#সুগন্ধা [ তৃতীয় ও শেষপর্ব]
প্রভা আফরিন
সর্বদা ভেবে এসেছি আমি ভীষণ ধীরস্থির স্বভাবের একজন মেয়ে। এ নিয়ে কিঞ্চিৎ গর্বও ছিল। বিয়ের পর সেই গর্ব আমার চূর্ণ হয়ে গেল। নিজেকে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করতে লাগলাম অধৈর্য এবং অস্থিররূপে। আমার এহেন দুরবস্থার জন্য দায়ী আসিফ। ভদ্রলোকের মাঝে কি এমন চৌম্বকীয় আকর্ষণ আছে যা আমি এড়াতে পারি না। আবার নির্লজ্জের মতো জড়াতেও পারি না। শুধু ভেতরে ভেতরে দ’গ্ধ হই, গুমরে উঠি। আ’স’ক্তি যে কতটা ভ’য়ং’কর তা হা’ড়ে হা’ড়ে টের পাচ্ছিলাম।
আসিফ আমায় এড়িয়ে যায় বিষয়টা তেমন নয়। মাঝে মাঝে টের পাই ওই দুটি শীতল চোখ আমায় খুঁজে অস্থির হয়। সান্নিধ্য পেতে মড়িয়া হয়। কিন্তু স্বল্পভাষী স্বভাব তা মোটেও প্রকাশ করতে দেয় না। এই আপাদমস্তক গোমড়ামুখো মানুষটাই আবার ঘুমানোর পর একদমই শিশু হয়ে যায়। গুটিয়ে আসে বুকের মাঝে।
সংসারটায় আমি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছি। জড়িয়ে গেছি প্রতিটি আসবাব ও মানুষের সঙ্গে। গিন্নির মতো সবদিক তদারকি করি। শ্বাশুড়ির খাওয়া থেকে শৌচকর্ম সব নিজেই করি। আমার ননদ আপাতত আমাদের সঙ্গেই আছেন। তার পাঁচ বছরের ছেলেটি ভীষণ জে’দি স্বভাবের। মুখ ফুটে একবার যা বলবে তা না পাওয়া অবধি শান্ত হবে না। এমনকি অন্যকে আঘা’ত করতেও ছাড়ে না। একদিন রা’গে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে সে আমার দিকে কাচের বাটি ছুড়ে মে’রে’ছিল। লেগে চোখ ফুলে উঠল। আসিফ জানতে পেরে জেসমিন আপাকে জিজ্ঞেস করল। আপা আমাকে বাঁকা চোখে দেখে বললেন,
“বাচ্চা ছেলে একটু দুষ্টুমি করতে গিয়ে ভুল করে গায়ে লাগিয়ে দিয়েছে। এতে বিচার দিতে হলো?”
আসিফ হিমশীতল কণ্ঠে বলল,
“বাচ্চা ছেলে নাহয় ভুল করেছে, তুই কি সেই ভুলটা শুধরে দিয়েছিস?”
“শাসন তো কম করি না। জানোই তো ওদের গোষ্ঠী কেমন ব’দমে’জাজি। র’ক্তের ধারা ছেলেটাও পেয়ে বসেছে। একদমই কথা শুনতে চায় না।”
“কোনোদিন যদি বাটি ছুড়ে মা’রার জায়গায় ছু’রি মা’রে। তখনও কি এই গোষ্ঠীর যুক্তি খাটবে, জেসমিন?”
ভাইয়ের কণ্ঠের উত্তাপ পেয়ে জেসমিন আপা ভড়কে গেলেন। তুতলে বললেন,
“তা হতে যাবে কেন?”
“এমন ছোটো ছোটো জে’দে আশকারা পেয়েই একদিন বড়ো কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। বাচ্চা কেমন আচরণের হবে সেটা এই বয়সে নির্ভর করে প্যারেন্টিং-এর ওপর। স্নেহে অন্ধ হয়ে ছেলের ভুলগুলোকে র’ক্তের তেজ, গোষ্ঠীর নাম দিয়ে গ্লোরিফাই করছিস তুই। এটা ভুল নয় দোষ। আর দোষটা তোদের প্যারেন্টিং-এর।”
জেসমিন আপা সেদিনই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছাড়লেন। আমাকে হিসহিসিয়ে বলে গেলেন,
“আসতে না আসতেই ভাই-বোনের মাঝে ফাটল ধরাতে উঠেপড়ে লেগেছ! রূপ তো নেই, কী দিয়ে বশ করেছ ভাইয়াকে? নিশ্চয়ই ইমোশনাল ট্র্যা’পে ফেলে সাধাসিধা ভাইয়াকে দুর্বল করেছ নিজের প্রতি। তাই তো বলি আমার ননদের মতো অপরূপ মেয়েকে উপেক্ষা করে আমার যোগ্যতাসম্পন্ন ভাইয়া কেন তোমাকেই বউ করল। মোহ কে’টে গেলে দেখব কীভাবে ধরে রাখো এসব।”
তী’ক্ষ্ণ বাক্যবা’ণে আমি আহ’ত হলাম। জেসমিন আপার ননদের চোখ ধাধানো রূপকে উপেক্ষা করা যেকোনো পুরুষের কাছে কষ্টসাধ্য। শুনেছি সেই মেয়েটির সঙ্গে আসিফের বিয়ের কথা উঠেছিল। কোনো এক কারণে আসিফ তাকে প্রত্যাখান করে আমায় বিয়ে করেছে। আমার সেই হীনমন্যতায় ভোগা সত্ত্বাটা আবারো জাগ্রত হলো। বুকের ভেতর ছড়ায় অস্থিরতা। আসিফ আদৌ আমাকে ভালোবাসে তো? নাকি আমি শুধুই তার মোহ? কিংবা অসুস্থ শ্বাশুড়ির জন্য পার্মানেন্ট কেয়ারটেকার? আসিফের কাছে উগড়ে দিলাম সকল শ’ঙ্কা। জানতে চাইলাম আমাকে কেন বিয়ে করল, আদৌ কি সে আমায় ভালোবাসে? নাকি দয়াকে ভালোবাসা ভেবে মূ’র্খের স্বর্গে বাস করছি আমি?
আসিফকে আমি প্রথমবারের মতো ভ’য় পেলাম সেদিন। জানলাম রে’গে গেলে ওর চোখ লাল হয়। দৃষ্টির ধার সহ্য করা কষ্টকর। আসিফ ভর্ৎ’সনা করে বলল,
“ধরো একদিন তোমার স্বামী তোমাকে ছেড়ে গেল। কী করবে?”
মনে যা এলো ভাবনা চিন্তা ছাড়াই তড়িৎ উত্তর দিলাম,
“ম রে যাব।”
আসিফ দূরত্ব মেটাল। ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে শক্তহাতে চেপে ধরল আমার চোয়াল। আ’ক্রোশে উচ্চারণ করল,
“অবলা নারী! ভালোবাসা ভালো, তবে অন্ধ ভালোবাসা ভ’য়ং’কর। স্বামী ছেড়ে চলে যাবে আর তুমি সেই মানুষটার জন্য প্রাণ দিয়ে দেবে? নিজের প্রতি সামান্যতম ভালোবাসা, আত্মমর্যাদা নেই? প্রাণটা এতটাই ঠুকনো?”
আমি বিভ্রান্তি নিয়ে তাকাই। ভাবনার অধঃপতনে নত হয় নেত্র। আসিফ আবার বলল,
“বেলী, নিজেকে ভালোবাসতে শেখো। অন্যের ভালোবাসা তুমি তখনই অনুভব করতে পারবে যখন নিজেই নিজেকে ভালোবাসতে পারবে। হীনমন্যতায় ভুগে, অন্যের মন রাখার চেষ্টা করে তুমি কোনোদিন সুখী হতে পারবে না। আমি দূরে না গেলেও তোমার এই মানসিকতা তোমায় ধীরে ধীরে মে রে ফেলবে। তুমি আজ আমায় পুরোপুরি হতাশ করলে।”
একরাশ হতাশা নিয়ে ও চলে গেল। এরপরের সময়গুলো আমার জন্য দু’র্বি’ষহই ছিল। ভাবনার দরজায় সজোরে আঘা’ত লেগেছিল কিনা! সারাজীবন ভালো মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টায়, অন্যকে খুশি রাখার চেষ্টায় আমি কখন যে নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গেছি খেয়ালই করিনি। আমার পরিবার নির্ভরশীল মনোভাব এবং নিজেকে দুর্বল ভাবাই হয়তো এরজন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ছিল। নিজের প্রকৃত সত্ত্বাকে আবিষ্কার করলাম অসহায় রূপে। যে কিনা আমারই ভালোবাসার অভাবে জীর্ণতায় ভুগছে বছরের পর বছর। এরপরের দুটো দিন আসিফ কথা বলল না আমার সাথে। দূরে দূরে থাকল। তার অনুপস্থিতি আটচল্লিশ ঘণ্টার প্রতিটা মুহূর্ত আমায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল মানুষটা মুখ ফুটে না বলে আমায় কতটা ভালোবাসা বিলিয়েছে, কতটা যত্ন নিয়েছে। আর আমি কিনা সেই ভালোবাসায় সন্দেহ প্রকাশ করেছি! যে আমায় আলো দেখাল তাকেই আমি দুঃখ দিলাম! মরমে ম’রে যাচ্ছিলাম প্রতিটা মুহূর্ত। দূরত্বের ভার বইতে না পেরে ছুটে গেলাম ওর কাছে। কান্নাকাটি করে ভিজিয়ে দিলাম বুক। পাষাণ নরম হলো। আমায় আগলে নিয়ে জানাল সেই সুখকর শব্দ যা আমার সকল দ্বিধা, জড়তা, হীনমন্যতা এক নিমেষে দূর করে দিল।
“জানো বেলী, আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা আমার মা। গাত্রবর্ণ হিসেবে তিনি শ্যামলা হলেও আমার কাছে ভুবনমোহিনী। মাকে সব সময় বলতাম আমার এমন কাউকে চাই যার মাঝে আমার মায়ের ছায়া থাকবে। মায়ের মতো মমতা তার দুচোখে ভাসবে। মেয়েরা যেমন স্বামীর মাঝে বাবার ছায়া খোঁজে ঠিক তেমন। তোমাকে দেখে আমি চমকেছিলাম। ওই দুটি চোখের নমনীয়তা, শ্যামলা ত্বকে লতানো কোমলতা আমাকে থমকে দিয়েছিল। দ্বিতীয়বার ভাবিনি। মাকে বলেছিলাম এই মেয়েটিই বোধহয় সে যার জন্য আমার মায়াকাতর সংসারটা অপেক্ষা করছে। ওকে আমার চাই-ই চাই।”
এরপর আর কোনো জড়তা ছিল না দুটি প্রাণের মাঝে। আমি এক পা এগোলে বিনিময়ে ও দু-পা এগিয়েছে। সে রাতে আমার সর্বাঙ্গে যেন ভোরের পবিত্র শিশির ছুঁয়ে গেছিল। নিজেকে ভালোবেসে ওর প্রতি ভালোবাসা দ্বিগুণ হয়েছিল।
মাসখানেক বাদে হুট করেই রিতু আমার শ্বশুর বাড়িতে এসে হাজির। আমাকে জড়িয়ে ধরে বিস্তর কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। জানতে পারলাম শ্বশুর বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে। শ্বাশুড়ি হাজারটা আদেশ নিষেধের মধ্যে রাখছে। এদিক থেকে ওদিক হলেই বাঁকা চোখে তাকাচ্ছেন। এদিকে খোলা আকাশের মুক্ত বিহঙ্গটা সংসারের জটিলতায় পড়ে হাঁসফাঁস করছে। রিতু বাবার বাড়িতে ভীষণ যত্ন ও স্বাধীনতায় বড়ো হয়েছে। জল গড়িয়ে পর্যন্ত খায়নি। কৈশোরের রঙিন ও নির্ভার মনকে বাস্তবতার রুঢ়তা স্পর্শ করেনি কখনো। সেই নির্ভার মনটা বিয়ের পর সংসারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও বাস্তবতার মাঝে পড়ে দিশেহারা অনুভব করছে। একসময়ের প্রণয় প্রগাঢ়তায় উজ্জ্বল মুখখানা কেমন ফিকে দেখায়। অভ্রও তাকে বুঝতে চায় না। শাসন করে। জে’দি রিতুও দেখা যায় পালটা উত্তর দিয়ে দেয়, যথারীতি লেগে যায় ত’র্ক। গতকাল সেই ত’র্ক চরমে পৌঁছালে রিতু রা’গ করে বাবার বাড়িতে গিয়েছিল। মাও ওর দোষ ধরে জামাইয়ের পক্ষ টেনে শ্বশুর বাড়ি ফিরতে বললেন। রা’গে, দুঃখে, অসহায়তায় মেয়েটা ঘুরেফিরে আমার কাছে এসেছে। সেই সূত্রে আজ প্রথমবারের মতো অভ্রের ফোন এলো আমার কাছে।
“হ্যালো! বেলী বলছেন?”
“জি, আপনি নিশ্চয়ই অভ্র?”
অপরপাশের মৌনতায় অস্বস্তির বিস্তার হতেই নিশ্চিত হলাম অভ্রই ফোন করেছেন। কথা বলতে আমারও ইতস্তত লাগছিল। সঙ্গে সঙ্গে আসিফের বলা কথাটা মনে পড়ল। আমি কোনো ভুল করিনি, কাজেই অন্যের সংকোচের দায় আমার নয়। গলা ঝেরে বললাম,
“আপনি চিন্তা করবেন না, অভ্র ভাই। রিতু আমার কাছেই আছে।”
অভ্র একটু সময় চুপ থেকে অভিযোগের সুরে বলতে লাগলেন,
“আপনার বোনটাকে একটু বোঝান। বাচ্চাদের মতো জে’দ ধরে থাকে সবকিছুতে। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব বলে বলে করাতে হয়। সামান্যতম ম্যাচুরিটি নেই, রেসপন্সিবিলিটি নেই।”
“বিয়ের আগে তো জানতেন আপনি একজন কিশোরীকে বিয়ে করছেন। একটা বছর তার সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কও রেখেছেন। তখন যেহেতু বাচ্চা ভেবে আশকারা দিয়েছেন তাহলে এখন কেন মুরুব্বিদের মতো ম্যাচুরিটি খুঁজছেন?”
অভ্র বোধহয় এতটা শক্ত আচরণ আশা করেননি। আমার মা আবার জামাই অন্ত প্রাণ। দোষ জামাই করলেও দায়টা মেয়েকে মুখ বুজে মেনে নিয়ে স্বামীকে মান্য করে চলতে হবে। মা নিজেও সর্বদা বাবার সামনে নিচু হয়ে থেকেছেন। তাই রিতুর সদ্য গড়ে ওঠা সংসারের জটিলতায় মা একই ফর্মুলা খাটাতে চেয়ে নিজের মেয়েকেই মানিয়ে নিতে জোর দিচ্ছিলেন। যার পরোক্ষ আশকারা পাচ্ছিল ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। অভ্র বললেন,
“সময়ের সঙ্গে তো মানুষের ম্যাচুরিটি গ্রো করে। সিচুয়েশন বুঝে আচরণ করতে হয়। রিতুর মাঝে সেসবের বালাই নেই।”
“সময়ের সঙ্গে ম্যাচুরিটি আসবে কিন্তু প্রশ্নটা হলো, আপনি কি ওকে সময়টা দিচ্ছেন? উপযোগী পরিবেশ বা ভরসা দিচ্ছেন? বিয়ের আগে প্রেমের আলাপ করতে যেভাবে সময় দিয়েছেন বিয়ের পরে সংসারী আলাপে কি একই সময় ব্যয় করেছেন?”
বলতে বলতে হঠাৎ রে’গে গেলাম আমি। মনে জমে থাকা ক্ষো’ভের কীটগুলো যেন শেকল ভে’ঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জানতাম অভ্র উত্তর দিতে ব্যর্থ। আজকে নিজেকে নিবারিত করলাম না। বললাম,
“আপনারা রেডিমেড জামা পরে, রেডিমেড খাবার খেয়ে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে এখন রেডিমেড বউয়ের মাঝেও নিজেদের চাহিদামতো সবগুণ উপস্থিত চান। অথচ বিয়ের আগে মেয়ের রূপ দেখে এতই মুগ্ধ ছিলেন যে বাকিসব তুচ্ছ ছিল। আপনাদের উচিত ছিল একবছর আগেই নিজেদের পছন্দ, অপছন্দের একটা লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া। তাহলে শ্বশুর বাড়িতে পা দেওয়ার আগে প্রস্তুতি নিয়ে যেত।”
চেঁচামেচিটা আসলে সবাইকে দিয়ে হয় না, সবাইকে মানায়ও না। একটু ক্ষো’ভ প্রকাশ করতে গিয়েই হাঁপিয়ে উঠেছি। বুক ধড়ফড় করছে। দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম। অভ্রের মৌনতায় আবারো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম,
“অভ্র ভাই, শুনতে খারাপ লাগছে জানি কিন্তু আপনার দোষটাও প্রকট। রিতু ইমম্যাচিওর, জে’দি, খামখেয়ালি মেজাজের, মনের কথা সরাসরি বলে দেয় হোক সে ভালো কি মন্দ। কিন্তু ওর দোষ আটআনা হলে আপনার দোষও বাকি আটআনা। আপনার কি উচিত ছিল না রিতুকে সংসারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করা? একা একটি মেয়ে পরিবার ছেড়ে আপনার সংসারে গেছে। শুধু কি তারই দায় আপনাদের সকলের মন মতো হওয়ার? বিপরীতে আপনারা ওর মনের খবর নিয়েছেন? সকলের মনমতো হওয়ার দায় একজনের ওপর দেওয়ার চেয়ে একজনের মনের দায় সকলের নেওয়া সহজ। সকলের কথা বাদ, আপনি স্বামী হয়ে যদি বোঝেন তাহলেই সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যেত। আসলে আপনারা দুজনেই ইমম্যাচিওর এবং ধৈর্যহীন মানুষ। আপনাদের দুজনেরই ম্যাচিওর হতে হবে।”
ত’র্ক বিত’র্কের শেষে ওপাশ থেকে একটা প্রলম্বিত শ্বাসের ধাক্কা এসে লাগল স্পিকারে। অভ্র স্তিমিত সুরে বললেন,
“এই ইমম্যাচিওর চোখে জীবনে একটাবার বোধহয় ম্যাচিওর মানুষটাকে পছন্দ করেছিলাম। আফসোস সেদিন মায়ের অবাধ্য হতে পারিনি। সকলের মতোই মনশ্চক্ষুর চেয়ে চর্মচক্ষুকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। হীরে ফেলে উজ্জ্বল কাচের পেছনে ছুটেছি। সেই আফসোসের ভার সারাজীবন বইতে হবে।”
“স্ত্রীর সম্মান রাখা আপনার দায়িত্ব। অন্যের সামনে তাকে কাচ বলে তাচ্ছিল্য করতে পারেন না। দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক করুন। আপনি একটি হীরকখণ্ড পেয়েছেন। তাকে ঘষেমেজে অলংকারের আকার দেওয়ার দায়িত্বটা এখন আপনার।”
ফোন রেখে দিলাম। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল ভাগ্যিস মায়ের অবাধ্য হননি। বিয়ের পর প্রতিনিয়ত অন্যের থেকে বউয়ের রূপের ঘাটতির কথা শুনে, চর্মচক্ষুকে প্রাধান্য দিয়ে কিছুদিন পর যে সুন্দরের প্রতি আকর্ষিত হতেন না তার কি নিশ্চয়তা? বিষাদে জর্জরিত আমিটাই বা কী করে আসিফের মতো নিখাদ মনের মানুষটাকে পেতাম? এই সংসারটা যে আমারই অপেক্ষায় ছিল। একটা কথা এখন খুব করে মানি, “নিশ্চয়ই দুঃখের পরেই আছে সুখ, কষ্টের পরে আছে স্বস্তি। (সূরা ইনশিরাহ ৯৪, আয়াত ৫-৬)”
পিছু ফিরতেই আসিফকে দেখলাম। ভদ্রলোকের নিঃশব্দে চলাফেরা করে চমকে দেওয়ার অভ্যাসটা এখনো গেল না। আমার মলিন মুখটা দেখে উনি ছড়া কে’টে বলল,
“এই অমাবস্যার রাতে,
শ্রাবণ মেঘের ঘনঘটা কেন তোমার কায়াতে?”
“আমিই তো রাত।”
“তুমি হলে রাত আমি নিশাচর,
অমাবস্যার আলিঙ্গনে মাতব জীবনভর।”
আমি হেসে ফেলি। বিশাল বুকের ছায়ায় নিজেকে গুটিয়ে নেই। সাহিত্যিকদের বইয়ের সৃষ্ট কৃষ্ণকলি কিংবা শ্যামাঙ্গিনীদের মতো অবহেলা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানো, রুখে দাঁড়ানো কিংবা শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রজ্জ্বলিত হওয়ার সংকল্প আমি কখনো করতে পারিনি। শুধু পেরেছি ভালোবাসতে। যে ভালোবাসার আকাঙ্খা আমায় নিজেকে অবহেলা করতে শিখিয়েছে, সেই ভালোবাসার প্রাপ্তিই আমায় নিজেকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে। চিনিয়েছে মায়ার সুবাস। আসিফ আমার জীবনের দ্যুতি হয়ে এসেছিল, আর আমি তার মায়াকাতর জীবনের সঙ্গী হয়ে। একে অপরের কমতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পরিপূরক হতে চেয়েছি। আসিফ আমার লজ্জাবনত মুখখানি আজলায় তুলে মুগ্ধ গলায় বলল,
“তোমার উষ্ণতায় সকাল আসুক
তোমার তরেই হোক সন্ধ্যা
মায়ায় ঘেরা সুবাস তুমি
আমার সুগন্ধা।”
(সমাপ্ত)