#সুগন্ধা [১] (ছোটোগল্প)
প্রভা আফরিন
আমার বিয়েটা ছিল অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। বিয়ের আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার কোনোরকম সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একটি মানুষকে আমি কবুল বলে নিজ জীবনের অংশ করে নিয়েছিলাম। জীবনের বদলটাও হয়তো সেখান থেকেই।
আমি সাদামাটা, মধ্যবিত্ত পরিবারের অনুগত একটি মেয়ে। ভালো রান্না জানি, আবৃতি জানি, পড়াশোনায় ফার্স্ট সেকেন্ড হতে না পারলেও প্রথম সারিতেই থাকতাম। ভালো মেয়ের যত বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার সবই কমবেশি ছিল। ভালো মেয়ের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতেই কিনা আমার কখনো প্রেম হয়ে ওঠেনি। মনের মাঝে নিষিদ্ধ অনুভূতির অনুপ্রবেশ ভালো লাগা অবধিই সীমাবদ্ধ ছিল। আর ছিল ভালোবাসার অপেক্ষা। একটি হালাল ভালোবাসায় মোড়া স্বপ্ন মনের মাঝে বুনতে শুরু করেছিলাম ভালোবাসা বোঝার পর থেকেই।
আমার মাধ্যমিক পাশ ব্যবসায়ী বাবা ও অক্ষরজ্ঞানহীন সরল মায়ের তিন কন্যার বড়ো জন আমি। যথারীতি মেয়ে যৌবনে পদার্পণ করতেই তাকে পাত্রস্থ করার চিন্তা শুরু হলো। ঠিক তখনই আমি অবগত হলাম এই সমাজে একজন ভালো মেয়ের চেয়েও সুন্দরীদের কদর বেশি। প্রথমবার পাত্রপক্ষের সামনে বসার আনকোরা অনুভূতিতে যখন আমি ভী’তস’ন্ত্র’স্ত তখন একটা পুরুষকন্ঠ সহাস্যে বলেছিল,
“পানি খাবেন?”
আমি জড়তায় কণ্ঠ হতে শব্দ বের করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তিনি তখন পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়েছিলেন। ভরসার চোখে বলেছিলেন,
“আপনি সহজ হোন। আমরা শুধু পরিচিত হবো।”
লোকটির স্বতঃস্ফূর্ততা আমায় মুগ্ধ করেছিল। মনে হয়েছিল কতদিনের চেনা। জানলাম উনার নাম অভ্র। স্বভাবে মিশুক প্রকৃতির একজন মানুষ। অভ্র যাওয়ার সময় আমার হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,
“আমাদের পরিচয় সবে শুরু…”
অভ্রের মিষ্টি হাসির আশকারায় আমি কেন জানি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলাম। সেই অনুভূতি আমার জন্য নতুন ছিল। ছিল প্রস্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় কোমল ও স্নিগ্ধ। কিন্তু সেই ফুল অকালেই ঝরে গেল দুদিন বাদে অভ্রদের বাড়ি থেকে আসা ফোনে। তারা জানালেন আমাকে নয় তাদের পছন্দ হয়েছে আমার ছোটোবোন রিতুকে। অভ্রদের আসার দিনই খেয়াল করেছিলাম অভ্রের মায়ের আমার চেয়েও আমার ছোটো বোনের প্রতি আগ্রহ বেশি। আমার ইন্টার পড়ুয়া বোন রিতু আমার থেকে দুই বছরের ছোটো। গায়ের রঙ শুভ্র রজনীগন্ধার ন্যায় উজ্জ্বল। কৈশোরের কোমলতায় তার মুখশ্রীতে অপার্থিব মুগ্ধতা। অন্যদিকে আমাকে গায়ের রঙ চাপা। ভালো মেয়েসুলভ গুণগুলো সেই চাপা রঙের দেয়াল ভেদ করে প্রকাশিত হতে পারছিল না যেন। সেই চাপা রঙে তীব্র অপমানের প্রতিফলন হয়েছিল কিনা জানি না কিন্তু বাবা আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে রিতুকেই অভ্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হলো। কারণ ছেলের বনেদি ঘর। বিরাট অর্থসম্পদের মালিক। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। এমন বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা নির্ঘাত মূর্খামি। আমার বাবা মূর্খামি করেননি। মা আমার সহজ সরল আগেই বলেছি। আমার মনের অবস্থা টের পেয়েই ক্ষীণ প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন।
“বড়ো মেয়েকে দেখতে এসে মেজো মেয়েকে পছন্দ করল। এমন মানসিকতার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা কি ঠিক হবে? আমাদের বেলীর মনের অবস্থাটা একবার ভেবে দেখবে না?”
বাবার র’ক্তনেত্রের সামনে মায়ের কথাগুলো কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে হতে হতে মিলিয়ে গেল। অতঃপর যেই অতিথিরা আমাকে দেখতে এসেছিল তারাই কয়েকদিন পর আবার ঘটা করে আমার বোনকে দেখতে এলো। রিতু স্বভাবে ভীষণ জে’দি। প্রথম প্রথম সে বিয়ে করবে না বলে প্রতিবাদ করল। কিন্তু একগুঁয়ে বাবার সামনে সেও টিকতে পারল না।
বাড়িতে থাকতে আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতাম। সেদিনের পর বাড়ির দেয়াল গুলোও যেন আমার অলক্ষ্যে উপহাস করা শুরু করল। বাড়িতে থাকতে দমবন্ধ লাগে। হাঁসফাঁস করে বুকের আচ্ছাদনে নিবিষ্ট হৃদয়টা। অভ্রের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে হয় একবার। সরাসরি জানতে ইচ্ছে হয় এভাবেই পরিচিত হতে চেয়েছিলেন আপনি? পরক্ষণেই নিজেকে বোঝাই, বিয়ে তো সারাজীবনের ব্যাপার। সকলের অধিকার আছে পছন্দের মানুষটিকে নিয়ে সারাজীবন কাটানোর। অভ্রের জন্য হয়তো রিতুই সঠিক।
অভ্র আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন অবশ্য। কিন্তু ততদিনে উনার নামের আংটিটা রিতুর আঙুলে উঠে গেছে। কাটা ঘা’য়ে আরেকটু নুনের ছিঁটে দিতে চাইনি বলেই উপেক্ষা করে গেলাম। অভ্রের দেওয়া চকলেটটা আমি না খেয়ে রেখে দিয়েছিলাম কেন জানি। রিতুর সঙ্গে বিয়ের কথা এগোলে চকলেটটা ওকেই দিয়ে দিলাম। রিতুর বিয়েটা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই হলো না। এমনিতেই বড়ো বোনের গায়ের রঙ চাপা। তাকে রেখে যদি মেজোটার বিয়ে হয়ে যায় তাহলে মন্দ কথা উঠবে। কাকে নিয়ে মন্দ কথা উঠবে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। তবে বুঝতে পারছিলাম আমার চেনাজানা সুখে আচ্ছাদিত জীবনটা ক্রমেই বদলে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে দীর্ঘতর হচ্ছে অপেক্ষা। ভালোবাসার অপেক্ষা।
আমরা তিনবোন একই ঘরে ঘুমাতাম। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর রিতুর মাঝে ধীরে ধীরে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মাঝরাত অবধি ফিসফিস করে কথা বলে, কাঁথার ভেতর আলো জ্ব’লে। তমসাচ্ছন্ন রুমটায় হুটহাট নৈশব্দ চুরমার করে ছড়িয়ে পড়ে ওর চাপা হাসির সুর। আমি অপরপাশে ঘাপটি মে রে পড়ে থাকি। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি রিতুকে হিং সা করছি? ছি! ছি! এতটাও ছোটো মানসিকতা আমায় না পেয়ে বসুক।
এদিকে আমার বিয়ে নিয়ে পরিবারের চিন্তার অন্ত রইল না। পাত্রপক্ষ সেই গায়ের রঙেই ইতস্তত করে। কেউ বা অর্থসম্পদ দাবী করে।
“যৌতুক দিয়ে বিয়ে আমি করব না।”
বাবার সামনে মুখ ফুটে এটুকু প্রতিবাদ করেছিলাম। এভাবেই বছর খানিক পেরিয়ে গেলে অভ্রদের বাড়ি থেকে তাড়া দিতে লাগল। রিতুটাও কেমন মুখ গোমড়া করে থাকে। নতুন পন্যের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বলে,
“আপা, এই ক্রিমটা মাখলে সাতদিনে গায়ের রঙ ফরসা হয়। থাইল্যান্ডের প্রোডাক্ট। রিভিউ আছে ভালো ভালো।”
“কাকের গায়ে ময়ুরের পালক লাগিয়ে মানুষকে বোকা বানাব বলছিস?”
“আজকাল সবাই এসব মাখে। ও বাড়ির তিশাকে দেখোনি? কি মেয়ে কি হয়ে গেছে রাতারাতি। ছেলেরা লাইন ধরে থাকে ওর পেছনে।”
“আমার ওসবের প্রয়োজন নেই।”
রিতু রা’গ করল। ওর গাঢ় প্রণয়ের আবেশে নিমজ্জিত দুটি চোখ পূর্ণতার অপেক্ষায়। আমিই পথের বাধা। আমি অভিমানে টইটম্বুর হয়ে রইলাম। বাবা, মা, বোন সকলে নিজেদের স্বার্থটাই দেখে চলেছেন। আমাকে কেউ কেন বোঝে না? তীব্র অভিমান জেঁকে বসে মনে। সেই অভিমান ভুলতে বইয়ের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় কাটাই। সাহিত্যিকরা অবশ্য শ্যামলা মেয়েদের ঠকায়নি। তারা শ্যামলা গাত্রের মেয়েদের বাহারী নামে ভূষিত করেন। লেখেন তাদের অপরূপ প্রেমের আখ্যান কিংবা ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। ধীরে ধীরে বাস্তব জগত থেকে বইয়ের কল্পনার জগতই আমার কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে।
মাসখানেক বাদে আবারো একটা সম্বন্ধ এলো। তবে এবার ঘটা করে পাত্রীদেখা হলো না। মুরুব্বি গোছের কয়েকজন মানুষ এসে আমায় দেখে গেলেন একদিন। দুদিন বাদেই জানতে পারলাম ছেলেপক্ষ বিয়ের তারিখ দিতে আসবে। বাবা-মা আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। বাড়িতে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। আমি চুপচাপ। পাত্রের ছবি দেখার ইচ্ছেও হলো না। শুধু জানলাম ভদ্রলোকের নাম আসিফ। পেশায় ব্যাংকার। অসুস্থ মাকে দেখাশুনা করতেই অত তাড়াহুড়োর বিয়ে। কোনো দাবীদাওয়া নেই তাদের। শুনে বিশেষ কিছুই বললাম না। বাবাও আমার মতামত নিয়ে মাথা ঘামালেন না। পরের শুক্রবারই বিয়ের দিন ঠিক হলো। মাঝে একদিন ভদ্রলোক আমায় ফোন করলেন। স্পিকারে ভেসে আসা গুরুগম্ভীর স্বরে কি যেন একটা ছিল আমি এলোমেলো হয়েছিলাম। তিনি জানতে চাইলেন,
“আপনি দেনমোহরে কি চান?”
“বই।”
“আর?”
“শুধুই বই।”
তিনি মেনে নিলেন। আমার পছন্দের বইয়ের লিস্ট চাইলেন। খুঁতখুঁতে মনটাকে দমাতে না পেরে আমি ফট করে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“আপনি আমাকে দেখেছেন?”
“দেখেছি।”
“আমাকে পছন্দ হয়েছে আপনার?”
ওপাশ থেকে স্মিত হাসির আওয়াজ এসেছিল নাকি নিশ্বাসের আওয়াজ বুঝে উঠতে পারিনি। তিনি পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি আমাকে দেখেছেন?”
“উহু।”
“যার সঙ্গে গোটা একটা জীবন কাটাবেন তাকে দেখে নেবেন না?”
যৌক্তিক প্রশ্ন। আমি উত্তর দিতে অপারগ। তীব্র অভিমানে বুকের ভেতরটা ছেয়ে আছে। শুধু মনে হচ্ছে একটা বিয়ে হলেই সবার নিস্তার। আমার নিস্তার হবে তো! উভয়দিকের উশখুশতার কারণে আমাদের কথা খুব একটা এগোয়নি। শুক্রবারে খুবই ছিমছাম আয়োজনে ঘরোয়া পরিবেশেই বিয়েটা হয়ে গেল। আসিফেরই নাকি ইচ্ছে ছিল বিয়েটা ছোটো করে হবে। চাচিরা ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলেন পাত্রের কোনো দোষ বা ত্রুটি আছে কিনা। নাহলে এমন চুপচাপ বিয়ে সাড়া কেন? আমি নিরব প্রস্তরখন্ডের মতো সবই শুনলাম। কবুল বলার পর পাশাপাশি বসানো হলে প্রথম দেখলাম উনাকে। বুকের ভেতর হুট করেই একরাশ দমকা হাওয়া বয়ে গেল। মনের মাঝে উঁকি দিল শ’ঙ্কা। আমার সুদীর্ঘ ভালোবাসার অপেক্ষা কি শেষ হবে এবার?
চলবে…