#সুখ_সন্ধানী
#পর্বঃ ৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
মারিয়ার শশুড়বাড়িতে আজকে রিসিপশন।যথারিতি আব্দুল মোমেন সাহেবের সব আত্মীয় স্বজন নিয়ে নাতনীর শশুড় বাড়িতে উপস্থিত হলেন।মারিয়াকে দেখে সবার মনে শান্তি লাগল।স্টেজে রানীর সাজে বসে আছে।সে তার পরিবারের সবাইকে দেখে খুব খুশী।রাফি মারিয়ার কাছে গেলে মারিয়া অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
—“রাফি ভাইয়া খবরদার আমার কাছে আসবে না।”
রাফি মুচকি হেসে বলল,
—“আমি কি অন্যায় করে ফেললাম আপামনি?”
—“আমার বিদায়বেলায় তুমি আমার কাছে।আসোনি।”
—“ওরে বাবা তাই রাগ করেছিস?আচ্ছা সরি।”
—“ঠিক আছে এবারের মত মাফ করলাম।”
—“আচ্ছা তোমরা সবাই এলে নোহা কোথায়?ওকে কোথাও দেখছিনা কেন?”
নোহার কথা শুনে রাফির হাসিহাসি মুখ নিমষেই অন্ধকার হয়ে যায়।চাপা নিশ্বাস ফেলে বৃদ্ধাজ্ঞুলি দিয়ে একটা ভ্রু চুলকে নেয়।মারিয়া আবার বলে,
—“ভাইয়া নোহা কি আসেনি।”
রাফি কিছু একটা ভেবে বলল,
—“এসেছে তো।”
—“তাহলে কোথায়?”
—“আছে হয়তবা কোথাও।”
রাফি আরো কিছুক্ষন কথা বলে স্টেজ থেকে নেমে আসে।
এরমাঝে আবার নোহার মা রুবি হন্তদন্ত হয়ে আসে রাফিকে সামনে পেয়ে বলে,
—” এই রাফি নোহাকে দেখেছিস?বলতো এতবড় মেয়ে নিয়ে কি করি?সকাল থেকে কিছু খায় নি।বোনের বাড়ির অনুষ্ঠান কই আগে আগে থাকবে তা না মেমসাহেবাকে খুজাঁর জন্য লোক লাগছে।অনেকক্ষণ হল কোথাও দেখছিনা তুই দেখেছিস?”
রাফি মাথা নেড়ে বলল,
—” না ছোটমা আমি নোহাকে দেখিনি।”
—“আচ্ছা পারলে একটু খুঁজে দে তো।আমাকে মারিয়ার শাশুড়ী ডাকছে কোন আত্মীয়ের সাথে নাকি পরিচয় করাবে।”
—“ঠিক আছে।”
রাফি কি করবে বুঝে না তার কি করা উচিত।অনেক ভেবেচিন্তে নিশিকে দেখে ডেকে কাছে আনে,
—“এই নিশি নোহা কোথায়?”
—“ভাইয়া নোহা অনেকক্ষন হল ওই পিছনে কর্নারের ওয়াশরুমে গেছে এখনো আসে নি।”
—“কতক্ষন হল গেছে।”
—“আসার পরেই।আসলে গাড়ি থেকেই ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।চোখ খুব লাল হয়ে ছিল।নোহা বলল কাজল পড়তে গিয়ে নাকি লেগেছে।তাই ওয়াশরুমে পানি দিতে গিয়েছে।”
—“আচ্ছা আমি দেখছি।”
তারপর রাফি ওয়াশরুমের রাস্তায় হাটে।একটা ওয়াশরুম থেকে পানি পরার শব্দ হচ্ছে,
রাফি ওয়াশরুমের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।মেয়েটা কাল রাতে আচানক জড়িয়ে ধরেছিল যেটা কিনা খুব বেশি বাড়াবাড়ি। রাফি কড়া কথা শুনিয়েছে।যার ফলেই তিনি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।রাফি গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
নোহার বুকে প্রেমের অনল দাউদাউ করে জ্বলে।গলায় প্রেমের বিষাক্ত কাটা আঁটকে আছে না পারছে গিলতে না পারছে ফেলে দিতে।প্রেমে পড়লে যে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় এটা সবার জানা কিন্তু একতরফা প্রেমের যে যন্ত্রনা সেটা হয়ত সবার জানা না।এক তরফা প্রেমে প্রিয় মানুষটা কাছে থাকলেও কথা বলা বারন।পাশে বসে হাত ধরা বারণ।মন খারাপ হলে জরিয়ে ধরা মানে ঘোরতর অপরাধ।যেটা কিনা কাল রাতে নোহা করে ফেলেছে,
কাল রাতে আড্ডার পরে নোহা তার নিজের রুমে না গিয়ে মারিয়ার রুমে যায়।রুমটা খালি দেখে নোহার খারাপ লাগে আপুর সাথে কত দুষ্টমি কত ঝগড়া।সব মানঅভিমান শেষে মারিয়াই নোহাকে বুকে টেনে নিত।খুব ভালোবাসে যে তার ছোট বোনটাকে।নোহার নিজেকে খুব একা লাগল।কারো সংজ্ঞ প্রয়োজন,নোহা কোনকিছু না ভেবেই রাফির রুমে ঢুকে যায়।অন্ধকার রুম থেকে বারান্দার হালকা চাঁদের আলোয় প্রিয় মানুষটার ছায়া দেখা যায়।নোহা বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে।সিগারেটের গন্ধ চারিপাশে ভরে আছে নোহা এই প্রথম সব লজ্জা ভুলে আলতো করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।রাফি কোন প্রতিক্রিয়া করে না চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে যেন সে নোহার এই নরম আলিজ্ঞনের প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল।নোহার হাতে রাফির বুকের টিপটিপ শব্দ লাগছিল।নোহা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নেয়, রাফি আস্তেকরে নোহার হাতদুটো বুক থেকে সরিয়ে দেয়।নোহার দিকে ফিরে তাকায়।রাফি শান্ত চোখে নোহাকে একপলক দেখে চাঁদের দিকে তাকায়।গম্ভীর গলায় বলে,
—“নোহা তুই কি চাস বলত?”
নোহা নিশ্চুপ হয়ে রাফির দিকে তাকিয়ে থাকে।
—“নোহা আমার সহ্যের সীমা আজকে অতিক্রম করে ফেলেছিস।”
নোহা কিছু না বলে অপলক দেখে। যেন আজকেই শেষ দেখা।
রাফি আগের মতই শান্ত দৃষ্টি মেলে বলে,
—“এভাবে তাকাই আছিস কেন?”
নোহা এবার মুখ খুলে বলে,
—“এমনি।”
রাফি এবার বোধহয় রেগে গেল,
ধমকে বলল,
—“এসব করার মানে কি হ্যাঁ? ”
নোহার সরল উত্তর,
—“আপুকে মনে পড়ছে।ভাল লাগছেনা।”
—“ভাল না লাগলে আমাকে জড়াই ধরতে হবে কেন?”
নোহা রাফির চোখে চোখ রেখে বলল,
—“কারন আপনি আমার শান্তি তাই।”
এমন সোজাসাপ্টা কথায় রাফি যেন আর কথা খুজে পেল না।খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
—“আমি চলে গেলে কি তুই খুশি হবি রে নোহা?”
রাফির এমন কথায় নোহা চমকে তাকায়।চলে যাবার কথা শুনেই কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে সে অবশ্যই এই মানুষটাকে না দেখে থাকতে পারবে না।
দৃঢ়ভাবে বলল,
—“আপনি চলে গেলে আমি মরে যাব।”
—“কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।মারিয়ার বিয়ের সব আয়োজন শেষ হলে আমি চাচ্চুকে বলে নতুন বাসায় শিফট হব।অলরেডি বাসা দেখাও হয়ে গেছে।”
নোহা চোখ বেয়ে পানি পড়ল।অপলক সামনের শ্যামবর্নের লম্বা স্বাস্থবান পুরুষটিকে দেখল।ঠোঁট কেঁপে উঠল।নোহা কান্না আটকানোর জন্য দাত দিয়ে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরল।কাঁপা কন্ঠে বলল,
—“আপনি আমার জন্য চলে যাচ্ছেন?”
রাফি মাথা নেড়ে বলল,
—“হ্যাঁ।সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কখনো এমন জঘন্য আচরন করতে পারেনা।কিন্তু তুই প্রতিনিয়ত এমনটাই করছিস।প্রচন্ড বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস আজকাল।সাথে অসভ্যও।”
নোহা চোখের পানি মুছে বলল,
—“আমি জানি আমি খারাপ তাই বলে চলে যেতে হবে?”
—“হ্যাঁ।”
—“প্লিজ এটা করবেন না।”
—“না করার কোন কারন থাকলে অবশ্যই করতাম না।”
—“আচ্ছা আপনি যা বলবেন আমি তাই করব তাও প্লিজ বাসা ছেড়ে যাবেন না।”
—“আমি যা বলব তুই কখনো তা শুনবি না আর মানবিও না।”
নোহা দ্রুত মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলল,
—“আপনি যদি আপনার কথা শুনার জন্য এই বাসায়ই থাকেন তাহলে যা বলবেন তাই শুনব।”
রাফি শান্ত গলায় বলল,
—“তুই ভেবে বলছিস তো?”
নোহা প্রচন্ড সিরিয়াসভাবে বলল,
—“সত্যি আমি রাজি।”
রাফি দুহাত ভাজ করে দাঁড়ায়।
—“আজকে থেকে আমার থেকে দূরে থাকতে হবে।আমার কাছে ভুল করেও আসা যাবে না,আমার রুমে আসা যাবে না,আমার সাথে কথাও বলা যাবে না,আর হ্যাঁ তোর ওই নিলজ্জ বেহায়া নজর দিয়ে আমাকে দেখা যাবে না।সবগুলো যদি মেনে নিতে পারিস তাহলে বাসায় থাকব আর যদি না মানতে পারিস তাহলে আমি বাসা।ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হব।এখন তুই ভাব কি সিদ্ধান্ত নিবি।”
রাফির শর্ত শুনে নোহা পাথরের মতো জমে যায়।একি শর্ত দিচ্ছে এই ছেলে,এই ছেলের মুখ না দেখলে তো নোহা মারা যাবে দুদিনে নোহার প্রান দেহ ছেড়ে পালাবে আর এই ছেলে কিনা বলছে নোহা যেন তাকে না দেখে।নোহা ফুপিয়ে।উঠে কান্না গলায় দলা পাকিয়ে উঠছে নিচের ঠোঁট সামান্য ফুলে কেঁপে ওঠে।
—“এটা আপনি কেমন শর্ত।দিলেন?আপনার কাছে না আসলাম না কথা নাইবা বললাম কিন্তু না দেখে কিভাবে থাকব।”
—“না দেখেই থাকতে হবে পারবি তো?”
নোহার নিচের ঠোঁট আবার ফুলে উঠে আর সমানতালে কাঁপতে থাকে।আঁকুল হয়ে বলে,
—“আমি মরে যাব তো।”
—“ওকে তাহলে বাসা ছাড়তেই হচ্ছে।”
নোহা মিনতি করে বলে”
—“প্লিজ দূর থেকে একটু দেখব।”
—“আমার দিব্যি তুই লুকিয়েও আমাকে দেখবিনা।ও’কে?”
নোহা ভেবে দেখল রাফিকে আটকানোর এই একটাই পথ।রাফি কখনো কারো সামনে রেগে যায় না কিন্তু শান্ত হয়েই গম্ভীর গলায় যা কিছু বলে এটাই করে এর হেরফের এই পর্যন্ত নোহা হতে দেখেনি।আর রাফির যত রাগ সব নোহার উপর,নোহার সাথে।যেভাবে রেগে যায় অন্য কেউ হয়তোবা কখনো এই রূপ দেখেনি।নোহার সাথেই এত রাগ কেন রাফির?দু’হাতে চোখের পানি মুছে বলল,
—“সব শর্ত মানব।এবার যাওয়া বন্ধ তো।”
—“হ্যাঁ বন্ধ।”
—“এবার পাঁচ মিনিট দেখি।আর কখনো দেখব না।প্লিজ..”
রাফি কিছু বলেনা শীতল চোখে নোহাকে পর্যবেক্ষণ করে।নোহা রাফির এই শীতল দৃষ্টি সহ্য করতে পারেনা।প্রায়ই দেখে রাফি এভাবে তার দিকে তাকায়, এই দৃষ্টিতে তখন কি থাকে বুঝা মুশকিল কিন্তু থাকে কিছু একটা যেটা কিনা নোহার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।নোহা চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
আজকে ভাগ্যক্রমে রাফির গাড়িতেই নোহার উঠতে হল।অন্য কাজিনরা উঠবে তাকেও জোড় করে উঠিয়েছে।নোহা বেশি ধোনামোনা না করে উঠে গেছে।এখন পর্যন্ত কেউ জানে না সে যে রাফিকে খুব ভালোবাসে।গাড়িতে উঠার পরে নোহার অবস্থা খারাপ সে রাফিকে চাইলেই আজকে দেখতে পারে কিন্তু কাল রাতের কথার পরে আর দেখা সম্ভব না তাহলে যদি সত্যি চলে যায়?না রাফি আশেপাশে আছে এই সস্থি।নোহা এই বলে মনকে বুঝ দেয় কিন্তু মন তাকে অন্য কথা শুনায় রাফিকে দেখার আকুল আবেদন জারি করে,নোহা এই বিরহে কাতর হয়ে চোখের জল ফেলে নিশি কয়েকবার নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে কেন কাঁদছে কিন্তু নোহা অজুহাত হিসেবে বলেছে কাজল লেগেছে তাই চোখ জ্বলে।কিন্তু লেগেছে তো অন্যখানে যেখানের ঠিকানা কেউ জানে না যার জানার কথা সে ফিরেও চায় না।
তখনি শিহাব গান প্লে করে,
—“আগে যদি জানিতাম তবেএএ
মন ফিরে চাইতাম।
এই জ্বালা আর প্রানে সহেনা রেএএএএ।এই জ্বালা আর প্রানে সহেনা।।”””
এই গান যেন নোহার বুকে সুপ্ত আগুনে কেরোসিন ঢেলে দিল।বুকে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে চোখে টিস্যু চেপে বসে রইল।হায় পাষান পুরুষ এক আকাশ ভালোবাসা বুজলে না।
দরজার নক করার শব্দে নোহা কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।চোখ মুছে দরজা খুলে।দরজা খুলে যাকে দেখে তাকে এই মূহুর্তে সে আশা করেনি কিভাবে আশা করবে যে কিনা গতকাল রাতেও সামনে যেতে নিষেধ করেছে এখন স্বয়ং তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নোহার লাল চোখ দেখে রাফি যা বুঝার বুঝে নিল।রাফি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে নোহা বুঝতে পারল কিছু বলতে চায়।নোহা মাথা নিচু কতে এগিয়ে যায়।
—“এসব করার মানে কি?”
নোহা নিশ্চুপ দেখে রাফির মাথা বিগরে যায় দাঁতেদাঁত চেপে বলল,
—“কি প্রমান করতে চাস?সবাই তোর দিকে অবাক হয়ে তাকায়।নোহা প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।এসব তোকে মানায় না।”
—“আমি মরে যাচ্ছি আর আপনি মানা না মানা নিয়ে পড়ে আছেন।”
—“পাগলামি বন্ধ কর। দেখবি সব ও’কে।”
নোহা শিহাবের চোখে চোখ রেখে বলল,
—“আমি মরে গেলে আপনি কি খুব বেশি খুশি হবেন?”
রাফির বুকে সুক্ষ্মভাবে সুচের খোচা লাগল।জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
—“আচ্ছা দূর থেকে দেখবি কাছে ঘেষবি না একদম।”
রাফি দ্রুত পায়ে সামনের দিকে চলে যায়।পিছনে কান্নারত মেয়েটার রক্তিমমুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে।নোহা এক হাত বুকে রেখে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে।”
চলবে….