#সুখের খোঁজে….(সূচনা পর্ব)
#মৌমিতা হোসেন।
ভোর বেলা উঠে নামায পড়ে বই নিয়ে বসেছে নিতু।আর মাত্র পনেরো দিন পর এসএসসি পরীক্ষা।অথচ এখনো অনেক পড়া বাকি।নিতু ভেবে পায়না এতো পড়ার কি দরকার।সেই তো বিয়ে দিয়ে দেবে। সংসার করবে,বাচ্চা লালন-পালন করবে।নিতুর ঘরের কাজ করতে খুব ভালো লাগে।মায়ের সাথে সব কাজে সাহায্য করে নিতু। শুধু পড়তে ইচ্ছে করেনা ওর।নিতু মায়ের কাছে গিয়ে বলে,’মা পড়াশোনা না করলে কি হবে? আমার কাছে অনেক কঠিন লাগে, পড়তে ভালো লাগে না। কিছুই মাথায় ঢোকেনা।’
মা সালেহা চা বানাচ্ছিলো।চা বানাতে বানাতে বলে,’একটু কষ্ট করে পড় মা।এখন পড়াশোনা না করলে কেউ দাম দেয়না।অন্তত এইচএসসি পাশ কর। নাহলে ভালো জায়গায় বিয়েও দিতে পারবো না তোকে। আল্লাহ জানে তোর কি হবে।’
নিতু মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,’যা হবে ভালো হবে। আমি তো সব পারি মা। শুধু পড়ালেখা করতে আমার ভালো লাগে না। অনেক কঠিন লাগে।’
মা দোয়া ইউনুস,আয়তাল কুরসি মনে মনে পড়ে ফুঁ দিয়ে দেয়।বলে,’যা এবার দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিয়েছি। এবার পড়তে বস।দেখবি সব পড়া মাথায় ঢুকবে। এখন যা আমাকে চা বানাতে দে।সেতু আর সাজিদ কে ডেকে উঠা।সকাল সাতটা বেজে গেলো এখনো ওঠার নাম নেই এই দু’জন এর। পড়তে বসবে কখন। ওদের ডেকে তুইও পড়তে বস। আমি চা নিয়ে আসছি।’
নিতু জানে ইচ্ছা না থাকলেও বাবার জন্য ওকে পড়তে হবে,পাশ করতে হবে। নাহলে বাবা ফয়সাল আহমেদ অনেক কষ্ট পাবে। ভাবতে ভাবতে সেতু আর সাজিদ কে ডাকতে থাকে।সেতু আর সাজিদ হলো নিতুর ছোট বোন আর ভাই।সেতু অষ্টম শ্রেণীতে আর সাজিদ চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে।এরা দু’জনই পড়াশোনায় ভালো। ওদের ডাকতেই উঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে।
নিতুরা থাকে মিরপুর চৌদ্দ নম্বরে।তিন রুমের বাসা । বাসাটা এখন ওদের জন্য ছোট হলেও ভাড়া কম হওয়ায় এখানেই থাকছে প্রায় বারো বছর ধরে।এই বাসার ভাড়া সব মিলিয়ে বারো হাজার।ফয়সাল সাহেব একজন সরকারি কর্মচারী।যা বেতন পায় তা দিয়ে এর বেশি ভাড়া দিয়ে থাকা ওনার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কষ্ট করে চলতে হলেও ওদের মনে শান্তি ছিলো।বেশ হাসি-আনন্দেই দিন কাটে ওদের।পড়ার মাঝেই মা সবার জন্য চা ,বিস্কিট নিয়ে আসে। সবাই চুপচাপ খেতে থাকে। নিতু কাপ রাখতে গিয়ে বলে,’মা আমি তোমাকে কাজে সাহায্য করি? তোমার তো কষ্ট হচ্ছে।’
মা খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলে,’তোর সামনে পরীক্ষা।একটু তো পড় । রেজাল্ট খারাপ হলে তোর বাবা খুব কষ্ট পাবে বলে দিলাম।’
নিতু বুঝতে পারে অযুহাত দেখিয়ে লাভ নেই।তাই গিয়ে পড়তে বসে।
এদিকে নিতুর মা তাড়াতাড়ি করে ভাত,ডাল রান্না করে, আলুভর্তা বানায়। সবাই সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে যায়।নিতুর বাবা অফিসে যায়। ওদের বিদায় দিয়ে দুপুরের রান্না বসায় সালেহা। সপ্তাহে দুই/তিন দিন অবশ্য সকালে ডিম ভাজিও থাকে। যেদিন ডিম থাকে সেদিন সাজিদ বেশ খুশি থাকে।এই বাজার দরে অল্প আয়ে প্রতি বেলায় ভালো খাবার যোগান দেয়া ফয়সাল সাহেব এর জন্য বেশ কষ্টকর।তাই একটু হিসাব করে চলতে হয়। মেয়েদের বিয়ের জন্য কিছু সঞ্চয়ও করতে হয়।মাথায় থাকে সব সময় এতো এতো চিন্তা।
নিতু পড়াশোনায় তেমন ভালো না হলেও কাজেকর্মে বেশ দক্ষ। সেলাই, রান্না এসবই পারে।শান্ত স্বভাবের, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।এক কথায় লক্ষি মেয়ে হলো নিতু। কিন্তু পড়াশোনায় ভালো না হওয়ায় বাবা খুব চিন্তিত নিতু কে নিয়ে।
অফিস থেকে এসে আজ ফয়সাল সাহেব এর শরীরটা কেমন জানি লাগছিলো। বুকে কয়েকদিন ধরেই চিনচিনে ব্যাথা করছে।ডাক্তার দেখানো দরকার কিন্তু খরচের ভয়ে যাচ্ছেনা।এই মাসে এখনো ছেলের স্কুলের বেতন দেয়নি।নিতুর পরীক্ষা সামনে তাই ওর জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হয়েছে আর এজন্যই সাজিদ এর বেতনটা দেয়া হয়নি। স্কুলে গিয়ে আজ বলে এসেছে সমস্যার কথা। আগামী মাসে একসাথে দুই মাসের বেতন দেবে।নিম্ন মধ্যবিত্ত দের এভাবেই চলতে হয়। অনেক দিন ধরে ভাবছে সালেহাকে একটা সুতির শাড়ি কিনে দেবে। খরচের প্রেশারে সেটাও হয়ে উঠছে না।ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো এভাবেই সব চাপা পরে যায় প্রয়োজনের কাছে।প্রয়োজন মেটানোই যেখানে দায় সেখানে এসব ইচ্ছা কীভাবে পুরন করবে সে। বর্তমান বাজার দরের সাথে যেনো কোনভাবেই পেরে ওঠেনা নিতুর বাবা।সব মিলিয়ে আজ কিছুটা অসহায় বোধ করছে। ফয়সাল সাহেব ডাকে নিতু কে।
নিতুর আজ শেষ স্কুল ছিলো।শাড়ি পরে গিয়েছিলো।সব বান্ধবীরা পরিকল্পনা করে শাড়ি পরে।নিতুর স্বাস্থ্য ভালো,গায়ের রং ফর্সা,লম্বা চুল। তবে দেখতে খুব যে সুন্দরী সেটা নয়। মোটামুটি চেহারা। লম্বা হওয়ায় শাড়ি পরার পর নিতু কে আজ দেখতে বেশ ভালো লাগছে।ওর চেয়ে সেতু দেখতে বেশি ফর্সা না হলেও বেশ মিষ্টি ।আজ স্কুলে সবাই মিলে বেশ মজা করে, অনেক ছবি তোলে। স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠান থাকায় আজ নিতুর বাসায় আসতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। এসে দেখে বাবা চলে এসেছে।বাবার ডাকে নিতু দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে বাবা?ডেকেছো আমাকে?’
বাবা নিতু কে দেখে অবাক হয়।ভাবে কতো বড় হয়ে গেছে মেয়েটা।সেই ছোট্ট পরীটা আজ শাড়ি পড়েছে।বাবা বলে,’মাশায়াল্লাহ। আমার মেয়েকে দেখতে আজ অনেক সুন্দর দেখা যাচ্ছে।কতো বড় হয়ে গিয়েছিস তুই।’
নিতু বাবার কথায় লজ্জা পায়।বলে,’বাবা আজ বিদায় অনুষ্ঠান ছিলো তাই আজ মায়ের এই শাড়িটা পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘হুম বুঝতে পেরেছি। আমার কাছে এসে একটু বসবি আম্মু?তোর সাথে একটু কথা ছিলো।’
নিতু সাথে সাথে এসে বাবার গলাটা জড়িয়ে ধরে বসে পরে।বলে,’বলো বাবা কি হয়েছে। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
‘হুম একটু খারাপ লাগছে আজ। বুকটা ব্যাথা করছে। কিন্তু আমি ডেকেছি অন্য কথা বলতে।’
‘বলো বাবা শুনছি আমি ‘
‘শোন মা পড়াশোনা ছাড়া জীবনে কেউ মুল্য দেবে না এই যুগে। আর মাত্র কয়দিন বাকি আছে পরীক্ষার। একটু ভালো করে পড় যেনো ভালো ভাবে পাশ করতে পারিস।কার কখন কি হয় সেটা কি কেউ বলতে পারে? আমি এখন আছি কাল তো নাও থাকতে পারি।জীবনে বিপদে পড়লে যেনো কখনো কারো কাছে হাত পাততে না হয়। পড়াশোনা করে যেনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারিস অন্তত এতো টুকু পড়াশোনা কর আম্মু।’
বাবার কথা শুনে নিতুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। পড়ালেখা করতেই তো ওর যেনো অনেক কষ্ট। তবুও নিতু বলে,’বাবা আমি পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করবো দেখে নিও। তোমার সম্মান আমি রাখবো।চিন্তা করোনা। তুমি শুধু দোয়া করো আমার জন্য।’
বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিতু পোশাক পরিবর্তন করে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে।বাবার কথায় নিতুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিতু বাবার কথা ভাবে আর মনে মনে বলে,’ইচ্ছে না হলেও আমি পড়বো বাবা।দেখে নিও আমি ভালো রেজাল্ট করে তোমাকে দেখাবো।’
পরদিন ভোরে উঠেই নামায পড়ে পড়তে বসে নিতু।সেতু, সাজিদ ঘুম থেকে উঠে বোনের পড়ার ধরন দেখে বেশ অবাক হয়। পরবর্তী কয়দিন নিতু খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। পরীক্ষা গুলো মোটামুটি ভালোই হয়।পড়ার পর নিতুর খুব আফসোস হয় কারন ও দেখলো পড়াগুলো খুব সহজ। আগে থেকেই পড়লে হয়তো আরো ভালো হতো পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হয়।
পরীক্ষা শেষ হবার এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ একদিন নিতুর বাবার বুকে ব্যাথা বেড়ে যায়। সকাল থেকেই ব্যাথা করতে থাকায় অফিসে যায়নি।নিতুর বাবা সালেহাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বলে,’এতোগুলো বছরে তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি সালেহা।এজন্য মাফ করে দিও। আমি না থাকলে মেয়েদের দিকে খেয়াল রেখো। নিজের যত্ন নিও। তুমি তো নিজের বেলায় খুব উদাসীন। এভাবে উদাসীন না হয়ে নিজের দিকেও একটু নজর দিও। আমার কিছু হলে ওদের দিকে খেয়াল রেখো।’
কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো তাই সালেহা স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘নিতুর আব্বু আপনার কি শরীর বেশি খারাপ লাগছে?কি সব আবোল তাবোল বকছেন?কোনো কিছুতেই আমার কোনো আফসোস নেই। আপনার সাথে আমি খুব সুখে সময় কাটিয়েছি।তাই এসব বাজে কথা রেখে চুপ করে রেস্ট নিন। আপনার এসব কথা আমার ভালো লাগছে না।’
কথাগুলো বলতে বলতে সালেহার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো। হঠাৎ এসব কথা শুনে নিতুর মায়ের মনের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে।
সন্ধ্যার পর ফয়সাল সাহেব এর শরীর বেশি খারাপ হয়ে যায়। সেটা দেখে মা নিতু কে ডেকে বলে,’নিতু মা তাড়াতাড়ি সামনের ফার্মেসি থেকে আসিফ ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয়।তোর বাবা কেমন জানি করছে।’
ডাক্তার আসিফ সামনের ফার্মেসি তে বসে। অনেক বছর ধরে এখানে আছে তাই নিতুদের পরিবারের সবাইকে খুব ভালো করেই চেনে। বিপদে আপদে ডাকলেই চলে আসে।নিতু দের সবাইকে বেশ আদর করে। সাজিদ কে দেখলেই চকলেট অথবা একটা পাঁচ টাকার কেক ধরিয়ে দেয়। এসবের জন্য ওরা সবাই ডাক্তার চাচাকে বেশ পছন্দ করে। এলাকায় ওনাদের নিজেদের বাড়ি। দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখের সংসার।ভালো এবং অমায়িক মানুষ হিসেবে এলাকায় ও ওনার বেশ পরিচিতি।
নিতু ওড়নাটা কোন রকম মাথায় দিয়ে দৌড়ে গেলো ফার্মেসিতে।আসিফ দেখেই বললো,’কি হয়েছেরে নিতু? এভাবে হাপাচ্ছিস কেনো?’
নিতু বলে,’চাচা দয়া করে তাড়াতাড়ি একটু বাসায় চলুন।বাবা কেমন জানি করছে।’
আসিফ তাড়াতাড়ি চেম্বার বন্ধ করে নিতুর বাসায় যায়। গিয়ে দেখে নিতুর বাবার অবস্থা ভালো নয়।হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। উনি দ্রুত এলাকায় কয়েকজনকে নিয়ে এম্বুলেন্স এ করে স্থানীয় এক হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাথে নিতুর মা আর নিতু ও যায়। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়না। হাসপাতালে নিতে নিতে এম্বুলেন্স এর ভেতরেই ফয়সাল সাহেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাসপাতালে ডাক্তার ওনাকে মৃত বলে ঘোষনা দিলে নিতুর মা কান্নায় ভেঙে পরেন।এক সময় সেন্সলেস হয়ে যায়।আর নিতু নিশ্চুপ, নির্বাক চেয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে……
চলবে।