#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-২
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
“আমার ভেতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছ তুমি হৃদয় জুড়ে ”
নোহার কন্ঠে যেন ভালোবাসার আকুল আবেদন ঝরে পড়ছে।কন্ঠ যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে,প্লিজ রাফি একবার ভালোবাসেন।শুধু একবার আমাকে নিজের করে আঁকড়ে ধরেন।আমি ধন্য হব,আমার পুড়ে যাওয়া হৃদয়ে একপশলা বৃষ্টি হবে।কিন্তু সেদিকে রাফির খেয়াল নেই।একজন যে তার সমস্ত ভালোবাসা উজার করে গান গাইছে বিরহে তার বুক পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সেদিকে ধ্যান দেয়ার কর্ম বুঝি রাফির না সে একধ্যানে পায়ের উপরে রাখা ল্যাপটপে হাত চালিয়ে যাচ্ছে।কপালের চামড়া খানিকটা কুচকানো।এসির নিচে বসেও নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্থিত্ব বিদ্যমান।সবাই নোহার গানে মুগ্ধ হয়ে করতালি দিল।কিন্তু নোহা সবার করতালি বাহবা উপেক্ষা করে একজনের সামান্য প্রশংসা আশা করছে সে নিজেও জানে নিষ্ঠুর মানুষ কিছু বলবেনা আদো গানটা শুনেছে কিনা এতেও ঢের সন্দেহ।নোহা মনখারাপের খাতা এখন খুলতে চায় না তাই মন খারাপের ঝাপি বন্ধ করে সবার দিকে তাকাল হাসি হাসি মুখ করে।
রাফি মোবাইলটা হাতে নিয়ে রেকর্ডিং বন্ধ করল।নোহা তার দিকে তাকালেই সে বুজে যায়।এর জন্য তার নোহার দিকে তাকাতে হয় না এতক্ষন যে ঘর ভর্তি মানুষের সামনে বেহায়া নজরে দেখছিল রাফি ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই বুঝেছে।কিন্তু সে কথা বলতে চায় না।আর এই মেয়ের সাথে তো অবশ্যই না।রাফি মোবাইল ল্যাপটপ হাতে উঠে দাঁড়ায়।সবার উদেশ্য করে বলে,
—“সবাই ইনজয় কর।আমি খুব ক্লান্ত।রুমে গেলাম।”
শিহাব চোখ ছোট করে বলে,
—“কিরে ভাই কি ব্যাপার রুমে বউ রেখে আসছিস নাকি? রুমে যেতে এত তাড়া কিসের?”
একথা শুনে সবাই হেসে ফেলে রাফি শিহাবের মাথায় একটা থাপ্পড় মেরে বলে,
—“রাখলেও রাখতে পারি।আড্ডা শেষ হলে ঘুমোতে আয়।”
রাফি নোহার দিকে একপলক তাকায়।তারপর রুমের দিকে পা বাড়ায়।ঘড়ির কাঁটা ঢকঢক করে এখন রাত তিনটায় গিয়ে আছড়ে পরেছে।বিয়ে থেকে এসেই সব কাজিনরা একসাথে আড্ডায় বসেছিল।যদিও তাদের বাসা একি পাড়ায় কিন্তু এভাবে কখনোই সবার একসাথে হওয়া হয় না।রাফি উঠে চলে যাওয়াতে যেন আড্ডার তাল নষ্ট হল একে একে সবাই উঠে যায়।নিশি রুমে যাবার জন্য পা বাড়াতেই শিহাব তার হাত টেনে ড্রয়িংরুমের পাশের একচিলতে বারান্দায় নিয়ে যায়।নিশি ভয়ে বুকে থু থু ছিটায়।তারপর রাগ্বত স্বরে বলে,
—“কি সমস্যা শিহাব ভাই?রাত বিরাতে হাত ধরে টানাটানি করেন কেন?”
শিহাব এক-পা সামনে এসে বলল,
—“আমি হাত ধরে টানাটানি করলেই দোষ?তখন যে ছেলেটার সাথে দাত কেলিয়ে হেসেহেসে,গা ঘেষাঘেষি করে সেল্ফি তুললি তখন দোষের বাক্স কইছিল?”
নিশি ফাটা বেলুনের মত চুপসে যায়।যাহ বাবা এটাও দেখে ফেলেছে।এই হনুমানের চোখ কি নিশির পিছনে সারাদিন সিসি ক্যামেরা হয়ে ঘুরে নাকি?ছেলেটা এত করে রিকোয়েস্ট করছিল আর সাথে তো মারিয়া আপু আর তার বর তমাল ছিল।ছেলেটা নাকি তমাল ভাইয়ের বন্ধু তাই তুলেছে ছবি।গলার স্বরে জোর করে একটু তেজ এনে বলল,
—“শিহাব ভাই! আমি মোটেই গা ঘেষি নাই।আপনি ভুল দেখেছেন।আর আমার হাত ছাড়ুন লাগছে।”
শিহাব নিশির হাত আরেকটু মুচড়ে ধরে বলল,
—“বদ মহিলা মিথ্যা বলিস কেন?দাঁড়া খালামনিকে কালকেই বলব আমি।”
নিশি হাতের ব্যাথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠে।চোখে পানি চলে আসে।মায়ের কথা শুনে চোখের পানির মাত্রা বাড়ে।আকুল কন্ঠে বলে,
—“শিহাব ভাই আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি।আপনি সারাজীবন কেন আমার সাথে এমন করেন?”
নিশি ফুপিয়ে কেঁদে দিল গলা দিয়ে কোনরকম শব্দ এনে আবার বলল,
—“প্লিজ মাকে বলবেন না।এর পরিবর্তে আপনি যা বলবেন তাই শুনব।”
নিশি কেঁদে ফেলায় শিহাব হকচকিয়ে যায়।সে চায়নি নিশি কাঁদুক।এই সামান্য কথায় নিশি এত ভয় পেয়ে যাওয়াতে শিহাব মুচকি হাসে রাতের আধারে যেটা কিনা নিশি দেখল না।
—“ভেবে বলছিস তো?যাই বলি তাই শুনতে হবে।”
নিশি উপরনিচ মাথা ঝাকিয়ে বুজাল যে সে রাজি।
শিহাব হাসল।নিরব থেকে অপলক এই মোহনীয় নিশি রাতে তার সামনের সিগ্ধ নিশিকে দেখে।হাত বাড়িয়ে নোহার যত্নে লাগানো বেলীফুলের গাছ থেকে এক থুকা বেলীফুল ছিড়ে নেয়।নিশি চুপচাপ সব দেখে এতক্ষন বেলীফুলের ঘ্রান আশেপাশে থাকাতেই মনে ঝিমঝিম বাতাস বইছিল।এখন শিহাব ঠিক তার সামনেই এক থুকা তাজা বেলী নাড়াচ্ছে।তারপর নিশির কানের কাছে ফুলের থোকা গুজে ফিসফিস করে বলল,
—“আমার বেলীফুল পছন্দ।খুব বেশিই পছন্দ।”
নিশি শিহাবের কথা আর কাজের কোন সারংশ খুজে পেল না হয়ত খুজে পেতে চায় না।ড্যাবড্যাব করে সামনের বলিষ্ঠ পুরুষটির দিকে তাকিয়ে রইল।তারপর চোখ নামিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।শিহাব ঠায় দাঁড়িয়ে রইল তার যে বেলীফুলের ঘ্রানে নেশা ধরে যায়।এই নেশা কাটাতে সারারাত এক অসহনীয় যন্ত্রনার শিকার হতে হবে।চোখ বন্ধ করে জোরেজোরে শ্বাস ফেলে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়।
রুবি চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে তার বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।মারিয়া তার পুতুল মেয়ে খুবই লক্ষীমন্ত মেয়ে তার।তার মেয়ের বিদায় কোনভাবেই মন মেনে নিতে পারছেনা।আনোয়ারা আর নাহার ভাইয়ের বউকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।কিন্তু তাদের চোখেও পানি।মেয়ে বিদায় খুব কষ্টকর এটা তাদের অজানা না।নাহারের বুকে অজানা সুক্ষ ব্যাথা চিনচিন করে উঠে তার মেয়েরা যে তার সব।মেয়েদের এভাবে দূরে পাঠিয়ে থাকবে কিভাবে সে?চোখের কোন বেয়ে পানি পরে।
আনোয়ারা রুবিকে সান্ত্বনার ছলে ধমকে বলে আহ রুবি কি শুরু করলি বল তো আমরা কালই তো মারিয়াকে দেখতে যাব।আর কাঁদিস না ভাই।তুই এভাবে কাঁদলে হাবিব কি করবে বল তো।গিয়ে দেখ আমার ভাইটা কি করছে মেয়ে তো তার চোখের মনি যা আগে হাবিব কে একটু দেখে আয়।রুবি উঠে তার স্বামীর কাছে যায়।মেয়েদের যে উনি কতো ভালোবাসে এটা তার অজানা না।রুমে গিয়ে দেখে হাবিব আরাম কেদারায় চুপ করে শুয়ে আছে,রুবি কাছে গিয়ে বসে,তার উপস্থিতি টের পেয়ে হাবিব বলে,
—“রুবি আমার ছোট মারিয়া কবে যে এত বড় হয়ে গেল টেরই পেলাম না!দেখ আজকে পরের ঘরে চলেও গেল।”
রুবি কিছু না বলে ফুপিয়ে কেঁদে দেয়।
—“রুবি তোমাকে যখন বিয়ে করি তখন তোমার বয়স আঠারো। বিদায়বেলায় যখন তুমি তোমার বাবা মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলে তখন খুব বিরক্ত লাগছিল।মনে মনে বলছিলাম আরে এভাবে কাঁদার কি আছে।অসহ্য।কিন্তু আজকে যখন আমার মারিয়া আমাকে ধরে কাঁদল তখন আমার বুক চিরে রক্ত বের হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল আমার কলিজা টেনে হিচড়ে কেউ বের করে নিয়ে যাচ্ছে।তোমার জন্য তোমার বাবার কষ্ট আজকে নিজে উপলব্ধি করলাম।খুব কষ্ট হচ্ছে রুবি।”
রুবি চোখ মুছে স্বামী কে স্বান্তনা দিলেন।
রাফি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়।নিজের জিবনে সে অনেকের ভালোবাসা পেয়েছে বাবা-মা না থাকায় সেই ছোট থেকে দাদি-দাদা, চাচ্চু-ছোটমা,ফুফুরা খুব ভালোবাসতো তাকে।হয়তবা বাবা মা না থাকার যে কষ্ট সেটা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করত।সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে তারা সবাই রাফির কাছে অনেক দামি।সবাই রাফির ইচ্ছাকে সবসময় প্রাধ্যান্য দিয়েছে।তার চাচ্চু হাবিব সাহেব কিছু চাওয়ার আগেই এনে দিয়েছে।উনার ছেলে মুনাফ, রাফি আর শিহাব তিনজনই সমবয়সী। হাবিব সাহেব তিনজনকেই সমানভাবে সব দিতেন।রাফির বুকে তাদের জন্য এক আকাশসম ভালোবাসা।তার মতো সুবিচক্ষন পুরুষ মাঝেমধ্যে অভিমান করে তার বাবা-মায়ের সাথে তারা কেন তাকে একা করে চলে গেল,এই দুনিয়ার কেন অন্য সবার মতো তার মা-বাবা নেই।পরক্ষনেই মনে হয় আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে নিয়েছেন এতে মানুষের তো কোন দোষ থাকার কথা না।আজকে রাফি প্রতিষ্ঠিত ভালো কম্পানিতে চাকরি করছে।রাফি সিগারেটের ফিল্টার হাতে এখনো দাঁড়িয়ে রাতের খোলা পরিবেশের বাতাস শরীরের প্রতি অংশ ছুয়ে যাচ্ছে।তখন নোহার জন্যই রুমে চলে এসেছে।মেয়েটা ইদানীং খুব বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে।আগে ধমক দিলে শুনত।এখন বেহায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।আকুল নয়নে বারবার ভালোবাসার আর্জি করে।নোহা মুখ ফুটে বলেনা সে রাফিকে ভালোবাসে।কিন্তু রাফি তার কাজে কর্মে বুঝে।মেয়েটা প্রতিকাজে ভালোবাসার নিবিড় ছোঁয়া একে দেয়।রাফির মতো ছেলেকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবেনা কোনটা ভালোবাসা কোনটা ভাইয়ের প্রতি বোনের মায়া।নোহা বড় হবার পরে রাফিকে কখনোই ভাইয়া বলেনা সবসময় সমন্ধহীন ভাবেই ডাকে।ভাইয়া বলতে বললে বলে না মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকে।রাফি ধমকে বলানোর চেষ্টা করানোতে কেঁদে দিয়েছিল তারপর থেকে রাফি আর কিছু বলেনা।মেয়েটা কেন বুঝেনা তাদের দুজনের মাঝে কখনোই কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। তাহলে কেন এত পাগলামি?কেন এত উতলা দৃষ্টি?কেন বারবার বেপরোয়া ভালোবাসার পরশে ছুঁয়ে যায় রাফির কাতর মনকে?দরজা খুলার শব্দে রাফির ধ্যান ছুটে যায়।শিহাব এসেছে বোধহয়।সিগারেটের ফিল্টার হাত থেকে ফেলে লম্বা শ্বাস নেয় তখনি পিছন থেকে নরম দুটি হাত জরিয়ে ধরে রাফিকে।রাফি আবেশে দুচোখ বন্ধ করে নেয়।বুকের ভেতর অসহনীয় তালে বাঁশি বাজে।না আর সহ্য করা যায় না এই বিরহ!অনেক হয়েছে আর নয়।
চলবে…..