সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ১০
#লেখা : রায়না মনি
ধারা ওর মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অঝোরের দিকে তাকালো। আনন্দের সাথে বললো,
“আপনি আজকে সত্যি সত্যি আসছেন আমি প্রথমে ভাবতেই পারিনি। আমি তো ভেবেছিলাম আমি রোজকার মতো স্বপ্ন দেখছি ।”
ধারার কথায় অঝোর একটু অবাক হলো, রোজকার মতো স্বপ্ন মানে ? ধারা কি ওকে নিয়ে রীতিমতো স্বপ্ন দেখাও শুরু করে দিয়েছে ? অঝোর একটু চিন্তিত হলো।
ধারাকে এটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করে বললো,
“ধারা তোমার মাথা ঠিক হইছে ?”
ধারা প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। শুধু মিষ্টি করে হাসলো। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
” আপনার তো এক মাস পরে আসার কথা ছিল, তা আপনি এক মাস আগেই চলে আসলেন যে ?”
“এক মাস আগে আমায় আসতে হয়েছে কারণ, বাস তো আর ঢাকা থেকে খুলনা আসার টিকিটে পুরো দেশ ঘুরাবে না ।”
ধারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তার মানে আমি যখন আপনাকে ফোন করে ছিলাম তখন আপনি বাসে ছিলেন ?”
“হুম। সময় অনুসারে আমার সে সময় বাসেই থাকার কথা।”
“কিন্তু আপনি আমায় এক দুমাস পরে আসবেন বললেন কেন ? আর আপনি তো বলেছিলেন আসার আগে আমায় জানিয়ে আসবেন, তাহলে জানাননি কেন ?”
“তোমায় একটু চমকে দিলাম ।”
ধারা মনে মনে বললো,
“হুম দারুণ ভাবে চমক দিয়েছেন। আমার জীবনের সেরা চমক এটা। এটা একরাশ সুখের চমক ।”
রুবিনা কিচেন থেকে ট্রে ভর্তি করে খাবার নিয়ে এলো। খেতে খেতে নানান কথা হলো অঝোর আর ধারার মাঝে। কথার একসময় অঝোর বললো,
“ধারা তোমার জন্য একটা গিফট আছে ।”
ধারা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার জন্য গিফট! কী গিফট ?”
অঝোর হাসি হাসি মুখ নিয়ে পাশে থাকা ব্যাগ থেকে খেলনার একটা বিড়াল বের করলো, আর তার সাথে তিনটা ছোট বিড়াল। এক কথায় বলা যায় মা বিড়াল এবং তার বিড়াল ছানা । বের করে টেবিলের উপর রাখলো। হাসতে হাসতে বললো,
“অনেক খুঁজেছি কিন্তু ব্যাঙ কোথাও পাইনি, তাই এই বিড়াল ছানা গুলো নিয়ে এলাম।”
বিড়াল গুলো দেখে আর অঝোরের কথা শুনে ধারা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অঝোর সেদিন সেই ব্যাঙের পেইন্টিং টা দেখে ছিল, ইশ!
ধারা টেবিল থেকে খেলনা বিড়াল গুলো নিয়ে অঝোরকে সৌজন্যমূলক ভাবে বললো,
“ধন্যবাদ ।”
অঝোর প্রতিউত্তরে হাসলো। তারপর বললো,
“আচ্ছা এখন আমি উঠি, যেতে হবে।”
ধারার মন খারাপ হয়ে গেল। বললো, “এখনই চলে যাবেন ?”
” প্রায় দেড় ঘণ্টা হয়েছে আমি তোমাদের বাসায় আছি, এখন কি আমার যাওয়া উচিত না ?”
ধারা অসহায় ভাবে বললো,
“হুম, যাওয়া তো উচিত ।”
অঝোর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, তা দেখে ধারাও দাঁড়ালো।
ধারা বললো,
“আবার আসবেন কিন্তু।”
অঝোর মিষ্টি করে হেসে বললো ,
“হ্যাঁ আসবো।”
অঝোর হাঁটা শুরু করলো। ধারা তাকিয়ে রইল অঝোরের যাওয়ার দিকে। অঝোর দরজার বাইরে চলে গেলে ধারা দৌঁড়ে নিজের রুমের ব্যালকনিতে চলে এলো। হাতে এখনও সেই খেলনা গুলো। রাস্তায় তাকাতেই অঝোরকে দেখতে পেল।
চারিদিকটা আবছা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। গাছের পাতা গুলোও হালকা হালকা নড়ছে বাতাসে। ধারার এই পরিবেশটা অচেনা না, খুবই পরিচিত। এ পরিবেশ যে বৃষ্টি নামার পূর্বাভাস জানাচ্ছে। ধারার মনে হঠাৎই নানান প্রশ্ন উঁকি দিলো। আচ্ছা অঝোর কি বৃষ্টি নামার আগে বাড়ি যেতে পারবে? নাকি আজকেও কোথাও আটকে থাকবে? নাকি আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরবে? ধারার অঝোরকে ডেকে বলতে ইচ্ছা করলো,
“ওহে অঝোর!
আজও তুমি বৃষ্টি ঘন মুহূর্তে ওই গ্যারেজটায় থেকে যাও। একটু প্রাণ ভরে দেখি তোমায়,
দেখি তোমার ওই কপালে লেপ্টে থাকা চুল গুলো,
দেখি একটুখানি ।”
ধারার ইচ্ছেটা মনে মনেই রয়ে গেল প্রকাশ করা হলো না।অঝোর চোখের আড়াল হয়ে গেল। কেটে গেল কিছুটা সময়। আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়া শুরু করলো। ব্যালকনির ভিতর বৃষ্টির পানি প্রবেশ করছে। ধারার হঠাৎ মনে পড়লো, আরে ওর তো স্কুলে যাওয়ার কথা আর ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে। পর মুহূর্তেই আবার ভাবলো, ধুর আজকের এই দিনটায় আবার কিসের স্কুলে যাওয়া। এতদিন পরে অঝোরকে দেখলো, এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আজকের দিন কেটে যাবে। একদিন স্কুলে না গেলে কিচ্ছু হবে না।
ধারার চোখ পড়ল হাতের উপর। খেলনা গুলোর উপর পানির ছিটা পড়ছে। অঝোরের উপহার গুলো ধারা ঘরের ভিতর নিয়ে এসে যত্ন করে টেবিলের উপর রেখে দিলো। তারপর আবার চলে গেল ব্যালকনিতে। একটু একটু শীতল অনুভূতি হচ্ছে। দূরের কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ধারার আজ ভীষণ ইচ্ছা হলো ছাদে গিয়ে ভিজবে। হ্যাঁ ও আজ ভিজবেই! কিন্তু স্কুলের ড্রেস গায়ে দিয়ে তো আর বৃষ্টিতে ভিজবে না। ধারা পোশাক পাল্টে নিলো। রুমের দরজা খুলে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো। না মাকে কোথাও দেখতে পেল না। এটাই মোক্ষম সুযোগ! ধারা দৌঁড় দিলো ছাদের উদ্দেশ্যে।
ধারা এক দৌঁড়ে ছাদে চলে এলো। জোরে একটা শ্বাস ত্যাগ করলো। ভাগ্যিস মা দেখেনি! যদি দেখতো তাহলে আর ছাদে এসে বৃষ্টি বিলাস করা হতো না। ধারা পা রাখলো ছাদে অল্প জমে থাকা পানির মাঝে। মনে হলো যেন কোন এক স্বর্গ সুখে ডুব দিয়েছে। গায়ে বৃষ্টির পানি পরতেই কোন এক অজানা অনুভূতি টের পেল। কিন্তু অনুভূতি টা ঠিক কি তা বুঝতে পারলো না।
ধারা রেলিং এর কাছে এসে দাঁড়ালো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো বৃষ্টিতে অপেক্ষারত অঝোরের সেই মুখ খানি। এই বৃষ্টি ঘন মুহূর্তে ধারার কিছু কথা ভীষণ ভাবে মনে নাড়া দিয়ে উঠলো। এই কথা গুলো ও শুধু নিজের মাঝেই রাখতে চায় না, জানাতে চায় সেই লোকটাকেও যে লোকটাকে নিয়ে ধারার সকল ভাবনা। কিন্তু কীভাবে জানাবে সে লোকটাকে ? মোবাইল থেকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেবে ? না এটা কিছুতেই করবে না। কিন্তু এটা না করলে কী করে জানাবে লোকটাকে ? ধারা উপায় খুঁজতে লাগলো। কিছুক্ষণ ভাবার পরেই মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। হ্যাঁ এটা করাই ঠিক হবে। ধারা দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে এলো। জামাকাপড় ভেজা থাকায় তা দিয়ে ঘরে পানি পড়ছে। ধারা টাওয়াল দিয়ে হাত মুছে মোবাইলটা হাতে নিলো। টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারটায় বসে পড়লো।
ধারার ফেসবুক আইডি নেই। বান্ধবীর ফেসবুক আইডি আছে, ফেসবুকে কোথায় কী তাও ধারা বান্ধবীর আইডি থেকে সব কিছু দেখেছে। কখনো ফেসবুক আইডি খুলেনি, কারন ফেসবুক ওর ভালো লাগতো না। একে বারে এসএসসি পরীক্ষার পরেই ফেসবুক আইডি খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ফেসবুক আইডি খোলাটা খুবই প্রয়োজন। ধারা একটা ফেসবুক আইডি খুলে ফেলল। নাম দিলো, ‘F W D’
ফুল নাম না দিয়ে প্রত্যেকটা নামের প্রথম অক্ষর গুলো দিয়েছে শুধু। ফারিহা থেকে F, ওহামিয়া থেকে W, আর ধারা থেকে D দিয়েছে। এই মুহূর্তে অন্য কোনো নাম নিয়ে ভাবার সময় নেই, তাই এই নাম দিয়েই আইডি খোলা। অঝোর কি বুঝতে পারবে এটা কার আইডি ? নাহ বোঝা সম্ভব না।
ধারা অঝোর লিখে ফেসবুকে সার্চ দিলো। কিন্তু এত লোকের মাঝে সে তার বিশেষ মানুষটাকে খুঁজে পেল না। কিন্তু এতেই ধারা থেমে থাকলো না, আবারও অঝোরের নাম লিখে সার্চ দিলো । তবে এবার শুধু অঝোর লিখে না, ইংরেজিতে Ojhor Mahmud লিখে সার্চ দিলো। কিন্তু এবারও একই ফল মিললো। কোনো আইডির প্রোফাইল পিকচারেই অঝোরের ছবি দেখতে পেল না। অঝোরের কপালের উপর পড়ে থাকা সুন্দর চুল গুলোর দেখা কোনো ছবিতেই মিললো না। ধারা বিরক্ত হয়ে গেল। বিরক্তিতে বলেই ফেললো,
“ধুর বাবা এ কেমন লোক যে ফেসবুকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না!”
ধারা আবার আইডি গুলো চেক করলো, কিন্তু না অঝোরকে কোথাও দেখতে পেল না। ধারা মোবাইলটা টেবিলের উপর রাখলো। অঝোরের আইডি তো পেল না তাহলে মনে জাগা কথা গুলো জানাবে কীভাবে? ধারার মাথায় কিছু আসছে না। ধারার হঠাৎ মনে হলো, ও একটা ভুল করে ফেলেছে। ধারা দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা আইডির টাইমলাইনে প্রবেশ করলো। প্রোফাইল পিকচারটা দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। পাওয়া গেছে তাকে। সামনেই আইডিটা ঘুর ঘুর করছে আর ও কিনা অযথা কত খুঁজে বেড়ালো। ধারার মনে হলো ওর অবস্থা এরকম যে,
‘ ওর বাস বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো, আর ও ভুল করে অন্য আরেকটা চলন্ত বাসের পিছনে ছুটছে ।’
অবশ্য অবস্থা এরকম হবেই বা না কেন ! অঝোর মাথায় একটা ক্যাপ দেওয়া পিক প্রোফাইলে দিয়ে রেখেছে । এর জন্য তো বোঝা যাচ্ছে না। পিকটার দিকে তাকালেই ধারার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ! এত সুন্দর চুল গুলো ক্যাপের নিচে ঢাকা পড়ে রয়েছে। এর কোনো মানে হয় !
থাক তার যেমন ইচ্ছা সে তেমন পিক দিয়ে রাখুক। এখন কথা গুলো লিখে পাঠাতে পারলেই হলো। ধারা দ্রুত টাইপ করে ফেললো ।
*** যদি আমি শ্রাবনের কালো মেঘে ঢাকা,
আকাশের দিকে তাকিয়ে দুঃখ বিলাস করি !
তাহলে কি তুমি আসবে শ্রাবনের অঝোরে ঝরে পড়া সুখময় বৃষ্টি ধারা হয়ে?
যদি আমি শ্রাবনের অঝোর বৃষ্টির সাথে
কেঁদে ফেলি বৃষ্টির ধারা হয়ে!
তাহলে কি তুমি আসবে আমার চোখ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টিকে সুখময় বৃষ্টির ছন্দ করে দিতে? ***
লেখাটা সেন্ট করেই ধারা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ফেসবুক থেকে বেড়িয়ে গেল। অঝোর কী রিপ্লাই দেয় কে জানে!
…
পরের দিন ধারা রিক্সায় করে স্কুলে যাওয়ার সময়, পাশে বসে থাকা বান্ধবীর সাথে অঝোরকে নিয়ে একের পর এক গল্প করেই যাচ্ছে। কথার মাঝেই ধারার চোখ আটকে গেল একটা দৃশ্য দেখে। ধারা এমন দৃশ্য দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ধারার ইচ্ছা করছে এখন রিক্সা থেকে ঝাঁপ দিতে ! এমন কিছু দেখতে হবে ও কি কোনোদিন ভেবেছে!
অঝোর একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। দুজনের মুখেই হাসি লেগে আছে। অঝোর কোনদিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। তাকালেই ওকে দেখতে পেতো । কী এমন কথা বলছে তারা যে আশেপাশে কোনো দিকে তারা চোখ রাখছে না? অঝোরকে ছাড়িয়ে ধারাদের রিক্সা সামনে চলে গেল। ধারা তবুও উঁকি মেরে পিছনের দিকে তাকিয়ে আছে।
ধারা অঝোরের সাথে থাকা মেয়েটাকে খুব ভালো করেই চিনে। মেয়েটার স্বভাব তেমন ভালো না। শুনেছে তার দুইটা বয়ফ্রেন্ড আছে। এই মেয়েটা এখন অঝোরের সাথে কী করছে? অঝোরকেও আবার বয়ফ্রেন্ড বানানোর দানরায় নেই তো? নাকি তাদের ভিতর অলরেডি রিলেশন শুরু হয়ে গেছে ? ভাবতেই ধারার বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো।
ইচ্ছা করছে যেয়ে মেয়েটার পাশ থেকে অঝোরকে টেনে নিয়ে আসতে। কিন্তু এটা ও এখন কিছুতেই করতে পারবে না। ধারার বুক তীব্র কষ্টে বিষিয়ে উঠতে লাগলো।
চলবে…