সুখের খোঁজে পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
1047

#সুখের খোঁজে….(শেষ পর্ব )
#মৌমিতা হোসেন

কেটে যায় আরো সাতদিন।গতো কয়েকদিন ধরে অনেক কিছুই তৌসিফ ভুলে যাচ্ছে। এখন আর তেমন কথাও বলেনা। শরীরের অবস্থা এতোটাই খারাপ যে এক দেখায় চেনাই মুশকিল ‌। তৌসিফ এর পক্ষে নড়াচড়াও একা একা সম্ভব হচ্ছেনা। মাঝে মাঝে অক্সিজেন প্রবলেম হচ্ছে।শুধু তাকিয়ে সব দেখে।এর মাঝে বাচ্চাদের দেখতে চাইলে ওদের নিয়ে আসে সালেহা বেগম। তুলি,নাহিন কেবিনে ঢুকেই দৌড়ে আসে বাবার কাছে। বাবাকে ডাকে। তৌসিফ চোখ খুলে দেখে মৃদু হাসি দেয়। কিন্তু কথা বলতে পারেনা কষ্ট হয় খুব।রক্তিম চোখ দুটো শুধু চেয়ে থাকে অপলক। কখনো চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে।

আর নিরব নিতু কে দেখার সাথে সাথে ওর কোলে লাফ দিয়ে ওঠে। খুব আদর করে দেয় ছেলেকে।মায়ের কোল থেকে আর নামে না নিরব।

আজ তুলি বাবার অবস্থা দেখে কেঁদে দেয়।বলে,”বাবা আমি বিরক্ত করি বলেই কি তুমি এখানে এভাবে শুয়ে আছো? আমার কিছু লাগবে না। আমি আর তোমাকে বিরক্ত করবো না। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমার সাথে বাসায় চলো। বাসায় আমাদের একটুও ভালো লাগেনা। অনেক কান্না পায়।আম্মুও কেমন হয়ে গেছে বাসায় যায়না। আমরা তোমাদের ছাড়া থাকতে পারিনা বাবা।”

তুলির সাথে আজ নাহিনও বলে,”আমি আর কিটক্যাট আনতে বলবো না আব্বু।এইযে প্রমিস করছি।প্লিজ তুমি আজ আমাদের সাথে চলো।”কথাগুলো বলেই দুই ভাই বোন তৌসিফ কে ধরে কাঁদতে থাকে।

ছোট্ট তুলির মুখে এতো সব কথা শুনে তৌসিফ এর বুকটা কষ্টে ভারী হয়ে উঠেছে। অনেক কষ্টে তুলি আর নাহিন এর মাথায় হাত রেখে আদর দিয়ে দেয়। দোয়া করে । নিতুর দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই নিতু বুঝতে পারে তৌসিফ কি বলতে চাচ্ছে। নিতু তৌসিফের কাছে নিরবকে নিয়ে আসে। তৌসিফ প্রানপ্রিয় ছোট বাচ্চার মাথায়ও হাত বুলিয়ে দেয়।নিরব এখন আর আগের মতো বাবার কোলে যেতে চায়না।তাই তৌসিফের বেশ কষ্ট লাগে।

পুরোটা বিকেল বাচ্চারা বাবার কাছেই থাকে। সালেহা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে বলার মতো কিছু খুঁজে পায়না। তৌসিফ কে তিনি ছেলের মতোই জানেন। খুব ভালোবাসেন।তাই ছেলে সমতুল্য জামাইয়ের এই করুন অবস্থা তিনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। যখনি দেখতে আসেন চোখদুটো আপন মনেই ভিজে যায়। পুরো বিকেল হাসপাতালে থেকে রাতে সাজিদের সাথে সবাই বাসায় চলে যায়।

নিতু আজকেও সবাই চলে যাওয়ার পর নামায পড়ে তৌসিফের মাথার কাছে বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে নেয়। প্রতিদিন রাতে তৌসিফের জন্য নিতু নফল নামায আদায় করে আরোগ্য লাভের দোয়া করে।আজ হঠাৎ তৌসিফ ব্যাথায় চিৎকার করে উঠলে নিতু কুরআন শরীফ টেবিলের ওপর রেখে তৌসিফের কাছে গিয়ে বলে,”কি কষ্ট হচ্ছে আপনার? খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

“অনেক কষ্ট হচ্ছে নিতু। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।” শুষ্ক ঠোঁটে কথাটা বলে কান্না শুরু করে তৌসিফ।

নিতু ভাবে কতোটা কষ্ট হলে একজন পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদে।নিতু আর সহ্য করতে পারেনা। তৌসিফ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি নার্স কে ডাকছি।এখনি ভালো লাগবে দেখবেন।এখনি ডাকছি।”তৌসিফের কপালে,গালে আদরে ভরিয়ে দেয় নিতু।

নিতু দৌড়ে বাইরে যেতে নিলে তৌসিফ যেতে নিষেধ করে বলে,” যেওনা নিতু। তুমি বরং আমাকে এখনি বাসায় নিয়ে যাও। আমি এখানে আর থাকবো না।শেষ সময়টায় অন্ততঃ আমার অনুরোধ রাখো। আমাকে এই মুহূর্তে বাড়ি নিয়ে চলো।”

“এখন রাত একটা বাজে। এতো রাতে কীভাবে নিয়ে যাবো বলেন? সকালে নিয়ে যাই? আমরা সকাল হলেই বাসায় যাবো ঠিক আছে?”

তৌসিফ রেগে ক্যানুলা খুলে ফেলে। অনেক দিন পর চিৎকার করে, রেগে যায়।তৌসিফের চিৎকারে নার্স,ওরার্ডবয় ছুটে আসে। নিতু এতো দিন পর তৌসিফের এই অবস্থা দেখে ভয় পায়।তৌসিফের কাছে এসে হাত ধরে চিৎকার করে বলে,”এটা কি করলেন? কতো রক্ত বের হচ্ছে ‌।কেনো আপনি আজ কথা শুনছেন না?”

তৌসিফ নিতু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর বলে,”বুঝতে চেষ্টা করো নিতু আমার মনে হয় সময় শেষ হয়ে আসছে। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। এখানে থাকলে আমি তাড়াতাড়ি মরে যাবো। আমি বাঁচতে চাই।আরো অনেক বছর তোমার সাথে, আমার সন্তানদের সাথে বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচাও নিতু।প্লিজ আমাকে বাঁচাও।”

নিতু অনুভব করে ওর কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। তৌসিফের কাঁধে হাত রেখে একটু সরাতেই দেখে তৌসিফের নাক থেকে রক্ত ঝরছে। নিতু দৌড়ে ডাক্তার ডাকতে যায়। এদিকে নার্স হাতে ক্যানুলা দিয়ে ইনজেকশন দিতে নিলে তৌসিফ হাত সরিয়ে নেয়।ব্যাথায় চিৎকার করে ।আজ যেনো আর সহ্য করতে পারছেনা তৌসিফ ।

ডাক্তার নিতুর সব কথা শুনে বলে,” আপনি বরং ওনাকে বাসায় নিয়েই যান। কখন কি হবে আল্লাহ জানে।”

“এমন কথা বলবেন না ডাক্তার সাহেব। দয়া করে কিছু একটা করেন।”

“আপনি অপেক্ষা না করে ওনার শেষ ইচ্ছা পূরণ করুন। আমি দেখি কি করা যায়।”

নিতু কাঁদতে কাঁদতে তাড়াতাড়ি তপুর কাছে ফোন দিয়ে সব বললে তপু তাড়াতাড়ি সাজিদ কে নিয়ে রওনা দেয়।

এদিকে তৌসিফ কে ক্যানুলা লাগাতে ওয়ার্ডবয়ও হাত চেপে ধরে। কিন্তু পারেনা।তৌসিফের কষ্ট দেখে নার্সের চোখেও পানি চলে আসে।এক পর্যায়ে ইনজেকশন দেয়ার আগেই তৌসিফ আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

এদিকে নিতু হাসপাতালের নিচে গিয়ে তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স ঠিক করে দৌড়ে পাঁচতলায় আসে। তৌসিফ এর অবস্থা দেখে,ডাক্তার এর কথা শুনে এখন আর নিতুর মাথায় কিছু কাজ করছে না। শুধু মনে হচ্ছে সময় শেষ।তৌসিফের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে হবে। যেভাবেই হোক ওকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে।লিফ্ট এর কথা ভুলেই যায় নিতু।সিড়ি বেয়ে ওঠার সময় দুবার পরে যায় ব্যাথা পায়। কিন্তু আজ সেদিকে নিতুর খেয়ালই নেই।মাথায় কাপড় নেই,শাড়ির আঁচল ছেড়ে এলোমেলো অবস্থায় দৌড়ে তৌসিফের কাছে যায়। বলতে থাকে,”আমি এম্বুলেন্স ঠিক করে এসেছি। একটু পরেই রওনা দেবো আমরা। আপনি কোন চিন্তা করবেন না তৌসিফ। আপনার ইচ্ছা আমি পুরন করবোই।”

নিতু ভাবে অন্য সময়ের মতোই হয়তো জ্ঞান হারিয়েছে তৌসিফ। তৌসিফের হাত রক্তে মাখা। নিতু তাড়াতাড়ি হাত ধরে অন্য হাতে শারীর আঁচল দিয়ে খুব আস্তে রক্ত মুছে দেয়। তারপর নার্স দের দিকে তাকিয়ে বলে,”ক্যানুলা লাগিয়ে ফেলুন এখন। একটু পরেই আমি ওনাকে বাসায় নিয়ে যাবো। তাড়াতাড়ি করুন।”

ডাক্তার সাহেব বলেন,”এসবের আর দরকার হবে না মিসেস নিতু।”

“কেনো দরকার হবে না?ক্যানুলা না লাগালে ঔষধ কীভাবে দেবেন?”

ডাক্তারেরও গতো এই কদিনে ওদের প্রতি একটা মায়া তৈরি হয়ে গিয়েছে।তাই মনে কষ্ট নিয়েই বলে,”ঔষধের আর প্রয়োজন নেই। রোগী আর আমাদের মাঝে নেই। তৌসিফ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওপারে চলে গিয়েছে।”

ডাক্তার এর কথা শুনে নিতু চুপ হয়ে যায়।আস্তে করে তৌসিফের দিকে তাকায়।ওর কপালে,গালে চুমু খায়।এক হাত দিয়ে শক্ত করে তৌসিফের হাত ধরে রাখে।আর অন্য হাত দিয়ে আলতো করে গালে হাত দিয়ে ডাকে তৌসিফ কে,”এই যে শুনছেন? তাড়াতাড়ি ওঠেন। আমরা বাসায় যাবো। আমি এম্বুলেন্স ঠিক করে এসেছিতো। তাড়াতাড়ি চোখ খুলুন।প্লিজ একবার আমার দিকে তাকান।”

তৌসিফ তখনও চুপ।নিতু তখন তৌসিফের বুকে মাথা রেখে দেখে তৌসিফ নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিনা। আবার ডাকে ,”এই যে শুনছেন।এসব মজা করবেন না প্লিজ।চোখ খুলুন। আমি জানি আপনি আছেন। আপনি বেঁচে আছেন।আরে এভাবে কেউ যায় নাকি?বলে যাবেন না আমাকে?বলা নেই কওয়া নেই…. আমার কাছ থেকে বিদায় নেবেন না? একটু আদর দিয়ে যাবেন না? আর একবার বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাবেন না?দয়া করে চোখ খুলে দেখেন আমি আপনার নরম তুলতুলে বৌটা আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। একদমই পারবো না। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তৌসিফ। আপনাকে অনেক ভালোবাসি। কীভাবে থাকবো আমি? কীভাবে……”নিতু তৌসিফ কে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

নিতুর চিৎকারে আশপাশের অন্য নার্স, রোগীরাও ছুটে আসে কেবিনে। তাদের চোখ দিয়েও অশ্রু ঝরে। কিন্তু এতে নিতুর কষ্ট বিন্দুমাত্র কমে না।এরই মধ্যে তপু আর সাজিদ দৌড়াতে দৌড়াতে রুমে ঢুকে নিতুর এই অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তপু ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে দেয়। সাজিদ দৌড়ে এসে বোনকে ধরে।এক সময় নিতু জ্ঞান হারায়।

তৌসিফদের বাড়ির সামনে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।চাচা,চাচি,ভাই,বোন, বন্ধু সহ সবার চোখে পানি। নিতুর এখনো জ্ঞান ফেরেনি। হাসপাতালে জ্ঞান হারালে তাড়াতাড়ি ডাক্তার নিতু কে চেক করে বলে যে অতিরিক্ত শকড এর জন্য জ্ঞান হারিয়েছে। একবার ভেবেছিলো নিতু কে হাসপাতালে রাখবে জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত। কিন্তু অনেক বিষয় চিন্তা করে ওকে আগেই এম্বুলেন্সে করে সাজিদের সাথে বাসাতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঘুমের ইনজেকশন দেয়ার কারনে এখনো নিতু ঘুমিয়ে আছে। সালেহা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে কাঁদছে মেয়ের পাশে বসে বসে।

তপু হাসপাতালের সব ফর্মালিটিজ শেষ করে তৌসিফের লাশ নিয়ে বাসায় যেতে যেতে ভোর পাঁচটা বেজে যায়।তৌসিফের মৃত্যুর খবর মাইকে ঘোষনা দেয়া হয়। পরদিন দুপুরে জানাযা পড়ানো হবে আর বাবার কবরের পাশেই কবর দেয়া হবে।সব কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়।

নিতুর ঘুম ভাঙে সকাল এগারোটায়।চোখ খুলেই লাফ দিয়ে উঠে বসে। আশেপাশে মা,চাচি,সাদিয়া, সেতু ছাড়াও কয়েক জন প্রতিবেশীদের দেখে খুব অবাক হয়। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।সালেহা তাড়াতাড়ি নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”এখন কেমন লাগছে মা?”

“ভালো লাগছে। কিন্তু কি হয়েছিলো আমার?আর আমি এখানে কেনো?উনি কোথায়?”

“কাল রাত থেকে তোর জ্ঞান ছিলোনা। খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম তোকে নিয়ে।”

“তাহলে তুলির বাবার কাছে কে? ওনাকে হাসপাতালে একা রেখে এসেছো? তোমরা কি মা?জানো যে মানুষ টা হাসপাতালে থাকতে একটুও পছন্দ করেনা। আমি পাশে থাকলে একটু ভরসা পায়।”কথাগুলো বলতে বলতে তাড়াতাড়ি বিছানার থেকে নেমে বাইরে যেতে নিলেই সালেহা বেগম নিতুর হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,”কি বলছিস এসব! তৌসিফ আর আমাদের মাঝে নেইরে মা…”

নিতু ধপ করে বসে পরে।মাথায় তীব্র যন্ত্রনা, বুকের ভেতর প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করে। মনে পরে গতো কালকের রাতের কথা।চোখ দুটো নিমিষেই রক্তিম হয়, ঝাপসা হয়।আস্তে করে বলে,”তৌসিফ এখন কোথায় মা?”

“বাসার সামনে তৌসিফের লাশ রাখা হয়েছে মা। জোহরের নামাজের পর জানাজা পড়ানো হবে।তোর শ্বশুর এর কবরের পাশেই কবর দেয়া হবে।গোসল করানো হয়ে গেছে।”

লাশ শব্দটা শুনেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। তীব্র কষ্ট নিয়ে নিতু বলে,”এটুকু সময়ের ব্যবধানেই ওনার নাম ধরে না ডেকে ওনাকে লাশ বলছো?আর আমাকে ছাড়াই এতো কিছু করে ফেললে তোমরা? মানুষটাকে তার পছন্দের এই ঘরটাতে আর আনতে পারলাম না আমি।”

নিতু দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে ঘরের বাইরে যেতে নিলে সালেহা এসে মেয়ের মাথায় কাপড় তুলে দেয়। বিথি, সেতু মিলে নিতু কে বাইরে নিয়ে যায়।বাইরে গিয়ে দেখে ঘরভর্তি মানুষ। থমথমে পরিবেশ। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা।যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে।আজ প্রকৃতিও কাঁদবে,আজ নিতুর সাথে সাথে প্রকৃতির মনটাও ভীষণ খারাপ।সবাই নিতু কে দেখছে আর কতো আফসোস করছে।বয়স্ক অনেকেই শান্তনা দিচ্ছে। নিতুর কাছে সবকিছু আজ বিষাক্ত লাগছে। বাড়ির বাইরে গিয়ে খাটিয়াতে তৌসিফের লাশ দেখে একটু ছুঁতে নিলেই সবাই বাঁধা দেয়।নিজ প্রানপ্রিয় স্বামী কে দুর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেই প্রান জুড়ায়। অঝোরে কাঁদতে থাকে।প্রানপ্রিয় স্বামীকে চাইলেও আটকে রাখতে পারবে না।অস্ফুট স্বরে নিতু বলে,”আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি আপনার শেষ ইচ্ছা পুরন করতে পারিনি। আপনাকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি শব্দটাও বলতে পারিনি। একেবারে অন্তিম মুহূর্তে আপনার পাশে থাকতে পারিনি। আমার জন্য আর একটু সময় আপনি কেনো অপেক্ষা করলেন না?”

নিতু চারিদিকে সবাইকে অগ্ৰাহ্য করে তৌসিফের পাশে গিয়ে বসে পরে,লাশের ওপর হাত রাখতেই আবার জ্ঞান হারায়।সবাই তাড়াতাড়ি নিতু কে ঘরে নিয়ে যায়। সবাই নিতু কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। তপু এসব দেখে কি করবে বুঝতে পারেনা।

এদিকে তুলি,নাহিন ঘুম থেকে উঠে এতো মানুষ দেখে একটু ভয় পায়।এর মধ্যে সেতু, সাদিয়া বলে যে ওদের বাবা এসেছে।কথা শেষ হবার আগেই তুলি, নাহিন দৌড়ে বাইরে যায়। বাবাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে দুজন মিলে বাবাকে অনেক ডাকে।কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে অনেক কাঁদে। সাজিদ এসে দুজনকে নিয়ে ঘরে যায়।

আর তপু কি করবে বুঝতে পারেনা। নিজেকে সময় ,ভাগ্যের কাছে অসহায় মনে হয়। ভাইয়ের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্টে ভেঙে পরে‌। নিতু কীভাবে নিজেকে সামলাবে সেটা ভাবতেই কষ্টে বুকটা ভার হয়ে যায়।

নিতুর জ্ঞান ফেরার আগেই তৌসিফের জানাজা,দাফন শেষ হয়।জ্ঞান ফিরতেই পাগলের মতো চিৎকার করে তৌসিফ কে ডাকতে থাকে।পুরো বাড়িতে তৌসিফ কে খুঁজে কোথাও না পেয়ে কাঁদতে থাকে।কেউ সামলাতে পারেনা নিতু কে। শেষমেষ ডাক্তারকে খবর দিলে ডাক্তার এসে নিতু কে ঘুমের ইনজেকশন দেয়।

অন্য দিকে তুলি, নাহিন মায়ের এই অবস্থা দেখে খুব কাঁদে।সেতু,বিথি ওরা সবাই তুলি, নাহিন,নিরবের খেয়াল রাখে। ওদের মমতা দিয়ে আগলে রাখে। ওরাও জানে না নিতু কখন এই কষ্ট ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।

ঐ দিনের পর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ বছর। তৌসিফের মৃত্যুর পর প্রায় ছয় মাস নিতু মানসিক ভাবে ভীষণ অসুস্থ ছিলো। প্রথমদিকে সুযোগ পেলেই যখন তখন প্রায়ই কাউকে কিছু না বলে নিতু তৌসিফের কবরের পাশে গিয়ে কখনো বসে বিরবির করে কথা বলতো,কখনো শুয়ে থাকতো। তাই বাসার সবার প্রথমদিকে নিতু কে সামলাতে বেশ সমস্যা হয়েছিলো।নিতু কে সামলাতে সবার বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। পরে সবার নজরদারিতে, অনেক বোঝানোর পরে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে সুস্থ হয় নিতু।সুস্থ হয় তৌসিফের কাছে দেয়া ওয়াদা পুরন করার জন্য। বাচ্চাদের মানুষ করার বিশাল দায়িত্ব এখন নিতুর ওপর।

একা থাকা অসম্ভব।তাই সালেহা বেগম সাজিদ কে নিয়ে এখন নিতুর বাসাতেই থাকে। সাজিদ চাকরি পেয়েছে, বিয়ে করেছে ছয় মাস হবে। দোকানের কাজ বাসায় বসেই সামলায় নিতু। দোকানের ছেলে দুটো বিশ্বস্ত হওয়ায় তেমন সমস্যায় পরতে হয়নি।আর তপু সব সময় সব বিপদে আপদে বড় ভাইয়ের মতো নিতুর পাশে থেকেছে। জুঁই, বিথি, সাদিয়া ওদের ভালোবাসা নিতুর প্রতি এখনো আগের মতই আছে। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। ভাইকে সবাই খুব মিস করে।

তুলি এখন দশম শ্রেণীতে পড়ে। দেখতে একেবারে নিতুর মতোই সুন্দরী হয়েছে। নাহিন পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে,আর নিরব পড়ে প্রথম শ্রেনীতে। তৌসিফের কথা নিরব কিছু না বললেও তুলি, নাহিন বাবাকে খুব মিস করে।সব সময় চেষ্টা করে নিতুর মন ভালো রাখার।

নিতু সুস্থ হলেও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারছিলো না। মাঝে মাঝেই যখন তখন নিতু তৌসিফের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে,একা কাঁদে,কথা বলে। বিভিন্ন সমস্যার জন্য মানসিক ডাক্তার দেখালে ডাক্তার নিতু কে যে কোন কাজে সারাক্ষন ব্যস্ত রাখতে বলে।তপু সহ বাড়ির সবাই মিলে ঠিক করে নিতু কে কোন একটি চাকরিতে ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু এইচএসসির পরে আর পড়াশোনা না করার কারনে তেমন কোন চাকরি নিতু কে দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই নিতু এখন পাশেই একটা প্রাইমারি স্কুলের কিছু বাচ্চাদের পড়ায়। এতে নিতুর একটু সময় কাটে। এসব কাজে ওর দিনের বেলাটা বেশ ভালোই কাটলেও রাত হলেই অস্থিরতা বাড়তে থাকে।বুক ভারি হয়ে যায়, নিঃশ্বাস আটকে যায়। তখন ওর রুমে কেউ যায়না।ঐ সময়টা নিতু একা থাকে। চিৎকার করে কাঁদে। তৌসিফের শেষ ইচ্ছা পূরণ না করার কষ্ট,আরেকটু না দেখতে পারার কষ্ট সব একসাথে যেনো চোখের পানি হয়ে বের হয়। নামাজ পড়ে দুহাত তুলে তৌসিফের জন্য দোয়া করে। মনে হয় যেনো বাচ্চাদের মানুষ করার জন্যই নিতু এখনো বেঁচে আছে। নাহলে আল্লাহর কাছে হয়তো নিজের মৃত্যুই কামনা করতো।কারন এভাবে তৌসিফের থেকে দূরে থাকার চেয়ে ওপারে একসাথে থাকতে চায় নিতু।তৌসিফ নামক সুখের খোঁজ পেয়েও আবার এভাবে হারিয়ে ফেলার জন্য মনে মনে অনেক অভিযোগ করে আল্লাহর কাছে। তৌসিফের ছবি বুকে জড়িয়ে খুব কাঁদে আর শুধু ভাবে,কি হতো আরো কিছুদিন এই মানুষটার সাথে থাকতে পারলে!! তাইতো নিতু তৌসিফের সাথে কাটানো প্রতিটি সুন্দর মুহূর্ত, প্রতিটি সুখের স্মৃতি নিয়েই বাকিটা জীবন কাটাতে চায়। তৌসিফের কাছে থেকে যেই ভালোবাসা পেয়েছে তার মাঝেই এখন নিতু সুখের খোঁজ করে সময় কাটায়…..

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে