সুখ সন্ধানী পর্ব-২২

0
714

#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-২২
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে,রুবি মনকে শান্ত করে নামায পড়ে,আল্লাহর কাছে সমাধান খুঁজে।জায়নামাযে বসে থাকা আর সম্ভব না রুবির মাথা টনটন করছে।চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাবার অবস্থা।একটু শোয়া গেলে বোধহয় ভালো হতো কিন্তু এখন শোয়া যাবে না রাতের দৃশ্য কোনভাবেই মন বা মাথা কোনটা থেকেই দূর করা যাচ্ছে না,এর বিহিত না করে বিছানায় শোয়া অসম্ভব।রুবি জায়নামায উঠিয়ে চেয়ারে বসে,বিছানায় হাবিব সাহেব ঘুমিয়ে আছে,সারা রাত প্রেশার হাই হয়ে থাকার কারনে ছটফট করেছে।রুবির চোখের সামনে রাতের দৃশ্যপট আবার ভেসে উঠে,হাবিব সাহেবের প্রেশার রাতে অত্যাধিক বেড়ে গিয়েছিল,বিছানায় উঠে বসে নিজের অসস্থির কথা রুবিকে জানায়,রুবি প্রথমে মাথায় পানি দিয়ে তারপর রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়,তেতুলের শরবত বানিয়ে খাওয়ালে প্রেশার খুব তাড়াতাড়ি কমে যায়,শরবত বানিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখে,রাফির রুম থেকে নোহা বেরোচ্ছে,গায়ে কালো শাড়ি কাপড় জড়ানো,খোলা চুলে এক ছুটে গিয়ে তার রুমে ঢুকে যায়।রুবি বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,হাপড়ের মতো বুকটা উঠানামা করছে,এমন দৃশ্য সে কোনদিন কল্পনাও করেনি,না করেছে সন্দেহ।রাগে,দুঃখে রুবির কান্না পেল,এমন মেয়ে নিজের পেটে ধরেছে ভেবে কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে উঠল।রুবি হাতের শরবতের গ্লাস টেবিলের উপর রাখলেন,নোহার রুমে যাবেন বলে মনস্থির করেন,একপা এগিয়ে আবার থেমে গিয়ে টেবিল থেকে গ্লাস হাতে নিয়ে স্বামীর কাছে যায়।এখন হাবিবের কাছে যাওয়া জরুরি,উনার শরীরের অবস্থা ভালো না,যদি কোনভাবে নোহার এই কৃতকর্মের কথা জানতে পারে তাহলে নির্ঘাত স্ট্রোক করবেন।রুবি সকাল হবার অপেক্ষায় ছিলেন এসব ভাবনা মন থেকে সরিয়ে আস্তেধীরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে,কিন্তু নোহা রুমে যাওয়া খুবই জরুরী।
নোহার রুমে ঢুকে দেখলেন,নোহা উদাস চোখে জানালা ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে।তিনি আশা করেছিলেন নোহা ঘুমিয়ে থাকবে কিন্তু না কি রকম বিধস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এটা দেখেই অজানা আতংকে বুক কামড়ে উঠল।নোহার কাছে দাড়ানোর পরেই নোহা টের পেল তার রুমে তার মা এসেছে।মায়ের দিকে তাকিয়ে নোহা ভিষন অবাক হলো,চোখ মুখ বসে আছে,কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছে,আর এই সাতসকালে তার রুমে আসার সঠিক কারণ আন্দাজ করতে পারল না।এমনিতেই সারারাত কান্নার ফলে শরীর ভেঙে আসছে,এখন মায়ের এই অবস্থা দেখে নোহা ছটফটিয়ে উঠে,
—“মা কি হয়েছে?তুমি ঠিক আছো তো?”

রুবি একনজরে পুরো রুম দেখলেন,রাতের অগোছালো শাড়ি বিছানায় পড়ে আছে।শাড়িটা হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন,
—“এটা কবে কিনেছিস?আর পরলি কখন দেখলাম না যে!”

নোহা ভড়কে গিয়ে মায়ের দিকে তাকায়।কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।আমতা-আমতা করে বলে,
—“মা এটা গতকাল কিনেছিলাম।আর পরিনি তো নতুন একদম।”

নোহার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই রুবি সপাটে নোহার গালে চড় দেয় নোহা সামলাতে না পেরে জানালার গ্রীলে গিয়ে ধাক্কা খায়।গাল মাথা একসাথে ব্যাথায় টনটন করে উঠে,কিন্তু নোহা এই সব
ব্যাথা অগ্রাহ্য করে রুবির দিকে তাকায়,নোহা এই মাত্র খেয়াল করল তার মায়ের চেহারাটা ভিষন কঠিন মনে হচ্ছে।নোহা কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই রুবি নোহার উপর ঝাপিয়ে পড়ে,দুহাত দিয়ে গলা চেপে বলে,
—“সর্বনাশিনী এই সর্বনাশা পথে যাবার আগে বুক কাঁপলনা?কিভাবে করলি এমন কাজ,তোর বাবা কত বিশ্বাস করে তোকে।”

নোহার নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগেই ধাক্কা দিয়ে রুবিকে সরাতে সক্ষম হলো।মায়ের কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।মা কিভাবে যানল?নোহা আস্তে করে বলল,
—“এসব কথার মানে কি মা?”

রুবির চোখ থেকে পানি পড়ছে,
—“একটা ছেলের রুম থেকে রাত তিনটায় একটা মেয়ে শাড়ি পড়ে বেরুনোর মানে কি হতে পারে তুই বল।”

নোহার ছলছল চোখ নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।রাতে মা দেখে নিয়েছিল!নোহা চুপ করে আছে দেখে বলল,
—“রাফি কি তোকে ভালোবাসে?”

নোহা মাথা নেড়ে সায় দেয়।
—“কবে থেকে শুরু করলি এমন নষ্টামি?”

নোহা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,
—“মা আমরা খারাপ কিছু করিনি।নষ্টামি বলার মতো কিছুই হয় নি মা।”

রুবি ফুসে উঠে বলল,
—“আমাকে বুঝাবি তুই?এই দিন দেখার জন্য রাফিকে পেলেপুষে বড় করেছিলাম।শেষমেষ কিনা রাফি! ছিহ!”

নোহা ভয়ে বলল,
—“উনার কোন দোষ নেই মা।”

রুবি তাচ্ছিল্য করে বলল,
—“উনি তো ফেরেস্তা দোষ কিভাবে থাকবে!আর তুই হইছিস বেশ্যামেয়ে রাতে ছেলেদের রুমে ঢুকে যাস।”

মায়ের কথা শুনে নোহা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।এসব শব্দ তার মা কখনোই বলে না।নোহা ভয়ে কাচুমাচু করে বলল,
—“মা আমরা বিয়ে করতে চাই।”

রুবি আবার তেড়ে এলেন,
—“বাবার কথা একবার ভাব।উনি এসব যে কতটা অপছন্দ করে তা তুই খুব ভালই জানিস,তারপরেও এতো অবাধ্য কিভাবে হলি?”

নোহা ফুপিয়ে কেঁদে দেয়,হাতজোড় করে বলে,
—“মা তুমি একটু বাবাকে ম্যানেজ করে দাও প্লিজ।আমি উনাকে ছাড়া বাঁচতেই পারব না।”

রুবি হতভম্ব হয়ে নোহাকে দেখে,তার মেয়েটা এই কয়দিনের আর এখনি কি নিলজ্জের মতো কথা বলছে।সব রাগ গিয়ে পড়ল নিজের উপর উনিই বুঝি মেয়েটাকে মানুষ করতে পারল না,রুবি শব্দ করে নিজেও কেঁদে দেয়,
—“আর তোর বাবা যদি জানতে পারে তাহলে উনি মারা যাবে।তখন তুই সুখে সংসার করিস।”

নোহা চুপ করে সব কথা শুনে,রাফি আগেই বলেছিল তাও নোহা একটা চেষ্টা করতে চাইছিল,কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে সব রাস্তা বন্ধ।রুবি আরও অনেক কথা শোনালেন।শেষ পর্যায়ে বললেন,
—“তুই যদি রাফির কথা তোর বাবাকে বলিস তাহলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে,আর যদি রাফির সাথে একবারে চলে যাওয়ার চিন্তা করিস তাহলে আমি আর তোর বাবা বিষ খেয়ে একসাথে মরে যেতে দ্বীধা করব না।”

নোহা মুখে দুহাত চেপে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।অস্পষ্ট স্বরে বলে,”মা”,

—“তোর বাবার কানে এসব কথা দেয়া যাবে না,উনি স্ট্রোক করবেন।উনি নিজে পছন্দ করে তোকে বিয়ে দিবে।এতদিন যা হয়েছিল সব ভুলে যা।”

রুবি হনহন করে চলে যায়।রেখে যায় বিধস্ত নোহাকে।ইশ কি জ্বালা প্রেমে এই জ্বালা থেকে মরনও ভালো।

রুবি নিজের রুমে যায় না।রাফির দরজায় চাপড় মেরে শব্দ করে।রাফি দরজা খুলে রুবিকে দেখে সরল মনে হাসে।কিন্তু রুবি হাসির ফিরতি হাসি দেয় না মুখ অন্ধকার করে রুমে ঢুকে, রাফি অবাক হয়!রুবি সচরাচর রাফির সাথে খুব মিশুক,হাসি ছাড়া মুখ কালো করতে কখনোই রাফি দেখেনি।রাফি অবাক ভাব গোপন করে রুবির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস্য চোখে তাকায়।
রুবি রাফিকে দেখে কোন ভনিতা না করে সোজাসাপটা বললেন,
—“রাত তিনটায় তোমার রুম থেকে নোহার বের হওয়াটা কেমন পর্যায়ে চলে গেছে সেটা তুমি নিজেই জানো।তোমার চাচ্চু শুনতে পেলে কেমন হবে ব্যাপারটা ভেবে দেখেছ?এই বাড়ি থেকে তোমাকে বের করার কোন অধিকার আমার নেই তারপরেও বলছি আমরা নোহাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিব সেটা খুবই শীগ্রই।তাই আশা করব তুমি আজকেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।বাবার আদর দিয়ে যিনি বড় করল তাকে এভাবে কষ্ট দেয়ার কোন মানে নেই।তোমার চাচ্চু এসব অসভ্যতামি শোনার আগেই চলে যাবে।সম্মান থাকতেই চলে যাও।”

রুবি রাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন।রাফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে।তার নোহার বিয়ে হবে অন্যকারো সাথে,এটা মানতেই কষ্ট হচ্ছে কিন্তু এটাই হবে আগেই জানত তারপরেও দুজনেই আগুনে সাতারে নেমেছে।রাফির বুকটা ধুপধাপ করে চিৎকার করছে।হঠাৎ খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলো।চুপচাপ কাঁদা নয় গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।এতো অসহায় কেন রাফি! নিজের দুঃখ কষ্ট,চাওয়া পাওয়া বলার কেউ নেই।সব রাগ অভিমান গিয়ে জড়ো হলো বাবা মায়ের উপর,উনারা থাকলে রাফির সব ইচ্ছা পূরুন হতো।অভিমানে রাফি কাঁদল।নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে সেদিন বিকালেই সবার থেকে বিদায় নিয়ে রাফি বাসা ছেড়ে দিল।হাবিব সাহেব বারবার যেতে নিষেধ করলেন,রাফির দাদা দাদি হাত ধরে আটকালেন,রাফি হাসিমুখে সবাইকে বুঝাল” ফ্লাটের কাজে মিস্ত্রিরিদের সামনে না থাকলে কাজ ঠিক ভাবে হয় না,তার যেতেই হবে।”

নোহা হতবিহ্বল হয়ে দেখল।শেষবারের মতো রাফির সাথে দু’দন্ড কথা বলতে পারল না রুবি যে সারাক্ষণ কাছে থেকেছে ,চোখে-চোখে রেখেছে।যাবার আগে রাফি একবার শুধু নোহার দিকে তাকাল,নোহা দেখতে পেল এক অসহায় পুরুষের চোখের দৃষ্টি।কিছু বলতে চাওয়া ঠোঁটের কাঁপন।নোহার তখনি মরে যেতে ইচ্ছে করল,সবার সামনেই রাফির বুকে মাথা রেখে বলতে ইচ্ছে হলো,”তুমি কোথাও যাও রাফি আমাকেও নাও,নাহলে আমার মরন হবে।”
কিন্তু বলা হলো না সব কথা বলা যায় না।নোহা অভিমান নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো”এমন বিশ্রী কাজটা না করলেও পারতে।মাগো আমার রাফিটা যে জনম দুঃখী।আমাকে হারিয়ে কিভাবে বাঁচবে বলো?”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে