#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২৬)
#মৌমিতা হোসেন
ভোরে ফজরের নামাজের পর নিতু চোখের পাতা এক করে। ঘুম ভাঙে সকাল আটটার দিকে।আজ রাহেলা খালা দেরি করে আসে।কদিন ধরেই ওনার শরীর একটু খারাপ।তাই আজ দেরি করে এসেছে। রাহেলা এসে নিতুর চোখ মুখ দেখেই বলে,”কি হইছে বৌ মনি?আফনের চোখ মুখ এরম ফোলা ক্যান?কানছেন ক্যান?কি হইছে?”
নিতু রাহেলা খালার অস্থিরতা দেখে বলে,”আরে চুপ করো খালা। আমার কিছু হয়নি।”
“তাইলে? আমার তুলি,নাহিন ভালো আছে?ওগোর কিছু অয়নাইতো?”
নিতু রাহেলার অস্থিরতা দেখে তাকে সবটা খুলে বলে।রাহেলাও শুনে মন খারাপ করে। অনেক বছর ধরে কাজ করায় বাসার সবার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে রাহেলার। নিজের পরিবারের মতোই ভালোবাসে সবাইকে। রাহেলা বলে,”আফনের আম্মারে খবর দেন। কয়দিন আইয়া থাইকা যাউক।আফনে একলা বাবুগো, তৌসিফ বাবারে সামলাইতে পারবেন না।”
“ভালো কথা বলেছো খালা। একটু পরে ফোন দিয়েই বলবো।মা আসলে ভালো হবে। তোমাকে ধন্যবাদ খালা। সত্যি তুমি অনেক ভালো।”
“হইছে আর কওন লাগবোনা।যে নিজে ভালা হের কাছে সবাইরেই ভালা মনে হয়।এহন যান আফনে বাবজানের সেবা করেন। আমি এদিক সামলাই আইজকা।”
“ঠিক আছে খালা। আমি একটু স্যুপ বানিয়ে নিয়ে যাই। বাকিটা তুমিই করো আজ।”
“আইচ্ছা ঠিক আছে।”
নিতু স্যুপ বানিয়ে তৌসিফ এর জন্য নিয়ে যায়। সারারাত ছটফট করে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।বাচ্চারাও ঘুমাচ্ছে।এই সুযোগে নিতু মায়ের কাছ ফোন করে সব কিছু খুলে বলে। সালেহা বেগম বলে যে তিনি দুপুরেই চলে আসবে।ফোন রাখতেই পাখির নিতু কে ডাকা শুরু হয়ে যয়। নিতু পাখির সাথে কিছু সময় কথা বলে পাখিকে খাবার দেয়, বারান্দায় ছোট বাগানের যত্ন নেয়।পুরো বসাটায় এই বারান্দাটা নিতুর খুব পছন্দের।মন খারাপ হলে বা চিন্তায় পড়লে নিতু এখানে এসে পাখির সাথে কথা বলে, নিজের বাগানের গাছ,ফুল দেখে এতে ওর মন অনেকটাই হালকা হয়।
বেশ কিছু সময় পর তৌসিফ এর ডাক শুনে ঘরে ঢুকে দেখে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। নিতু তাড়াতাড়ি তৌসিফ এর কাছে গিয়ে ওকে উঠিয়ে হাত মুখ মুছে স্যুপ খাইয়ে দেয়। তৌসিফ পুরোটা সময় নিতু কে দেখতে থাকে অপলক।এক সময় বলে,”এভাবে আদর করে খাওয়ালে তো আমি অসুস্থ হলেই ভালো।রোজ রোজ তুমি এতো যত্ন নেবে, সারাক্ষন আমার পাশে থাকবে আর আমায় এভাবেই ভালোবাসবে।”
নিতু খানিক রাগ দেখিয়ে বলে,”এমন কথা আর কোনদিন বলবেন না। সুস্থতা আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত।আর আমি কি আপনি অসুস্থ না হলে আপনার খেয়াল রাখি না? আপনার যত্ন নেইনা?”
“হুম নাও তো। কিন্তু এই যে এখন একটু বেশি নিচ্ছো।এই বেশি ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বললাম।”
“না আর কখনো এভাবে বলবেন না। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”কথা শেষ করতেই তুলি ঘুমঘুম চোখে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে আমিও বাবাকে অনেক ভালোবাসি।
হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় তৌসিফ এর হাতে ব্যাথা পায়।উফফ শব্দ করতেই নিতু তুলির দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙায়।তুলি কিছু বুঝতে না পেরে বলে,”বাবার কি হয়েছে? কীভাবে ব্যাথা পেয়েছে বাবা?”
“সেটা বাবাকে ব্যাথা দেয়ার পর খেয়াল করলে হবে?বাবা অনেক ব্যাথা পেয়েছে তাই একটু সাবধানে ধরবে বাবাকে।আর আজ স্কুলে যেতে হবে না। বাসায় বাবার পাশে থাকো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে মামনি। আমি আর বাবাকে ব্যাথা দেবো না।আর আজ সারাক্ষণ আমি বাবার পাশেই বসে থাকবো।”
তৌসিফ এতোক্ষণ ধরে মা মেয়ের কথা শুনে নিতুকে চোখ টিপ দেয় আর বলে,”এবার তোমরা থামবে? আমার মা কি আমাকে ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়েছে যে ওকে এতো বকছো?”তুলি বাবার কথা শুনে খুশি হয়ে যায় আর দ্রুত বাবার পাশে বসেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
তুলি বলার মতো আর কিছু খুঁজে পায়না।বাবা আর মেয়ের আহ্লাদ দেখতে থাকে।ঔষধ নিয়ে এসে তৌসিফ কে খাইয়ে একটু রেস্ট নিতে বলে।এর মধ্যেই নাহিনও ঘুম থেকে উঠে যায়। নিতু বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে।মাঝে মাঝে এসে তৌসিফ এর কিছু লাগবে কিনা দেখে যায়। তৌফিক আজ পুরোপুরি রেস্ট এ।তাই শুয়ে বসে নিতুর ব্যস্ততা দেখতে থাকে। ঘামে ভেজা শাড়ির ব্লাউজ, কপালে এলোমেলো চুল, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ এসব কিছুই তৌসিফ কে আকর্ষণ করে। কিন্তু হায় এমন দিনেই বেচারা বাসায় যেদিন কিনা মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। তৌসিফ আনমনে এসব ভাবতে থাকে আর মিটমিট হাসতে থাকে।এর মধ্যে নিতু এসে বলে,”কি হয়েছে আপনার?টাকা ছিনতাই হওয়ার কষ্টে মাথায় সমস্যা হয়েছে নাকি?এই অবস্থায় এভাবে হাসছেন কেনো?”
তৌসিফ এর ধ্যান ভাঙে।বলে,”না বৌ কিছু হয়নি। তোমাকে দেখছি। দেখতে ভালো লাগছে।আর তাই হাসছি।”নিতুর হাত ধরে বললো ,”এতো কাজ করতে হবে না। আমার কাছে এসে বসো। আমার তোমাকে প্রয়োজন।”
এরই মধ্যে তৌসিফ এর চাচিরা, তপু, তপুর বৌ সবাই হুরমুর করে তৌসিফ এর ঘের প্রবেশ করে।নিতু তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে দেয়।এই একটা অভ্যাস সবাই বলেও দুর করাতে পারেনি। কাউকে দেখলেই নিতু মাথায় কাপড় দেয়।আর তৌসিফ কে আপনি করা বলে।
সবাই তৌসিফ কে দেখতে এসেছে।চাচিরাও অস্থির হয়ে বলে,”এখন থেকে এসব টাকা পয়সার ঝামেলা যেদিন থাকবে সেদিন তপু কে আগে থেকেই বলে রাখবি।একা একা যাবিনা কোথাও।কতো বড় বিপদ থেকে আল্লাহ বাঁচিয়েছে?”
“ঠিক আছে চাচি এসব ঝামেলার দিন এখন থেকে আমি তপু কে খবর দেবো হলো তো?”
সবাই বেশ কিছু সময় থাকে।তুলি, নাহিন দাদির সাথে,ফুপির সাথে খেলায় মেতে ওঠে। কিছু সময় থেকে তারপর সবাই চল্ যায়।তপু যাওয়ার সময় বলে,”কিছু লাগলে ফোন দিস কিন্তু।আর এক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে।তোর অসুস্থতার জন্য তোর বৌ একটু কয়দিনের জন্য শান্তিতে থাকতে পারবে।”বলে চোখ টিপ দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যেতে থাকে।
তখন তৌসিফও হাসে আর বলে,”সুস্থ হয়ে নেই ভাই তারপর তোকে এই প্রশ্নের উত্তর দেবো। অপেক্ষা কর।”
নিতু দুজনের হাসিতেই কেমন এক রহস্য খুঁজে পায়।বলে,”কি ব্যাপার বলোতো।কি নিয়ে তোমরা দুই ভাই এমন বাচ্চাদের মতো করছো?”
তৌসিফ বাম হাত দিয়ে নিতু কে ধরে ওর পাশে বসিয়ে দেয়।বলে ,”তোমাকে নিয়ে। কয়েকদিন তোমাকে ঠিকমতো ভালোবাসতে পারবো না সেটা নিয়ে বেচারা আফসোস করছে।তোমারও কি আফসোস হচ্ছে বৌ?”
এতো ঝামেলার মাঝে তৌসিফ এর এমন কথা শুনে নিতু লজ্জায় লাল নীল হতে থাকে। তৌসিফ এর দিক থেকে চোখ সরিয়ে বলে,”আপনারা এতো নির্লজ্জ কেনো?যা মুখে আসে তাই কি বলতে হয়? একটু রেখে ঢেকে বলা যায়না?”
তৌসিফ নিতুর গালে হাত রেখে বলে,”না বলা যায়না। এখনি তো বলার সময়।তাই বলি।আর তুমিও দুই বাচ্চার মা হয়ে এখনো কেনো এতো লজ্জা?”হঠাৎ ব্যাথা বেড়ে যাওয়ায় তৌসিফ কপাল কুঁচকে শব্দ করলে নিতু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে ওঠে।সেই সকালে ওঠার পর থেকেই বকবক করে যাচ্ছে। শরীরে হাত দিয়ে দেখে আবার জ্বর আসছে। তৌসিফ কিছু বলতে যাবে ওমনি নিতু মুখে হাত দিয়ে চুপ করতে বলে।ঔষধ খাইয়ে ঘুমাতে বলে। বাচ্চাদের নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে অন্য রুমে চলে যায়।যাতে তৌসিফ ঠিকমতো ঘুমাতে পারে।
বিকেল চারটার দিকে সালেহা বেগম আসে। সাজিদ এই বছর এইচএসসি দিয়েছে।এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়ছে আর সেতুর অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে ।ওদের পড়াশোনার জন্য সালেহা চাইলেও এসে নিতুর কাছে বেশিদিন থাকতে পারেনা।সেতুর কাবিন হয়েছে এক কলেজের লেকচারার এর সাথে। পরীক্ষা শেষ হলে অনুষ্ঠান করে তুলে নেবে। তুলি খালামনিকে দেখেই আহ্লাদে আরো গলে পরলো।আর নাহিন সেই যে মামার সাথে ঘুরতে বের হয়েছে আর আসার নাম নেই। নিতুর জন্য অবশ্য ভালোই হয়েছে।ও নিশ্চিন্তে তৌসিফ এর দেখাশোনা করছে।
প্রায় পনেরো দিন পরে সালেহা বেগম চলে যায়। তৌসিফ এখন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ।এই কদিন সবাই মিলে বেশ আনন্দে কাটে।ভাই অসুস্থ শুনে জুঁই, সাদিয়া এসে ঘুরে যায়। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে বেশ কষ্ট পায়।রাগী হলেও তপু আর তৌসিফ দুই ভাইকেই বোনেরা খুব পছন্দ করে,খুব ভালোবাসে।সাদিয়ার বিয়ে হয়েছে ছয় মাস আগে।ছেলে সরকারি চাকুরিজীবী।বেশ ভালো আছে।
এখন বাকি আছে বিথি ।বিথির বিয়েও ঠিক হয়ে আছে।ছেলে ব্যবসা করে।নিউ মার্কেটে দুটো দোকান আছে।ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে আর কি লাগবে।ওর সামনে দ্বিতীয় বর্ষে ফাইনাল পরীক্ষা।শেষ হলেই বাড়িতে শুরু হবে বিয়ের আমেজ। সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।
নিতু দিনরাত সেবা করে তৌসিফ কে সুস্থ করে তোলে।হাতের ক্ষত শুকাতে বেশ সময় লাগে। তৌসিফ নিতুর ভালোবাসায়,যত্নে সুস্থ হয়। নিতুর প্রতি ওর ভালোবাসা,শ্রদ্ধা আরো বহুগুনে বেড়ে যায়। জীবনে নিতু কে ছাড়া যেনো তৌসিফ এখন অসহায়।প্রায় দুই মাস পরে আবার দোকানে যাওয়া শুরু করে।পাশের দোকানটা তৌসিফ কিনে নেয়। তবে সব ক্ষেত্রে সাথে করে তপু কে নিয়ে যায়। এবার তৌসিফ খুব মনোযোগ সহকারে ব্যবসা শুরু করে।
আজ বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক দিন পর আজ নিতু কে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় তৌসিফ এর। ভালোবাসার মানুষটি গতো দুই মাস ধরে ওর কতোই না সেবা করলো।এক হাতে বাচ্চাদের স্কুল, সংসার সব সামলিয়েছে কোন প্রকার বিরক্তি ছাড়া। নিতুর উদারতা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তৌসিফ কে খুব মুগ্ধ করে।এতো ভালো কেউ হতে পারে? নানান ভাবনায় মত্ত থাকে ও।মনে মনে ঠিক করে নিতুর জন্য কোন উপহার কিনে নিয়ে যাবে। হঠাৎ খেয়াল হয় অনেক দিন নিতু কে কিছু কিনে দেয়না, বিয়ের পর কোথাও বেড়াতেও নিয়ে যায়না। সবাই বিয়ের পর কতো জায়গায় বেড়ায়। তৌসিফ এসবের কিছুই করেনা। তৌসিফ ঠিক করে এবছর শীত এলে নিতু কে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবে। সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে। নিতু শুনলে নিশ্চই খুব খুশি হবে।
আর আজ কি দেয়া যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা আইডিয়া আসে মাথায়। তৌসিফ আজ তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে শাড়ির দোকানে গিয়ে নিতুর জন্য একটা গোলাপী রঙের সুতি শাড়ি কেনে, ফুলের মালা কেনে।আজ একটু নিতু রানিকে সাজাতে মন চাচ্ছে।আর মন চাচ্ছে খুব ভালোবাসতে। বাচ্চাদের জন্যও টুকটাক কেনাকাটা করে তাড়াতাড়ি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তৌসিফ।
চলবে…….
#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২৭)
#মৌমিতা হোসেন
বাইরে মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।রাত দশটা বেজে গেছে এখনো তৌসিফ না ফেরায় চিন্তা হয় নিতুর।ঐ দিনের পর থেকেই একটু দেরি হলে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। বাচ্চাদের খাইয়ে তৌসিফ কে ফোন দেয় নিতু। কিছুক্ষণ রিং হবার পর রিসিভ করে জানায় যে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। নিতু নিশ্চিন্ত হয়ে বাচ্চাদের ঘুম পারিয়ে তৌসিফ এর অপেক্ষায় বসে থাকে। বৃষ্টি থাকায় রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকে তাই তৌসিফ এর ফিরতে আজ এতো দেরি।রাত এগারোটায় কলিং বেল এর আওয়াজ শুনলেই নিতু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তৌসিফ ভিজে টুপটুপা। নিতু দেখেই বলে,”ভিজে একি অবস্থা হয়েছে আপনার? তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে ফ্রেশ হন।আজতো নির্ঘাত আপনার ঠান্ডা লাগবে।এতো ভিজলেন কি করে?”
“এক সাথে এতো কথা বললে উত্তর দেবো কীভাবে? আগে ব্যাগগুলো ধরো। বাইরে যেই বৃষ্টি গাড়িতেই ছিলাম।নেমে এটুকু আসতেই ভিজে এই অবস্থা। তুমি খাবার রেডি করো খুব খিদে পেয়েছে। আমি গোসল করে আসছি।”তৌসিফ সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। এদিকে নিতু ব্যাগগুলো রুমে নিয়ে রেখে আগে তৌসিফ এর কাপড় বের করে দেয় তারপর তাড়াতাড়ি খাবার গরম করে।এর মধ্যে তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে আসলে দুজন মিলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। খাওয়ার মাঝেই তৌসিফ বলে,”খাওয়া শেষ হলে তাড়াতাড়ি রুমে আসো। তোমার জন্য গিফ্ট আছে।”
নিতু খানিক অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”এই বৃষ্টির মাঝে আপনি গিফ্ট কিনেছেন কোথা থেকে।এজন্যই আপনার এতো দেরি আজ?”
“বলতে পারো এজন্যই একটু দেরি। কতোদিন তোমাকে কিছু কিনে দেই না।আর এজন্য তুমিও কতোদিন আমাকে আদর করো না, কাছে আসো না তাই ভাবলাম বৌকে খুশি করতে কিছু গিফ্ট কিনে দেই।”কথাগুলো বলে তৌসিফ মিটমিট হাসতে থাকে।আর নিতু খাওয়া বন্ধ করে লজ্জায় কি বলবে খুঁজতে থাকে।মাথা নিচু করে খাবার নাড়াচাড়া করতে থাকে।
এমন সময়ে তৌসিফ আবার বলে,”এতো দিন হয়ে গেছে তবুও তুমি অল্পতেই এতো লজ্জা পাও কেনো বলোতো?অবশ্য লজ্জা পেলে তোমাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগে তখন আরো বেশি আদর করতে ইচ্ছে করে। ভাবছি নাহিন এর বয়স দু’বছর হয়ে গেছে এখনি যদি আরেকজন বাবু আনা যায় তাহলে…..।”
নিতু আর চুপ থাকতে পারেনা।বলে,”ধ্যাত, আপনাকে নিয়ে আর পারা যায়না। দিন দিন এতো নির্লজ্জ হচ্ছেন কেনো বলুনতো?”
তৌসিফ নিতুর দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আজ আবার একটু নির্লজ্জ হতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই।আর অনেক দিন তো না ভালোবেসে তোমায় শান্তি দিলাম আজ নাহয় একটু ভালোবেসে শান্তি দেই?”
তৌসিফ এর চোখে আজ অন্য রকম আকুতি, আবদার, অধিকার।এই আকুতি উপেক্ষা করার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই নিতুর নেই। নিতু লাজুক হাসি হেসে কোন রকম খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে রুমে যায়। তৌসিফ বাচ্চাদের পাশে বসে ওদের কপালে আদর দিচ্ছিলো।এমন সময় নিতু কে দেখে শাড়ি আর ফুলের মালাটা এগিয়ে দিয়ে দুষ্টুমির স্বরে বলে ,”আজ তাহলে তোমার মনেও একই তোলপাড় চলছিলো?”
নিতু ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,”মানে?”
“মানে এজন্য আমার কলিজার টুকরোদের আজ তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছো? তুমিও একাকী আমার সঙ্গ পেতে চাও?যাক ভালোই হলো। আমি পাশের রুমে অপেক্ষায় আছি তুমি শাড়িটা পরে আসো।”
নিতু লজ্জা পেয়ে সামনে থেকে যেতে নিলে তৌসিফ হাত ধরে টেনে নিজের কাছে এনে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”খোঁপায় মালা আর চোখে কাজল পড়তে ভুলো না যেনো লাজুক বৌ।”
তৌসিফ পাশের রুমে অপেক্ষায় থাকে নিতুর। এদিকে নিতুও অনেক দিন পর আজ একটু আয়নায় নিজেকে দেখে।বাচ্চা, সংসার নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়।আর গতো দুমাস তৌসিফ কে নিয়েই সারাক্ষন ব্যস্ত ছিলো।এর মাঝে নিজের দিকে নজর দেবার সময়ই পায়নি। চেহারায় কেমন ক্লান্তির ছাপ, এলোমেলো চুল। নিজেকে আয়নায় দেখে নিতু খানিকটা বিরক্ত হয়।মনে মনে বলে,”এতো সুন্দর মানুষ টার পাশে সত্যি আজ আমি বেমানান। আজ নিজেকে একটু সাজাতেই হবে।”শাড়িটা বের করে দেখে খুব খুশি হয়।শাড়ি পরে চুল আঁচড়ে খোঁপায় ফুলের মালা পড়ে। চোখে কাজল, হালকা লিপস্টিক এতেই নিজেকে বেশ পরিপাটি মনে হয়। এভাবে তৌসিফ এর সামনে যেতে বেশ লজ্জা বোধ করে।
রাত প্রায় একটা বাজে নিতু পাশের রুমে তৌসিফ এর কাছে যায়। গিয়ে দেখে তৌসিফ কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে।মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পরেছে।এটা দেখে নিতুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। অনেক আগেই রেডি হয়ে আসতে নেয় এর মাঝেই নাহিন ঘুম থেকে উঠে গেলে ওকে ঘুম পাড়াতে সময় লাগে।আর তাই দেরি হয়। নিতু তাই আর কোন কথা না বলে তৌসিফ কে কিছুক্ষণ দেখে আস্তে করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে থাকে। বৃষ্টির পানি এসে মুখে পরছে, কিছু সময় পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ঠান্ডা বাতাসে শীত শীত লাগছে।সব মিলিয়ে বেশ ভালো লাগে নিতুর। নিতু ভাবে, সারাদিন মানুষ টা কতো কষ্ট করেছে তাই ঘুমিয়ে যখন পরেছে তখন আজ আর তার ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। তাকে ঘুমাতে দেয়া উচিত।
এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কোমরে কারো হাতের স্পর্শে শিহরিত হয় নিতু।ও বুঝতে পারে যে তৌসিফ জেগেই আছে। তৌসিফ নিতু কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে দিয়ে বলে,”এতোক্ষণে আসার সময় হলো?”
নিতু কাঁপা কন্ঠে বলে,”নিহান উঠে গিয়েছিলো। ওকে ঘুম পাড়াতে দেরি হয়ে গেলো।আর আপনি ঘুমাননি এখনো?আমি ভেবেছি আপনি ঘুমিয়ে পরেছেন।”
তৌসিফ নিতুর সামনে এসে বলে,”না ঘুমাইনি। ঘুমিয়ে পরলে এতো সুন্দরী বৌকে দেখতাম কীভাবে বলো?মাশাআল্লাহ! আমার বৌকে পুরো পরীর মতো লাগছে।”
নিতু খুব লজ্জা পায়। তৌসিফ নিতুর কপালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,”অনেক ধন্যবাদ নিতু। আমার জীবনে এসে জীবনটাকে এতো রং দিয়ে রঙিন করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। অনেক ভালোবাসি তোমাকে।”
নিতু ও বলে,”আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”
বাহিরে সারারাত ধরে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে।আজ যেনো বৃষ্টি বন্ধ হবার নামই নিচ্ছেনা।তেমনি তৌসিফ নিতু কে সারারাত ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে।এই ভালোবাসার যেনো কোন শেষ নেই। দু’জনই পুরো রাত জুরে একে অপরকে ভালোবাসা দেয়া নেয়ায় মেতে থাকে। ভোরবেলা নাহিনের কান্নার শব্দে নিতু তাড়াতাড়ি উঠে যেতে নিলে দেখে তৌসিফ নিতু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।হাত সরাতে নিলেই তৌসিফ বিরক্ত হলে নিতু আস্তে করে বলে,”নাহিন উঠে গিয়েছে।হাত সরান যেতে দিন।”
তৌসিফ একটু বিরক্ত হয়ে বলে,”বাবাটা আজকাল শান্তিতে তোমায় আদরটাও করতে দেয়না। অনেক হিংসুটে হয়েছে।”
তৌসিফ এর কথা শুনে নিতু হেসে দেয়। তাড়াতাড়ি তৌসিফ এর হাত সরিয়ে উঠে কাপড় ঠিক করে নাহিন এর কাছে চলে যেতে নিলে তৌসিফ ডেকে বলে,”ঘুম পারিয়ে আবার আমার কাছে আসো নিতু। তোমাকে আমার আরো লাগবে। তোমাকে জড়িয়ে ধরে আরো কিছু সময় ঘুমাতে চাই ।”
নিতু লাজুক হেসে চলে যায়।এভাবেই বেশ হাসি আনন্দেই দুজনের সংসার জীবন কাটতে থাকে। সুখের খোঁজ যেনো পেয়েই গিয়েছে দু’জন। নিতু শুধু দোয়া করতো এই সুখের অনুভুতি যেনো কখনো না হারিয়ে যায়।
কেটে যায় আরো পাঁচটি বছর।এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়। তপুর আরো একটা ছেলে হয়।প্রথম বাচ্চাকে এই বছর স্কুলে দিয়েছে।বৌ বাচ্চা নিয়ে বেশ ভালোই আছে তপু।
সাদিয়া,বিথি, জুঁই তিনজনই ওদের সংসার জীবনে বেশ ভালো আছে। বিথির জমজ ছেলে।বয়স তিন বছর।আর জুঁই এর এক ছেলে এক মেয়ে।সাদিয়ার এখনো বাচ্চা হয়নি।ডাক্তার দেখাচ্ছে। একটু সমস্যা আছে তাই কনসীভ হচ্ছেনা।
সেতুর এক ছেলে বয়স তিন বছর।আর সাজিদ মাস্টার্স দেবে এবার।চাকরিও খুঁজছে।চাকরি পেলে সালেহাকে আর সেলাই করতে দেবে না। পুরোপুরি রেস্ট এ চলে যাবে।সবাই যার যার মতো বেশ ভালোই দিন কাটাচ্ছে।
তুলি এখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী।আর নাহিন প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। তৌসিফ আর নিতুর ঘরে এখন আরো একজন নতুন সদস্য আছে।তুলি আর নাহিন এর জন্য ছোট এক ভাই নিয়ে এসেছে তৌসিফ আর নিতু।বয়স তিন বছর। দেখতে একেবারে তৌসিফ এর মতো।ছোট ছেলের নাম রেখেছে নিরব। এদিকে তৌসিফ এর ব্যবসা বেশ ভালো চলছে। নিতুর নামে একটা জায়গা কিনেছে । ভাবছে আরেকটা দোকান কিনবে। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে তৌসিফ।বাসায় যেকোন অনুষ্ঠানে সবাই একসাথে হয়,বেশ হাসি আনন্দে দিন কাটতে থাকে সবার।
নিতু আর তৌসিফ এর ভালোবাসা দিনদিন যেনো বেড়েই চলছে।একজন অন্যজনকে ছাড়া এখন কোন কিছু কল্পনাই করতে পারেনা।কিন্তু নিতুর কপালে হয়তো আল্লাহ সুখ বেশি দিন স্থায়ী রাখেনি ।বেশ কিছু দিন ধরে তৌসিফ এর শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা।এমন সুঠাম দেহের মানুষটা আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করতে পারছে না। খাবারে অরুচি তৈরি হচ্ছে। বেশিক্ষণ কাজ করলেই কাহিল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের কিছুই নিতুকে জানায়নি তৌসিফ।কারন ও অল্পতেই অনেক টেনশন করে।আর দেখা যাবে ডাক্তার এর কাছে যেতে বলবে যেটা তৌসিফ এর জন্য সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ। ছোটবেলা থেকেই কেনো জানি হাসপাতাল,ডাক্তার ,ঔষধ এসবে অনীহা। তাই খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তৌসিফ নিজের জন্য ডাক্তার এর কাছে যায়না। তাছাড়া তৌসিফ ভেবেছে অতিরিক্ত কাজের প্রেশারে হয়তো এমনটা হচ্ছে।তাই বিষয়টা ততোটা গুরুত্ব দেয়না।
নিতুর নজরে অবশ্য বিষয়টা এড়ায়নি।তাই আজ সকালে নাস্তার টেবিলে নিতু বলে,”আপনার শরীর কি খারাপ? ক’দিন ধরে দেখছি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছেন না,কেমন দুর্বল লাগছে দেখতে।”
যেই ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো। তৌসিফ মনে প্রানে চাচ্ছিলো যে নিতু যেনো বিষয়টা খেয়াল না করে। তৌসিফ নাস্তা খেতে খেতে বললো,”তেমন কিছু না বৌ। অতিরিক্ত কাজের ঝামেলায় হয়তো এমন লাগছে। নতুন দোকানের কাজ শেষ হলেই দেখবে ঠিক হয়ে গিয়েছি।তখন টানা কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে নেবো।”
“এসব বাহানা করে লাভ নেই।আজ বিকেলে একটু ডাক্তার দেখান। আপনাকে দেখতে কেমন রোগী মনে হচ্ছে।”
“আচ্ছা দেখা যাবে।”বলে তৌসিফ চেয়ার ছেড়ে উঠে নিতুর কাছে গিয়ে ওর কপালে আদর দেয়।আর দোকানের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। নিতু কে আর কোন কিছু বলার কোন সুযোগ দেয়না। নিতু জানতো যে তৌসিফ কে ডাক্তার দেখাতে বললে ও এমনটাই করবে।তাই নিতু একটু হতাশ হয়ে বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য রেডি হতে চলে যায়।
চলবে……..