেয়াইন আল্লাহপাক যেটুকু আমায় দিয়েছেন তাতেই আমার শোকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবো না। ধার দেনা করতে হবে না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি ভালোই চলতে পারবো। আজ তাহলে আসি বেয়াইন।
বাবা চলে যাওয়ার পর সুচরিতা আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করে মনে মনে শপথ নিলো ওর যদি মেয়ে হয় ওকে নিজের পায়ে দাড় না করিয়ে বিয়ে দিবে না। আজ যদি ওর চাকরি থাকতো তাহলে ওর বাবার আদর আপ্যায়ন সবই ঠিকমতো হতো। আর মানুষের এসব মিথ্যে কথা হজম করতে হতো না। ও যেখানে ওর হাতখরচ টুকু ওর স্বামীর কাছ থেকে চেয়ে নেয় না সেখানে কিভাবে ওর জা একটা জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা শাশুড়ীর কানে ঢুকিয়ে দিলো। আর শাশুড়ীমা সেটা বিশ্বাস করে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করলেন।
সুচরিতাকে বাহির থেকে দেখলে ননীর পুতুলের মতো মনে হলেও ওর ভিতরটা ছিলো ইস্পাতের মতো কঠিন। সুতরাং হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার মেয়ে সুচরিতা নয়। ওর স্বামী যেহেতু ব্যবসার কাজে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায় তাই বাড়ি আসার পর সংসারের কোনো কথা স্বামীকে জানায় না। ওর স্বামী হিমেল ওকে প্রচন্ড ভালোবাসে। যে কটাদিন থাকে সুচরিতা ওর মনটা খারাপ করে দিতে চায় না।
সেবার হিমেল সিঙ্গাপুর থেকে আসার সময় ওকে যেভাবে চমকে দিলো ওর সব কষ্টগুলো এক লহমায় দূর হয়ে গেল। যে তারিখে আসার কথা ছিলো সে তারিখে না এসে হিমেল দু,দিন আগে চলে এসেছিলো। সিঙ্গাপুরে গিয়ে হিমেল সেবার কাজে মন বসাতে পারেনি। সুচরিতার জন্য মনটা খুব পুড়ছিলো। কোনোকাজে মন বসাতে পারছিলো না। ওর বিদেশী পার্টনার টিংকু ওর মন খারাপ দেখে বললো,
——চলো, তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবো মুহুর্তে মন ভালো হয়ে যাবে।
—–কোথায় নিয়ে যাবে? আমি জানি এই মুহুর্তে বউ ছাড়া কেউ আমার মন ভালো করতে পারবে না।
——সেটাতো এই মুহুর্তে সম্ভব না। তবে আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবো তোমার শরীর ও মন দুটো ফুরফুরে হয়ে যাবে।

হিমেল হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত ন,টা বাজে। টিংকুর সম্পর্কে ওর অনেক কথাই শোনা আছে। এর মধ্যে নিত্য নতুন নারী সঙ্গ অন্যতম। ওর সাথে ব্যবসায়িক ডিলটা হওয়া এখনও হিমেলের বাকি আছে। তাই হিমেল এই মুহুর্তে টিংকুকে চটাতে চায় না। ওর সাথে গিয়ে দেখা যাক হিমেলের জন্য কি অপেক্ষা করছে।
টিংকু ওকে একটা সেভেন স্টার হোটেলে নিয়ে গেল। সেখানে সারিবদ্ধ ভাবে সুন্দরী রমনীরা বসে আছে। টিংকু ফিচেল হাসি দিয়ে বললো,
——তোমাদের মতো যারা ম্যারেড ব্যাচেলার বিজনেস ম্যান এদেশে বিজনেস করতে আসে শুধু তাদের জন্য আমাদের এই হেরেমখানা। এদেরকে একরাতের জন্য অনেক ডলার খরচ করতে হয়। যেটা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তোমার খরচটা আমি বহন করবো। এটা তোমার জন্য আমার স্পেশাল গিফট।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে