#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৩০)
#মৌমিতা হোসেন
তপুর আসতে দেরী দেখে তৌসিফ বলে,”কি ব্যাপার নিতু তপু এখনো আসছে না কেনো?আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না।চলো আমরাও ভেতরে যাই।”
নিতু বাধা দেয়। নিতু ইচ্ছে করেই ভেতরে যায়নি।কারন নিতু গেলে তৌসিফ ও যাবে।আর রিপোর্টে যদি খারাপ কিছু আসে তখন তৌসিফ ভেঙে পড়বে। তাই তপু যখন একাই যেতে চায় তখন আর নিতু নিষেধ করেনি।
তৌসিফ যেতে চাইলে নিতু বলে,”আর একটু বসেন। এতো অস্থির হচ্ছেন কেনো? তপু ভাই এখনি চলে আসবে।”
“বসে থাকতে ভালো লাগছে না নিতু।একদম ভালো লাগছে না।”কথাটা বলেই তৌসিফ তপুকে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল বের করে।
এর মধ্যেই নিতু বলে,”ঐ যে দেখেন তপু ভাই চলে এসেছে। শুধু শুধু অস্থির হন আপনি ।” দু’জন তপুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তপুর চেহারা দেখে নিতুর কেমন জানি মনের মধ্যে খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দেয়। তবে খুব করে দোয়া করে যেনো তপু ভাই এসে বলে যে, রিপোর্ট ভালো এসেছে।
তপু একরাশ চিন্তা নিয়ে ওদের সামনে এসে দাড়াতেই তৌসিফ বলে,”কীরে আজ তো মনে হচ্ছে তুই রোগী হয়ে গিয়েছিস।এমন লাগছে কেনো তোকে ?কি হয়েছে? রিপোর্ট দেখে ডাক্তার কি বললো?”
তৌসিফের কথায় তপুর ধ্যান ভাঙে। সামনে ওদের দেখে থতোমতো খেয়ে কি বলবে কীভাবে বলবে ভাবতে থাকে।এরই মধ্যে নিতু বলে,”ভাইয়া কি হয়েছে?কোন সমস্যা? আপনাকে এমন লাগছে কেনো?ডাক্তার কি বললো?”
তপু নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”তেমন কিছু না। ভেতরে একজন রোগীর কথা শুনে খারাপ লাগছিলো।”
তপুর কথা শুনে তৌসিফ আর নিতু দু’জনই একসাথে বলে ,”ও আচ্ছা।”
তৌসিফের কষ্ট হচ্ছে তবুও ম্লান হেসে বসে পরে। নিতু সাথে সাথে বলে,”কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
“হুম একটু খারাপ লাগছে। তপু তো রিপোর্ট এনেছে।সব কাজ শেষ এখন চলো বাসায় যাই। হাসপাতালে আর ভালো লাগছেনা আমার।”
তপু বলে,”না কাজ শেষ হয়নি।তোর আরো ২/৩ টা টেস্ট করাতে হবে।আর টেস্টগুলো আজকেই করাতে হবে।”
নিতু একটু চিন্তিত হয়ে বলে,”আবার টেস্ট কেনো ভাইয়া? রিপোর্ট দেখে ডাক্তার কি বললো?”
তৌসিফও তপুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তপু ওদের চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে। মনে মনে বলে,কি বলবে ওদের?এমন খবর কি করে দেবে ভাইকে, নিতু কে।আর এখনো তো নিশ্চিত না।তাই ঠিক করে এখনি খবরটা কাউকে বলবে না।এসব ভাবনার মাঝেই নিতু আবার বলে,”কি ব্যাপার তপু ভাই? বলেছেন না কেনো?ডাক্তার কি বলেছে?”
তপু বলে,”তেমন কিছু না। কিছু ঔষধ দিয়েছে।আর আজকেই টেস্ট গুলো করিয়ে রিপোর্ট দেখাতে বলেছে। তাই আর কি।”
নিতু বলে,”আলহামদুলিল্লাহ। একটু চিন্তামুক্ত হলাম। মনে প্রানে দোয়া করছি যেনো এই টেস্টের রিপোর্ট ও ভালো আসে।”তৌসিফ এর হাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে ওকে ভরসা দেয়।
তপু বলে যে,”চলো এখন আগে টেস্টগুলো করি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
টেস্ট করাতে গিয়ে দেখে এগুলো আজ রাতে করানো যাবে না। সকালে করাতে হবে। তাই তপু প্রথমে তৌসিফ আর নিতু কে চলে যেতে বলে। কিন্তু তপু তৌসিফের শরীর খারাপ থাকায় ওদের আর একা ছাড়েনা। একটা সিএনজি করে সবাই একসাথে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসে।
তৌসিফ বাসায় এসে কিছু না খেয়েই শুয়ে পরে।তৌসিফের এই অবস্থা দেখে নিতু খুব মন খারাপ করে। মনে প্রানে দোয়া করে তৌসিফের সুস্থতার জন্য। বাচ্চাদের খাইয়ে ঘুম পাড়াতে গেলে আজ তুলি বলে,”আম্মু বাবার কি হয়েছে?বাবা কদিন ধরে আগের মতো আমার সাথে খেলে না,গল্প করেনা। আমার একটুও ভালো লাগেনা।”
নিতু মেয়েকে আদর করে কাছে এনে বলে,”তোমার বাবার শরীর একটু খারাপ মা। তাই এখন একটু কম খেলছে তোমাদের সাথে। দোয়া করো বাবা সুস্থ হলেই আবার আগের মতো খেলবে তোমাদের সাথে।”
তুলি তবুও মন খারাপ করে মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। সবাই ঘুমালে নিতু রুমে এসে তৌসিফ কে দেখতে থাকে।কেমন যেনো কষ্ট হয় বুকের ভেতর।চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে।ঘুম ধরা দেয়না চোখে। রাতে তৌসিফ এর আবার জ্বর আসে।নিতু জোর করে উঠিয়ে ঔষধ খাওয়ায়।জলপট্টি দেয়।জ্বর একটু কমলে অস্থিরতা কমাতে ওযু করে নামাযে বসে। দুহাত তুলে তৌসিফ এর সুস্থতা কামনা করে। জায়নামাজের পাটিতে বসে থেকেই কখন যে ভোর হয়ে যায় টের পায়না নিতু। ইবাদাত শেষ করে নাস্তা বানাতে চলে যায়। আজকেও তৌসিফ এর সাথে হাসপাতালে যাবে তাই ঠিক করে তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করবে।
খুব ভোরেই তৌসিফের ঘুম ভাঙে। শরীরটা একটু ভালো লাগছে। রাতে হঠাৎ করে খুব খারাপ লাগছিলো। কিছু একটা যে হয়েছে সেটা তপু না বললেও তৌসিফ বুঝতে পেরেছে। নিতু কে পাশে না পেয়ে জোরে ডাকে। নিতু তৌসিফের ডাক শুনে দৌড়ে যায় ওর কাছে। ভাবে যে হয়তো তৌসিফের খারাপ লাগছে। রুমে তাড়াতাড়ি যেতে নিয়ে দরজায় ধাক্কা খেয়ে হাতে প্রচন্ড ব্যাথা পায়। তৌসিফ সেটা দেখে আসতে নিলে ওর মাথায় চক্কর দেয়। সাথে সাথে বসে পরে। নিতু ব্যাথা নিয়েই এসে বলে,”আপনার শরীর ঠিক আছে তো?কোন সমস্যা হয়নি তো?”
তৌসিফ নিতুর হাত ধরে বলে,”না কোন সমস্যা নেই। একটু মাথায় চক্কর দিলো।তেমন কিছু না। খেতে পারছিনা তাই হয়তো এই দুর্বলতার জন্য মাথা ঘুরাচ্ছে।যাক তুমি কোথায় ব্যাথা পেয়েছো দেখাও তাড়াতাড়ি। আবার কেটে গেলো নাকি?”
তৌসিফের অস্থিরতা দেখে নিতু বলে,”একটু শান্ত হয়ে বসুন।তেমন কিছু হয়নি।এতো অস্থির হবেন না।”
“এরপর থেকে এতো তাড়াহুড়ো করে কাজ করবে না।সব সময় আমি থাকবো না তোমার খেয়াল রাখার জন্য। নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে।”কথাটা বলেই তৌসিফ এর কেমন জানি লাগলো আজ।
নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে একটু রেগে বললো,”এটা কেমন কথা বললেন? আপনি থাকবেন না মানে?কোথায় যাবেন? আমার খেয়াল সব সময় আপনাকেই রাখতে হবে। সবার খেয়াল আমি রাখবো সমস্যা নেই।কখনো এক্ষেত্রে আপনাকে অভিযোগ করার সুযোগ দেবো না। কিন্তু আমার যত্ন, খেয়াল রাখতে হবে শুধু আপনাকেই। মনে থাকে যেনো।”
“সেতো রাখবোই। কিন্তু যখন আমি থাকবো না তখন?তখনের জন্য নিজের খেয়াল রাখা শেখো আমার নিতু রানি।”
নিতু তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে বলে,”এমন দিন কখনো না আসুক। আমি অনেক বছর আপনার সাথে থাকতে চাই।একদম বুড়ি হওয়া পর্যন্ত।বুড়ি হয়েও আপনাকে পাশে চাই।”
তৌসিফ হেসে দিয়ে বলে,”বুঝতে পেরেছি।আর বলতে হবে না। আমার নিতুর আজ আদর লাগবে।তাই নিজ থেকেই আমার এতো কাছে এসেছো আজ তাইনা?”
কথা শেষ করে নিতুর আরো কাছে আসতে নিলেই নিতু তৌসিফ কে সরিয়ে দিয়ে বলে,”ধ্যাত, আপনাকে কিছু বলাও মুশকিল।বলি এক বোঝেন আরেক। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে রেডি হন। তপু ভাই এসেছিলো। তাড়াতাড়ি যেতে হবে টেস্ট করাতে।আল্লাহর নাম নিয়ে এই রিপোর্ট ভালো আসলে আর যেতে হবেনা হাসপাতালে। ওখানে গেলেই আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।ভয় লাগে, অজানা এক আশঙ্কা ঘিরে ধরে আমাকে।”
“ঠিক বলেছো। আমারও ভালো লাগেনা।আচ্ছা তুমি নাস্তা রেডি করো আমি রেডি হয়ে আসছি।”তৌসিফ ওয়াসরুমে চলে যায়।আর নিতু ও নাস্তা রেডি করতে যায়।আজ আর বাচ্চাদের স্কুলে পাঠায়না। তৌসিফ আর নিতু রেডি হয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তপু অফিসে গিয়ে ছুটি নিয়ে হাসপাতালে আসে।নিতু দের যাওয়ার আগেই তপু হাসপাতালে পৌঁছে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তৌসিফদের রাস্তায় যানজট থাকায় পৌঁছাতে একটু সময় লাগে।
হাসপাতালের গন্ধ বরাবরই তৌসিফ এর অপ্রিয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া এখানে পা রাখার মানুষ তৌসিফ না।বাবা আর নিতুর বেলায় কীভাবে যেনো শক্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলো। তবুও অনেক অবুঝের মতো আচরন করেছিলো তখন। কবে বাসায় নিয়ে আসবে এই পায়তারাই করেছিলো সব সময়। এবার শরীর এতো বেশি খারাপ না লাগলে হয়তো অসতেও চাইতো না।জোর খাটাতো। কিন্তু নাক থেকে রক্ত পড়ার পর থেকে খুব চিন্তায় আছে আর এজন্যই এসেছে।যাই হোক টেস্ট এর ওখানে সিরিয়াল,এতো অসুস্থ মানুষ সব দেখে কেমন যেনো অস্থির লাগতে থাকে ওর। আবার জ্বর আসে। অবশেষে তৌসিফ এর নাম ধরে ডাকলে তপু ধরে নিয়ে যায়।জ্বর আসায় খুব দুর্বল লাগছে তৌসিফের।
টেস্ট করাতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। তৌসিফের শরীর অনেক খারাপ লাগছে।তাই তপু তাড়াতাড়ি সিএনজি ঠিক করে বাসায় নিয়ে আসে।ভেবেছিলো টেস্ট করানোর পর অফিসে চলে যাবে। কিন্তু তৌসিফের অবস্থা দেখে আর ওদের একা ছাড়ার সাহস হয়নি। বাসায় ফিরতে চারটা বেজে যায়।বাসায় আসার সাথে সাথে বাচ্চারা সবাই ঘিরে ধরে ওদের। কিন্তু তৌসিফের অবস্থা দেখে নিতু সবাই কে রুম থেকে বের করে দেয়। তৌসিফের খুব খারাপ লাগলেও কিছু করার থাকে না।মন চাইলেও শরীর সায় দিচ্ছেনা।তাই চুপচাপ শুয়ে পরে।
তপু তৌসিফের অবস্থা দেখে চিন্তায় পরে যায়। মনে প্রানে দোয়া করে যে, ডাক্তার যা বলেছে সেসব যেনো ভুল হয়।আজকের টেস্ট এর রিপোর্ট যেনো ভালো আসে ।তপুর চিন্তিত চেহারা দেখে নিতু বলে,”ভাইয়া আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?কাল থেকেই দেখছি কিছু একটা নিয়ে আপনি খুব চিন্তিত। আপনার ভাইয়ের রিপোর্ট ঠিক আছে তো? মিথ্যে বলবেন না ভাইয়া।”
তপু নিতুর কথা শুনে কি বলবে ভেবে পায়না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”না নিতু তেমন কিছু না। আজকের টেস্ট এর রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে। দোয়া করো যেনো ভালো খবর আসে।আর ওকে আপাতত দোকানে যেতে দিওনা। ফোনে কথা বলে দোকান সামলাতে বলো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। রিপোর্ট কবে দেবে?”
“এইতো এক সপ্তাহ পরে। একটু সময় লাগবে। তৌসিফের শরীর খারাপ লাগলেই আমাকে ফোন দেবে।যাই হোক আমাকে জানাবে।”কথাগুলো বলে তপু চলে যায়।
নিতুর খুব ক্লান্ত লাগে।কোন রকম খেয়ে নামাজ পড়ে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায়, ওদের খাইয়ে দেয়। সালেহা বেগম, রাহেলা ওদের দুজনকে দেখে মন খারাপ করে। খুব চিন্তায় পরে যায়।
তৌসিফ পরের দিন দোকানে যেতে চায়। কিন্তু নিতুর নিষেধ এর জন্য আর যায়না। রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাইরে যাওয়া চলবেনা এটা খুব কড়া করে নিতু বলে দিয়েছে।তাই বাসায় বসে ফোনেই যতোটুকু পারে তদারকি করে।যখন একটু ভালো লাগে তখন বাচ্চাদের সাথে খেলে,গল্প করে। নিতুর সাথে ভোরের আকাশ দেখে,পাখির সাথে কথা বলে,রাতে জ্যোৎস্না বিলাশ করে। কেনো জানি তৌসিফের ভেতরে সব সময় কেমন এক অস্থিরতা বিরাজ করছে । তবে যতোটা পারছে সেই অস্থিরতা,ভয় নিতুর সামনে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছে। শরীর খারাপ লাগলেও সহসা বুঝতে দিতে চাচ্ছেনা। তৌসিফের মনে হচ্ছে রিপোর্ট ভালো আসবে না। রিপোর্ট পাওয়ার আগের এই সময়টা ওর কাছে দুর্বিষহ মনে হচ্ছে।
চলবে……
#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৩১)
#মৌমিতা হোসেন
রিপোর্ট হাতে পেতে এখনো তিনদিন বাকি। তৌসিফের শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে।জ্বর যায় আবার আসে।সমস্ত শরীর ব্যাথা।ভোর রাতে একবার বমির সাথে রক্ত গেছে। এটা দেখে তৌসিফ বেশি ভয় পেয়েছে।ভাগ্য ভালো তখন নিতু ঘুমে বিভোর ছিলো।তাই টের পায়নি। নাহলে আরো অস্থির হয়ে যেতো। তৌসিফ আস্তে করে এসে আবার শুয়ে পরে। তবে চোখে আর ঘুমেরা ধরা দেয়না।খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিতে থাকে মন।
এদিকে নিতুও তৌসিফ এর শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিন্তায় পরে যায়। তপু কে বললে ও রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে।তপুও বুঝতে পারে খুব খারাপ কিছু হয়তো সামনে ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কার সাথে এসব আলাপ করবে , কীভাবে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
বাসার সবাই তৌসিফের শরীরের এই অবস্থা দেখে মন খারাপ করে আর খুব চিন্তায় পড়ে যায়।আজ জুঁই, সাদিয়া, বিথি সবাই এসেছে। তৌসিফের শরীর খারাপ শুনে সবাই পরিকল্পনা করে একসাথে আসে। তবে এসে ভাইকে এমন অবস্থায় দেখে সবাই আৎকে ওঠে।দুমাস আগেও তৌসিফ দেখতে যেমন ছিলো এখন কেউ দেখলে চিনবেই না। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে ওদের কারোরই ভালো লাগে না। নিতু কে দেখেও ওরা খুব মন খারাপ করে।কেমন বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে ওকে।গতো কিছুদিন ধরে তৌসিফের সেবা করে আর তৌসিফের চিন্তায় চিন্তায় নিতু নিজের শরীরের দিকে নজর দেয়ার কথা ভুলেই গিয়েছে।
আজ অবশ্য সবাইকে একসাথে দেখে তৌসিফ আর নিতু খুব খুশি হয়। তৌসিফের শরীর খারাপ থাকলেও সবাই সারাটা দিন একসাথে হাসি আনন্দে কাটায়।আনমনেই তৌসিফ বলে,”হতে পারে এটাই সবার সাথে একসাথে হাসি আনন্দে কাটানো আমার শেষ দিন।”
বিথি কথাটা শুনে বলে,”এমন খারাপ কথা বলছো কেনো ভাই? দেখবে রিপোর্ট নরমাল আসবে।ঔষধ খেলেই ভালো হয়ে যাবে।”
“তাই যেনো হয়রে। তোদের ছোটবেলায় অনেক বকেছি কেউ রাগ করিস না যেনো আমার ওপর। সবাই মাফ করে দিস।”
তৌসিফের এই কথা শুনে সবার খুব মন খারাপ হয়। ভাবে হয়তো জ্বর এর জন্য আবোলতাবোল বকছে। বিথি উঠে তৌসিফের কাছে গিয়ে বলে,” বড় ভাই হিসেবে তুমি আমাদের কোন অন্যায় দেখলে বকতেই পারো।এতে আবার মাফ কিসের ভাই? তোমার বকা আমরা সবাই ভালোবাসি। তোমার কাছে আমরা আজীবন ছোটই থাকব।তাই এমন কথা আর কোনদিন বলো না।”
বিথির কথায় জুঁই আর সাদিয়াও একমত পোষন করে।সবাই তৌসিফের কথায় মন খারাপ করে।আর এদিকে নিতুর ভেতরে তোলপাড় চলতে থাকে।এর মধ্যে তৌসিফের আবার জ্বর এলে নিতু জোর করে রুমে নিয়ে শুইয়ে দেয়।জ্বরের ঘোরে সারারাত অনেক কিছুই বলে তৌসিফ।তার পুরোটা জুড়েই ছিলো নিতু। রাতে আবারো রক্তবমি হয়।এটা দেখে নিতুর টেনশন বেড়ে যায়। সারারাত নিতু চোখের পাতা এক করেনি।মাথায় পানি দেয়,জলপট্টি দেয়। এদিকে সালেহা তৌসিফ আর নিতুর এই অবস্থা দেখে নিজেও চোখের পানি ফেলে।কেনো জানি সালেহার ভেতরেও অস্থিরতা কাজ করছে। ভালো লাগে না কিছু।নাতিদের সামলায় তিনি।
ভোরের দিকেও জ্বর কমে না তৌসিফের। অতিরিক্ত জ্বর এ তৌসিফ জ্ঞান হারায়। নিতু ভয় পেয়ে তপু কে ফোন করে জানালে তপু তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স এনে তৌসিফ কে নিয়ে এলাকার ঐ হাসপাতালে ভর্তি করায়।ডাক্তার বলে, অতিরিক্ত তাপমাত্রার জন্য তৌসিফ সেন্সলেস হয়েছে। সারাদিন তৌসিফের সাথেই থাকে নিতু আর তপু। বিকেলে জ্ঞান ফেরে তৌসিফের।জ্বর কিছুটা কমে। তৌসিফের জ্ঞান ফিরতেই নিতুর মুখে হাসি ফোঁটে।নিতু তৌসিফের হাত ধরে বলে,”এখন কে..কেমন লাগছে আপনার?”
তৌসিফ মৃদু হাসার চেষ্টা করে অস্ফুট স্বরে বলে,”এইতো ভালো। একটু ভালো লাগছে।”তৌসিফ হাত উঠিয়ে নিতুর গালে দিতে গিয়ে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে।সমস্ত শরীর ব্যাথায় আর হাতে ক্যানুলা লাগানো থাকায় তৌসিফের হাত নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। তৌসিফের কষ্ট দেখে নিতু কেঁদে দেয়।নিজেই এগিয়ে এসে তৌসিফের কপালে আলতো চুমু খায়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে ,”ভালোবাসি । আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”
তৌসিফ নিজেও আস্তে করে বলে,”আমিও ভালোবাসি তোমাকে।এই টুকু জ্বর হয়েছে আমার এতেই তুমি নিজের কি হাল করেছো?এমন পাগলামী করলে হয় বলো? এজন্যই তো খারাপ লাগলেও তোমাকে বলতাম না আমি।কান্না বন্ধ করো। পাগলী বৌ ।”
নিতু অনেক কষ্টে কান্না থামায়। কিন্তু বুকের ভেতর অসহ্য ব্যাথা অনুভব করে। তীব্র ব্যাথা। শরীরে শক্তি পাচ্ছেনা এক বিন্দু।অনেক চেয়েও নিতু তৌসিফ কে ওর কান্নার কারন বলতে পারেনা।আসোলে হাসপাতালে আনার পরেই ডিউটি ডাক্তার তৌসিফের অবস্থা দেখে ওর বিষয়ে ডিটেইলস জানতে চায়। নিতু সব বলার পর ডাক্তার গতো সপ্তাহের রিপোর্ট দেখে তৌসিফের কি হয়েছে সেটা বলে। সব শুনে অনেকটা সময় নিতু বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিলো।কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না।
আর এই পুরো বিষয়টি তপুর সামনে এতো দ্রুত ঘটেছে যে, চাইলেও বিষয়টা আর লুকিয়ে রাখতে পারে না তপু। তাছাড়া তিনদিন পর রিপোর্ট দিলে তো সবটা আরো ভালো ভাবে জানতেই পারতো। তপু মনে প্রানে দোয়া করছিলো যে আগের রিপোর্ট যেনো ভুল হয়।ভেবেছিলো শিওর হয়ে তারপর নাহয় সবাইকে জানাবে বিষয়টা। কিন্তু সেটা আর হলো না। তপু নিতুর অবস্থা দেখে ওকে গিয়ে বলে,”ধৈর্য ধরো বোন।এখনো কনফার্ম না। রিপোর্ট অনেক সময় ভুল আসে। আমি মনে প্রাণে দোয়া করছি যেনো রিপোর্ট ভুল হয়।”
নিতু আস্তে করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমাকে বলেননি কেনো ভাইয়া? আমাকে আপনার বলা উচিত ছিলো।”
“এমন খবর আমি কীভাবে বলবো তোমাকে বোন?আর আমি এখনো বিশ্বাস করি রিপোর্টে ভুল এসেছে।এই টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করিনা যে আমার ভাইয়ের এতো কঠিন অসুখ হয়েছে। আমার ভাইটার কিছু হতে পারেনা। আমি হতে দেবো না।”তপু কাঁপা স্বরে কথাগুলো বলে কেঁদে দেয়।কারন তৌসিফের অবস্থা দেখে ও নিজেও বুঝতে পারছে যে রিপোর্টে যা এসেছে তা ঠিক হবার সম্ভাবনা বেশি।
নিতু সেই থেকে আর তপুর সাথে কোন কথা না বলে তৌসিফের এর পাশে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে।কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় নিতুর খেয়াল নেই। তপু এসে কয়েকবার ডাকলেও ফিরে তাকায় না। তৌসিফের জ্ঞান ফেরার পর এতোটা সময় বাদে কথা বলে নিতু।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
তপু তৌসিফ আর নিতুর কথা শুনে একটু শান্ত হয়। এতোটা সময় তপু নিতু কে নিয়েও চিন্তায় ছিলো আর খুব অধীর আগ্ৰহে ভাইয়ের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিলো।বেশ কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলে তপু ডাক্তার এর সাথে তৌসিফ এর কাছে যায়।ডাক্তার সব চেক করে পরবর্তী রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে চলে যেতে নিলে তৌসিফ বলে,”আমি বাসায় যাবো কখন? মানে আমি হাসপাতালে আর থাকতে চাচ্ছিনা।”
ডাক্তার কিছু বলতে নিলেই নিতুর ইশারায় বুঝতে পেরে বলে,”এইতো আরো কয়েকটা দিন থাকতে হবে।
তারপর যাবেন।”
তপুর দিকে তাকিয়ে বলে,”পেশেন্ট এর দিকে খেয়াল রাখবেন।আর বাকিটা রিপোর্ট আসার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
ডাক্তার চলে গেলে তৌসিফ এর কাছে এসে তপু বলে,”কিরে একেবারে ভয় পাইয়ে দিয়েছিস।এখন কি অবস্থা? একটু ভালো লাগছে?”
“নারে ভালো লাগছে না।ব্যাথা হচ্ছে।সব জায়গায় ব্যাথা। সত্যি করে বলতো আমার কি হয়েছে? এমনটা আগে কখনো লাগেনি তো।”
নিতু সাথে সাথে বলে,”কি হবে? কিছু হয়নি। কিছু হয়নি আপনার।ডাক্তার বলে গেলো তো যে কিছু হয়নি । এমনি অনিয়মের জন্য শরীর খারাপ লাগছে আপনার।আর …আর কিছু না।”
তবুও নিতুর সাথে তাল মিলিয়ে বলে,”সেটাই তেমন কিছু হয়নি তোর। চিন্তা করিস না। রিপোর্ট আসলে বোঝা যাবে।”
তৌসিফ ওদের কথা শুনে কিছু বলেনা। তবে সমস্যা যে গুরুতর সেটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। নিতুর হাত ধরেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। সন্ধ্যায় সালেহা বেগম তৌসিফ কে দেখতে সাজিদের সাথে হাসপাতালে আসে। সাথে নাতিদের নিয়ে আসে। সারাদিন মা’কে না দেখে ওরাও অস্থির হয়ে যায়। হাসপাতালে এসেই তিনজন নিতুর কোলে দৌড়ে আসে।তুলি তৌসিফের কাছে এসে দেখে ঘুমাচ্ছে। বাবার এই অবস্থা দেখে খুব মন খারাপ করে। বাবার হাতে চুমু খায়।ধীর পায়ে হেঁটে মায়ের কাছে গিয়ে বলে,”মা বাবার কি হয়েছে?বাবা কথা বলছেনা কেনো?”
“বাবার জ্বর আম্মু।তাই ঔষধ খেয়ে তোমার বাবা ঘুমাচ্ছে।”
“বাবা কবে বাসায় যাবে? এখানে বাবার থাকার দরকার নেই। বাবাকে বাসায় নিয়ে চলো। আমি বাবার দেখাশোনা করবো।তাহলেই বাবা সুস্থ হয়ে যাবে।”
নিতু চুপচাপ তুলির কথা শোনে।কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না।কি বলবে?কবে সুস্থ হবে?
তুলি আর নিতুর কথা শুনে তপু এসে তুলিকে কোলে তুলে নেয়।আদর দিয়ে বলে,”এইতো মা আর ক’দিন পরেই তোমার বাবা বাসায় যাবে। একটু সুস্থ হোক।”
ওদের কথাবার্তায় তৌসিফ এর ঘুম ভেঙে যায়।চোখ খুলে বাচ্চাদের দেখে খুশিতে বাচ্চাদের নাম ধরে কাছে ডাকে।তুলি আর নাহিন বাবার কন্ঠ শুনেই দৌড়ে যায় বাবার কাছে।ক্যানুলা লাগানো হাত দিয়ে ওদের আদর করতে গেলেই ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে । অমনি নিতু দৌড়ে তৌসিফের কাছে গিয়ে বলে,”আপনার কোথায় কষ্ট হচ্ছে ?কেনো হাত নাড়াতে গেলেন?চুপ করে শুয়ে থাকুন।”
তৌসিফ কে বলেই তুলির দিকে তাকিয়ে বলে,”কেনো বিরক্ত করছো বাবাকে?”
তুলি মায়ের কথায় কেঁদে দেয়। তৌসিফ তুলিকে কাছে ডাকে। নিতু কে বলে,”আমার মায়ের সাথে কখনো এভাবে রেগে কথা বলো না নিতু। এটা আমার পছন্দ না।”
নিতু অনুভব করে বাবা-মেয়ের ভালোবাসা।তাই চুপ হয়ে যায়। তৌসিফ তুলিকে আদর করে দেয়।নাহিন,নিরব কে আদর করে।নিরব বাবার কোলে উঠতে চায় কিন্তু তৌসিফ কোলে নিতে পারেনা। খেতে না পারায় তৌসিফের শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।তাই ভোরে আসার পর থেকেই স্যালাইন চলছে। নিজের দুর্বলতা দেখে আজ তৌসিফের নিজেকে কেমন যেনো অসহায় মনে হয়।এই অল্প কদিনেই যে এতো দুর্বল হয়ে পরেছে সেটা তৌসিফ নিজেও খেয়াল করেনি।এতো শক্ত সবল একজন মানুষ সে কিনা আজ তার এই ছোট্ট কলিজার টুকরোদের কোলেও নিতে পারছে না। এতো টুকু শক্তি পাচ্ছেনা তৌসিফ। নিজের অবস্থা দেখে খুব অবাক হয়। কষ্টে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে।
তুলি , নাহিন তৌসিফের কাছে এসে বলে,”বাবা আমাদের কোলে নিতে হবে না। আমরা তো এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। তুমি আমাদের সাথে একটু গল্প করোনা বাবা। অনেক দিন গল্প বলোনা।নানুমনি আমাদের আবার নিয়ে যাবে বাসায়।তাই ততোক্ষণ তুমি আমাদের গল্প শোনাও। ”
তুলি ছোট হাত দিয়ে বাবার চোখ মুছে দেয়। তৌসিফ তখন কষ্ট হলেও হেসে বলে,”এখানে দুজন চুপ করে বসো আম্মু। আমি ভেবে দেখি কি গল্প বলা যায়।”
বাবার কথা শুনে দুই ভাই বোন চুপ করে তৌসিফের পাশে বসে।আর বাবার বলা গল্পের অপেক্ষায় থাকে।
এদিকে সালেহা নিতু কে নিয়ে বাইরে এসে বলে,”কি ব্যাপার মা নিতু তোকে এমন বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে কেনো?ডাক্তার কি বলেছে?”
নিতু মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বলে,” কিছু ঠিক নেই মা। কিছু ঠিক নেই। তোমার জামাই অনেক অসুস্থ।”
“অসুস্থ বুঝলাম। কিন্তু এতো ভেঙে পড়ছিস কেনো? ঠিকমতো ঔষধ খেলে দেখবি ভালো হয়ে যাবে। রিপোর্টে কি এসেছে?”
নিতু মায়ের কাছে সব খুলে বললে সালেহা বেগম কি বলবে বুঝতে পারেনা। বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।একি শুনছে সে? কতোই বা বয়স হয়েছে তৌসিফের। কীভাবে কি করবে বুঝতে পারেনা। নিতু কে বলে,”আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। বেশি করে নামাজ পড়।দান,সদকা কর। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ চাইলে দেখবি তৌসিফ ঠিক একদিন সুস্থ হয়ে যাবে।”
নিতু মনোযোগ দিয়ে শোনে মায়ের কথা।আর মনে প্রানে আল্লাহকে ডাকে যেন আল্লাহ তৌসিফ কে সুস্থ করে দেয়।”
চলবে…..