সুখময় বৃষ্টি পর্ব:১৪
#লেখা : রায়না মনি
ধারার মনে কষ্টরা তীব্র থেকে আরও তীব্র তর হতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগেও অঝোর আসায় একটু হলেও মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল, আর এখন অঝোরের এমন করার জন্য মুখটা শরৎ এর ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশের মতো হয়ে গেছে। ধারার খুব ইচ্ছে করছিল অঝোরকে একটু খানি দেখতে। ইচ্ছা করছিল এক ছুটে নিচে গিয়ে অঝোরের সামনে দাঁড়াতে। কিন্তু ও কিছুতেই নিচে যায়নি। অঝোর যখন ওকে দেখতেই চায় না, ও কেন অঝোরকে দেখবে? দেখবে না ও অঝোরকে! একদম দেখবে না! কষ্টে কষ্টে মরে গেলেও আর অঝোরকে দেখার ইচ্ছা পোষণ করবে না মনে! কিছুতেই করবে না!
ধারার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো! ধারা বিছানার উপর বসে পড়লো। যে কষ্টটা এতদিন ধরে একটু মনের ভিতর চেপে রেখেছিল, আজকে সেই কষ্টটা অঝোর এসে পুনরায় জাগিয়ে দিলো!
অঝোর এতটাই নিষ্ঠুর ও আগে বুঝেনি।
ধারার চোখ পড়ল সোকেজের দিকে, অঝোরের দেওয়া সেই খেলনা বিড়াল গুলো রাখা। ধারা উঠে সোকেজ টার কাছে গেল। খেলনা গুলো হাতে নিয়েই প্রচণ্ড রাগে মেঝেতে ছুড়ে ফেললো।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ধারার! ওর সাথে একটু দেখা না করেই অঝোর চলে গিয়েছে! ও এটা কখনোই আশা করেনি অঝোরের কাছ থেকে!
ধারা এসে আবার বিছানার উপর বসলো। কিছুটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে ধারা একটু শান্ত হলো। তবে চোখে এখনও পানি লেগে আছে। ধারা মেঝেতে পড়ে থাকা খেলনা গুলোর দিকে তাকালো। খেলনা গুলো দেখে ধারার ভীষণ মায়া লাগলো। ধারা বসা থেকে উঠে ধীর পায়ে হেঁটে খেলনা গুলোর কাছে গিয়ে, খেলনা গুলো হাতে তুলে নিলো। এই খেলনা গুলো ও কখনোই ফেলে দিতে পারবে না, কখনোই না! এগুলো অঝোরের দেওয়া স্মৃতি, অঝোর এগুলো মজা করে দিলেও, ওর কাছে এগুলো ভীষণ প্রিয়। ধারা খেলনা গুলোর দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আমি আমার কষ্ট কখনোই তোদের দিবো না । তোদের খুব যতনেই রাখবো আমি ।”
ধারা খেলনা গুলোর উপর চুমু খেয়ে আবার খুব যত্নে সোকেজে রেখে দিলো।
…
বাইরে ঝড় বইছে, তুমুল ঝড়। প্রকৃতির ঝড়, বৃষ্টির সাথে সাথে ধারার চোখ থেকেও অবাধ বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির পানি পেয়ে গাছপালা গুলো আনন্দে মেতে উঠেছে, আর ধারার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেছে। ধারা যতই বলুক অঝোরকে মনে করবে না, কিন্তু বৃষ্টি নামলেই অঝোরকে মনে করতেই হয়, না চাইতেও! এমন একটা বৃষ্টির দিনেই তো অঝোর এসেছিল ওর জীবনে। আর এসেই তো একরাশ কষ্ট ঢেলে দিয়েছে জীবনে! আগে বৃষ্টি দেখলে হলে ধারার আনন্দ হতো, আর সেই বৃষ্টিকেও ওর কাছে আনন্দ থেকে কষ্ট বানিয়ে ছেড়েছে অঝোর!
কোনো কিছুতে ধারা এখন আর ভালো লাগার অনুভূতি খুঁজে পায় না! আর অঝোর তো নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে। একজনকে কাঁদিয়ে সে খুব আনন্দের সময় কাটাচ্ছে হয়তো। অঝোর কত বড় নিষ্ঠুর ওর কথা একটু মনেও করে না! এই অঝোরকে যেভাবেই হোক ভুলে থাকতেই হবে, ভুলতে না পারলেও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
এসব ভাবনার মাঝেই ধারার কানে কিছু একটা শব্দ ভেসে আসলো। প্রচুর বাতাস, বৃষ্টি থাকার কারনে স্পষ্টভাবে শুনতে পারলো না। ধারণা করতে পারলো রুমের দিক থেকেই শব্দটা আসছে। ধারা ব্যালকনি থেকে রুমে গেল। বুঝতে পারলো কিসের শব্দ। দরজায় করাঘাত করার শব্দ। দরজার করাঘাতের শব্দের সাথে সাথে মায়ের গলা ও শুনতে পেল। ধারা ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু পেপার বের করে চোখের পানি মুছে নিলো। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে, আর হালকা ফুলে আছে।
এখন কী করবে ও? মা যদি দেখে ফেলে চোখ লাল হয়ে গেছে, তারপর যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তখন কী বলবে? দরজা ধাক্কানোর তীব্র শব্দ কানে আসতেই ধারা প্রায় লাফিয়ে উঠলো। ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুললো। দরজা খোলার সাথে সাথেই রুবিনা কিছুটা রাগত সুরেই বলে উঠলো,
“ধারা তোর অবস্থা কী বল তো, দরজা খুলতে এত সময় লাগলো কেন? সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি! কোথায় ছিলি তুই ?”
ধারা দরজা খুলেই নিচের দিকে মুখ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, যাতে মা চোখ দুটো না দেখতে পারে। আর বাইরে মেঘের কারণে পরিবেশটা কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, যার কারণে মুখ দেখার সম্ভাবনা খুবই কম। ধারা নিচের দিকে তাকিয়েই বললো,
“মা ব্যালকনিতে ছিলাম আমি, বৃষ্টি পড়ার শব্দের জন্য তোমার ডাক শুনতে পাইনি ।”
রুবিনা এটা নিয়ে আর কিছু বলেলো না। চুলোয় তার রান্না বসানো, তার মন রয়েছে সেদিকে।
“দিয়া ফোন করেছে কথা বলবে তোর সাথে।
তোর ফোনটা ভেঙে গেল, তারপর একটা ফোন কিনে দিতে চাইলাম, কিন্তু তুই বললি আর ফোন চালাবি না। এখন ফোন নিয়ে শুধু আমার দৌঁড়াতে হচ্ছে । তোর আব্বুকে কি একটা ফোন কিনে নিয়ে আসতে বলবো?”
ধারা মনে মনে বললো, ‘মা তোমরা তো আর জানো না, ফোনটা আমি নিজেই ভেঙে ফেলেছিলাম। আমি ফোন দিয়ে আর কী করবো!’
মায়ের সাথে বললো,
“না মা আমার আর ফোন চালাতে ইচ্ছে করে না ।”
“আমি ফোন নিয়ে আর দৌঁড়া দৌঁড়ি করতে পারবো না। তোর বান্ধবীরা ফোন দেয়, দিয়া ফোন দেয়, অর্ক ফোন দেয় আর তুই কিনা ফোন চালাবি না। অর্ক তো সেদিন থেকেই শুধু বলছে তোকে তাড়াতাড়ি ফোন কিনে দিতে। তোর কোনো কথাই আর শুনছি না আমি। আজকেই মোবাইল নিয়ে আসতে বলবো । রান্না বান্না ফেলে রেখে এভাবে আর দৌঁড়াতে পারবো না।”
কথা গুলো বলেই মোবাইলটা ধারার হাতে দিয়ে রুবিনা তড়িঘড়ি করে নিচে চলে গেলেন।
ধারা মোবাইলটা নিয়ে আবার ব্যালকনিতে আসলো। তারপর দিয়ার কাছে কল ব্যাক করলো। দিয়া কল রিসিভ করতেই ধারা বললো,
“হ্যালো দিয়া আপু বলো ।”
দিয়া কোনো কথা বললো না। মোবাইলের ওই প্রান্ত থেকে শুধু কান্নার শব্দ ভেসে আসলো। ধারা অবাক হয়ে বললো,
“একি তুমি কাঁদছো কেন ?”
দিয়া কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছেরে ধারা! আমি আর বোধ হয় বাঁচতে পারবো না।”
“কী হয়েছে আপু? এভাবে কেন কথা বলছো? অসুস্থ নাকি তুমি?”
” ও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে, চরম ভাবে ধোঁকা দিয়েছে আমাকে !”
“ও টা কে সাব্বির ?”
“হ্যাঁ সাব্বির! ও বিয়ে করে ফেলেছে অন্য কাউকে। আমাদের কলেজেরই একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে ঢাকা চলে গেছে। এখন শুনলাম বিয়েও করে ফেলেছে! ও আমার সাথে এভাবে প্রতারণা করবে আমি ভাবতে পারিনি কখনো। ওর জন্য কী না করেছি আমি। ওর জন্য তো আমি জীবন টাও দিয়ে দিতে পারতাম, ও আমাকে এভাবে কাঁদাতে পারলো !”
দিয়ার কথা শুনে ধারার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। কিছু কিছু ছেলেদের স্বভাব এমন কেন? একদম ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না।
কেউ ভালোবাসার নাটক করে দিনের পর দিন ঠকিয়ে যায়, আবার কেউ ভালোবাসার কথা শুনে এড়িয়ে দূরে চলে যায়। কেন এত কষ্ট দেয় তারা?
আর সাব্বির ছেলেটা যে ভালো না খারাপ, তা ধারা আগে থেকেই জানতো। কিন্তু এত খারাপ তা ভাবেনি। দিয়া আপুকে রেখে একেবারে বিয়েই করে ফেললো বেয়াদবটায় ! দিয়া আপু সাব্বিরের চরিত্রটা আগে থেকে বুঝতে পারলো না। দিয়া আপু যে সাব্বিরের জন্য পাগল তা ধারা বেশ ভালো করেই জানে। দিয়া আপুকে এখন কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায় সেটা ভাবতে লাগলো ধারা। একটু ভেবে বললো,
“আপু কান্নাকাটি করো না তো। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। সাব্বির ছেলেটা যে খারাপ তা আমরা আগে থেকেই জানতাম, তুমি বুঝোনি । অর্ক তো তোমাকে অনেক আগেই সাবধান করে দিয়েছিল, তুমি কিছু বিশ্বাস করোনি। উল্টো তুমি অর্ককে যা খুশি তাই বলে কষ্ট দিয়েছো। এমন কী অর্কের সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছো। যাই হোক, সাব্বির খুবই খারাপ ছেলে । আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো যে তোমার জীবন থেকে ও দূরে চলে গেছে।”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে ধারা! আমার ভাইটার সাথেও আমি অন্যায় করেছি ওর জন্য! নিজের আপন ভাইকে বিশ্বাস করিনি, ওকে বিশ্বাস করেছি। আর আমার বিশ্বাসী মানুষটা আমাকে এভাবে ঠকালো! এখন আমার কী হবে! আমি আর বাঁচতে পারবো না , কিছুতেই বাঁচতে পারবো না। সাব্বির আমার নিঃশ্বাস ছিল, সাব্বিরকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।”
কথা গুলো বলেই দিয়া ফোনটা কেটে দিলো।
ধারা ফোনটা হাতে নিয়ে কতক্ষণ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। দিয়া আপু আবার কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে না তো? ভাবতেই ধারার ভীষণ ভয় করতে লাগলো। কী করবে ও এখন? মায়ের কাছে বলে দিবে? তারপর মা ফোন করে বাড়ির সবার কাছে বুঝিয়ে বলবে। না থাক আগে অর্কর সাথে সব বলে দেখি ও কী করে। ধারা অর্কর কাছে ফোন দিয়ে সাথে সব কিছু বললো।
…
অর্ক সব রাগ ভুলে দিয়ার কাছে ফোন দিয়েছিল। দিয়া শুধু কাঁদতে কাঁদতে একটা সরি বলেছিল অর্ককে, আর কোনো কথা বলেনি। অর্ক সাব্বিরের এই বিষয় নিয়ে ওর আম্মুর সাথেও কোনো কথা বলেনি, বললে পরিস্থিতি অন্য রকম হয়ে যেতে পারে। যা বলার এসে বলবে।
অর্ক এখন কুমিল্লা যাওয়ার পথে। বোনের এমন অবস্থা দেখে ও আর বসে থাকতে পারেনি, বোনকে নিয়ে আসতে কুমিল্লা যাচ্ছে। বলা তো যায় না এই পরিস্থিতিতে একা একা থেকে ওর বোন কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে কিনা! ভালোয় ভালো বোনকে এখন কিছুদিনের জন্য নিয়ে আসতে পারলেই হয়। না আসতে চাইলেও যেভাবে পারবে সেভাবেই আনবে। বাড়িতে নিয়ে এসে সবার কাছে সব কিছু খুলে বলবে। সবাই মিলে যদি বোনকে বিয়েও দিয়ে দেয় তাতেও অর্কর কোনো আপত্তি নেই। ওর বোন ভালো থাকলেই হলো, সাব্বিরের ভাবনা কাটিয়ে উঠাতে আপুর জীবনে একজন মানুষ দরকার। যে সব সময় আপুকে আগলে রাখবে। আচ্ছা আপু যদি বিয়ে করতে রাজি না হয় তখন কী করবে? সেটা বাসার সবাই ভালো বুঝবে। ও সর্বদা ওর বোনের পাশে থাকবে।
একজন খারাপ ছেলের চলে যাওয়ার কথা ছিল, সে চলে গেছে। এটা ওর বোন বুঝতে পারছে না । ভুল যা করার করে ফেলেছে, সেটা ধরে বসে থেকে তো কোনো লাভ হবে না । খারাপ মানুষটার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে জীবনটা গুছিয়ে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দেখিয়ে দিতে হবে, ওর মতো খারাপ ছেলে ধোঁকা দেওয়াতে কিছুই যায় আসেনি, বরং ভালো হয়েছে। এগুলো কি ওর বোন বুঝে না কিছু? ভালো কিছু না বুঝে হাবিজাবিটা খুব ভালো বুঝে। এবার আর ওর বোন নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে পারবে না, পরিবারের লোকজন যেটা ভালো বুঝে সেটাই হবে।
চলবে…