#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-১৯
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★
নোহা ধীরপায়ে এগিয়ে যায়।রাফির কেমন ব্যবহার হবে এটা ভেবেই এক অজানা ভয় হৃদপিণ্ড খামচে ধরেছে।অন্ধকারে জলন্ত লাল বিন্দু উঠানামা করে জানান দিচ্ছে প্রিয় পুরুষ তার পুরু ঠোঁট সিগারেটে পোড়াতে ব্যাস্ত।নোহা বারান্দায় পা রাখতেই রাতের শান্ত হাওয়া শরীর ছুঁয়ে গেল,আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল আজকে চাঁদের আলো খুব কম,আলোর পথে মেঘেরা বাধা দিচ্ছে,আশেপাশে গুটিকয়েক তারা জ্বলমল করছে।বুকে হাত দিয়ে সাহস সঞ্চার করে রাফির একহাত দূরে দাড়াল।গোপনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।আমতা-আমতা করে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই রাফি বলল,
—“নোহা আমি আজকে যা বলল মন দিয়ে শুনবি।”
আচমকা রাফির কথা শুনে নোহা চোখ বড় করে তাকাল।সে ভেবেছিল তার উপস্থিতি রাফি টের পায়নি।রাফি গম্ভীর কন্ঠে আবার বলল,
–“তুই যেটা চাস সেটা কখনোই সম্ভব না।”
এটুকু কথা শুনেই নোহার চোখে জ্বলন টের পেল,আবারো আগের বিচ্ছেদ,আহ এই যন্ত্রণা কি শেষ হবার নয়?
নোহা কাপা গলায় বলল,
–“কাল রাতে..”
রাফি বাকিটা শুনল না তার আগেই বলল,
—“কাল রাতের সব ভুলে যাবি।”
নোহা ফুসে উঠে বলল,
—“ভুলে যাবি বললেই কি ভুলা যাবে?”
রাফি হাতের আধাখাওয়া সিগারেট ছুড়ে দূরে ফেলে দেয়।তারপর নোহার দিকে ফিরে নরম গলায় বলে,
—“নোহা সবকিছুতেই জিদ ভালো না।”
নোহা গলা ধরে আসে,
—“আপনি আমার জিদ না।আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।”
—“আমি জানি।”
নোহা এবার ফুপিয়ে কেঁদে দিল,
—“জানলে কেন এত দূরে সরেন।কেন আমাকে কাছে টানেন না?”
রাফি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।বুকে দু’হাত ভাজ করে বলে,
—“কাছে না টানার কারন হলো আমি তোকে ভালই বাসিনা।”
নোহার বুক মুচরে উঠে,চোখ দিয়ে নোনতা পানি নিচে নেমে যায়,ডান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে দাতে দাত চেপে বলে বলে,
—“আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”
নোহার কান্না আর রাফির সহ্য হয় না।তাই সাথে সাথেই বলে,
—“হ্যাঁ ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।”
নোহার অন্তর কেঁপে ওঠে।সজ্ঞানে থাকা অবস্থাই রাফি স্বীকার করেছে ভালোবাসে।ভেতরের আনন্দ চাপা দিয়ে মুখে বলল,
—“তাহলে এত দূরে সরান কেন আমাকে?”
রাফি আকাশের দিকে তাকাল।দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
—“কারন কাছে টানার কোন অধিকার আমার নেই।”
নোহা দ্রুত রাফির খুব নিকটে আসে।আকুল কন্ঠে বলে
—“কেন রাফি?আমি কি এমন অপরাধ করলাম যে আমাকে এত দূরে রেখে দিয়েছেন?”
রাফি চোখ বন্ধ করে নেয়।নোহা যতবার তাকে রাফি বলে ডাকে বুকের কোথাও খুব সুখের ব্যাথা হয়।কিন্তু এই সুখ পাখিটাকেই রাফি ধরে রাখতে পারবে না।চোখ বন্ধ করেই বলে,
—“নোহা তুই আমাকে ছাড়াও ভালো থাকবি।”
নোহা এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলে,ফুপিয়ে বলে,
—“মরে যাব,সত্যিই মরে যাব।”
রাফি অসহায় চোখে নোহাকে দেখে।তারপর বলতে শুরু করে,
—“নোহা আমি যখন ছোট তখন আব্বু আম্মু মারা যায়।দাদা দাদি বেচে থাকার পরেও তোর আব্বু আম্মুই আমাকে নিজেদের বুকে টেনে নেয়।কখনো বাবা মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি।সব চাহিদা খুব আপনভাবে পূরন করে দিয়েছে।নিজের ছেলের চাইতে আমাকে বেশি বিশ্বাস করে।এখনো তুই যদি আমার সাথে থাকিস তারা নিশ্চিন্তে থাকে।কারন আমার কাছে তারা তোকে চোখ বন্ধ করে রেখে যেতে পারে যানে আমি তোর ভাই হই।ছোটবেলা থেকেই দেখেছি চাচ্চু কাজিন রিলেটেড বিয়ে গুলো পছন্দ করে না,তাদের খারাপ,অসভ্য,বাবা মায়ের অবাধ্য সন্তান বলে আখ্যা দেয়।তাও আমার অবুঝ মন তোর পাগলামির কাছে হেরে গেল, কখন যে তোর মাঝে আটকে গেল টের পেলাম না।কিন্তু আমার হাত-পা বাধা।চাচ্চুর সাথে কখনোই বেইমানি করতে পারব না।উনার বিশ্বাস আমি কখনোই ভেঙ্গে যেতে দেব না।বাবার স্নেহ দিয়ে লালন করেছে,আমি তাকে কি করে কষ্ট দেই বল?এতটা স্বার্থপর কি করে হই বল?”
বলতে বলতে রাফি নিঃশব্দে কাঁদে।রাতের আধার বলে নোহা দেখতে পায় না।কিন্তু নোহা ঝাপিয়ে রাফির বুকে আসে।দুই হাত দিয়ে যতটা সম্ভব আকড়ে ধরে।কান্নাজড়িত গলায় নাক টেনে বলে,
—“এই কারনেই আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছেন আপনি?”
রাফি দুহাত দিয়ে নোহার মুখ তার দিকে করে।খুব কাছে হওয়ায় নোহা দেখে রাফির গালে পানির সরু স্রোত।নোহা হাউমাউ করে কেঁদে বলে,
—“আমি কোন সমাজ সংসার চাই না।আমার আপনাকে চাই,আপনাকে এক আকাশ ভালোবাসা দিতে চাই।প্লিজ।”
তারপর থেমে আবার বলে,
—“কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন,আর কেনই’বা নিজে কষ্ট পাচ্ছেন।আমাকে ভালোবেসে দিন না রাফি।”
রাফি হাসার চেষ্টা করে,ভিজা গলায় বলে,
—“সম্ভব না তো।”
নোহা ছটফট করে বলল,
—“সব সম্ভব।আমি আব্বুকে বুঝিয়ে বললেই আব্বু মেনে নিবে।”
রাফি নোহার মুখ চেপে বলে,
—“খবরদার চাচ্চুকে কিছু বলবি না।চাচ্চু কষ্ট পাবে।”
নোহার কেঁপে উঠে।তার রাফি তাকে খুব ভালোবাসে এটা জানার পরেও সে কিভাবে দূরে সরে যাবে?কাতর গলায় ডাকল,
—“রাফি…”
রাফির বুকটা টনটন করে নিজের সুখের কথা জানান দিতে ভুলল না,চোখ বন্ধ করেই জবাব দিল,
—“হুম,”
—“আমি বাবাকে ম্যানেজ করে নিব।”
—“পারবি না নোহা।”
—“পারব। আব্বু আমাকে খুব ভালোবাসে।আমার সব ইচ্ছা আব্বু পুরন করে দেয়।”
রাফি খুন নমনীয় ভাবে বলে,
—“কাউকে ছাড়া বেচে থাকা অসম্ভব না তো!তুইও পারবি।”
নোহা রেগে যায়।চিৎকার করে বল,
—“আমি মরে গেলেই আপনার শান্তি তাই না?আচ্ছা এখনি মরে যাব আপনার আর কোন প্যারা নাই।চিল।”
এটা বলেই নোহা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।রাফি খপ করে হাত ধরে বলে,
—“এভাবে চিল্লাচ্ছিস কেন?সবাই শুনবে তো।”
নোহা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে,
—“রাফি,আপনি ছাড়া অন্য কাউকে আমি কখনোই মানতে পারব না।”
রাফি অপলক নোহাকে দেখে।তারও তো ইচ্ছা করে নোহার ভালোবাসায় হারিয়ে যেতে কিন্তু চাচ্চু?নোহা অনুরোধের সুরে হাতজোড় করে বলল,
—“প্লিজ আমাকে একটা চান্স দেন প্লিজ।”
রাফি নিজের সাথে হেরে যায়,মনের যুক্তির দুয়ারে তার যুক্তি খুবই নড়েবড়ে।ঠোঁট কামড়ে হাসে।
—“এই চান্স যদি কাজে না লাগাতে পারেন তো কি শাস্তি নিবেন?”
—“আপনি যা বলবেন তাই হবে।”
—“সিউর তো”
—“হ্যাঁ।”
রাফি আকাশের দিকে ফিরে বলে,
—“আচ্ছা।”
নোহা ঘুরে গিয়ে রাফির সামনে দাঁড়ায়,
—“কি আচ্ছা?
—“তুই যা বললি।”
নোহা আনন্দে কেঁদে দেয়,
—“সত্যি!”
—“হ্যাঁ।”
—“খুব ভালোবাসবেন তো?”
রাফি কিছু বলল না।সে চাইছিল আজকে নোহাকে একেবারে দূরে সরাবে কিন্তু কি হল?নোহা আরো আষ্টেপৃষ্ঠে মেখে গেল।নোহার চোখের ঝিলমিল আনন্দ তার চোখে পড়ছে।কাজটা কি ঠিক হলো? তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
—“কিন্তু শর্ত আছে।”
নোহা চুপসে বলল,
—“আবার কি শর্ত?”
—“চাচ্চুকে না মানাতে পারলে অথবা এমন পরিস্থিতি আসলে আমরা ভূলে যাব যে একে অপরকে চাই।”
নোহা আর কিছু শুনতে চায় না।রাফি তাকে এখন থেকে ভালোবাসবে এটাই অনেক।এসব শর্ত ফর্ত বাদ।তাও মাথা নেড়ে বলে রাজি।রাফি আর কিছু না বলে আবার অন্ধকারে চোখ রাখে নোহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
—“ভালোবাসবেন তো আমায়?”
রাফি হাত দিয়ে চুল আঁচড়ে নেয়।
—“নোহা আমি তোর থেকে কত বড় জানিস?”
নোহা কাচুমাচু করে বলে,
—“বেশি না মাত্র দশ বছর।”
রাফি অবাক হয়ে বলে,
—“দশ বছর তোর কাছে মাত্র?”
নোহা মাথা নেড়ে বলল,
—“হ্যাঁ ”
রাফি বলল,
—“আর কয় বছর পরেই বুড়ো হয়ে যাব।তখন?”
চাঁদের আলোপথ থেকে মেঘ সরে পৃথিবীর বুকে জ্যোৎস্না আসতে দেয়,সেই আলোতে নোহা লজ্জা পায়।ফিসফিস করে বলল,
—“এই বুড়োটাকেই ভালোবাসব।”
রাফি নেশানেশা চোখে নোহাকে দেখে।এই মেয়েটার সামনেই তার শক্ত খোলস নরম হয়ে যায়।নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেও কোথাও খাদ থেকে যায়।
নোহা রাফির চোখের দিকে তাকাতে পারছেনা।আজকেই প্রথম নোহা রাফির চোখের ভাষা বুঝল।কাঁপা গলায় বলল,
—“আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”
নোহার কথা শুনে রাফি শব্দ করে হেসে দিল,
—“কবে থেকে অনুমতি নেয়া শুরু করলি?”
নোহা হাসল না,চোখ পিটপিট করে বলল,
—“সম্মতির ভালোবাসায় প্রথম ছোঁয়ার অনুমতি চাই।”
রাফি আটকে গেল,এমন আবদার উপেক্ষা করার সাধ্যি কার!রাফি’ও পারল না,নোহাকে কিছু না বলে দু’হাতে কাছে ডাকল।নোহা লক্ষী বিড়ালের মতো গুটিসুটি মেরে বুকে মাথা রাখল।
রাফির চোখ বন্ধ করে নোহার স্পর্শ নিল।কাঁপা কাঁপা হাতে নোহার পিঠে হাত রাখল।রাফি হাত রাখার সাথে সাথেই নোহা যেন কেঁপে ওঠে,রাফি ব্যাস্ত হয়ে হাত সরাতে চাইলে নোহা করুন গলায় বলল,
—“অনেক বছরের তৃষ্ণা রাফি।প্লিজ একটু মেটাই।”
আহ,কি মোহনীয় আবদার,এমন পাগল করা কথা শুনে রাফির সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।শরীরের হরমোন জেগে উঠে তাকে রমনীর বিষ বানে ঠেলে দিল।জ্ঞানে থাকা অবস্থাই এই প্রথম রাফি নোহাকে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরল বুকের খাচায়।চুলের ভাজে নাক ঘষে বলল,
—“নোহা আমাকে সামলাতে পারবি তো?”
নোহা রাফির স্পর্শে পাগল হয়ে গেল।বুকে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
–“পারব।আর না পারলে আপনি শিখিয়ে দিবেন।”
রাফির বুকে সুখের বাতাস বইল।মনে হল আজকে কিছু পূর্ন হলো যার সুখ বুকের পাখি সইতে পারছে না।উত্তেজনায় ছটফট করছে।নোহাকে বুক থেকে আঁকড়ে তুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়াল।ফিসফিস করে বলল,
—“আমি কিন্তু ভিষন খারাপ।”
নোহা কিছু না বলেই লাজুক হেসে আবারো রাফির বুকে মাথা রেখে বুঝল রাফির হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।নোহা খিচে চোখ বন্ধ করে নিল।এই সুখের অপেক্ষায় কত প্রহর কেটেছে,অবশেষে সেই ক্ষন,সেই প্রিয় পুরুষ।
★★★
নিশির হঠাৎ করে প্রচন্ড পেট ব্যাথা।ব্যাথায় পাগলের মতো কাঁদছে।সবাই তড়িঘড়ি করে হসপিটালে নিয়ে গেল।শিহাব অফিসে ছিল,খবর পেয়ে ছুটে গেল।গিয়ে দেখল সাদা কাপড়ের চাদরের নিচে নিশিকে সাদা বেডে শুইয়ে রেখেছে।হাতের কাছের স্যালাইন অল্পকরে শরীরে প্রবেশ করছে।নিশিকে এই অবস্থায় দেখে শিহাবের আত্মা শুকিয়ে যায়।তখনি নাহার রিপোর্ট হাতে ছুটে এলেন।শিহাব কে দেখে ভরসা পেলেন।রিপোর্ট শিহাবের হাতে দিয়ে বলল,
—“বাবা তুই ডাক্তারের কাছে যা।গিয়ে দেখ কি বলে।আমি যাব না আমার হাত পা কাঁপছে।”
শিহাব দেরী না করে ডাক্তারের কেবিনে ডুকে।এরপর ডাক্তার যা বলে তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না।চোখের কোল বেয়ে পানির অস্থিত্ব টের পায়।এটাও হওয়ার ছিল!
—চলবে—