#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-২০
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★
নিশির শারীরিক সমস্যাটা সহয করে ডাক্তারের ভাষায় বললে,জরায়ুতে টিউমার।অনেকদিন আগেই এটা বাসা বেধেছে এতদিন ডালপালা মেলে বিস্তর জায়গা দখল করে বসে আছে।এতদিন পেট ব্যাথা হলে বুঝত পিরিয়ড হচ্ছে বা হবে সেজন্য বুঝি ব্যাথা কিন্তু ক্ষুনাক্ষরেও টের পায়নি কিসের ব্যাথা।ডাক্তার শিহাবকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেছে।নিশি অবিবাহিত এই মূহুর্তে অপারেশন সম্ভব না।অপারেশনের পরে বাচ্চা না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।তাই নিশির পরিবারের উপর এই সিদ্ধান্ত দিল।শিহাব কি বলবে মাথায় আসছেনা,ছলছল চোখ নিয়ে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।তার নিশির যে বাচ্চা খুব প্রিয়।মোবাইলে কথা বলার সময় কয়েকবারই বাচ্চার নাম ঠিক করেছে শিহাব’ও নিশির বাচ্চামোতে সায় দিয়ে হেসেছিল।কিন্তু দুজনের কেউই জানতনা তাদের সামনে কতবড় বিপদ অপেক্ষা করছে।হাত-পা মৃদু কাঁপছে।
ডাক্তার শিহাবের অবস্থা বুঝতে পারল।
আলতো করে হেসে বলল,
—“শিহাব সাহেব একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
শিহাব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকায়।
—“নিশি কি আপনার বিশেষ কেউ?”
শিহাব মুখের লালা দিয়ে গলা ভিজায়।মাথা নাড়িয়ে বলল,
—“হ্যাঁ খুব।”
ডাক্তার আগের মতোই বললেন,
—“আরেকটা উপায় আছে।বিয়ের পরে একবার কনসিভ করার পরে যখন ডেলিভারি হবে তখন টিউমারের অপারেশনটাও করে ফেলা সম্ভব।এতে করে কিছুটা ঝুঁকি থাকে।কিন্তু একটা বেবি পাবে।সব মেয়েরই তো মাতৃত্বের স্বাধ পাওয়ার ইচ্ছে থাকে।আপনারা চাইলে সব সম্ভব।আর যদি চান বিয়ের আগেই অপারেশন করাবেন তাহলেও আমাদের আপত্তি নেই আমি শুধু আপনাকে পথ দেখালাম।”
শিহাব সব বুঝেশুনে ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হলো।
ইতোমধ্যে নিশির নানাবাড়ির সবাই হসপিটালে চলে এসেছে।শিহাব সবাইকে প্রথম থেকে বুঝিয়ে বলল,নাহার খুব ভেঙ্গে পড়লেন।তার এমন চাঁদের মতো ফুটফুটে মেয়ের এমন ভাগ্য।কেন হলো?সবাই যখন নাহারকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তখন নিশি কেবিনে শুয়েই চোখের পানি ফেলছিল।তার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষন আগে দরজার পাশে শিহাবের কন্ঠ শুনে মনযোগ দিয়ে বুঝল তার মিঠি নামের সোনাপাখি দুনিয়াতে আসার সম্ভাবনা খুব কম।সেদিনও নিশি শিহাবকে বলছিল প্রথম মেয়ে হলে নাম হবে মিঠি।শিহাব হেসে সায় দিয়েছিল।নিশি দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে।তার কান্না শুনে সবাই কেবিনে আসে শুধু একজন ছাড়া।শিহাব করিডোরে পা ফেলে শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ায়।নিশির কান্না তার সহ্য হবেনা।সবার সামনেই যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে।পরিস্থিতি যেমনি হোক নিশিকে শিহাব আগলে রাখবে।চোখ বন্ধ করে বুঝল কারো উপস্থিতি পাশে তাকিয়ে রাফিকে দেখল।রাফি বুঝতে পারল শিহাবের মনের অবস্থা,
—“তুই শক্ত থাকিস শিহাব।নিশি ছোট মানুষ আগলে না রাখলে কিভাবে হবে বল।”
প্রিয় বন্ধুর কথা শুনে শিহাব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল।বিবশ মুখে বলল,
—“আমার নিশিটা খুব ভাল রে।ওর সামনে কেন এত নিষ্ঠুর পরিস্থিতি দাড়ালো?”
রাফি শিহাবের কাধে হাত রাখে,
দৃঢ় মনোবল নিয়ে বলল,
—“আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব।এত ঘাবরে যাস না তো।..”
সবাই পরামর্শ করে ঠিক করা হলো আপাতত নিশির ব্যাথা কমানোর ওষুধ দেয়া হবে ওষুধপত্র দিয়ে নিশিকে রিলিজ করে দেয়া হলো।এক মূহুর্তের জন্য শিহাব নিশির দিকে তাকায়নি,কিন্তু নিশি কাতর নয়নে বারবার শিহাবের দিকে তাকিয়েছে।দুজনেই জমে শক্ত হয়ে আছে।দুজনের আচরন নাহারের চোখে আটকালো।কিন্তু এত কিছু না ভেবে নিশিকে বেড থেকে তুলে সিটে বসিয়ে দিল।বাসায় আসার পরে সবাই নিজ গন্তব্যে ফিরে গেল।নুরজাহান নাহারকে রান্নাঘরে সাহায্য করতে ছুটে গেল।শিহাব ড্রয়িংরুমে গম্ভীর মুখ করে বসে এদিক ওদিক দেখল তারপর চোখের পলকেই নিশির রুমে ডুকে দরজা আটকে দিল।নাহার শিহাবের জন্য চা এনেছিলে,শিহাবকে নিশির রুমে ডুকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন,শিহাব যখন দরজা আটকে দিল তখন নাহার পিছন ফিরে নুরজাহানকে দেখলেন,নুরজাহান রান্নাঘরে ফ্রিজে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।নাহার দ্রুত পায়ে তার কাছে যায়।উত্তেজিত গলায় বলে,
—“আপা..”
কিন্তু নাহারের কথা নাহারের মুখেই রইল।তার আগেই নুরজাহান বলল,
—“নাহার আমরা এই নিয়ে পরে কথা বলব।”
নাহার জানে তার আপা এক কথার মানুষ তাই নিজের সব প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়ে দুইবোন রান্না শুরু করে।
নিশির চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি বুকের জামা ভিজে যাচ্ছে।তার বুক হাহাকার করে জানান দিচ্ছে কিছু কি হারিয়ে ফেলল?শিহাব তো এমন ছেলে না,এমন বিপদের দিনে কিভাবে একবারও কাছে না এসে থাকতে পারল?নিশির ব্যাকুল হৃদয় তো ওই মানুষটার সানিধ্য আশা করেছিল।তখনি খট করে দরজা খুলে যায় শিহাব ধীরপায়ে খাটের পাশে দাঁড়ায়।তারপর চুপচাপ নিশির গা ঘেসে বসে পড়ে।নিশি কিছু না বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে দেয়।শিহাব নরম গলায় বলল,
—“আমি কি চলে যাব?”
নিশি কান্না করা অবস্থায়ই মাথা নেড়ে না করে।শিহাব প্রসন্ন মুখে হাসে,নিশির পেছন দিয়ে একহাত নিয়ে কাছে টেনে নেয়।কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
—“আর এক ফোটা চোখের পানি পড়লে কিন্তু ভালো হবে না জান।”
নিশি ফুপিয়ে উঠে,ধরা গলায় বলে,
—“আমি যদি আপনাকে বাচ্চা দিতে না পারি তাহলে কি ভালোবাসবেন না,বিয়ে করবেন না?ভুলে যাবেন আমায়?”
শিহাব মুচকি হেসে নিশির হাতের ভাজে তার হাত রাখল,
—“তুই কি নিজেকে বাচ্চা পয়দার মেশিন মনে করিস?বাচ্চার সাথে ভালোবাসার আর বিয়ের কি সম্পর্ক কি?”
নিশি শিহাবের মুখের দিকে তাকালো,
—“আপনি কখনো যদি বাবা না হতে পারেন!”
—“না হলে নাই।আমার জান-পাখির বর হতে পারলেই চলবে।”
শিহাবের আদুরে কথায় নিশি ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল,তার শিহাবটা এতো ভালো কেন?এত আদর করে কেন?
—“খালামনি মেনে নিবে না তো।উনার একমাত্র ছেলে…”
কথা শেষ করার আগেই শিহাব বলে,
—“আমি মানিয়ে নিব।আর তুই তোর খালামনিকে চিনিস না?তোকে খুব ভালোবাসে,আর মনে হয় আমাদের সম্পর্কের কথা কিছুটা জানেও।”
নিশি শিহাবকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে,ফিসফিস করে বলে,
—“আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না।আমি আপনাকে ছাড়া বাচতেই পারবনা।একদম মরেই যাব।”
শিহাব প্রতিউত্তরে কিছু না বলে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খায়।
নিশিদের ড্রয়িংরুমেই আজকে সবাই খেতে বসেছে।শিহাব খাওয়ার এক পর্যায়ে সোজা-সাপ্টাভাবে বলল,
—“খালামনি আমি নিশিকে বিয়ে করতে চাই।তোমাদের কি কোন আপত্তি আছে?”
নাহার অবাক হয়ে তার স্বামীর দিকে তাকায়।সুলতান হক অবশ্য শিহাবকে মনে মনে খুব পছন্দ করেন।এদিকে শিহাবের বাবা মা দুজনেই নির্বাক যেন আগেই জানতেন এমনটা হবে।শিহাব যে আজকেই এমন কাজ করে বসবে নিশি কল্পনাও করেনি।লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে।নাহার কখনো ভাবেনি শিহাব নিশি একে অপরকে ভালোবাসে।আর এমন পরিস্থিতিতে এসেও যে শিহাব পিছু হটেনি তাই নাহার ড্যাবড্যাব করে সবার দিকে তাকাচ্ছে।নুরজাহান বোনের অবস্থা দেখে বলল,
—“এখনি বিয়ে হবেনা,নিশি ইন্টার শেষ করুক।আর আপাতত কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই।আব্বার বাসার কেউ যেন না যানে।ভাই মত দিবে না।পরে বুঝিয়ে বলব।”
সবার জানা আছে তাদের ভাই হাবিব কাজিন রিলেটেড বিয়ের পক্ষে না।নাহার কিছু না বলে মাথা নাড়লেন।নুরজাহান ছোট বোনের মাথায় টোকা দিয়ে বললেন,
—“এবার একটু হাসি দে।”
নাহার মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল।নিশি অবাক হয়ে সবার কথাগুলো শুনল।এত সহযে শিহাব তার হয়ে যাবে কল্পনাও করেনি।লাজুক হেসে উঠে গেল।
★★★★★
রাফি নোহাকে বলেছে,তার রুমে আসা যাবে না।যখন বলবে তখনি আসবে।নোহা তাতেই সানন্দে রাজি।রাফি তাকে ভালোবাসে এটাই বড় পাওয়া আর কিছু চাই না।তাদের প্রনয়ের আজ পঁচিশ দিন।এই পঁচিশ দিনে দুজনে ভালোবাসার সাগরে ভেসেছে।সারারাত ফোনে খুটুরমুটুর করে কাটিয়েছে।নোহা এখন চঞ্চল চড়ুই পাখির মতো উড়ে বেড়ায়।এই কয়দিনে এক কাপে দুজনে চা খাওয়া হয়েছে,হাতে হাত রেখে জ্যোৎস্না দেখা হয়েছে।
সন্ধ্যায় নোহা রুম থেকে বেরিয়ে দেখে রাফি টিভি দেখছে।উড়ুউড়ু মন নিয়ে সে’ও রাফির পাশের সোফায় বসে,রাফি দেখে চোখ রাঙ্গানী দেয়,নোহা কোন প্রতিক্রিয়া করার আগেই হাবিব সাহেব এসে সোফায় বসে,রুবিকে ডেকে ঠান্ডা পানি দিতে বলে।
তারপর রাফির উদ্দেশ্যে বলে,
—“আজকালকার ছেলে মেয়ে এমন কেন বলতো?ছি ছি ছি।”
রাফি নোহা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল,
রাফি আগ্রহে জিজ্ঞেস করল,
—“কি হয়েছে চাচ্চু?”
তিনি রুবির হাত থেকে পানি গ্লাস নিয়ে এক চুমুক দিলেন,
—“আরে পাশের বাসার জান্নাত আর রাব্বি পালিয়ে গেছে।ওরা দুজন ভাই বোন হয়ে এমন কাজ কিভাবে করল?হোক চাচাতো বোন কিন্তু বোন তো এমন নিলজ্জের মতো পালিয়ে গেল,এখন বাবা মা মুখ দেখাতে পারবে?কেমন ছেলেমেয়ে পেলেপুষে বড় করেছে।এদের আগেই মেরে কবর দেয়া উচিত।”
রুবি কথা টেনে বলল,
—“এক বাড়িতে থাকত,কখনো নজরে পরেনি কারো?এসব কিভাবে করে বেয়াদবগুলা।”
হাবিব বাকি পানিটা খেয়ে বলল,
—“ভাই বোন ভেবে কেউ কখনো সন্দেহ করেনি।কিন্তু ওরা দুজনে যে এমন কেলেংকারী বাধাবে এটা কে জানত।”
তারপির নোহা রাফিকে দেখিয়ে বলেন,
—“রাফি নোহা যে একসাথে বসে আছে আমি কি সন্দেহ করব ওরা প্রেম করে।আর আমার ছেলেমেয়েরা এমন করার মানুষ না।নিজের হাতে বড় করেছি এই বিশ্বাস আছে।ওইগুলার মতো অসভ্য হবে না,এটা আমি হান্ডেড পার্সেন্ট দিয়ে বলতে পারি।দেখনা রাফির কাছে নোহাকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।”
রাফি কিছু না বলে থম মেরে বসে থাকে।এতদিনের ভয়টা আজকে পাকাপোক্ত রূপ নিল।গলা শুকিয়ে গেছে।আড়চোখে নোহাকে দেখল তার দিকেই ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।বুক চিরে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপনে ছাড়ল।তারপর মোবাইলে রিংটোন বাজিয়ে ফোন আসার বাহানায় উঠে রুমে চলে যায়।
নোহার চোখে পানি টলটল।সে সচোক্ষে দেখল তার অতী সুখের প্রনয়ে ফাটল।আলগোছে তার রুমের দিকে পা বাড়ায়।মনে মনে আর্তনাদ করে আমার রাফি!
—চলবে—