সুখ সন্ধানী পর্ব-০৪

0
752

#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-৪
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★
নুরজাহান বেগমের স্বামীর নাম আমিনুল শিকদার।একসময়ের আর্মি অফিসার ছিলেন।এখন বর্তমানে অবসর নিয়েছেন।উনার চেহারা,শারীরিক গঠন সব দিক দিয়ে খুবই সুদর্শন।এক দেখায় যে কারো নজর কেড়ে নেন।উনার একমাত্র ছেলে সাদাফ শিকদার শিহাব।বাবার মতই শারীরিক গঠন পেয়েছেন।আর মায়ের দুধে আলতা গায়ের রঙ।বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা।এই এক বছর হলো চাকরির বয়স।
আজকে শিহাবের কাজে মন বসছেনা।শরীরের প্রতিটা রক্তকণা আজকে ঘোরতর প্রতিজ্ঞা করে অনশনে নেমেছে যদি তার সেই প্রিয় মুখ দর্শন না করায় তাহলে সে কোন কাজেই মনোযোগ দেবে না।কতদিন হল যেন নিশিকে দেখা হচ্ছে না?হ্যাঁ হ্যাঁ এক মাস দশ দিন কাজের চাপে কোথাও যাওয়ার ফুসরত নেই।কিন্তু মন বাবাজি আজ বেকে বসেছে,আজকে তার কাছে যাওয়া চাই তার রাগী মুখ দেখা লাগবেই ঝগড়া করে হলেও তাকে আজকে কিছু মূহুর্তের জন্য চাইই চাই।এই হতচ্ছাড়া ঘাড়ত্যাড়া মন নিয়ে শিহাব খুব ঝামেলায় আছে যখন তখন খুব উদ্ভট ইচ্ছা নিয়ে আবদার করে ইচ্ছা পূরুন না করলেই শুরু হয় তার ঘাউড়ামি কোন কাজে স্থির থাকে না।অফিস শেষ করে ঘড়ি দেখল রাত আটটা। আজকে একটু বেশি চাপ গেছে তার উপর কয়েক বার ভুল করে বসেছিল।গাড়িতে আরাম করে বসে এসি ছাড়ে।শার্টের উপরের বোতাম খুলে টাই খুলে নেয়।আরাম করে ড্রাইভিং সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে।কিন্তু এই আরাম মন বাবাজির বুজি সহ্য হল না সে নতুন করে ফুসে উঠে বলল”বাবার টাকায় কেনা গাড়ির এসি কি খুব আরাম রে শিহাব?নিজেই শুধু আরাম পাবি তা তো হয় না আমাকেও একটু শান্ত কর”।শিহাব ভ্রু কুচকে মনের গোপন বাসনা শুনল।তারপর হাসল মনকে একটু প্রশ্রয় দেয়াই যায়।এতে অবশ্য মনটা কন্ট্রোলে থাকবে।তারপর নাহার খালার বাসার উদ্যেশ্যে গাড়ি ছুটাল।আধাঘন্টায় তাদের বাসার নিচে পৌঁছে মোবাইল হাতে নিশিকে ফোন লাগাল,
—“এই বদ মহিলা আকাম-কুকাম করে এখন বাসায় বসে আছিস?দুই মিনিট সময় দিলাম তাড়াতাড়ি বাসার নিচে নাম।এক সেকেন্ড লেট হলে ঘুম হারাম করে দেব।ফাস্ট।”

নিশি আচমকা এমন হুমকি শুনে চোখ বড় করে তাকাল।ওমা তাকে এমন হুমকি দেবার মানে কি?এমন কি করল যে সোজা তার বাসার নিচে চলে আসছে?নিশি দাতে দাত চেপে আল্লাহ কাছে ফরিয়াদ করল,”আল্লাহ গো এই কেমন খালাতো ভাই দিছ আল্লাহ? আমার জীবন তো ত্যানা ত্যান করে দিতেছে।আমি কি এমন পাপ করছিলাম যে এমন জল্লাদ বিটকেল আমার খালাতো ভাই?”
নিশি গেইট দিয়ে বের হয়ে গাড়ির গ্লাসে টোকা দিল।
শিহাব গ্লাস না খুলে ডোর খুলে দিল।
নিশি কপাল কুচকে বলল,
—“শিহাব ভাই আমি কি করেছি তাড়াতাড়ি বলেন?”

শিহাব ত্যাড়া গলায় বলেন,
—“কেন এত তাড়া কিসের?মোবাইলে বয়ফ্রেন্ডকে চ্যাটলিস্টে রাইখা আসছিস নাকি হ্যাঁ?তুই বাচ্চা একটা মেয়ে বড় ভাই ডাকছি ছোট্ট পোষা বিড়াল ছানার মত চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে থাকবি তা না এসেই কুত্তার মত ঘেওঘেও শুরু করছিস।”

নিশি নাকের পাটাতন ফুলিয়ে গাড়িতে উঠে বসল,আর সাথে সাথেই শিহাব স্টার্ট দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
নিশি আৎকে উঠে বলল,
—“শিহাব ভাই আমরা কোথায় যাচ্ছি?থামান প্লিজ।আপনি এতগুলো অপমান করেছেন আপনার সাথে যাব না থামান।”

শিহাব বিরক্ত হয়ে বলল,
—“চুপ কর তো।তুই একদম তোর ফুফুদের মতো হইছিস।কাজে অকাজে খালি পকপক করিস।”

ফুফুদের কথা বলাতে নিশির গায়ে লাগল সে ফুসে উঠে বলল,
—“শিহাব ভাই।আমার ফুফুদের টানবেন না।তারা খুবই ভালো মনের মানুষ।”

শিহাব নাক কুচকে বলল,
—“কেমন ভালো জানা আছে।তুই আর তোর ফুফুরা সব এক ক্যাটাগরির।সব গুলা ধ্যান্ধাবাজ।”

নিশি তেতে উঠল,
—“শিহাব ভাই…”
নিশি কথা বলার আগেই শিহাব গাড়ি থামিয়ে রাগি দৃষ্টি নিয়ে নিশিকে ধমক দিয়ে বলল,
—“এই বলদ কথায় কথায় ভাই ভাই করিস কেন?এক লাইন কথা বললে দুইবার ভাই ভাই করে।কি অসহ্য জ্বালা!ভাই বলে বলে হার্ট অ্যাটাক করার ধান্ধা করছিস নাতো?”

নিশি নিষ্পাপ মুখে বলল,
—“ভাইকে ভাই না বলে কি বলব আর?আর আমি ভাই বললে আপনি হার্ট অ্যাটাক কেন করবেন?”

—“তুই বুজবি না।”

—“আচ্ছা নাইবা বুজলাম তাহলে কি বলে ডাকব?”

শিহাব আনমনে বলে,
—“শিহাব বলবি।”

নিশি চমকে বলে,
—“কি বলব!”
শিহাব ঘোর থেকে বেরিয়ে বলে,
—“যা মন চায় বলিস এখন চল রেস্টুরেন্টে আমার প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে।”

শিহাব যতই চায় এই মেয়ের সাথে ঝগড়া করবে না কিন্তু কিভাবে যেন হয়ে যায়।এই মেয়ের জন্মের সময় নিশ্চয়ই নিশির বজ্জাত ঝগড়াটে ফুফুরা ঝগড়া লেগে ছিল তাই জন্মগত পেয়েছে।শিহাব সামনে হেটে গিয়ে রেস্টুরেন্টের দরজা টেনে ধরল যেন নিশি যেতে পারে।এই ব্যাপারটা নিশির খুব ভালো লাগল শিহাব ওর সাথে যতই ঝগড়া করুক তার ব্যাপারে অনেক কেয়ারফুল।কেন এত কেয়ার নেয় সেটা নিশি জানে না।জানলেও হয়ত তলিয়ে দেখেনা।রেস্টুরেন্টে দুজন খেয়ে আবার গাড়িতে এসে বসে।শিহাব চুপচাপ বসে নিশিকে দেখছে।
নিশি অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
—“কি হয়েছে ভাইয়া।”
শিহাব পকেট থেকে একটা বেলীফুলের মালা বের করে নিশির হাতে পরিয়ে দিল।নিশি অবাক হল কিন্তু কিছু বলল না।
শিহাব ঘোরলাগা গলায় বলল,
—“নিশু”

নিশি আস্তে করে বলল,
—“হুম।”
নিশির চোখে চোখ রেখে বলল,
—“বেলীফুল আমার খুব পছন্দ।খুব বেশিই পছন্দ।তোকে কেন বেলীফুল দেই জানিস?”
নিশি মাথা নেড়ে না বলল।
শিহাব হালকা কালচে ঠোঁট একটু প্রসারিত করে হাসল।”আচ্ছা জানতে হবে না”বলেই নিশির কোমড়ে হাত দিয়ে একটানে শিহাবের কাছে টেনে আনে,তারপর খুব যত্ন সহকারে সামনের চুল কানের পিছনে গুজে দিয়ে কপালে একটা চুমু খায়।তারপর আবার সিটে বসিয়ে দেয়।তারপর খুব স্বাভাবিক ভাবেই গাড়ি চালায় যেন কিছুই করেনি সবকিছুই আগের মতো স্বাভাবিক।নিশি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শিহাবের দিকে।আজকে বোধহয় তার অবাক হবার দিন।এটা কি করল শিহাব ভাই?মানে কি?নিশির হাত আনমনেই কপালে চলে যায় পরমূহুর্তেই লজ্জায় মাথা নামিয়ে বসে থাকে।তাদের বাসার সামনে এসে নিশি এদিক ওদিক না তাকিয়েই এক ছুটে বাসায় চলে যায়।শিহাব হাসে জিতে যাওয়ার হাসি।বুকে হাত রেখে মনকে বলে, “আজকে একটু বেশিই বেশামাল হয়ে গেছিস তো?”তারপর মোবাইল হাতে নিয়ে নিশির নাম্বারে একটা মেসেজ পাঠায়।

নিশি তার রুমে এসে খাটে বসে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে।তার জীবনের প্রথম চুমো ওই হনুমানটার কাছ থেকে পেল?হায়-হায় তার ভবিষ্যত হাজবেন্ডের কাছে কি জবাব দিবে?নিশির অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।আয়নার সামনে গিয়ে নিশি নিজেকে দেখল,লজ্জায় গাল দুটো টমেটোর মতো হয়ে আছে।ইশ কি করলেন এটা?আমি এই মুখ নিয়ে কিভাবে সবার সামনে যাব?আয়নায় ভাল করে খেয়াল করল চুমুর দাগ পড়েছে কিনা।নিজের সাথেই নিশি বিরবির করল,”সালা উগান্ডার হনুমান ব্যাংকের হিসাব করতে করতে কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?”তখনি নিশির মোবাইলে মেসেজ টোন বাঁজল।নিশি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল শিহাব মেসেজ দিয়েছে।

“”নিশু তোর শরীর কি তুলোর নাকি রে?এত নরম হতে হবে কেন?হাড্ডি আছে তো শরীরে?আচ্ছা তুই বলতে হবে না আরেকবার দেখা হলে প্রেট্টিক্যালি জড়িয়ে ধরে ট্রাই করব কি বলিস?”

নিশি এমন উদ্ভট মেসেজ দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেল।একি সর্বনাশ এই ছেলের আজ কি হল?এমন করছে কেন?নিশি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল আগামী একমাস শিহাবের ছায়ার পাশে দিয়েও হাটবে না।লজ্জায় নিশি চোখ খিচে বন্ধ করে মরা লাশের মত বিছানায় পড়ে রইল।ইশ এই মুখ মাকে কিভাবে দেখাবে তার মনে হচ্ছে চুমুর ছাপ স্পষ্ট কপালে লেগে আছে।তার গায়ে শিহাবের ছোঁয়া লেগে আছে।হায় হায় একি করল হনুমানটা?হাতের বেলীফুলের মালা থেকে ভুরভুর করে ঘ্রান বেরোচ্ছে।মালাটা বারবার শিহাবের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।আমার সাথেই কেন এমন কাজ করার ইচ্ছা হল শিহাব ভাই? হোয়াই খালাতো ভাই হোয়াই?

দূরের একটা গাছ থেকে কোকিলের মধুর ডাক শোনা যাচ্ছে।কি মধু মিশিয়ে ডাকে!নোহা ছাদের দোলনায় বসে ভাবে আহা আমি যদি কোকিল হতাম এমন মধুর স্বরে ডেকে ডেকে রাফিকে ভালোবাসার কথা বলে দিতাম।শুনতে না চাইলেও মিষ্টি সুরে বলে পাগল করে দিতাম।আচ্ছা রাফি কি একেবারেই বুঝে না নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে?আচ্ছা রাফির কি গালফ্রেন্ড আছে?নোহা চট করে দাঁড়াল কই কখনো এটা তো ভেবে দেখেনি।গালফ্রেন্ড আছে বলেই কি নোহাকে এত অবহেলা এত অবজ্ঞা?নোহা আর ভাবতে পারেনা।মাথা ঝিনঝিন করা যন্ত্রণা নিয়ে নিচে চলে যায়।বাসায় গিয়ে দেখে রাফি অফিস থেকে ফিরে এসেছে।রাফি সোফায় বসে আয়েশ করে কফি খাচ্ছে।এই সন্ধ্যায় ছাদ থেকে আসাতে রুবি খুন্তি হাতে মারার জন্য তেড়ে এলেন।রাফির সামনে নোহা অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নামিয়ে ফেলল।
রাফি আলতো কন্ঠে বলল,
—“ছোটমা আমার মাথা খুব ব্যাথা করছে তোমার ওষুধটা একটু রুমে দিয়ে যাও তো।”
এই বলে রুমে চলে গেলেন।
রুবি নোহার হাতে ওষুধ দিয়ে পাঠাল।নোহা চুপিচুপি রুমে ঢুকে। মারিয়ার বিয়ের পরে আর আসেনি এই রুমে অনেকদিন পরে এসে মনে ঠান্ডা হাওয়া দোল খেল।তারপর বিনাশব্দে বিছানার পাশে চুপচাপ দাঁড়াল।রাফি আধশোয়া হয়ে বসে আছে।নোহাকে দেখে ভ্রু কুচকায়।
—“তুই আসছিস কেন?নিষেধ ছিল ভুলে গেছিস?”
নোহা মাথা নিচু করেই বলল,
—“আমি আসতে চাইনি মা জোর করে পাঠাল।”
—আচ্ছা রেখে যা।”

নোহা মিনমিন করে বলল,
—“আমি মাথায় লাগিয়ে দেই?”

রাফির ইচ্ছে করছিল কেউ লাগিয়ে দিক কিন্তু নোহাকে সেই চান্স দিলে নোহা মাথায় চেপে বসবে এই পাগল মতির মেয়েকে কোনভাবেই কাছে ঘেষতে দেয়া যাবে না।একে তো নাচুনে বুড়ি সাথে থাকে যদি।ডোলের বারি।তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।রাফি চোখ কুচকে বলল,
—“আমি লাগিয়ে নিতে পারব তুই যা।”
নোহা আর বেশি কথা বলে না চলে যায়।দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকায়,
—“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
রাফি নোহাকেই দেখছিল অনেকদিন পরে একান্তে কাছে এসেছে মেয়েটা।
—“হুম কর।”

—“আপনার কি গালফ্রেন্ড আছে?”

রাফি মনে মনে হাসল।
—“থাকলে কি ঘটকালি করবি নাকি।”
নোহা মুখ কালো করে বলল,
—“জানতে চাইছি আছে?”

—“একদিন সময় হলে ঠিক জানবি।এখন যা তোকে দেখলেও রাগ লাগে।”
নোহা মনে আঘাত পায়।মানুষটা সবসময় তাকে এভাবেই আঘাত করে।
নোহা যাওয়ার পরে রাফি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।রাফির মা বাবার উপর অভিমান হচ্ছে তারা থাকলে জীবনের সাঁজটা অন্যরকম হত।এত ছাইপাঁশ ভাবতেই হত না।রাফির মাইগ্রেনের ব্যাথা ধীরেধীরে বেড়ে যায়।রাফি মনে মনে ভাবে সে যদি পাশে থাকত তবে বুঝি মাইগ্রেনের সাথে যুদ্ধ করে আমায় সুখ দিত।কবে কাছে আসবে আমার সুখ সন্ধানী কবে?

নিশি আর নোহা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম নিয়ে ভর্তি হয়েছে।দুজনেই খুব ভালো বন্ধু।ইতোমধ্যে নোহার মনের ভাব নিশির জানা হয়ে গেছে।রাফির প্রতি নিশির বড্ড রাগ হলো এমন আগুন সুন্দরীর ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করার সাধ্যি কেমন করে হল?

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে