সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ১

0
1894

সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ১
#লেখা : রায়না মনি
ধারা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে । টিভিতে ‘ধামাল’ মুভিটা চলছে । মুভিতে চার বন্ধুর অবস্থা দেখে ধারা একটু পর পর হেসেই চলছে । এই হিন্দি কমেডি মুভিটা ধারার খুব প্রিয়। ধারা বেশ কয়েক বারই মুভিটা দেখেছে তবুও এই মুভিটা দেখার প্রতি অনীহা জাগে না।
রুবিনা আফরোজ কিচেনে রান্না করছে। অনেক ক্ষণ ধরে মেয়ের এমন হাসাহাসি শুনছে। মেয়েটা এমনই, টিভির সামনে বসলেই মাঝে মাঝে হাসির শব্দে বাড়ি মাথায় তুলে। রুবিনা আফরোজ বাইরে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার হয়ে আসছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। ছাদের উপর কিছু কাপড় শুকাতে দেওয়া আছে। এখন রান্নাটা ফেলে উপরে যেয়ে কাপড় চোপড় আনবে, তার থেকে ধারাকে আনতে বললেই হয়। রুবিনা কিচেন থেকেই ধারাকে ডেকে বললো,
“ধারা ছাদ থেকে কাপড় গুলো নামিয়ে আন, বৃষ্টি নামবে মনে হয়।”

ধারা মুভি দেখায় এতটাই মনোযোগী ছিল মায়ের কথা বলার শব্দই শুধু শুনলো, কী বললো সেটা শুনলো না।
রুবিনা আফরোজ রান্নায় মন দিলো।
কিছুক্ষণ পর আবার ধারার হাসি শুনতে পেল। তার মানে ধারা ছাদে যায়নি। রুবিনা আফরোজ এবার কিচেন থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে আসলো।
“কিরে ধারা তোরে না বললাম ছাদ থেকে কাপড় গুলো নামিয়ে আনতে ?”

“মা মুভিটা শেষ হোক তারপর আনবো।”

“মুভিটা শেষ হোক মানে ? তোর মুভি শেষ হতে হতে শুকনো কাপড় গুলো ভিজে, আবার শুকিয়ে যাবে ।”

“মা কাপড় গুলো ভেজার কথা আসছে কেন? ছাদে রোদে দেওয়া কাপড় গুলো ভিজবে কীভাবে ?”

“হইছে বুঝছি! তোর মুভির ভিতরই ডুব দিয়ে থাক তুই। আমি যে একটু আগে বললাম বৃষ্টি নামবে, সেটা কি শুনিসনি ? বাইরের অবস্থা দেখছিস অন্ধকার হয়ে আসছে।”
ধারা জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো হ্যাঁ সত্যিই অন্ধকার হয়ে গেছে। ধারা টিভিটা অফ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আসলে মা টিভির শব্দের জন্য শুনতে পাইনি তোমার কথা। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”

ধারা ছাদে যেয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো।
সময়টা ভর দুপুর বেলা, অথচ মনে হচ্ছে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো, কালো মেঘে ঢেকে গেছে পুরো আকাশ । কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই।
বৃষ্টি নামার আগ মুহূর্তে এমন সময়টা ধারার খুব ভালো লাগে। আর ভালো লাগে দুপুর বেলার মুষলধারে বৃষ্টি।
ধারা চারপাশ টায় তাকিয়ে দেখলো, একদম থমথমে পরিবেশ। পাশের বাসার ছাদ থেকে লাইজু আন্টি কাপড় চোপড় নিয়ে নেমে যাচ্ছে। বাড়ির সামনের রাস্তার দিকে তাকালো ধারা । বেশি মানুষ জন দেখা যাচ্ছে না, দুই একজন মানুষ দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি নামার আগেই ঘরে ফিরতে চায় তারা।

ধারা কাপড় গুলো নিয়ে ছাদ থেকে নেমে, দোতালায় নিজের রুমে আসলো । যেভাবে মেঘ জমেছে আকাশে তাতে মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। ধারা মনে মনে ঠিক করে নিলো, আজ মুষলধারে বৃষ্টি নামলে যেভাবেই হোক মার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবেই। মা জানলে একদম বৃষ্টিতে ভিজতে দিবে না।
ধারা রুমের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে ভরে যাওয়া প্রকৃতি দেখছে। বৈশাখ মাসে প্রায়ই এমনটা হয়ে থাকে ।

বৃষ্টি শুরু হলো, সাথে হালকা বাতাস। ধারা গাছ পালা গুলো দেখছে। গাছ গুলো বাতাসে এদিক ওদিক হেলেদুলে যাচ্ছে। ধারার মনে হলো গাছ গুলো বৃষ্টির অপেক্ষায়ই ছিলো, বৃষ্টির ছোয়া পেতেই তারা আনন্দে নেচে উঠেছে। ধারা ব্যালকনি থেকে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলো। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো হাতে পড়তেই কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো।
আস্তে আস্তে বৃষ্টি বেড়েই চলছে। চারদিকে তাকিয়ে ধারার মনে হলো কুয়াশা জমে আছে। বৃষ্টির জন্যই এমনটা মনে হচ্ছে ।

অনেকটা সময় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকার পরে ধারার মনে পড়লো বৃষ্টিতে ভেজার কথা। আগে নিচে নেমে দেখতে হবে মা এখন কী করছে । ধারা যখন ব্যালকনি থেকে নিচে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো, তখন আচমকা ওর চোখ গেল রাস্তার ওই পাশে সালাম আঙ্কেলের গ্যারেজের দিকে।
বন্ধ গ্যারেজের সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।
দুপুর বেলা তাই প্রায় সব দোকানই বন্ধ। এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে লোকটা কেন ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ? ধারা ভেবে পেল না।
একটু পড়েই ধারা যুক্তি দাঁড় করালো, লোকটা নিশ্চয়ই বৃষ্টির জন্য বাসায় ফিরতে পারছে না তাই দাঁড়িয়ে আছে।

ধারা নিচে থেকে ঘুরে আসলো । মা এখনও কিচেনে রান্না করছে। মাছ তেলে ভেজে নিচ্ছে, তার মানে এখন মায়ের উপরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে আসাই যায়।
ধারা যখন ছাদে যাওয়ার জন্য সিঁড়িতে পা রাখলো, তখন তার বৃষ্টিতে আটকে পড়া লোকটার কথা মনে পড়লো।
আচ্ছা লোকটা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই তো বাসায় ফিরতে পারে, বৃষ্টিতে ভেজাও হবে বাসায় ও ফেরা হবে। তা না করে দাঁড়িয়ে আছে।
জ্বর আসতে পারে বলে, লোকটার মা ও কি লোকটাকে ধারার মায়ের মতো বৃষ্টিতে ভিজতে নিষেধ করে দিয়েছে ? হতে পারে।
ধারা ভাবতে লাগলো, ধারা যদি এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে একা কোনো দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, তাহলে কেমন লাগতো? ভাবতেই ধারার গা কেমন ছমছম করে উঠলো।
লোকটার নিশ্চয়ই এখন দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। লোকটা আছে নাকি চলে গেছে?
ধারা আর ছাদে গেল না। বৃষ্টিতে ভেজার আগ্রহটা এখন আর নেই। ধারা রুমে চলে আসলো। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো লোকটা এখনও আগের জায়গায়ই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
ধারা একদম ব্যালকনির গ্রীলের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।
বার বার গ্যারেজের দিকেই চোখ যাচ্ছে।
লোকটা লম্বা আছে, ছয় ফিটের কম তো হবেই না। ফুল হাতার শার্ট আর নীল জিন্স পরা মনে হয়। রং টা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখা। চুল গুলো মনে হচ্ছে কপালে লেপ্টে আছে। দেখতে হ্যান্ডসামই লাগছে ।
তবে বৃষ্টির জন্য শুধু স্পষ্ট ভাবে লোকটার মুখটাই দেখা যাচ্ছে না।

ধারা অনেক ক্ষণ লোকটার দিকেই তাকিয়ে রইল । বাতাসের সাথে বৃষ্টির ঝাপটা এসে ধারাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু ধারার সেদিকে খেয়াল নেই।
ধারা আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দেখতে পেল একটা রিক্সা এসে গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়েছে। গ্যারেজে অপেক্ষারত লোকটা এগিয়ে গিয়ে রিক্সায় উঠলো। লোকটা ওঠার পরই রিক্সা টা আবার চলতে শুরু করলো। ধারা তাকিয়ে রইল চলন্ত রিক্সাটার দিকে। রিকশাটা ধারার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলে ধারা চোখ ফিরিয়ে আনলো রাস্তা থেকে। ধারার মন খারাপ হয়ে গেল। ধারার মনে হলো লোকটা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে ভালো হতো। ধারার আর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। ধারা রুমে গেল।
রুমে যেয়েই খেয়াল করলো বৃষ্টির পানিতে ধারা প্রায় ভিজে গেছে। শীতল একটা অনুভূতি হচ্ছে। ধারা আর দাঁড়িয়ে থাকলো না, একটা থ্রি পিছ নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকলো শাওয়ার নিতে।

দুপুরে খেতে বসে ধারার খুব খালি খালি লাগছে। ডাইনিং টেবিলে ধারা একাই খেতে বসেছে। একা একা খেতে ধারার একদম ভালো লাগে না। কিন্তু কোনো উপায় নেই এখন, কারণ এখন রমজান মাস চলছে। ধারার মা রোজা রাখছে।
বাসায় এখন ধারা আর ধারার মা ছাড়া কেউ নেই। ধারার আব্বু গ্রামের বাড়িতে গেছে।
“মা একটু এদিকে আসো না।”

রুবিনা আফরোজ রুমে বসে কুরআন তিলাওয়াত করছিল, ধারার ডাক শুনে থামলো।
“কেন ধারা কিছু লাগবে তোর?”

“একা একা ভালো লাগছে না মা।”

রুবিনা আফরোজ মেয়ের খবর জানে। তাই কুরআন শরীফ বন্ধ করে ঠিকমতো রেখে ডাইনিং রুমে গেল।

দুপুরে খাওয়ার পরে ধারা ড্রয়িং রুমে সোফার উপরে শুয়ে রইল। কিছু ভালো লাগছে না, টিভিও দেখতে ইচ্ছা করছে না। কেন এমন হচ্ছে ধারা বুঝতে পারছে না। ঘুমাতে চেষ্টা করলো, অনেকক্ষণ ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে রাখলো কিন্তু ঘুম আসলো না। হঠাৎ করেই দুপুরের কথা মনে পড়ে গেল। লোকটার কথা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না। একটু পর পরই শুধু মনে পড়ে। আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না, ধারা উঠে নিজের রুমে গেল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে