#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৩২)
#মৌমিতা হোসেন
রাত নয়টার দিকে সালেহা বেগম নাতিদের নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।যাওয়ার আগে তৌসিফ বাচ্চাদের প্রান ভরে আদর করে। জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে আদর দেয়। নিতুর কাছে অনুরোধ করে বলে,”আজ ওদের হাসপাতালে আমার সাথে রেখে দাওনা। আমার কাছে থাকুক।নিরব কতো ছোট।ও আমাদের ছাড়া থাকতে পারবে না নিতু। রাতে তোমাকে না পেলে কাঁদবে।”
“কী বলছেন এসব। এখানে থাকার জায়গা কোথায়? হাসপাতাল কতৃপক্ষ এটা মানবে না।আর ওদের রাখলে আমি আপনার যত্ন নেবো কীভাবে?তাই এমন আবদার করবেন না প্লিজ।”
“একটু চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?”কথাটা বলেই তৌসিফ তপুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,”একটু দেখ না ভাই।ওদের আজ রাতটা এখানে থাকতে দেয়া যায়না?”
“ভাইরে শরীর খারাপ এর সাথে সাথে তোর মাথাও খারাপ হয়ে গেছে। নাহলে এই ছোট বাবাদের হাসপাতালে থাকতে দেয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করতে বলতিনা । চারিদিকে রোগ বালাই এর অভাব নেই।এর মধ্যে ওদের এখানে থাকাটা অনেক রিস্কি হয়ে যায় ভাই।আর এখানে রাতে একজনের বেশি থাকতেও দেয়না। দরকার হলে কাল দিনে আবার নিয়ে আসবো ওদের হলো?”
তপুর কথা শুনে তৌসিফ ভাবলো ঠিক কথাই তো বলছে তপু।এসব ব্যাপারে তৌসিফ এতো সচেতন হয়েও কীভাবে এমন অসচেতন এর মতো কথা বললো?এসব ভেবে নিজেই দ্ধন্দে ভুগতে থাকে । তুলি যাওয়ার সময় খুব মন খারাপ করে।ওর কথা মনে আসতেই তৌসিফের মনটা খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটা বাবা বলতে অজ্ঞান। সেখানে বেশ কিছুদিন যাবৎ মেয়েকে ঠিকমতো আদরটাও করতে পারছে না। মনে মনে দ্রুত যেনো সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারে সেজন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে।
তপুও সারাদিন ছিলো। অনেক কষ্ট করেছে।তাই থাকতে চাইলেও নিতুর অনুরোধে সালেহা বেগমের সাথে তপুও চলে যায়। তবে যাওয়ার আগে কিছু দরকার পড়লেই নিতু যেনো সাথে সাথে তপু কে ফোন দিয়ে জানায় এই কথা বারবার বলে যায়। বাচ্চাদের ফেলে রাতে এই প্রথম নিতু বাইরে থাকবে।তাই ওর মনটা খুব উশখুশ করতে থাকে। যাওয়ার আগে বারবার ওদের আদর করে দেয়।নিরব যাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে তাই ওকে নিতে তেমন সমস্যা হয়নি।নিতু সবাইকে বিদায় দিয়ে তৌসিফের কাছে এসে বলে,”কি হয়েছে?মন খারাপ করে বসে আছেন কেনো?”
তৌসিফ মুখ ভার করে বলে,”আমি কেমন স্বার্থপর হয়ে গিয়েছি তাই না নিতু?আমার জন্য আজ তোমার কষ্ট হবে। ওদের ফেলে তুমি যে থাকতে পারো না সেটাতো আমি জানি। তবুও নিজের কথা ভেবে আমি তোমাকে একবারও ওদের সাথে যেতে বললাম না।”
“না আপনি মোটেই স্বার্থপর না। আমি না থাকলে আপনার কাছে এখানে কে থাকবে বলুন? ওদের সাথে বাসায় ওদের নানু,মামা,চাচা, চাচি সবাই আছে। সবাই ওদের খুব ভালো ভাবে খেয়াল রাখবে। কিন্তু আপনার খেয়াল রাখতে এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাছাড়া আপনাকে আপনার সবচেয়ে অপ্রিয় জায়গায় একা রেখে আমিও বাসায় যেয়ে শান্তি পেতাম না।তাই নিজেকে দোষ দেয়া বন্ধ করুন।”কথাগুলো বলে নিতু তৌসিফের হাত ধরে পাশে বসে।
তৌসিফ অন্য হাত দিয়ে নিতুর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,”হয়তো তুমি ঠিক বলছো। আমার খেয়াল রাখার জন্যতো শুধু তুমি আছো। অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার তাইনা নিতু? খুব বেশি বিরক্ত করছি তোমায়।”
নিতু তৌসিফ এর হাতে চুমু খায়। আলতো করে ক্যানুলার জায়গায় হাত বুলিয়ে বলে,”একটুও কষ্ট হচ্ছেনা।আর একটুও বিরক্ত করেছেন না। আপনার জন্য এটুকু করতে না পারলে আপনার অর্ধাঙ্গিনী হলাম কেনো? আমার জন্য এই ভবঘুরে আপনি সারাদিন কতোই না কষ্ট করেন।আর আমি আপনার অসুস্থতায় সামান্য আপনার সেবা করতে পারবো না? এটা কি করে হয়?”
তৌসিফ তৃপ্তির হাসি হেসে বলে,”তোমার জন্য তেমন কিছুই করতে পারিনি নিতু। তুমি আমার জীবনে না এলে আমি জানতেই পারতাম না যে জীবনটা এতো সুন্দর। কখনো বুঝতে পারতাম না যে প্রেম, ভালোবাসার অনুভূতি এতো স্নিগ্ধ, এতো মধুর!! জানো?তোমার জন্য অনেক কিছু করতে ইচ্ছে হয় আমার।ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সকল সুখ এনে তোমার জীবনটা আনন্দে ভরিয়ে দেই।যেখানে থাকবে না কোন দুঃখ,কষ্ট।আচ্ছা নিতু তোমাকে কতোটা ভালোবাসি সেটা কি তুমি বুঝতে পারো?আমি না তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।আর তাই হয়তো প্রতিনিয়ত তোমাকে হারানোর ভয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে তোমার থেকে আমি অনেক দুরে চলে যাচ্ছি। আগে তো কখনো এমন মনে হয়নি। তাহলে এবারের অসুখে কেনো আমার এমন মনে হচ্ছে?”কথা বলতে বলতে তৌসিফের চোখ বেয়ে পানি গরিয়ে পরে।
নিতু কেঁদে দেয়। খুব চেষ্টা করেও কান্না আটকে রাখতে পারেনা। তৌসিফ নিতুর চোখের পানি মুছে দিতেই নিতু উঠে তৌসিফকে জড়িয়ে ধরে। তৌসিফ নিতুর বুকে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে থাকে।চোখ থেকে দু’জন এর পানি অবিরত ঝরছে। দুজনের মাঝে বেশ কিছু সময় চলে পিনপতন নিরবতা। তৌসিফ খেয়াল করলো ও শতো চেষ্টা করেও নিতুর পিঠে হাত রেখে ওকে সামলাতে পারছে না। নিতু নিজেকে সামলে বলে ,”আপনি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার কিছু হবে না।আমি হতেই দেবো না।আর আপনি শুধু শুধু টেনশন করছেন। আমাকেও এটা সেটা বলে কষ্ট দিচ্ছেন। তাই এসব বিষয় নিয়ে আর কোন কথা বলবেন না।এখন আমরা আনন্দের গল্প করবো, শুধু ভালোবাসার কথা বলবো।ঠিক আছে?”
তৌসিফ মাথা নেড়ে সায় দেয়। মুখে কিছু বলতে নেবে তখনই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি হয়।আর বমির সাথে রক্ত যায়।যেটা দেখে দু’জনি ভয় পায়। শরীরে আবার প্রচন্ড ব্যাথা হয় সাথে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তৌসিফ ব্যাথায় চিৎকার করে জ্ঞান হারায়। নিতু তৌসিফের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে আনে।ডাক্তার ব্যাথার ইনজেকশনসহ আরো কতো গুলো ইনজেকশন দিয়ে বলে,”পেশেন্ট এর অতিরিক্ত ব্যাথার জন্য জ্বর এসে জ্ঞান হারিয়েছে ।ঔষধ দিয়েছি আস্তে আস্তে কমবে।আর বাকি রিপোর্ট আসার আগে পুরোপুরি ট্রিটমেন্ট শুরু করা যাচ্ছেনা।তাই অপেক্ষা করতে হবে।আর..”
নিতু উদ্বেগ নিয়ে বলে,”আর কি ডাক্তার সাহেব?”
“আর ওনার অবস্থা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছেনা। যেসব লক্ষণ দেখছি সেগুলো …যাক আগেই কিছু বলা উচিত হবে না। রিপোর্ট আসুক অপেক্ষা করি। খেয়াল রাখবেন ব্যাথা হলেই ব্যাথার ইনজেকশন দিতে হবে।”কথাগুলো বলেই ডাক্তার সেখান থেকে চলে যায়।
নিতু চুপচাপ তৌসিফের পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করে। মায়ের বলা কথা মনে পরতেই তাড়াতাড়ি ওজু করে নামায পড়তে বসে। দুহাত তুলে খুব কাঁদে। তৌসিফের আরোগ্য লাভের জন্য দোয়া করে।মন প্রান দিয়ে দোয়া করে যেনো রিপোর্ট ভালো আসে। সারারাত নির্ঘুম কাটে নিতুর। তৌসিফ কে নিয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে যায়। রাতে আর কিছু খাওয়া হয়না নিতুর। তৌসিফ এর পাশে চেয়ারে বসে কখন যে ঝিমুনি আসে টের পায়না।
ভোরের দিকে মাথায় কারো হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙে নিতুর। তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিতু তাকাতেই মৃদু হেসে বললো,”এভাবে ঘুমোচ্ছো কেনো নিতু? আমার জন্য শেষমেষ তোমার শরীর খারাপ হবে দেখো।”
নিতু তৌসিফের হাত ধরে ওর কথার জবাব না দিয়ে বললো,”এখন কেমন লাগছে আপনার?ব্যাথা কমেছে? কিছু খাবেন?”
“এখন অনেক ভালো লাগছে। কিছু খাবো না নিতু। খেতে নিলেই বমি হবে।খেতে পারছিনা বলেই তো স্যালাইন দিচ্ছে তাই না?”
“হুম, তবুও বললাম যদি কিছু খেতে ইচ্ছে করে তাই।”বলে তৌসিফের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খায়।
“তোমাকে আরো কিছু কথা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর কোথায়?”
“কোন কথা?ওও আচ্ছা আমি এখানে কেনো? আসোলে আপনার সাথে গল্প করতে করতে কখন যে চোখ লেগে এসেছে টের পাইনি।আর আমার শরীর ঠিক আছে।সুস্থ আছি আলহামদুলিল্লাহ।”
তৌসিফ খুব আস্তে করে বললো,”সে তো দেখতেই পাচ্ছি। অনেক সুস্থ আছো তুমি।এই কদিনে চেহারার কি অবস্থা বানিয়েছো? খুব বিদ্ধস্ত লাগছে তোমাকে। রাতে নিশ্চই খাওনি তুমি তাইনা?”
নিতু মিথ্যা বলতে পারেনা।তাই মাথা নিচু করে বসে থাকে তৌসিফের পাশে। তৌসিফ নিতুর গালে হাত রেখে বলে,”এমন করোনা নিতু। নিজের খেয়াল রাখো।এতোটা হৃদয়হীন হবেনা দয়া করে। তোমার এমন চেহারা দেখলে আমার কতোটা কষ্ট হয় সেটা নিশ্চই আর নতুন করে বলতে হবে না।তাই দয়া করে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো।এখন আমার পাশে আমি তোমাকে চাইনা। আগে কি খাবার আছে দেখো। কিছু খেয়ে তারপর আমার কাছে আসবে।তার আগে নয়। ”
নিতু তৌসিফের রাগ সম্পর্কে অবগতো।তাই ওর কথা ফেলতে পারেনা। সত্যি কয়েকদিনের অনিয়মে নিতুর বেশ কাহিল লাগছে। অসুস্থ হলে তৌসিফের দেখাশোনা কীভাবে করবে।তাই টেবিলের ওপর রাখা ভাত খেতে নিয়ে দেখে সেগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে।সেই গতো সন্ধ্যায় আনা খাবার এতোটা সময় ভালো থাকার কথাও না।তাই সেগুলো সব ফেলে দিয়ে টেবিলে রাখা কেক,বিস্কিট খেয়ে পানি খায়। শরীরে জ্বর জ্বর অনুভব করায় তৌসিফের অগোচরে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নেয়।
তৌসিফ শুয়ে শুয়ে নিতুর সব কাজকর্মই দেখতে থাকে। নিতু তৌসিফের কাছে গিয়ে বসে মাথায় হাত দিয়ে দেখে জ্বর আছে কিনা।না এই মুহূর্তে নেই। তৌসিফ বলে,”নিতু চলো না আজ বাসায় চলে যাই। এখানে থাকতে একটুও ভালো লাগছে না। হাসপাতালের কেমন যেনো একটা গন্ধ আছে।ঐ গন্ধে আমি আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আমার অস্থির লাগছে।”
“দয়া করে এমন করবেন না। আপনাকে এখন বাসায় নেয়া যাবেনা।আর ডাক্তার আপনাকে এখন ছাড়বেইনা।পড়শু রিপোর্ট আসবে। আগে দেখি রিপোর্টে কি আসে তারপর নাহয় দেখা যাবে।তাই আগামী দুই দিন চুপচাপ থাকুন।”
“কিন্তু আমি যে এখানে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবো। বোঝার চেষ্টা করো।”
নিতু তৌসিফের মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে,”এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা নয়।এই কদিন আমি যা বলবো তাই শুনবেন।”তৌসিফ আর কিছু বলেনা। নিতুর হাত ধরে শুয়ে থাকে।
দুপুরের দিকে তপু আসে। বিকেলে তৌসিফ কে দেখতে চাচারা সবাই, সাদিয়া, জুঁই,বিথি আসে ।তৌসিফের এই অবস্থা দেখে সবাই খুব মন খারাপ করে। সবাই দোয়া করে তৌসিফ যেনো দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। নিতু আর এই দুই দিনে একটু সময়ের জন্যও বাসায় যায়না।বাসায় বাচ্চাদের সাথে ফোনে কথা বলে।
পরদিন সকালেই সালেহা বেগম নাতিদের নিয়ে হাসপাতালে হাজির হয়।বিশেষ করে নিরব নিতু কে ছাড়া অনেক কান্না করছিলো।তাই বাধ্য হয়েই সকালে হাসপাতালে আসে। তৌসিফ কিছু খেতে পারেনা তাই স্যালাইন চলতে থাকে।আর যখনি বেশি ব্যাথা হয় তখনি ব্যাথা আর ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়।আজ আর বাচ্চাদের সাথে কথা বলার এনার্জিও ছিলো না তৌসিফের । তাই তুলি, নাহিন খুব মন খারাপ করে। বিকেলে সালেহা বেগম নিতু কে সান্তনা দিয়ে নাতিদের নিয়ে বাসায় চলে যায়।
তৌসিফের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে। তপু সন্ধ্যায় হাসপাতালে আসে।আজ রাতে তৌসিফের রিপোর্ট দেয়ার কথা।তাই অফিস শেষে বাসায় না গিয়ে সরাসরি হাসপাতালে আসে।বেশ কদিন ধরে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে তপু ক্লান্ত হয়ে গেছে। রিপোর্ট নিয়ে তপু কেবিনে এলে নিতু জানতে চায় যে সব ঠিক আছে কিনা। তপু বলে,”এসব তো আমি বুঝবো না বোন। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার এলে উনি দেখে বুঝতে পারবেন।তাই অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই।”
তৌসিফ আজ বেশ অসুস্থ।জ্বর আজ আর কমছেই না।ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।তৌসিফের অবস্থা দেখে নিতু, তপু দু’জনই খুব চিন্তিত। ভালো লাগছে না কিছুই।কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা। নিতুর চোখ থেকে পানি ঝরছেই।কি করবে বুঝতে পারছে না। অবশেষে রাতে ডাক্তার এসে সব দেখে বলে,”রোগীর অভিভাবক কে?”
তপু বলে,”হ্যা বলুন। আমি ওর ভাই।আর এই হলো নিতু।ও হলো তৌসিফের ওয়াইফ।”
“আচ্ছা ।যা বলবো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আস্তে আস্তে মনকে শক্ত করেন।এই তিনদিন ওনার সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে যা অনুমান করেছিলাম তাই হয়েছে।রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। একেবারেই লাস্ট স্টেজে আছে। লিভার সিরোসিস এর ক্ষেত্রে প্রথম দিকে ধরা পড়লেও দেখা গেছে রোগী যতোদিন বেঁচে থাকে ততোদিন তাকে ট্রিটমেন্ট এর ওপরেই থাকতে হয়।হ্যা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়। তবে সেটাও খুব ব্যায়বহুল।আর অনেক ঝামেলার। তবুও চেষ্টা করা যেতো যদি সমস্যা টা প্রথম দিকে ধরা পরতো।এখন যেই অবস্থায় আছে তাতে আমাদের হাতে আর কোন কিছু করার নেই।এখন আল্লাহ যে কদিন হায়াত রেখেছে সেই কদিন আর কি।”ডাক্তার কথাগুলো বলার সাথে সাথে নিতু ধপ করে করে চেয়ারে বসে পরে। বুকের ভেতর তীব্র ব্যাথা অনুভব করে, বাকশক্তি যেনো হারিয়ে ফেলেছে।চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে নিমিষেই।
ডাক্তার বলেন,”নিজেকে সামলে নিন।যেকোন পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন। ওনাকে এখন এই অবস্থায় বাসায় নেয়া যাবেনা। একেবারেই না।যেই কদিন আল্লাহ হায়াত দিয়েছেন সেই কদিন ট্রিটমেন্টের ওপরেই থাকতে হবে।”
তপু আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনা।কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার এর কাছে এসে বলে,”এভাবে বলবেন না প্লিজ।কি করা যায় একটু দেখুন । টাকা-পয়সা যা লাগুক সমস্যা নেই। আমার শুধু ভাইটাকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত চাই।আর কিছু না।”
“সব সময় সব ক্ষেত্রে যদি টাকা-পয়সা থাকলেই সমস্যার সমাধান হতো তাহলে তো কাজই হতো। এখন আল্লাহ কে ডাকা ছাড়া কোন উপায় নেই।”ডাক্তার কথাগুলো বলে নার্স কে ঔষধ বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান।
চলবে……
#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৩৩)
#মৌমিতা হোসেন
ঐ রাতের পর হাসপাতালে আজ তৌসিফের পনেরোতম দিন চলছে । তৌসিফ কে বাসায় নেয়া আর সম্ভব হয়নি। শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।পেটে ,পায়ে পানি এসেছে, শরীর আরো রুগ্ন হয়েছে,কেমন বিদ্ধস্ত দেখা যাচ্ছে তৌসিফ কে।কে বলবে যে ,এই সেই সুঠাম দেহের চমৎকার দেখতে রাগী মানুষটা!!ক্যানুলা লাগানো জায়গাটা ফুলে কালো হয়ে গিয়েছে। বারবার ইনজেকশন, খেতে না পারা সব মিলিয়ে এক করুন অবস্থা।
প্রথম তিন চারদিন তৌসিফ বাসায় যাওয়ার জন্য খুব অস্থির ছিলো। নিতু কে বারবার বলেছে বাসায় নিয়ে যেতে। কিন্তু পরে যখন এই কঠিন অসুখের কথা জানতে পারে তখন থেকে কেমন যেনো চুপ হয়ে যায়। সবার সাথে কথা বলা কমিয়ে দেয় ।বাচ্চারা দেখতে আসে প্রায় প্রতিদিন। ওদের বিভিন্ন কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে।চোখ থেকে পানি ঝরতে থাকে।শব্দহীন বোবাকান্না কাঁদে তৌসিফ। অনেক কিছু বলতে চায়, বাচ্চাদের ভালোবাসতে চায় কিন্তু পারেনা। নিজেকে অক্ষম, অসহায় বাবা মনে হয়। বাচ্চাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তায় অস্থির হয় বারবার। নিতু কীভাবে সামলাবে নিজেকে, বাচ্চাদের! বাচ্চাদের নিয়ে দু’জনের কতো স্বপ্ন ছিলো।সেই স্বপ্ন নিতু একা কীভাবে পুরন করবে! সব মিলিয়ে চিন্তা করে নিজের প্রতি আফসোস হয়। হতাশা ঘিরে ধরে তৌসিফ কে। মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে অনেক অভিযোগ করে।আরো কিছু দিন পৃথিবীতে থাকতে দিলে কি এমন ক্ষতি হতো !এমন অনেক প্রশ্ন ভীড় করে মাথায়। জীবনে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষতে থাকে সারাক্ষণ।
এই কদিনে নিতু ও সব সামলাতে সামলাতে কাহিল হয়ে যায়। নিতু কে দেখেও এখন অসুস্থ মনে হয়। সবাই বারবার বলার পরেও নিতু কে গতো কয়দিনে এক ঘন্টার জন্যও বাসায় নিতে পারেনি। একটু সময়ও নিতু তৌসিফ কে চোখের আড়াল হতে দেয়না । তৌসিফের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত যেনো এখন অতি মূল্যবান। নিজের নাওয়া, খাওয়া কোন দিকেই নজর নেই নিতুর।
হঠাৎ হঠাৎ তৌসিফ অসুস্থ হয়ে পড়ে।তখন ভয় পায় নিতু। চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তৌসিফ আর নিতুর অবস্থা দেখে আশেপাশে অন্যরাও দুঃখ প্রকাশ করে। নার্স, ওয়ার্ড বয়ের চোখ থেকেও অশ্রু ঝরে।যখন তৌসিফের সেন্স থাকে তখন বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কথা বলতে চায় নিতু, অনেক গল্প করে । যাতে করে তৌসিফের মন ভালো থাকে।কিন্তু এই এতো কথা,এতো গল্পের মাঝে তৌসিফ থাকে নিশ্চুপ, নির্বাক ।ফ্যাল ফ্যাল করে নিতুর দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে। অনেক অনেক কথা বলতে চেয়েও বলতে পারেনা। নিতু ভেতরে ভেতরে নিঃশ্বেষ হয়ে গেলেও তৌসিফের সামনে সেটা প্রকাশ না করার চেষ্টা করে।যখন নিজেকে আর সামলাতে পারেনা তখন ওয়াশরুমে ঢুকে কল ছেড়ে ইচ্ছা মতো কাঁদে। তৌসিফ সেটা বুঝতে পারে কিন্তু কিছুই বলেনা। নিশ্চুপ , নির্বাক চেয়ে চেয়ে দেখে।ভাগ্যের এই নির্মমতায় কী বা বলবে তৌসিফ!
আত্মীয়-স্বজন সবাই জেনে গেছে তৌসিফের অসুস্থতার কথা।যখন যে সময় পায় এসে তৌসিফ কে দেখে যায়।বিথি, জুঁই, সাদিয়া দুই একদিন পরপর আসে ভাইকে দেখতে।এসেই ভাইয়ের অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পরে। ভাইয়ের বলা সেদিনের কথাই যে সত্যি হবে সেটা কখনো ভাবেনি ওরা। নিতুর অবস্থা দেখে শান্তনা দেয়ার ভাষাও যেনো হারিয়ে ফেলেছে সবাই।পুরো পরিবারের সবার এখন একটাই চিন্তা,এখনো একটাই চাওয়া আর সেটা হলো আল্লাহ যেনো কোন চমৎকার কিছু দেখায়।আর তৌসিফ সুস্থ হয়ে যায়।
দোকানের কাজকর্ম আপাতত তপুর নির্দেশনায় চলছে। সাজিদও গিয়ে তদারকি করছে সময়ে সময়ে। সংসারের কর্তা যে সারাদিন বাইরে কি কি কাজ করে সেটা এখন নিতু ভালোভাবে বুঝতে পারছে। তৌসিফকে ছাড়া এসব সামলানো যে নিতুর পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
আজ তৌসিফ নিতু কে নিয়ে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখে। কিন্তু শেষে হঠাৎ নিতু কোথায় যেনো হারিয়ে যায়।ঘুমের মাঝে নিতু কে খুঁজে কাঁদতে কাঁদতে তৌসিফ এর ঘুম ভাঙে।চোখ খুলেই তাই চিৎকার করে নিতু কে ডাকে। নিতু পাশেই বসছিলো। তৌসিফের ডাকে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে তৌসিফ কে। জানতে চায় কি হয়েছে।
তৌসিফ বুঝতে পারে যে সে স্বপ্ন দেখছিলো। নিজেকে একটু সামলে নিতুর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,”নিতু আমি স্বপ্নে দেখলাম তুমি কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছো। আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি জানো? অনেক খুঁজেও দেখি তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিনা।”কথাগুলো বলে তৌসিফ কাঁদতে থাকে।
নিতু তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি আপনার পাশেই আছি।দেখেন আমাকে।এই যে আমি।”
“তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওনা নিতু। আমাকেও কোথাও যেতে দিওনা। আমার একা একা অনেক ভয় হয়। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা।”তৌসিফ অসুখের কথা শোনার পরে আজকেই মন খুলে এতো কথা বলছে, কাঁদছে। নিতু বাঁধা দেয়না। তবে কি বলবে খুঁজেও পায়না। তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে নিতুও কাঁদতে থাকে।
“আমাকে কোথাও যেতে দিওনা নিতু।কেনো এমন হলো আমাদের সাথে? আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাইনা।কোথাও যেতে চাইনা নিতু। কোথাও না।”নিতুর নিজেকে অসহায় মনে হয়।কি করবে ও ভেবে পায়না। কীভাবে বাঁচাবে তৌসিফ কে।
“আপনাকে আমি কোথাও যেতে দেবো না। আমি ডাক্তার এর সাথে কথা বলে আপনাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো। আপনার চিকিৎসা করাবো। দেখবেন আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।আমিও যে আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”নিতু কাঁদতেই থাকে। তৌসিফ আবার অসুস্থ হয়ে যায়। নিতু চিৎকার করে নার্স কে ডাকলে নার্স এসে ইনজেকশন দেয় আর তৌসিফ আবার ঘুমের রাজ্যে যায়।গতো কয়দিন ধরে এই একই ঘটনা ঘটছে। তৌসিফের কষ্ট হলে যখন চিৎকার করে তখনই তাই নার্স দৌড়ে কেবিনে চলে আসে।এই কদিনে তাদেরও একটা মায়া তৈরি হয়ে গেছে ওদের দুজনের প্রতি।
এই শেষ সময়ে তৌসিফের জন্য কোন চিকিৎসা নেই।যখন যেই সমস্যা হচ্ছে তখন সেই ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে।ঘন্টায় ঘন্টায় অবস্থার অবনতি হচ্ছে। নিতু স্বচোক্ষে সবটা দেখছে। তবুও ঠিক করে ডাক্তার এর সাথে কথা বলবে। দেশের বাইরে কোথাও এর ট্রিটমেন্ট আছে কিনা জানবে।
বিকেলে তপু আসলে নিতু বলে,”ভাইয়া আরেকবার ডাক্তার এর সাথে কথা বলে দেখেন না প্লিজ। আমরা ওনাকে নিয়ে আরো ভালো ডাক্তার দেখাই অথবা দেশের বাইরে নিয়ে যাই। আল্লাহ যদি চান তাহলেতো সুস্থ হতেও পারে।ওনার কষ্ট আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”
তপু কি বলবে ভেবে পায়না। নিতুর দিকে আজকাল সহজে তাকায় না তপু।এতো সুন্দর মেয়েটার আজ কি করুন অবস্থা,করুন আকুতি। নিতু কে সব সময় তপু ছোট বোনের মতোই স্নেহ করে এসেছে।তাই নিতু কে দেখলেই খুব কষ্ট হয় তপুর।আজ নিতুর অনুরোধের উত্তরে কি বলবে তপু?কারন ডাক্তার বলার পরপরই তপু অন্য আরো দুই জায়গায় নিয়ে টেস্ট করিয়েছে। রিপোর্ট একই এসেছে।এই হাসপাতালে তপুর পরিচিত ডাক্তার তাই তৌসিফ কে অন্য কোথাও আর নেয়া হয়নি।ডাক্তারদের একই কথা এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে আছে। আল্লাহ যেই কদিন হায়াত দিয়েছে সেই কদিনই এখন বাঁচবে।এখন যেই অবস্থা তাতে কোন চিকিৎসায় কাজ হবে না।তাই…..
নিতু আবার বলে ,”ভাইয়া কিছু বলুন।ডাক্তার এখনি চলে আসবে।”
“তুমি যেহেতু বলছো সেহেতু আমি ডাক্তার এর সাথে আবার আলাপ করবো। কিন্তু এটাতো তুমিও জানো বোন যে ,এখন ডাক্তার এর পক্ষে আর কিছুই করার নেই।কোনো চিকিৎসা থাকলে কি আমি আমার এই ভাইকে এতো কষ্ট পেতে দেই বলো বোন? ভাইকে দেখে কি আমার কষ্ট হচ্ছে না? নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে কারন আমি আমার ভাইটার জন্য কিছুই করতে পারছিনা।ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ। সব শেষ বোন সব শেষ….।”তপু তৌসিফের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে কেঁদে দেয়।
নিতু আর কিছু বলেনা।কি বা বলবে।চোখ মুছতে মুছতে তৌসিফের পাশে গিয়ে বসে।এর মধ্যে ডাক্তার এসে তৌসিফ কে দেখে বলে,”আল্লাহ কে ডাকুন। এছাড়া আর কিছুই করার নেই।”
নিতু হাত জোড় করে করুন আকুতি করে বলে,”এমন কথা বলবেন না ডাক্তার সাহেব।দয়া করে কিছু একটা করুন।যতো টাকা লাগবে আমরা জোগাড় করে নিয়ে আসছি। তবুও ওনাকে সুস্থ করে দিন।প্লিজ কিছু একটা করুন।”
ডাক্তার কি বলবে।সত্যি এখন ওনার কিছুই করার নেই। নিতু কে উদ্দেশ্য করে ডাক্তার বললো,”আল্লাহ আপনাকে কষ্ট সহ্য করার শক্তি দিক এটাই দোয়া করি।”
নিতুর চোখ থেকে পানি পড়ছে।এ পানি যেনো আজীবনের জন্য পরতে শুরু করেছে।আনন্দ শেষ হয়ে কষ্টের জীবন শুরু হয়েছে।যার শুরু তো আছে কিন্তু শেষ নেই। সন্ধ্যার পর তৌসিফের জ্ঞান ফিরলে তপু বিদায় নিয়ে চলে যায়। নিতু দরজা লাগিয়ে তৌসিফের পাশে এসে গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,”কিছু লাগবে?”
“না লাগবে না।”
“এখন কেমন লাগছে?”
“খুব কষ্ট হচ্ছে নিতু। আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে? এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে । ভালো লাগছে না। বাচ্চারা কোথায়? আমার তুলি,নাহিন কোথায়? তুমি ওদের কোথায় রেখে এসেছো?”তৌসিফ অস্ফুট স্বরে কথাগুলো বলতে থাকে।
নিতু এক বুক কষ্ট নিয়ে বলে,”এখন অনেক রাত। এতো রাতে বাসায় কীভাবে যাবো বলুন।আর কয়েক দিন পরে যাবো বাসায়। আপনি সুস্থ হয়ে নিন।”
“তুমি আজকাল মিথ্যে বলো নিতু। অনেক মিথ্যে বলো। তুমি জানো আমি আর সুস্থ হবো না তবুও কেনো আমাকে মিথ্যে আশার আলো দেখাও? আমি তাই বাকিটা সময় আমার ভালোবাসাময় ঘরটাতে থাকতে চাই। আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে আমার পাশে চাই। আমাকে আর আশা না দেখিয়ে বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।”
নিতু নিরবে কাঁদে। বুকটা মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। তবুও মনকে শক্ত করে,স্থির হয়ে বলে,”ঠিক আছে আপনাকে নিয়ে যাবো কাল।হলো? এবার স্থির হন। উত্তেজিত হলে আপনার শরীর আরো খারাপ করবে।”
তৌসিক নিতুর হাত দুটো বুকের মাঝে এনে শক্ত করে ধরে রেখে বলে,”আজ কিছু কথা বলি মন দিয়ে শুনবে।আর যা জিজ্ঞেস করবো তার সঠিক উত্তর দেবে?”
“হুম দেবো,বলুন।”
“আমার হাতে আর বেশি সময় নেই তাইনা? আমি কি খুব শীঘ্রই তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো?”
নিতুর মুখ থেকে কথা বের হয়না।চোখ মুছে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। তৌসিফ খুব কষ্টে নিতুর গালে হাত রেখে বলে,”কাদেনা বৌ। আমি মেনে নিয়েছি তুমিও মেনে নাও। আল্লাহ তায়ালা আমাদের একসাথে পথচলা এটুকুই রেখেছিলো। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।সুখ আমাদের জীবনে ধরা দিতে দিতে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। আমাকে মাফ করে দিও। আমি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না।বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তোমাকে আগলে রাখতে পারলাম না। তোমার সব দুঃখের ভাগ নিতে পারলাম না। এসবের জন্য আমাকে মাফ করে দিও। বিয়ের পর আমার খারাপ আচরণের জন্যও মাফ করে দিও।”
নিতু তৌসিফ এর মুখে হাত রেখে বলে ,”চুপ করুন। আপনি কোন ভুল করেননি যার জন্য আপনাকে মাফ চাইতে হবে। আপনি আমাকে এই কয়েক বছরে যেই সম্মান, ভালোবাসা দিয়েছেন সেগুলো আমার জন্য যথেষ্ট। বরং আমার কোন ভুল হলে আপনি আমাকে মাফ করে দিয়েন।আর এখন চুপ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেন।”
তৌসিফের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, ঠোঁট শুকিয়ে কথা বেধে যাচ্ছে তবুও বলে,”না নিতু আজ ঘুমালে চলবে না। অনেক কথা বলার আছে। মনে হচ্ছে সময় একেবারেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাইনা নিতু। একেবারেই যেতে চাই না।যাক শোন ,আমরা কেউই তেমন পড়াশোনা করতে পারিনি। আমাদের ইচ্ছা ছিলো বাচ্চাদের অনেক পড়ালেখা করাবো। জানি তোমার একার পক্ষে অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। তবুও বলবো চেষ্টা করো আমাদের সন্তানেরা যেনো পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে। দেশের জন্য কিছু করতে পারে।”
নিতু অশ্রুসিক্ত অবস্থায় বলে,”চেষ্টা করবো। অবশ্যই চেষ্টা করবো।”
“আর দোকান থেকে যেই টাকা আসবে সেটা দিয়েই তোমরা চলতে পারবে। নিতু তুমি সামলাতে পারবে তো সব? তুমি তো আমার নরম তুলতুলে বৌ। তুমি একা থাকতে পারবে তো? বলো না আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?”কাঁদতে থাকে তৌসিফ ।
এবার আর নিতু নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।আর বলতে লাগলো,”আমি থাকতে পারবো না। কোনো ভাবেই আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না ।আপনাকে ছাড়া থাকবো এটা ভাবতেই আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে যখন সত্যি থাকবেন না তখন আমার কি হবে? আমিও মরে যাবো আপনাকে ছাড়া। আল্লাহ কেনো আমার ভাগ্যে আপনাকে এতো কম সময় রাখলো?এমন কি গুনাহ করেছি আমি? আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। আমি থাকতে পারবো না। কিছুতেই থাকতে পারবো না।”
তৌসিফ নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।নিজেও আজ খুব কাঁদে।দুজন যেনো কেঁদে কেঁদে আজ ভেতরের সব কষ্ট দুর করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। কিন্তু এই কষ্ট কি সত্যি কমে যাওয়ার মতো কষ্ট? তৌসিফ ঘুমিয়ে পড়ে। তৌসিফ এর পাশে নিতুও মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখে।কান্নার কারনে চোখ ফুলে জ্বালাপোড়া করছে। খুব মাথা ব্যাথা করছে।”
পরদিন নিতু ডাক্তারকে তৌসিফ এর বাসায় যাওয়ার কথা বললে ডাক্তার নিষেধ করে ।কারন এখন যতো দিন যাচ্ছে ওর অবস্থা ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে।তাই নিতু আর জোর করেনা।
চলবে……..