সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ১১
#লেখা : রায়না মনি
ধারা এখন ছাদে দোলনার উপর বসে আছে। মনটা একেবারে ব্যাথায় পরিপূর্ণ!
কিছুতেই মন থেকে সকালের দেখা সেই দৃশ্য সরাতে পারছে না। পুরো ক্লাসেও আজ একটুও মন দিতে পারেনি। খুব অমনোযোগী ছিল বলে ম্যামের কিছু কথাও শুনতে হয়েছে! কিছু খেতেও পারেনি। দুপুরের খাবার খেতে বসে উঠে গিয়েছিল বলে, আম্মু ভাত মেখে খাইয়ে দিতে আসছিল। তাও খায়নি দেখে আম্মু কতক্ষণ বকাবকি করেছে!
কিছু খাবে না ধারা। না খেয়ে খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলেও আজ কিছু খাবে না।
ধারা কয়েক বার ফেসবুকে ঢুকে ঘুরে আসছে, অঝোরের কোনো খবর নেই। ওর পাঠানো ম্যাসেজটা সিন হয়েছে, কিন্তু কোনো রিপ্লাই আসেনি। হয়তো অঝোর চিনতে পেরেছে এই আইডি ওর, হয়তো বা চিনতে পারেনি ! মনের টান থাকলে অঝোর ঠিকই চিনতে পারবে।
ধারার আর বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছে করছে এক দৌঁড়ে অঝোরদের বাসায় গিয়ে অঝোরের সাথে কথা বলতে !
ধারা কতক্ষণ ছাদে হাঁটাহাঁটি করলো। জীবনে ঘটে যাওয়া ভালো ভালো কিছু মুহূর্তের কথা স্মরণ করলো, ছোট বেলার কথা স্মরণ করলো, তাও মন থেকে সেই বেদনাদায়ক দৃশ্য সরাতে পারলো না!
ধারার শুধু ভয় হচ্ছে অঝোর ওর কাছ থেকে হারিয়ে যাবে নাতো ! অঝোর হারিয়ে গেলে ধারা কীভাবে থাকবে? অসম্ভব! অঝোর শুধু ওর, শুধুই ওর।
এরপর অঝোর বাসায় আসলে অঝোরের কাছে সব কিছু বলে দিবে। অঝোরকে নিয়ে ওর মনে যত অনুভূতি আছে, সব প্রকাশ করে দিবে।
সন্ধ্যার পরে ধারা ব্যালকনিতে বসে বসে ভাবছে ঠিক কীভাবে অঝোরকে কথা গুলো বলবে। আদৌ কি কথা গুলো গুছিয়ে বলতে পারবে? না বলতেই হবে। গুছিয়ে পারুক আর যেভাবে পারুক বলতেই হবে।
অস্বস্তি, উত্তেজনা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বাইরে বৃষ্টিতে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম। মাঝে মাঝে দমকা শীতল হাওয়া এসে ধারাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে, তাও ধারা ঘেমে যাচ্ছে। কী যে এক ভোঁতা অনুভূতি হচ্ছে ওর! একটু শান্তি পাচ্ছে না মনে । যতক্ষণে না অঝোরের কাছে সব খুলে বলতে পারবে, ততক্ষণে হয়তো আর শান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
…
কোনো রকমের কেটে গেল দুটো দিন। ধারা এখন সোফার উপরে শুয়ে আছে। বাসায় ও একা । আব্বু আর মা আব্বুর এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছে, দাওয়াত ছিল। ধারা যায়নি, ওর এখন মন মেজাজ একদম ভালো নেই তাই। ধারার মাথায় এখন নানা ধরণের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তা করতে করতেই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো, বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছে। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠায় ধারার ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গেল। ধারার মন বলে উঠলো অঝোর এসেছে। ধারার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ধারা হন্তদন্ত হয়ে উঠে দৌঁড় লাগালো দরজার দিকে।
যখন দরজা খোলার জন্য হাত বাড়ালো তখন খেয়াল হলো নিজের দিকে। এ কী অবস্থা ওর! গায়ে পরা টপস কুঁচকে রয়েছে, জিন্স এক পায়ের প্রায় হাঁটু পর্যন্ত গুঁটিয়ে রাখা, আর এক পা ঠিকঠাক মতো আছে। হায় হায় এই অবস্থা ও কখন করলো? তড়িঘড়ি করে ঠিক করে ফেললো।
তারপর খেয়াল হলো ওর গায়ে ওড়না নেই। এসব কী হচ্ছে! ওড়নাটা কোথায়? সোফার দিকে তাকিয়ে দেখলো ওড়নাটা সেখানে পড়ে আছে। দৌঁড়ে গিয়ে ওড়নাটা সুন্দর ভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো। চুল গুলোও এলোমেলো হয়ে আছে, থাকুক এখন চুল ঠিক করার সময় নেই। দু দিন ধরে এমন আউলা জাউলা ভাবে থাকতেই ভালো লাগছে।
দরজার কাছে গিয়ে ধারা আগন্তুক ব্যক্তির প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“দরজার ওপাশে কি আপনি ?”
ধারার কথা শুনে অঝোর কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এটা কেমন প্রশ্ন? সবাই প্রশ্ন করে, ‘ কে ? বা কে আসছেন?’
আর ধারা কী প্রশ্ন করলো। ধারা কি তবে দেখেছে যে ও এসেছে? নাকি অন্য কারো আসার কথা আছে?
“কাকে ভাবছো তুমি? তুমি যাকে ভাবছো সে আসেনি, আমি আসছি ।”
অঝোরের কথা শুনে ধারা খিলখিল করে হেসে উঠলো। বলে কী অঝোর? অঝোর তো আর জানেনা ও অঝোরকে ভেবেই এই কথা বলেছে। অঝোরটা একদম কিছু বুঝে না!
ধারা দরজা খুলে দিয়েই বললো,
“আমি যাকে ভেবেছি সে ই এসেছে ।”
অঝোর বাসার ভিতর ঢুকে বললো,
“ওহ, তুমি হয়তো দেখেছো যে আমি এসেছি। আমি ভেবেছিলাম অন্য কেউ আসার কথা ছিল হয়তো।”
“না আমি আপনাকে দেখিনি, আমি তো জাস্ট অনুমান করলাম ।”
“কী বলো ! এমন অনুমান ও করা যায় নাকি? আমার তো আজকে আসার কথা ছিল না, তুমি তো জানতে না যে আমি আসবো। হঠাৎ করে এমন অনুমান কী করে করা যায়?”
“আমি এমন অনুমান করতে পারি । কে পারে বা পারে না আমার জানা নেই, তবে কিছু কিছু মানুষকে নিয়ে আমি খুব ভালো অনুমান করতে পারি।”
“ও আচ্ছা । আঙ্কেল কোথায় ?”
“বাসায় নেই ।”
“আজকে তো ছুটির দিন, আজকে তো বাসায়ই থাকার কথা।”
“আব্বু তার বন্ধুর বাসায় গেছে।
আপনি তো আমাদের বাসা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে, আমাদের কথা ভুলে যান!”
“কেন তোমার এমন মনে হলো? তোমাদের ভুলে গেলে এখন কি তোমাদের বাসায় আসতাম?”
“এমন মনে হওয়ার কারণ আছে বলেই মনে করলাম । সেই যে একদিন এসে একটু দেখা করে গেলেন, আর তো আসলেন না! অথচ বাসার সামনে দিয়ে যাওয়া আসা ঠিকই করেছেন !”
“খুব যে তোমাদের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করেছি তা কিন্তু না । দু দিন একটু বাজারে গিয়েছি ।”
ধারার আবার সেদিনের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। রাগ, কষ্ট সব মিশে এক হয়ে গেল। একটু রাগী সুরেই বললো,
“হ্যাঁ বাজারে যাওয়ার নমুনা তো দেখতেই পেয়েছি।”
ধারার কথার মধ্যে কিছু যে একটা ছিল তা অঝোর বুঝতে পারলো না। অঝোর বললো,
“আন্টি কোথায়? আন্টিকে একটু ডেকে দাও। আমি আজকেই ঢাকা চলে যাব তাই একটু তাড়া আছে ।”
অঝোরের কথা শুনে ধারার কষ্ট গুলো আরও বেড়ে গেল!
আজকেই চলে যাবে, অথচ এখন এসে কীভাবে তাড়া দেখাচ্ছে! একটু বেশি সময় নিয়ে আসলে কী হতো? যেভাবে তাড়া দেখাচ্ছে তাতে মনের কথা গুলো কি আজ বলে দিতে পারবে? আজ না বলা গেলে, দেখা যাবে আর হয়তো কথা গুলো বলার কোনো পরিস্থিতিই থাকবে না। অঝোর অন্য কারো হয়ে বসে থাকবে! আজ বলতেই হবে। কী কী বলবে সেটা ভাবতে গিয়ে টের পেল ও কাঁপছে। না অঝোরের সামনে বসে এসব ভাবা যাবে না। ভাবতে গেলে দেখা যাবে কাঁপাকাঁপি বেড়েও যেতে পারে। ধারা অঝোরের সামনে থেকে একটা দৌঁড় দিলো। এক দৌঁড়ে নিজের রুমে এসে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।
অঝোর ধারার এমন কাণ্ড দেখে অতি বিস্মিত হয়ে বসে আছে। ধারা এমন করলো কেন? ও কী বললো আর ধারা কী করলো? বললো আন্টিকে ডেকে দিতে, আর ধারা কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে টিমিয়ে এমন ভো দৌঁড় লাগালো। কাউকে ডেকে আনতে এভাবে দৌঁড়ে যাওয়া লাগে? অঝোর অপেক্ষা করতে লাগলো ধারা আন্টিকে নিয়ে নিচে আসার।
ধারা কিছুটা সময় পার হওয়ার পর নিজেকে স্বাভাবিক করে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসলো। এসে অঝোরের সামনে দাঁড়ালো। ধারাকে একা আসতে দেখে অঝোর বললো,
“কী ব্যাপার আন্টি আসলো না ?”
“আপনার আন্টি বাসায় থাকলে তো আসবে। মা ও আব্বুর সাথে গেছে।”
“তাহলে তুমি অমন ভাবে দৌঁড়ে কোথায় গিয়েছিলে?”
“গিয়েছিলাম এক জায়গায়। আপনি একটু আমার সাথে আসেন তো।”
“কোথায় যাবো ?”
“আসেন । আসলেই দেখতে পাবেন।”
“ধারা আমার সময় নেই আমার তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।”
“কী তখন থেকে শুধু তাড়া দেখিয়ে যাচ্ছেন! এতই যখন তাড়া তখন আসলেন কেন? আমাদের বাসায় আসলেই আপনার তাড়া থাকে ! আমি সব সময় খেয়াল করেছি এটা!”
অঝোর কিছুই বুঝতে পারছে না যে ধারার কী হয়েছে। ধারাকে দেখে ঠিক মনে হচ্ছে না। এই যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে নেই। পা দুটো কেমন কেমন করে যাচ্ছে, ঘামছে । হলো টা কী ধারার ?
অঝোরের ভাবনার মাঝেই ধারা বলে উঠলো,
“কী হলো বসে আছেন কেন? আসুন একটু আমার সাথে । আমার একটু কথা আছে আপনার সাথে ।”
“কথা থাকলে বলো। এখানে বসেই তো শুনতে পারি ।”
“না এখানে বসে শুনলে বুঝতে পারবেন না। আমার সাথে আসুন।”
অঝোর আর কথা বাড়ালো না। কিছু বলেও এখন লাভ হবে না, ধারা নাছোড়বান্দা। তাই বললো,
“আচ্ছা চলো ।”
ধারা অঝোরকে নিয়ে ছাদে আসলো। চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে, ধারা আকাশের দিকে তাকালো। দেখলো শ্রাবণের আকাশটা কালো মেঘে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। যে কোনো মুহূর্তেই আবার বৃষ্টি নামবে। সকালেও ঝুম বৃষ্টি ছিল। কিছুটা সময় সব কিছু শান্ত ছিল। আর এখন সময়টা বিকালে বেলা। এখনও আবার বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব।
অঝোর এসে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালো। তারপর বললো,
“কী বলবে এবার বলো ।”
ধারা যেনতেন না ভেবেই বলে ফেললো,
“আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে ?”
ধারার কথায় অঝোর অবাক চোখে ধারার দিকে তাকালো। এসব কথা ধারা কেন জিজ্ঞেস করছে ? অঝোর বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললো,
“গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা তা জেনে তুমি কী করবে ?”
ধারা স্পষ্টভাবে বললো,
“আছে আমার দরকার আছে…
আপনি শুধু বলুন আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে কি না ?”
অঝোর অবাক হলেও এবার মজার ছলেই বললো,
“গার্লফ্রেন্ড তো নেই, তবে হতেই বা কতক্ষণ !”
অঝোরের কথা শুনে ধারার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। কী বলছে এসব অঝোর? গার্লফ্রেন্ড হতেই বা কতক্ষণ! তার মানে ওই মেয়েটার সাথে? না আর ভাবতে পারলো না এটা নিয়ে। রাগে অভিমানে অঝোরকে বলেই ফেললো,
“এসব কী বলছেন আপনি ?”
অঝোর ধারার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো,
“কেন কোনো ভুল বলে ফেললাম কি ?”
ধারার এবার খুব রাগ হলো অঝোরের প্রতি! মনে মনে বললো,
“ভুল তো আগে থেকেই করে বসে আছেন। আচ্ছা আপনার কি কোনো রুচিবোধ ও নেই নাকি ?
পৃথিবীতে এত মেয়ে থাকতে ওই অসভ্য মেয়েটাকেই কেন আপনার গার্লফ্রেন্ড বানাতে হবে ? ওর থেকে তো নাইজেরিয়ার কালো মেয়েরাও কত ভালো। আর আপনি কিনা ওই মেয়েকে চয়েস করেছেন!”
ধারা মনে মনে একটা ভেংচিও কাটলো। ধারার মনে পড়লো আরে ও তো এখন এসব নিয়েই ভেবে যাচ্ছে। এসব নিয়েই যদি সময় পার করে তাহলে নিজের কথা বলবে কখন? আর তাছাড়া অঝোর তো বলেছে গার্লফ্রেন্ড হতে পারে, ওই মেয়েটাকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে তো ফেলেনি। না এসব নিয়ে ভাবলে হবে না , আগে নিজের কথা বলতে হবে। ধারা অঝোরের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
“আপনাকে আমি আরও কিছু বলতে চাই ।”
“বলার জন্যই তো তুমি এখানে নিয়ে এসেছো। আরো কিছু জানতে চাওয়ার থাকলে তা জিজ্ঞেস করতে পারো, কোনো সমস্যা নেই ।”
ধারা কথা গুলো কীভাবে বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। আবারও আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
“না মানে… আসলে কী হয়েছে…”
অঝোর ধারাকে এমন করতে দেখে ওকে ধাতস্থ করে বললো,
“তুমি নির্ভয়ে বলো ।”
চলবে…