#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৭)
#মৌমিতা হোসেন
নিতুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে। তৌসিফ এর কাছে আসায় ও বেশ ভয় পায়,বিরক্ত হয়।ওর তো ভালো লাগেনি। অনেক কষ্ট হয়েছে।এখনো হচ্ছে।এতো দিন নাটক, সিনেমায় স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্ক দেখেছে।এমন সম্পর্ক তো দেখেনি ও। মা-বাবাকেও দেখতো তারা কতো সুখি। তাহলে ওর বেলায় এমন হলো কেনো।
ধীরপায়ে হেঁটে নিতু আলমারি থেকে চাদর নিয়ে বিছানার চাদর পাল্টে দেয়।এর মধ্যে দরজায় কেউ ধাক্কা দিলে তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে বড় করে ঘোমটা দেয় যাতে গলার দাগ না দেখা যায়। দরজা খুলতে যাবে এমন সময় তৌসিফ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিতু কে থামতে বলে।নিজে গিয়ে দরজা খুলে দেখে বিথি, সাদিয়া এসেছে। তৌসিফ বলে,”কিরে এতো সকালে এসে দরজা নক করছিস কেনো?কি দরকার।”
তৌসিফ বাসার সবার সাথেই এমন একটু মেজাজ ভাব নিয়ে থাকে।তাই তপু ছাড়া বোনদের সবাই ওকে একটু ভয়ই পায়। তপু ভালো ছেলে, ঠিকমতো পড়ালেখা শেষ করে এখন চাকরি খুঁজছে, সবাই ভালো বলে তাই তৌসিফ এর সাথে ওর লাগালাগি চলতেই থাকে। তৌসিফ এর লাইফস্টাইল তপুর একেবারে পছন্দ না।এই বিয়ের আগে ও তৌসিফ কে বলেছিলো যে যদি ঠিকমতো সংসার করতে পারে তবেই যেনো বিয়ে করে । নতুবা শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন যেনো নষ্ট না করে। তৌসিফ ও বিয়েটা করতে চায়নি কিন্তু বাবার জন্য শেষমেষ করতে বাধ্য হলো।
যাই হোক বিথি ভাইয়ের কথায় উত্তর দেয়,”ভাইয়া চাচা,মা সবাই ভাবিকে আর তোমাকে ডাকছে নাস্তা খেতে।চলো।”
“হুম আসছি একটু পর। গিয়ে বল সবাইকে খাওয়া শুরু করতে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, বলছিলাম যে ভাবি কোথায়?”
তৌসিফ তাকায় বোনদের দিকে,”আছে ভেতরে।রেডি হচ্ছে।যা এখন।”বলেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাড়ান্দায় চলে যায় মাথা মুছতে মুছতে।রুমের সাথেই দক্ষিনে একটা বাড়ান্দা আছে। সেখানে খাঁচায় একটা টিয়া।সকালে কাপড় নাড়ার সময় দেখেছিলো নিতু। নিতু চুপচাপ দাঁড়িয়ে তৌসিফ এর কান্ড দেখলো আর কথা শুনলো।
তৌসিফ রুমে এসে নিতু কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,”কী ব্যাপার মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি রেডি হও।আর একটু ঢেকেঢুকে থেকো।এই ওয়েনমেন্ট লাগিয়ে নাও।”
নিতুর কেনো জানি তৌসিফ এর কথা ভালো লাগছে না।তাই কিছু না বলে চুপচাপ রেডি হলো।গয়না গুলো পড়লো।চুড়ি পরলো যাতে হাতের কাটা জায়গা দেখা না যায়।মাথায় বড় করে ঘোমটা দিতে নিলে তৌসিফ আবার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে নেয়। নিতু খানিক ভয় পেয়ে সরে গিয়ে দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে বাইরে গিয়ে দাড়ায়। এতে তৌসিফ এর বেশ রাগ হয়। নিতু কে বেশ পছন্দ হয়েছে ওর।একদম নরম তুলতুলে। দেখলে নেশা ধরে যাচ্ছে। তবে এই পছন্দ ঠিক তেমন পছন্দ নয়। দৈহিক টান বলা যায় একে।তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে পাঞ্জাবি পড়ে বের হয়। নিতুর সাথে রাগে কোন কথা বলেনা। তৌসিফ এর পেছনে পেছনে নিতু ধীরপায়ে হেঁটে ডাইনিং এ যেতেই দেখে চাচা,চাচি,বাবাসহ সবাই বসে কথা বলছে। নিতু সবাইকে সালাম জানায়।।বিথি, সাদিয়া দ্রুত এসে নিতু কে নিয়ে চেয়ারে বসায়। তৌসিফ ওর মতো করে চেয়ার টেনে বসে খাওয়া শুরু করে।অন্য সময়ে সবাই যার যার বাসাতেই খাওয়া দাওয়া করে। তৌসিফ এর বিয়ের জন্য আজ সবার এক সাথে খাওয়া দাওয়া।যাই হোক টেবিলে তপুও বসেছিলো। তপু কানের কাছে এসে তৌসিফ কে বলে,” আজতো বৌ এর জন্য অপেক্ষা কর।আর কি করেছিস ওর সাথে? মেয়েটা তো হাঁটতে ও পারছেনা।”
তৌসিফ রেগে তাকায় তপুর দিকে। কিন্তু সবাই সামনে থাকায় কিছু না বলে চুপ থাকে। তপু নিজেই পরিচিত হয় নিতুর সাথে।বয়স অনেক কম দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নিতুর জন্য মায়া হয় তপুর।নাস্তা শেষ হলে আকবর আলি তৌসিফ কে বলেন বিকেলে রেডি হয়ে নিতু কে নিয়ে যেনো ওদের বাসায় যায়। ওখানে একদিন থেকে তারপর যেনো চলে আসে।
এই কথা শুনে নিতু বেশ খুশি হয়।কারন ও আজ আর তৌসিফ এর সাথে থাকতে চাচ্ছিলোনা। মাকে খুব মিস করছে নিতু।কিন্তু তৌসিফ বাধ সাধে।বলে,”বাবা আজ আমার বন্ধুরা আসবে নিতু কে দেখতে।আর আমারও একটু কাজ আছে। তাই আজ যেতে পারবো না।কাল নিয়ে যাবো।”
এই কথা শুনে নিতুর মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা।
তৌসিফ নাস্তা শেষ করে রুমে যাওয়ার আগে নিতু কে রুমে যেতে বলে। এদিকে বিথি, সাদিয়া সহ সবাই সামনে থাকায় ইচ্ছা করে নিতু রুমে যায়না। ওদের সাথে বসে কথা বলতে থাকে। রুমে গিয়ে তৌসিফ অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে বের হয়ে দেখে তখনও নিতু ওর বোনদের সাথে গল্প করছে। দেখেই তৌসিফ এর মেজাজ বিগড়ে যায়। রেগে নিতু কে ডাকতেই ও কেঁপে ওঠে।বিথিরাও ভয় পেয়ে বলে,”আচ্ছা ভাবী তুমি রুমে যাও ভাইয়া ডাকছে। বিকেলে গল্প করবো।”
নিতু ভয় পায়। তৌসিফ এর চোখের দিকে তাকিয়েই মাথা নিচু করে ফেলে। তৌসিফ ওর হাত ধরে রুমে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।গলার স্বর উঁচু করে বলে,”কখন তোমাকে ডেকে এসেছি। এতোক্ষণ আসোনি কেনো?”
হাত কচলাতে কচলাতে উত্তর দেয়,”সবাই গল্প করছিলো তাই..”
কথা শেষ হবার আগেই তৌসিফ এসে ওর গাল চেপে ধরে বলে,”এরপর থেকে আমি ডাকলে যেনো সাথে সাথে সামনে হাজির থাকো।এর ব্যাতিক্রম হলে খবর আছে।”
নিতু কেঁদে দেয়। কাঁপা কন্ঠে বলে,”আ..র কখনো এমন হবে না। আমি ব্যাথা পাচ্ছি। দয়া করে ছাড়ুন আমাকে।”
নিতুর কান্না দেখে তৌসিফ ওকে ছেড়ে দিয়ে আকষ্মিক ঘর ছেড়ে বাইরে চলে যায়। নিতু কিছুই বুঝতে পারেনা। তবে এই পনেরো দিনের ভালোলাগাটা আস্তে আস্তে যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। তৌসিফ দুপুরে বাসায় খেতে আসে না। নিতুর অবশ্য তৌসিফ না থাকায় ভালো লাগছে। দুপুরে খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ চাচি,বিথি, জুঁই সবার সাথে গল্প করে রুমে এসে কখন যে নিতু ঘুমিয়ে পরে টেরই পায়নি।সমস্ত শরীর ব্যাথায় নিতুর কিছু ভালো লাগছিলো না।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যায় তখনো তৌসিফ ঘরে না ফিরলে আকবর আলির চোখে লাগে। তিনি তৌসিফ কে ফোন দেয়।কাজ,ব্যস্ততা ইত্যাদি জানিয়ে লাইন কেটে দেয় তৌসিফ।আকবর আলি বুঝতে পারে ইচ্ছা করেই আজ নিতু কে ঐ বাসায় নিয়ে যায়নি তৌসিফ। হয়তো বন্ধুদের সাথে বসে কোথাও আড্ডা দিচ্ছে।।মন খারাপ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করে এবার যেনো ছেলেটা ঘরমুখো হয়,অসৎসঙ্গ ত্যাগ করে।
এদিকে নিতু সন্ধ্যার পর মাকে ফোন দিয়ে অনেকক্ষন কথা বলে। সাজিদ,সেতু ও কথা বলে।ওরা বারবার নিতুরা কখন বাসায় যাবে সেটা জানতে চায়। নিতু বলে যে পরদিন যাবে। তৌসিফ কেনো আজ ওকে বাসায় নিয়ে গেলো না সেটা ও আর ভাবতে পারলো না। নিতুর কাছে সব কিছু খুব অদ্ভুত লাগে। ছোট্ট এই জীবনে কখনো প্রেম ভালোবাসার পাল্লায় পড়েনি।বাবা-মা এর ভালোবাসা দেখে ভাবতো সব স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনে হয় এমনি সুন্দর মিষ্টি সম্পর্ক থাকে। তৌসিফ কে দেখার পর থেকে গতো পনেরো দিন নিতুও ওকে নিয়ে সময়ে অসময়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু কাল রাতের পর থেকে ওর আর ভালো লাগছেনা।সব কিছুই বিরক্ত লাগছে। মনে মনে ঠিক করে বাসায় গিয়ে মাকে বলবে বিষয়টা। ভাবতে ভাবতে কখন যে অনেক রাত হয়েছে নিতু সেটা টেরই পায়নি।
রাত দশটা বাজলে ও তৌসিফ বাড়ি না ফিরলে আকবর আলির নিতুর জন্য খারাপ লাগে। তিনি নিতুর কাছে এসে বলেন,”একটা জরুরী কাজ পরে যাওয়ায় তৌসিফ এর আসতে দেরী হবে মা।তুই নাহয় খেয়ে শুয়ে পর।তোর শ্বাশুড়ি থাকলে এসব দায়িত্ব সেই পালন করতো।আর আমার ছেলেটাও হয়তো এমন হতো না কিন্তু কি করবো বল সবই ভাগ্য।আস্তে আস্তে সংসার এর দায়িত্ব তোকেই বুঝে নিতে হবে মা। আমি তাহলে এখন যাই শুয়ে পরি।”
নিতু কিছুই বলেনা। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। হালকা জ্বর অনুভব করায় কিছু না খেয়েই শুয়ে পরে।আজও গভীর রাতে হঠাৎ কারো স্পর্শে ঘুম ভাঙে নিতুর। উঠতে গেলেই তৌসিফ এর কন্ঠস্বর শুনে কি করবে ভেবে পায়না। নিতুর তখন ভালোই জ্বর শরীরে,প্তচন্ড মাথা ব্যাথা সাথে শরীর ব্যাথা। তৌসিফ যখন নিজের কাজে ব্যস্ত তখন কষ্টে এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিতু বাধা দেয় তৌসিফ কে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”প্লিজ আমাকে এখন ছাড়ুন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেক ব্যাথা হয়।”
বেসামাল তৌসিফ নিতুর কোন কথাই শোনে না। শুধু বলে,”সারাদিন ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর নয়।তাই চুপ থাকো।”উন্মাদের মতো তৌসিফ নিতু কে ভোগ করে।কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে আজ এক পর্যায়ে নিতু জ্ঞান হারায়।কখন যে ভোর হয় টেরই পায়না নিতু। তৌসিফ এর ডাকে নিতুর জ্ঞান ফেরে।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিতু কে ডাকছে। নিতু দ্রুত উঠতে গিয়েও পারেনা উঠতে। তৌসিফ মনে হলো একটু স্বস্তি ফিরে পায়। নিতু কে বলে,”তোমার অবস্থা দেখেতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।এই টুকুতেই এই অবস্থা?বাকি জীবন তোমাকে নিয়ে কীভাবে কি হুম? উঠে ফ্রেশ হয়ে ওষুধ খাও।তারপর রেডি হও।আজ তোমার বাসায় যাওয়ার কথা।”
নিতু এতোক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে সব শুনেছে। কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি।ভয়, ঘৃনা,লজ্জা সব ঘিরে ধরেছিলো ওকে। বিছানা থেকে কোনরকম নেমে ওয়াশরুমে যাবে তখনি তৌসিফ আবার ডাকে। একটু আমতা করে বলে,”স্বামী-স্ত্রীর এসব কথা আবার বাইরে অন্য কাউকে বলো না যেনো।”
নিতু হালকা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে যায়। খুব কষ্ট হচ্ছিলো নিতুর।রেডি হয়ে দুজন একসাথে নাস্তা করে । নিতু ওষুধ খায়। সবাই নিতু কে দেখে জিজ্ঞেস করে নিতুর কি হয়েছে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে ও অসুস্থ।তৌসিফ বলে যে জ্বর হয়েছে।এসব বলে কাটিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি নিতুর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
নিতুর মায়ের বাড়িতে আজ উৎসব। বিভিন্ন রান্নার আয়োজন চলছে। জামাই আসবে বলে কথা। সাজিদ, সেতু মহাখুশি। দুপুরে ওরা বাসায় পৌঁছালে সালেহা এসে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। নিতু মাকে ধরে কেঁদে দেয়। সালেহা নিতু কে দেখে আঁতকে ওঠে। মেয়েকে দেখে মায়ের মন কেনো জানি বলছে মেয়ে ভালো নেই।শরীরের উত্তাপ টের পায় সালেহা।মেয়ের করুন মুখের দিকে তাকাতেই তৌসিফ এসে সালাম জানায়।আর বলে,”মা আসলে বিয়ের অতিরিক্ত ধকলের জন্য নিতুর পড়শু থেকেই জ্বর। আপনি চিন্তা করবেন তাই জানানো হয়নি। ওষুধ খাচ্ছে কমে যাবে ইনশাল্লাহ।”
সালেহা আর কথা বাড়ায়না। দুজনকে নিতুর রুমে নিয়ে গিয়ে রেস্ট নিতে বলে রুম থেকে বের হয়। কিন্তু বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে সালেহার।মায়ের মন হয়তো এমনি। সন্তানের কিছু হলে না বলতেও টের পেয়ে যায়।
চলবে….