#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২৮)
#মৌমিতা হোসেন
নিতু সারাদিন বাচ্চা, সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও তৌসিফ কে নিয়েও মনে মনে চিন্তা হতে থাকে ।আজ সকালে যাওয়ার পর থেকে তৌসিফ একবারও ফোন দেয়না।তাই নিতুর খুব চিন্তা হয়। দুপুরে নিতু ফোন দিলে দোকানের এক কর্মচারী ফোন রিসিভ করে বলে যে,তৌসিফ আজ ব্যস্ত।পরে ফ্রি হয়ে ফোন দেবে। এতে নিতুর বেশ মন খারাপ হয়। নিতু বুঝতে পারে ডাক্তার এর কাছে যাওয়ার কথা বলেছে বলেই তৌসিফ এমন করছে।তাই কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দেয়।
এদিকে তৌসিফ সত্যি আজ খুব ইচ্ছে থাকলেও নিতুর ফোন রিসিভ করেনি। প্রতিদিন কয়েকবার ফোন করে নিতুর সাথে কথা বলবে এটাই যেনো নিয়ম হয়ে গেছে।আজ তাই একটু অস্থির লাগছিলো। তবে ঐ যে ডাক্তার এর কাছে যেতে হবে তাই এড়িয়ে গেছে।
বিকেলে নিতু আবার তৌসিফ কে ফোন দেয় কিন্তু ঐ সময়ে ও সত্যি ব্যস্ত থাকায় নিতুর সাথে কথা বলতে পারেনি।কাজ শেষ করে রওনা দেয়ার আগে তৌসিফ নিজেই ফোন দেয় নিতু কে। নিতু তখন ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত। তৌসিফ এর ফোন দেখেই রিসিভ করে বলে,”আসসালামুয়ালাইকুম। এতোক্ষনে আপনার সময় হলো ফোন করার?”
“রাগ করোনা নিতু।আজ খুব ব্যস্ত ছিলাম। সত্যি বলছি।”
“বুঝতে পেরেছি।আর বলতে হবে না। আপনি কেনো সারাদিনে ফোনে কথা বলেননি সেটা আমার জানা আছে।”
“আচ্ছা এই বিষয়ে আমরা বাসায় এসে কথা বলি। আমি এখন রওনা দেবো।”
“আচ্ছা সাবধানে আসবেন।”বলে নিতু ফোন রেখে তৌসিফ এর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকে।
তৌসিফ এর বাড়ি ফিরতে রাত নয়টা বেজে যায়। তৌসিফ কে দেখতে খুব দুর্বল লাগছিলো। তৌসিফ কে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসতে বলে নিতু রান্নাঘরে চলে যায়। খাবার গরম করে। তৌসিফ খেতে বসে খাবার নেড়েচেড়ে বলে,”খেতে ভালো লাগছে না নিতু।”
“কেনো রান্না ভালো হয়নি?”
তৌসিফ এর শরীর একটু বেশি খারাপ লাগছিলো। তাই নিজ থেকেই বলে,”জানিনা তবে কিছুদিন ধরে কিছুই মজা লাগছে না। খেতে নিলেই বমি পাচ্ছে। তুমি অযথা টেনশন করো তাই তোমাকে ইচ্ছা করে বলিনি।ভাত খাবো না। তুমি বরং খেয়ে আমাকে এক গ্লাস লেবুর শরবত দাও দেখি ভালো লাগে কিনা।”তৌসিফ হাত ধুয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পরে।
নিতুর গলা থেকেও আর খাবার নামে না।সব গুছিয়ে রেখে তৌসিফ এর জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে যায়।রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ ঘুমিয়ে পরেছে। নিতু রুমে না যাওয়া পর্যন্ত তৌসিফ সাধারণত ঘুমায় না।আজ তাই তৌসিফ এর চেহারায় এতো ক্লান্তি দেখে বেশ খারাপ লাগছে । কিছুটা টেনশন হচ্ছে। মনে মনে ঠিক করে কাল যেভাবে হোক ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাবে।সরবতের গ্লাস টেবিলে রেখে তৌসিফ এর পাশে শুয়ে নিতুও ঘুমিয়ে পরে।
খুব ভোরে পাখির ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে।আজ আকাশ কিছুটা পরিস্কার। বারান্দা বৃষ্টির পানিতে ভেজা। নিতু নামাজ পরে বারান্দায় একা বসে সকালটা উপভোগ করতে থাকে। তৌসিফ এর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্ত গুলো মনে করে আর একা একা হাসতে থাকে।রাহেলা খালা আসলে নাস্তা রেডি করে বাচ্চাদের রেডি করিয়ে স্কুলে দিয়ে আসে।স্কুলে নেয়ার দায়িত্বটা ছোট বাবু আসার পর থেকে তৌসিফ নিজেই পালন করে। কিন্তু আজ তৌসিফ অসুস্থ থাকায় নিতু আর ওকে ডাকেনি।নিতুই নিয়ে যায়। বাসায় এসে দেখে তৌসিফ ঘুম থেকে উঠে গেছে। নিতু পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে ,”শরীরের কী অবস্থা?”
“এইতো ভালো। তুমি আজ আমাকে ডাকোনি কেনো? আমি নিয়ে যেতাম ওদের।আর শরীরের কথা জিজ্ঞেস করছো কেনো বলোতো?”
নিতু কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলে,”আপনার শরীর ভালো না তাই আপনাকে ডাকিনি।আজ আপনি ডাক্তার এর কাছে যাবেন। আমি আজ আপনার কোন কথাই শুনবো না।”
তৌসিফ নিতুর হাত ধরে টেনে পাশে বসায়, গালে দুহাত রেখে বলে,”এতো টেনশন করো কেনো বলোতো?তেমন খারাপ লাগলেতো আমি নিজেই ডাক্তার এর কাছে যেতাম।টেনশন করে আমার গুলুমুলু বউটার মুখটা অন্ধকার করে রাখলে আমার ভালো লাগে বলো?”
নিতু তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে ওমনি তৌসিফ নিতুর ঠোঁটে চুমু খায়। নিতু অপ্রস্তুত হয়ে পরে।সরে যেতে নিলে তৌসিফ নিতু কে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বলে,”বাবুটা ঘুমাচ্ছে। তোমাকে একটু আদর করি? একটু ভালোবাসি?”
নিতু লজ্জা পেয়ে তৌসিফ এর পাশে থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে বলে,”খালা বাসায়।আর ছোট বাবু এখনি উঠে যাবে জনাব। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। অসময়ে নয়।”
তৌসিফ নিতুর দিকে আগাতে থাকে আর বলে,”খবরদার বৌ দরজার বাইরে যাবে না। যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখানেই থাকো।আর ভালোবাসা মাঝে মাঝে অসময়ে হলে ক্ষতি কি?”
নিতু লাজুক কন্ঠে বলে,”কোন ক্ষতি নেই। তবে এখন অনেক কাজ আর বাবু উঠেই যাবে। আমি যাই আমার কাজ আছে।”
তৌসিফ নিতুর কথা শেষ হবার আগেই ওর হাত ধরে কাছে টেনে বলে,”তোমার এই ছোটাছুটির অভ্যাস আর গেলো না। বুড়ো হলেও কি এমন করবে?এখন নাহয় শক্তি আছে তাই তোমায় ধরতে পারি। বুড়ো হলে তো শরীরে শক্তি থাকবে না।তখন তোমায় আটকাবো কীভাবে?”কথা শেষ করে কাছে যেতে নিলেই নীরব কেদে ওঠে।আর ঐদিকে রাহেলা খালাও নিতু কে ডাক দেয়। এই অবস্থা দেখে তৌসিফ, নিতু দুজনই উচ্চস্বরে হেসে দেয়।দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে।
নিরব এর কান্নার গতি বাড়তে থাকলে নিতু তাড়াতাড়ি ওকে কোলে নিয়ে ঠান্ডা করে।ঐ দিকে রাহেলা খালা ডাকতে থাকে। তৌসিফ এর কাছে নিরবকে রেখে নিতু রান্না ঘরে যায়। তৌসিফ আজ আর সকালে দোকানে যায়না। নিতু যেতে দেয়না আর ওর নিজেরও যেতে ইচ্ছে করেনা। খুব দুর্বল লাগছে আজ। কিন্তু নিতু কে ব্যাপারটা বুঝতে দেয়না।
দুপুরের পরে দোকানে যেতে নিলে নিতু বলে,”আজ যাওয়ার দরকার নেই।আজ বিকেলে ডাক্তার এর কাছে যাবেন।”
“কি এমন হয়েছে যে ডাক্তার এর কাছে যেতে হবে? আমি ভালো আছি নিতু। এতো দুশ্চিন্তা করোনা তো। তবে তুমি যখন বলছো তখন সময় করে একদিন যাবো।”
নিতু খুব মন খারাপ করে বলে,”সেই একদিন টা আজ হলে ক্ষতি কি? আপনার চেহারা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে।প্লিজ একবার চলুন।”
তৌসিফ নিতু কে জড়িয়ে ধরে বলে,”যাবো বললাম তো বৌ।আজ অনেক কাজ দোকানে। সকালে যাইনি।এখনো দেরি করে যাচ্ছি। বিকেলে আর বের হতে পারবো না নিতু রানি।”
নিতু জানে যে এখন যতোই বলুক তৌসিফ যাবেনা।তাই আর কিছু বলেনা। কিছুটা অভিমান করে চুপ থাকে। তৌসিফ নিতুর কপালে আদর দিয়ে বলে,”একটু হাসি দাও না।এতো সুন্দর চেহারা যদি এমন প্যাচার মতো করে রাখো তাহলে ভালো লাগে বলো?”
নিতু মলিন চেহারা নিয়ে তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”হাসি আসছেনা আমার। খুব চিন্তা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে।অথচ আপনি কথাই শুনতে চাচ্ছেন না।এমন করলে হয়?”
“হয়।এমন মলিন চেহারা নিয়ে থেকো নাতো।ডাক্তার দেখাতে গেলে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাবো।এতো এতো টেস্ট,অযথা এতো এতো ঔষধ উফফ ভাবতেই বিরক্ত লাগছে আমার।আর শরীর তেমন বেশি খারাপ লাগলে তো যাবোই।”
নিতু তৌসিফ এর বুকে মাথা রেখে বলে,”মনে রাখবেন।এরপর যখন আমি অসুস্থ হবো তখন আমিও আপনার কথা শুনবো না।ডাক্তার এর কাছে যাবো না। কিছুতেই না।”
তৌসিফ নিঃশব্দে হাসে আর বলে,”ঠিক আছে সময় হলে দেখা যাবে।এখন একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমায় বিদায় দাও।”
নিতু একটা হাসি দিয়ে বলে,”এবার হলো?”
“হুম হলো।”তৌসিফও হাসি দিয়ে বিদায় নিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নিতু আবার ওর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে।
বেশ কয়েকটি দিন এভাবেই কেটে যায়।নিতু ও কয়েকবার ডাক্তার এর কাছে যাওয়ার কথা বলে । কিন্তু তৌসিফ যেতে না চাওয়াতে আর বলেনা। তৌসিফ এর ওজন আরো কমতে থাকে, চেহারা দেখলেই মনে হয় ও অসুস্থ, খাবারে দিন দিন অরুচি আসতে থাকে। তবুও ডাক্তার ভীতি সহ বিভিন্ন কারনে তৌসিফ আর ডাক্তার এর কাছে যায়না।
নিতু কে কাল হঠাৎ চাচিরা সবাই বলে , তৌসিফ এভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে কেনো? ওকে যেনো ডাক্তার কাছে নিয়ে যায়।তখন ত্রনিতুর হঠাৎ তপুর কথা মাথায় আসে।তাই কাজের ফাঁকে তপুর সাথে দেখা করতে যায়। তপু হঠাৎ ওর বাসায় নিতুর আগমনে বেশ অবাক হয়।বলে,”কি ব্যাপার নিতু? তুমি আমার বাসায়?কোন সমস্যা হয়েছে কি?”
নিতু সালাম জানিয়ে বলে ,”ভাইয়া একটা দরকার ছিলো। একটু সাহায্য করতে পারবেন?”
“হুম বলো। নিশ্চই করবো।”
“ভাইয়া উনি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ। কিছু খেতে পারেনা। খুব দুর্বল। আমি কোনভাবেই তাকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যেতে পারছিনা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তার ডাক্তার দেখানো উচিত। আপনি যদি ওনাকে একটু বলতেন। এ ব্যাপারে আমার কোন কথাই শুনতে চাচ্ছেনা।”
তপু বেশ চিন্তায় পরে যায়। তৌসিফ সারাক্ষন থাকে দোকানে।আর তপু থাকে অফিসে।অফিসের ব্যস্ততা,বৌ বাচ্চা সব সামলে বেশ কিছুদিন ধরে তৌসিফ এর সাথে দেখা হয়না ওর।এর মধ্যে তপুর বৌ এসে বলে,”হ্যা ভাবি সেদিন তৌসিফ ভাইকে দেখে আমিও বলতে চেয়েছিলাম যে, ভাইয়া অসুস্থ কিনা।কেমন রোগা হয়ে গেছে।ডাক্তার দেখাতে বলেন।”
নিতু হতাশার স্বরে বলে,”এজন্যইতো তপু ভাইয়ের কাছে এসেছি।ভাইয়ার কথা যদি শোনে।ডাক্তার এর ব্যাপারে উনি বরাবরই উদাসীন।আর অনেক ভীতু।”
দুজনের কথা শুনে তপু একটু বিরক্ত হয়ে বলে,”তৌসিফ এর শরীর ভালো না।আর এই কথাটা তোমরা আমাকে এতো দেরীতে বলছো? আশ্চর্য ব্যাপার।আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি দেখছি ব্যাপারটা। নিতু তুমি তৌসিফ রাতে বাসায় এলে আমাকে একটা ফোন দিও ।আর কালতো বন্ধ আছে।দেখি ওকে নিয়ে কাল ডাক্তার এর কাছে যেতে পারি কিনা।”
“আচ্ছা ঠিক আছে ভাইয়া। আমি তাহলে এখন আসি।বাসায় বাবুরা একা।”
“ঠিক আছে যাও।আর জানিও।”তপু নিতু কে বিদায় জানিয়ে বেশ চিন্তায় পরে যায়।
নিতু তপু কে বলতে পেরে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বাসায় যায় আর তৌসিফের অপেক্ষা করতে থাকে। তৌসিফের আজ ফিরতে রাত নয়টা বেজে যায়।আজ ওকে আরো বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছিলো। তৌসিফ কে দেখে নিতুর খুব খারাপ লাগে। তাড়াতাড়ি এক গ্লাস সরবত এনে দিয়ে তপু ভাইকে ফোন দিয়ে জানায়।
তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে এলে দেখে যে ওর রুমে তপু বসে আছে। তপু কে দেখে তৌসিফ খুব অবাক হয়।বলে,”কি ব্যাপার তপু তুই এই সময়ে?”
তপু নাহিন আর নিরব এর সাথে খেলছিলো। তৌসিফ এর শব্দ পেয়ে ওর দিকে তাকাতেই বেশ চমকে যায়।একই বিল্ডিং এ থাকলেও গতো প্রায় দুই তিন সপ্তাহ ওদের দেখা হয়না।কারন মাঝে তপু অফিসের কাজেও বেশ কিছুদিন ঢাকার বাইরে ছিলো।আজ রোগা,ক্লান্ত তৌসিফ কে দেখে তাই তপু বেশ অবাক হয়।ওর মনের মধ্যে খারাপ কিছু ঘটার আভাস পায়।এতো সুঠাম দেহের অধিকারী ভাইয়ের মাত্র এই কদিনে শরীরের এই অবস্থা যে কেনো কারো চোখে লাগার মতো ছিলো। এসব ভাবনার মধ্যে তৌসিফ তপুর সামনে এসে কাঁধে হাত রেখে বলে ,”কিরে কোন ধ্যানে হারিয়ে গেলি?কি হয়েছে? অনেক দিন পর দেখা হলো তোর সাথে।কোথায় নাকি গিয়েছিলি?”
চলবে…….
#সুখের খোঁজে…(পর্ব -২৯)
#মৌমিতা হোসেন
তপু উত্তরে বলে,”হুম অফিসের কাজে কিছুদিন ঢাকার বাইরে ছিলাম।কাল এসেছি। অনেক দিন তোর সাথে দেখা হয়না তাই চলে এলাম গল্প করতে।”
তৌসিফ চুল ঠিক করে তপুর পাশে খাটে শুয়ে পরে।বলে,”ভালো করেছিস। ভালো লাগছে না খুব ক্লান্ত লাগছে কয়দিন ধরে।খেতে পারছি না।”
“তোর এমন অবস্থা হয়েছে কেনো?তুই কি নিজেকে আয়নায় দেখেছিস ?এই কদিনেই এতো রোগা হয়ে গিয়েছিস কেনো?ডাক্তার দেখাসনা কেনো?”
তৌসিফ সবটা বুঝতে পেরে হেসে বলে,”নিতু এনেছে তোকে? মেয়েটা কেনো যে এতো অস্থির!!”
তপু একটু বিরক্ত হয়ে বলে,”নিতু একা অস্থির হবে কেনো? তোকে দেখে তো আমারই অস্থির লাগছে।কাল আমরা ডাক্তার এর কাছে যাবো। আমি সকালেই এপোয়েনমেন্ট নিয়ে রাখবো।”
তৌসিফ একটু হেসে বলে,”আরে ভাই এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেনো?তেমন কিছু হয়নি।ডাক্তার দেখাতে হবে না।”
নিতু সেই সময় ঘরে ঢোকে।সব শুনে কিছুটা অধিকার নিয়ে জোর গলায় ও বলে,”অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। কালকেই ডাক্তার দেখাবেন।”
ভাই আর বৌ এর জোড়াজুড়িতে তৌসিফ শেষমেষ রাজি হয়। দুই ভাই বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তপু কে নিতু অনেক খেতে বললেও খায়না।কারন তৌসিফ কে দেখে মুখে হাসি নিয়ে কথা বললেও মনে মনে খুব চিন্তায় পরে গিয়েছে তপু।
তৌসিফ আজকেও খেতে বসে একটু খেয়ে আর খেতে পারলো না।নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”খেতে পারছিনা নিতু।বমি পাচ্ছে। আমি বসি তুমি খাও।”
“আজকাল প্রায়ই আপনি এমনটা করছেন। এভাবে না খেলে হবে?দুপুরেও আজকাল ঠিকমতো খাননা।সব খবরই কিন্তু আমার কাছে আসে।”
তৌসিফ একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,”তুমি কি আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছো?যাই হোক সব কিছুই হচ্ছে অতিরিক্ত কাজের প্রেশারে।”
নিতু একটু জোর খাটিয়ে বললো,”আপনি যা বললেন বুঝলাম। তবে কাল ডাক্তার দেখাতে হবে।”
“ঠিক আছে নিতু রানি যাবো ডাক্তার এর কাছে।” এসব বলার মাঝেই হঠাৎ তৌসিফ এর বেশি খারাপ লাগলে দ্রুত বেসিন এর কাছে যায়। বমি হয় সাথে নাক থেকে রক্ত পড়তে থাকে।রক্ত দেখে তৌসিফ ভয় পেয়ে যায়। দুর্বল অবস্থায় তাড়াতাড়ি কল ছাড়ে যাতে নিতু দেখতে না পায়। কিন্তু তার আগেই নিতু এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিতু ভয় পেয়ে একরাশ চিন্তা নিয়ে তৌসিফ কে দেখতে থাকে। মস্তিষ্ক খারাপ কিছু ইঙ্গিত দেয় । তাড়াতাড়ি তৌসিফ কে ধরতে গিয়ে দেখে ওর শরীরে জ্বর। নিতু তৌসিফ এর মুখ ধোয়ার পর ওকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। তৌসিফ ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়ে।
রাতে নিতুর আর খাওয়া হয়না।সব গুছিয়ে রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ ঘুমিয়ে পড়েছে।নিতু ও গিয়ে তৌসিফ এর পাশে শুয়ে পরে। কিন্তু কিছুতেই আজ ঘুমেরা চোখে ধরা দেয়না।ভোরের দিকে কখন যেনো ঘুমিয়ে পরে নিতু।পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে নিতুর।চোখ খুলে দেখে তৌসিফ ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। নিতু আস্তে করে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা রেডি করতে যায়।তার আগে তুলি আর নাহিন কে দেখে যায়। দুই ভাই-বোন এখন আলাদা রুমে ঘুমায়।বড় হয়েছে তাছাড়া এক বিছানায় জায়গাও হয়না। নিতুর অবশ্য এতে মনের মধ্যে খুব খচখচ করে। রাতে দুই তিন বার এসে দেখে যায়।কাল তৌসিফ কে নিয়ে চিন্তায় আর ভালো লাগছিলো না তাই আর ওদের দিকে মনোযোগ ছিলোনা। রুমে গিয়ে দেখে দুই ভাই-বোন ঘুমে বিভোর।ভাবে এরই মধ্যে কতো গুলো বছর কেটে গেলো।এতো সুন্দর একটা পরিবার,এমন রাগে কটকট করা মানুষটা আজ কতো সহনশীল হয়েছে।হুট করেই এখন আর রাগ করেনা।সংসারের প্রতি কতো মনোযোগী হয়েছে। সবাইকে কতো ভালোবাসে।ভাবলে স্বপ্ন মনে হয়।আজ তৌসিফ এর চিন্তায় ভালো লাগছে না।ডাক্তার দেখানোর আগে এই অশান্ত মনটা আর শান্ত হবে না।
এর মধ্যে রেহানা খালা আসলে দু’জন মিলে খাবার রেডি করে।বন্ধের দিন থাকায় সবাই দেরি করে ওঠে। তৌসিফ কে আজ সকাল থেকেই একটু অন্যরকম লাগছে।চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।শরীর যে খারাপ লাগছে বোঝা যাচ্ছে। নিতু কপালে হাত দিয়ে দেখে এখন জ্বর নেই। সবাই একসাথে বসে নাস্তা খায়। তবে তৌসিফ এর খাওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্ৰহ ছিলোনা। তৌসিফ একটু খেয়ে ওর রুমে চলে যায়।আসোলে রাতে নাক থেকে রক্ত পড়ার পর থেকে ও খুব চিন্তায় আছে।তাই কিছু ভালো লাগছেনা।
নিতু তৌসিফ এর ব্যাপারটা বুঝতে পারে। বাচ্চাদের খাওয়ানো শেষ করে রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ চুপচাপ শুয়ে আছে।বন্ধের দিন এমন সময়ে ও বাচ্চাদের নিয়ে হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকে।আর আজ….যাই হোক নিতু তৌসিফের পাশে গিয়ে বসে কপালে হাত দিয়ে বলে,”শরীর বেশি খারাপ লাগছে? নাস্তা খেলেন না কেনো?”
“না তেমন কিছু না। ভালো লাগছে না কোন কিছু।আর খেতে ইচ্ছেই করেনা। খেতে নিলেই বমি পায়।”
“আজ ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খেলেই দেখবেন ভালো হয়ে যাবেন।এতো টেনশন নিয়েন না। বাচ্চারা সবাই আপনার হৈ হুল্লোড় দেখার জন্য অপেক্ষায় আছে পাঠিয়ে দেই?”
তৌসিফ বুঝতে পেরে বলে,”হুম দাও। আমি ঠিক আছি।”
“আর দুপুরে কি খাবেন বলুন।আজ আপনার পছন্দে রান্না হোক।”
তৌসিফ হেসে নিতুর গালে হাত রেখে বলে,”আজ আমার বৌ যা রাঁধবে আমি তাই খাবো।”
নিতুর মনে মনে দুশ্চিন্তা থাকলেও কিছু বুঝতে দেয়না।বলে,”আচ্ছা ঠিক আছে। নিতু বাচ্চাদের ডেকে তৌসিফ এর কাছে বসিয়ে রেখে রান্নায় চলে যায়। বিকেলে তপু এসে তৌসিফ আর নিতু কে নিয়ে এলাকায় এক হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তার দেখায়।ডাক্তার সব শুনে বেশ কিছু টেস্ট দেয়।আর রিপোর্ট নিয়ে আবার দেখা করতে বলে।ডাক্তার তৌসিফ আর নিতু কে বাইরে পাঠিয়ে তপু কে বললো যে ,সে খারাপ কিছু সন্দেহ করছে। তবে মন থেকে চাইবে যেনো তার সন্দেহ ভুল হয়।তপু ডাক্তার এর কথা শুনে খুব চিন্তায় পরে যায়।
সব টেস্ট করিয়ে বাসায় ফিরতে ওদের রাত হয়। নিতু কয়েকবার তপু কে জিজ্ঞেস করে যে ডাক্তার কি বলেছে। কিন্তু নিতু দুশ্চিন্তা করবে তাই আর বলেনি। এদিকে তৌসিফ ও খুব চিন্তায় পরে যায়। শরীরটাও খুব ক্লান্ত লাগে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে। দুজনের মাঝে রাতে আর তেমন কোন কথা হয়না।
রিপোর্ট দেয়ার কথা দুই দিন পর।এই দুই দিন তৌসিফ সকাল হলেই দোকানে চলে গেছে। তবে শরীর খারাপ লাগায় দোকান থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। তৌসিফের বারবার মনে হচ্ছিলো খারাপ কিছু হয়েছে।কারন ওর শরীর প্রচন্ড খারাপ লাগছে গতো কদিন ধরে। কিছু সমস্যা গতো এক সপ্তাহ ধরে হচ্ছে যেমন,নাক থেকে রক্ত পড়া, পেটে ব্যাথা, প্রচন্ড ক্লান্তি।এসব দেখে প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও ঐ দিন ডাক্তার এর কথার ধরনে তৌসিফ খুব ভয় পায়।নিতু অতিরিক্ত টেনশন করে তাই ওকে এই সমস্যা গুলো বুঝতে দিতে চায়নি। মনে মনে আল্লাহকে ডাকে যেনো রিপোর্টে তেমন খারাপ কিছু না আসে।
এদিকে নিতুর এই দুই দিন দুই রাত কাটে নির্ঘুম। ভেতরে অস্থিরতা বাড়তেই থাকে। নামাজ পড়ে শুধু দোয়া করে যেনো সব ভালো হয়। তৌসিফ যেনো সুস্থ হয়ে যায়। সংসার এর কোন কিছুই নিতুর ভালো লাগে না।ফোন করে সালেহা বেগমকে বাসায় আসতে বলে।কারন বাচ্চাদের দেখাশোনা,স্কুল কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছিলো না। রাহেলা খালাও নিতুর অবস্থা দেখে দু’হাত তুলে তৌসিফ এর জন্য দোয়া করে।
সবাই টেনশন করবে তাই তপু তৌসিফ এর বিষয়টা বাসায়ও কাউকে জানায়নি। তবে তপু কে দেখে সবাই বুঝতে পেরেছিলো যে কিছু একটা নিয়ে ও খুব চিন্তায় আছে।
সালেহা বেগম পরদিন সকালেই নিতু দের বাসায় চলে আসে। নিতুকে খারাপ চিন্তা না করে নামাজ পড়ে তৌসিফ এর জন্য দোয়া করতে বলে। কিন্তু তৌসিফ কে দেখে সালেহা বেগম নিজেও চিন্তায় পরে যায়।
আজ বিকেলে রিপোর্ট দেয়ার কথা। তপু সকালে তৌসিফের বাসায় এসে বলে যে,ও একাই অফিস থেকে ফেরার পথে রিপোর্ট নিয়ে আসবে। ওদের যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু নিতু বলে,”না ভাইয়া আমিও যাবো। একবারে ডাক্তার এর কাছে গিয়ে রিপোর্ট দেখিয়ে আসবো।”
“তোমার যাওয়ার দরকার নেই তো। বাচ্চাদের একা বাসায় রেখে হাসপাতালে শুধু শুধু কেনো কষ্ট করবে?”
“না ভাইয়া। আমার ভালো লাগছে না। আমি যাবো।আর বাসায় আম্মু আছে। সমস্যা হবে না।”
তপু বুঝতে পারে নিতু কে বলে লাভ নেই তাই বলে,”ঠিক আছে। আমি অফিস থেকে চলে আসবো। তুমি চলে যেও রিকশা নিয়ে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
তৌসিফ আজ কোন কথা বলেনা।চুপ থাকে। তবে মনে মনে ঠিক করে নিতুর সাথে ও যাবে। শরীর বেশি খারাপ লাগায় আজ আর তৌসিফ দোকানে যায়নি। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়েছে। তবে সারাদিন তৌসিফ আর নিতুর মাঝে ছিলো নিরবতা।যে যার মতো কাজ করতে থাকে। বিকেলে নিতু রেডি হতে নিলে তৌসিফ ক্লান্ত শরীরেই নিতুকে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে। নিতু চোখ বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। গভীর ভাবে উপলব্ধি করে ওর প্রানপ্রিয় মানুষটিকে।
কিছুক্ষণ নিরব থাকার পরে তৌসিফ বলে,”নিতু আমার খুব ভয় লাগছে। অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে তোমাদের হারিয়ে ফেলবো আমি।কোন এক ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছি মনে।কেমন লাগছে ঠিক বোঝাতে পারবো না নিতু।”
তৌসিফের অবস্থা দেখে নিতু নিজেকে শক্ত করে। মনকে শান্ত করে।তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”এতো টেনশন করবেন না।দেখবেন রিপোর্টে সব ভালো আসবে।কোন ঝড় আসবে না। আমি আসতে দেবো না।আপনি একটু রেস্ট নিন। আমি রিপোর্ট নিয়ে আসি।”
তৌসিফ নিতুর গালে হাত রেখে মন ভরে কিছুক্ষণ নিতু কে দেখে । কপালে চুমু খেয়ে বলে,”তোমার কথা যেনো সত্যি হয়। আমাদের সুখের সংসারে যেনো কোন ঝড় না আসে।”
নিতু তৌসিফ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তৌসিফ বলে,”আমিও যাবো। দুজন মিলে আজ রিকশা ভ্রমন করতে করতে যাবো। তুমি আজ সেই লাল শাড়িটা পড়ে সাজবে আমার জন্য।”
নিতু হেসে দেয়।বলে,”ঠিক আছে।এই অসুস্থ অবস্থায় ও আপনার মনের রং শেষ হয়না তাইনা? আপনি রেডি হন।”
তৌসিফের কথা অমান্য করার সাধ্য নিতুর নেই।নিতু লাল শাড়িটা পরে রেডি হয় আর তৌসিফও একটা পাঞ্জাবি পরে। দুজন মিলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রিকশায় ওঠে। পথে তৌসিফ নিতুর প্রিয় বেলি ফুলের মালা কিনে নিজ হাতে খোঁপায় পড়িয়ে দেয়।মনের ভেতরে অজানা আশঙ্কা থাকলেও কেউ কাউকে বুঝতে দেয়না।দুজনের হাসপাতালে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়। গিয়ে দেখে তপু ওদের আগেই চলে এসেছে। তপু ওদের এভাবে দেখে খুশি হয়। বলে,”ভালোই প্রেম হুম!! আমি তোদের জন্য এসে অপেক্ষায় বসে আছি। আর তোরা সেজেগুজে ঘুরে বেড়িচ্ছিস?”
তৌসিফ বলে,”হুম অনেক দিন পর দুজন মিলে রিকশা ভ্রমন করলাম।”তৌসিফ এর শরীর বেশ খারাপ লাগছিলো। কথা বলতে বলতে তাই ও পাশে চেয়ারে বসে পরে। নিতু আবার টেনশন শুরু করে।
তপু গিয়ে রিপোর্ট এনে ডাক্তার এর অপেক্ষায় বসে থাকে। অবশেষে তপু গিয়ে রিপোর্ট ডাক্তারকে দেখালে ডাক্তার বলেন, “আমার সন্দেহই ঠিক ।যতোটুকু বোঝা যাচ্ছে লিভার সিরোসিস হয়েছে।তবে কোন অবস্থায় আছে সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। এটা বোঝার জন্য আরো কিছু টেস্ট করাতে হবে।এখনি ভয় পাবেন না। মানসিক ভাবে শক্ত হতে হবে। আমি আপাতত কিছু ঔষধ দিচ্ছি।রোগিকে ঠিকমতো ঔষধগুলো খাওয়াবেন।আর যতো দ্রুত পারেন টেস্টগুলো করিয়ে রিপোর্ট এনে দেখা করবেন।”
তপু ডাক্তার এর কথা শুনে কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছিলো না।দাঁড়িয়ে বলে,”ঠিক আছে। আমি তাহলে টেস্ট করিয়ে একবারে রিপোর্ট নিয়ে আসবো।”
“শুধু রিপোর্ট না রোগিকে নিয়ে আসবেন।”
“ঠিক আছে “বলে তপু উঠে দাড়ায়। কিন্তু তপুর পা চলছিলো না। এদিকে বাইরে নিতু আর তৌসিফ তপুর অপেক্ষায় বসে আছে। মনে প্রানে দোয়া করছে যেনো কোন খারাপ খবর না আসে।
চলবে……..