সিদ্ধান্ত! (প্রথম পর্ব।)
“সোহেল অফিস শেষে কি একটু ফ্রি আছিস? জরুরী একটা কথা ছিল দোস্ত!” লাঞ্চের পর পর আসিফের কলটাতে একটু অবাক হলাম। আজ ওকে বেশ উদ্বিগ্ন বলেই মনে হল।
“না রে ফ্রি নাই, তানিশার কোচিং আছে! অফিস শেষে ওকে ড্রপ করতে হবে। তবে তোর বিষয়টা খুব বেশি জরুরী হলে আমি না হয় সোমাকে বলবো, মেয়েকে কোচিংয়ে ড্রপ করে দিতে!” স্কুল জীবন থেকেই বন্ধুরা আমার কাছে প্রায়োরিটি পায়, তাইতেো আসিফকে নিরাশ করলাম না।
“ঠিক আছে বন্ধু, আমি ছয়টার মধ্যে তোর অফিসে আসছি। তারপর দুজন কাছাকাছি কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসব নে।” তড়িঘড়ি করে আসিফের ফোন রাখার পর বুঝলাম, ও নিশ্চয়ই খুব বড় ধরনের একটা ঝামেলায় আছে। আমি অবশ্য খুব বেশি চিন্তা না করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলাম। নিজেরই এখন হাজারো সমস্যা, তাইতো ইদানিং অন্যের বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ পাই না।
“দোস্ত, শায়লা কে বিয়ে করতে চাই। অনেকদিন ধরে চিন্তাভাবনা করে আমার এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিষয়টাতে তোর একটু সাহায্য চাইছি!” মতিঝিলে আমার অফিস লাগোয়া একটা রেস্টুরেন্টে বসতেই, আসিফের বলা এ কথাটা আমার মাথায় যেন বাজ হয়ে পড়লো। তিন কন্যা সন্তানের বাবা, সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মুখে এ এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে আমি বসা থেকে উত্তেজনায় সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম।
“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস আসিফ? না আমার সাথে ফাজলামো করছিস।” আমার অবিশ্বাস্য চোখ আর রাগের গর্জনে রেস্টুরেন্টে বসা আশেপাশের মানুষরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আসিফ মেধাবী ছেলে, আমি উত্তেজিত হয়ে গেছি তাইতো পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাকে নিয়ে দ্রুতই রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে চলে এলো। আমি তখনো রাগে গজরানোতে। ও একটা রিক্সা ডেকে আমাদের দুজনেরই প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, পুরোটা রাস্তাতে ও চুপচাপ৷ আমিও ওর দিকে একবারের জন্য তাকালাম না।
টিএসসির কাছাকাছি এসে রিক্সাটা ছেড়ে দিয়ে ও বেশ স্বাভাবিক গলায় “দোস্ত প্রথমে আমার পুরো কথাটা শোন, তারপর রিয়েক্ট কর! আমার নিজেরও তো অনেক ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। আর তুই ই একমাত্র ব্যক্তি যার কাছে আমি কথাটা শেয়ার করতে চাচ্ছি। আমি শায়লাকে ছাড়া বাঁচবো না। ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। ”
কাহিনীটা হঠাৎ নাটক সিনেমার মতো করে শুরু করে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। মূল অংশটা শুরু করার আগে আমার বন্ধু আসিফ আর আমাদের আরেক বন্ধু শায়লার পরিচয় দিয়ে রাখছি। আমরা তিনজনই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সহপাঠী, ক্লাস টেনে কালাম স্যারের বাসায় ব্যাচে প্রাইভেট পড়ার সময় থেকেই আসিফ-শায়লার পরিচয় ও প্রেমের শুরু। ওদের তুমুল প্রেম চলল কলেজ জীবনেও। এরপর একসাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করা আর কাকতালীয়ভাবে আমি, আসিফ আর শায়লা, তিনজনেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যাওয়া। আমি শায়লা ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে আর আসিফ হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের। আমাদের সে সময়ের উত্তাল বন্ধুত্ব ও অসাধারণ সব স্মৃতি, শিকি শতক পরে এসেও মাঝেমধ্যে সুখ স্মৃতি হয়ে ধরা দেয়।
সংক্ষেপেই বলছি, আসিফ আর শায়লার বিয়েটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি, আর তা নানানবিধ কারণে। এক নাম্বার কারণ হলো, আসিফদের পারিবারিক অবস্থা আর দ্বিতীয়টা ওর অনিশ্চিত ক্যারিয়ার। শায়লার বাবা ছিলেন সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, ভদ্রলোক সম্ভবত শেষ পর্যন্ত সচিব হিসাবে রিটায়ারমেন্টে যায়। তাইতো মুগদাতে থাকা ব্যাংকের এক তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর সন্তান আসিফের সাথে শায়লার বাবা কিছুতেই বিয়েতে রাজি হয়নি। আর সত্য বলতে কি, এমবিএ করার সময়টাতে শায়লা নিজেও আসিফ এর বিষয়ে কনফিউজড ছিল, অন্ততপক্ষে কথাটা আমি জানতাম।
আইবিএ থেকে এমবিএ করা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে যখন শায়লার বিয়ে হল, আসিফ অনেক কষ্ট পেয়ে আমাদের বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। ও বিষয়টাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আসিফ শায়লাকে মন থেকেই ভালোবাসতো, আমরা বন্ধুরা ভালো করে জানতাম। তাইতো আমরা সবাই ছেলেটার প্রতি সমবেদনায় আবার একই সাথে শায়লাকেও কিন্তু বন্ধু বলেই মনে করতাম। খুব খারাপ লাগতো, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবারের প্রবল বিরোধিতায় মেয়েটার আস্তে আস্তে প্রেম থেকে দূরে সরে যাওয়ার সেইসব দৃশ্য দেখে।
এরপর আমাদের সবার জীবন চলতে লাগে জীবনের নিয়মে। আমিও একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরী নিলাম, এরপর বিয়ে থা করে সংসার জীবনে। আসিফ আমাদের স্কুলের মেধাবী ছাত্রদের একজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ছাত্র হলেও ছেলেটা আসলেই তুখোড়। আর তার প্রমাণও দিল বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একেবারে প্রথম দিকে নিজের অবস্থান রেখে। সরকারি চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে আসিফের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল রাতারাতি, বন্ধুদের মাঝেও ও বেশ গুরুত্ব পায় আর কর্মক্ষেত্রেও খুব ভালো করতে লাগে। এই তো কিছুদিন আগে সরকারের যুগ্ম সচিব পদেও পদোন্নতি পেল।
আসিফের স্ত্রী, লায়লা ভাবি আমাদের খুব পছন্দের একজন। পুরোপুরি গৃহিণী এই ভদ্রমহিলা ওদের তিন কন্যা সন্তানকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। ওদের বড় মেয়েটা এ বছর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়েছে, বাকি দুটো মেয়ে ভিকারুন্নেসাতে পড়ে। সব মিলিয়ে আসিফ লায়লার আপাত সুখের এক সংসার, সমাজের অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। আমরা বন্ধুরা এখনো প্রায়ই ওদের ইস্কাটনের সরকারি কোয়ার্টারে জড়ো হই, আড্ডা আার ভাবীর মজার মজার রান্না সাবার চলে মাঝরাত পর্যন্ত।
স্ত্রী কন্যাদেরসহ সুখের সংসার, প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়সে এসে আসিফের প্রাক্তনকে বিয়ে করার ফের অভিপ্রায়, আমাকে আজ উন্মাদ করে দিল। এই ছেলেটার সাথে আমার বন্ধুত্ব প্রায় চল্লিশ বছরের, আজ কেন যেন মনে হল ভুল মানুষের সাথে আমার এতদিনের বন্ধুত্ব। সে আদতেই একজন খারাপ মানুষ, তাহলে এসব ভাবতে পারে কিভাবে!
আসিফের প্রাক্তন শায়লার সাথে অন্যান্য স্কুল বন্ধুদের মত আমার এখনো যোগাযোগ আছে, আর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে। আমাদের বন্ধুদের সবার জানা, প্রায় বছর দশেক আগে শায়লার ডিভোর্স হয়েছে। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বেইলি রোডে নিজেদের এপার্টমেন্টে থাকে। নিজে একটা বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও নিজের চাকুরী, মেয়েকে নিয়ে ও খুব ভালো আছে। অন্ততপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিন্তু তা ই বলে।
আমার মনে খচখচ করছে, হঠাৎ করে কি এমন হলো যে আসিফ তার প্রাক্তন শায়লার জন্য বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে গেল। একবার ভাবলাম এ প্রসঙ্গটাতেই আর যাব না, অযথা আসিফের এই অনৈতিক ভাবনাতে সায় দেওয়ার কোন মানে নেই। তারপরও বন্ধুর ভুল ভাঙানোর চেষ্টায় খানিকটা অনিচ্ছা সত্বেও জিজ্ঞেস করা “তুই কি সিরিয়াস, শায়লার সাথে কি আবারো রিলেশনে জড়িয়েছিস? একবারও তোর স্ত্রী বাচ্চাদের কথা চিন্তা করিস নি?”
“দোস্ত, আমি শায়লাকে ছাড়া বাঁচবো না! আমি ওকে একেবারে ছোটবেলা থেকে ভালবাসতাম, এখনো বাসি। আর মেয়েটা সত্যই খুব কষ্টে আছে রে বন্ধু, আমার সাথে কথা হয়েছে! আমি এখন আমার সত্যিকারের ভালোবাসাকে পরিণতি দিতে চাই। আমি শায়লাকে বিয়ে করব। বন্ধু, তোর কাছে জোর মিনতি, আমাকে একটু সাহায্য কর।”
সিদ্ধান্ত (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।)
“তোর বাইশ বছরের সংসার জীবন, স্ত্রী তিন কন্যা, সেই সাথে চাকুরী ও সামাজিক অবস্থান! এর সব কিছু কি একবার ভেবে দেখেছিস? শায়লাকে যদি এ অবস্থায় বিয়ে করিস, আগে ভাগেই বলে রাখছি তুই কিন্তু সব হারাবি। অন্য বন্ধুদেরতো নয়ই, আমাকেও তোর এসব পাগলামিতে পাবি না। একটা কথাই বলতে চাই, তুই কিন্তু খাল কেটে কুমির আনছিস! এখনো সময় আছে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে!” পঁচিশ বছর আগে প্রেমিককে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করা শায়লাকে আসিফের বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ, বিষয়টাকে মোটেও সহজভাবে নিলাম না। আসিফ সম্ভবত আমার অবস্থানে সন্তুষ্ট হলো না। তাইতো তার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টায়।
“সোহেল, দোস্ত তোকে আজ একটা গোপন কথা বলছি। সংসার জীবনে তোদের ভাবির সাথে কিন্তু আমি মোটেও সুখী নই। হ্যাঁ, ও নিঃসন্দেহে ভালো একজন গৃহিণী, পরিবারের সবার দেখভাল করে। কিন্তু বেশ অনেকদিন ধরেই লায়লা কিন্তু আমাকে আর আকর্ষণ করে না। কেন জানি প্রেম-ভালোবাসা এই জিনিসগুলো ওর মধ্যে এখন আর নেই। কেমন একটা রোবট জীবনে, বাচ্চাদের নিয়েই ওর শত ব্যস্ততা। আরও একটা কথা তোকে শেয়ার করছি, ও কিন্তু অনেকদিন ধরেই আমার সাথে বিছানাও শেয়ার করে না। নানান অজুহাতে রাতের বেলায় ছোট মেয়েটার সাথে ঘুমায়। আচ্ছা দোস্ত তুই ই বল, আমি তো একটা পুরুষ মানুষ। আমারও তো দৈহিক কিংবা মানসিক চাহিদা রয়েছে, তাই না? লায়লা কিন্তু এই জিনিসগুলো একেবারে বোঝার চেষ্টা করে না। তাইতো বছর দুয়েক আগে হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে আমার জীবনে শায়লার উপস্থিতি যেন তপ্তদিনে এক পশলা বৃষ্টি! ওর সঙ্গ কিংবা কথোপকথন, আমি ভীষণ এনজয় করি! একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতো করে।” আসিফ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পাবলিক লাইব্রেরির সিড়ির গোড়ায় চলে এলাম, ওখানেই আমাদের বসে পড়া।
আজ আমি ওর গল্পের এক মনোযোগী শ্রোতা। প্রতিটা কথায় ভীষণ অবাক হচ্ছি। ইদানিংকালে আধুনিক পরিবারগুলো যে কত রকমের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই!
“তুই যে তোর প্রাক্তনের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে গেছিস, এটা কি ভাবি বা তোর পরিবারের কেউ জানে?” আসিফকে ইন্টারাপ্ট করলাম।
“আরে না, আমার বউয়ের কি আমাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় আছে। আমি যদি রাতে বাসায় নাও ফিরি, লায়লা হয়তোবা আমার কাছে এই বিষয়ে কৈফিয়তও চাবে না! না দোস্ত, শায়লার বিষয়টা এখনো পর্যন্ত কেউউ জানে না। আজ ই তোর কাছে প্রথমবারের মতো কনফেস করলাম।” পুরো বিষয়টি যে এখনো গোপন আছে, জানতে পেরে ভালো লাগলো।
“তোর নেওয়া বিয়ের এই সিদ্ধান্তে, শায়লার কি মত? ও কি ওর মতামত তোকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে!” কথোপকথন আর না বাড়িয়ে, আসিফের কাছ থেকে ঘটনাটার সর্বশেষ কি অবস্থা, বোঝার চেষ্টা করলাম।
“তুই তো শায়লাকে চিনিস দোস্ত। ও কি কখনো মুখ ফুটে কিছু বলেছে। আমি অবশ্য আমার ভালোলাগা ও বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা ওকে জানিয়ে দিয়েছি! ও অবশ্য প্রত্যুত্তরে এখনো কিছু বলেনি, তবে আমি ওকে খুব ভালো করে জানি। নীরবতা যে ওর সম্মতির লক্ষণ, তা ধরেও নিয়েছি। কিন্তু আমার সমস্যাটা কিন্তু অন্য জায়গায়, পরিবার বা প্রফেশন সামলিয়ে পুরো বিষয়টাকে কিভাবে সামলাবো! এই বিষয়টাতে তোর একটু সাপোর্ট চাচ্ছি বন্ধু, আমার মাথা ইদানিং ঠিকভাবে কাজ করছে না। তবে আমি আমার জীবনে শায়লাকে চাই, প্রকৃত ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে।” আসিফের সাথে কথোপকথনের এই পর্যায়ে এসে আমার একটু খটকা লাগে।
ছেলেটাকে আজ আমার প্রথম থেকেই একটু অন্যরকম লাগছে। সত্য বলতে কি, বন্ধু আসিফকে সাহায্য করার জন্যই এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। তাইতো ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম “দোস্ত তুই বিষয়টা নিয়ে কোন চিন্তা করিস না, আমি দেখছি। আপাতত তোর কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই। ইনশাল্লাহ তোর জন্য যেটা ভালো হবে, সেটাই করবো। বন্ধু হিসাবে তোকে এই নিশ্চয়তাটা দিলাম।” খুব খুশি হয়ে সে রাতে আসিফ বাসায় ফিরেও গেল।
আর এদিকে আমি বলতে গেলে সারারাত ঘুমোতে পারলাম না, বারবার আসিফের বাচ্চাদের ও ওর পরিবারের কথা মনে পড়তে লাগলো। আবার একই সাথে আসিফকে পুরোপুরি সুস্থ বলেও মনে হলো না বলে কষ্টবোধে। ওর জন্য কিছু একটা করতে হবে এই ভাবনা নিয়ে ভোরের দিকে ঘুমোতে গেলাম।
“তোর কি মাথা খারাপ সোহেল? আমি কেন আসিফকে বিয়ে করতে যাব? ওর স্ত্রী আছে, তিনটা মেয়ে, কত সুন্দর একটা সংসার! আমি কেন জেনে শুনে একটা সংসার ভাঙতে যাব। আর সত্য বলতে কি, হাসিবের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, জীবনে কারো সাথে আর সম্পর্কে জড়াবো না। মেয়ে আরিশাকে নিয়ে আমি এখন বেশ ভালোই আছি!” পরদিন লাঞ্চ শেষে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সোজা চলে এলাম গুলশানে, শায়লার অফিসে। বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে, খোলামেলা ভাবে আসিফের নেওয়া বিয়ের সিদ্ধান্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই শায়লার দেওয়া এই উত্তরে প্রাণ ফিরে পেলাম। শায়লাকেও আমার অনেকদিন ধরে চেনা, ও যে কোনরকম ভনিতা করছে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।
“তবে যে আসিফ বলল, তোর সাথে গত দুই বছর ধরে ওর খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, প্রতিদিন কথা হয় । তোরা না কি প্রায়ই দেখাও করিস? আর আসিফ না কি বিয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়টা তোকে জানিয়েছেও?” অনেকদিনের বন্ধুত্বের খাতিরে, শায়লাকে বিষয়গুলো নিয়ে আমার সরাসরি জিজ্ঞেস।
“আসিফ একেবারে মিথ্যে বলেনি! হ্যাঁ ওর সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়, সামনাসামনি দেখাও হয়েছে বার কয়েক! কিন্তু এর সব কিছু একেবারে বন্ধু হিসাবে, অন্ততপক্ষে আমার দিক থেকে কোন রিলেশনে জড়ানোর ইচ্ছা গোড়া থেকেই নেই। ও রাতের বেলায় ফ্রি থাকে! আচ্ছা তুই ই বল, নিঃসঙ্গ এই আমাকে কাছের কোন বন্ধু যদি প্রতিদিন সময় দেয়, ভালো ভালো কথা বলে! আমার কি ইচ্ছা করবে না তার সঙ্গ পেতে?” শায়লার দেওয়া এই যুক্তি মেনে নিতে পারলাম না। আমি নিশ্চিত, শায়লা প্রশ্রয়েই আসিফের এই তিলকে তাল বানানো। আর আসিফকেও দোষ দিতে পারি না, ও যে স্কুল জীবন থেকেই শায়লা পাগল। আমি আর কথা বাড়ালাম না, সমস্যাটার দ্রুত সমাধান করতেই।
“শায়লা তুই যেটা করছিস, এটা মোটেও এথিকাল না। ফেইসবুকে বা গ্রুপে তোর প্রাক্তন বা বন্ধুরা থাকতেই পারে। তাই বলে তাদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা কিংবা সামনাসামনি দেখা করা, অন্ততপক্ষে তোর মত মেয়ের কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি। তোদের এইসব নিছক আনন্দের জন্য একটা সুন্দর পরিবার এখন ধ্বংস হওয়ার প্রান্তে। বন্ধু হিসেবে তোর কাছে জোর অনুরোধ, পুরো বিষয়টি চাইলে তুই আজই শেষ করে দিতে পারিস।” শায়লার আত্মসম্মানবোধ প্রচন্ড, ও আমার বলা শেষ কথাটায় সম্ভবত ভীষণ অপমান বোধ করল।
” যা, দিস ইজ ওভার!” এই কথা বলে আমার সামনে দিয়ে হনহন করে চলে যাওয়া এই মেয়েটার জন্যও খারাপ অনুভবে। হয়তো মেয়েটা বুঝতেও পারেনি, ওর টাইম পাস করার বিষয়গুলোতে যে আসিফ এতটা পাগল হয়ে যাবে। তবে শায়লাকে যে পুরো বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাতে পেরেছি, এতেই সান্তনা পেলাম।
এরপর গুলশান দুই থেকে জ্যাম ঠেলে খিলগাঁওয়ে আমাদের বাসায় ফেরার পথটুকুতেই যে অনেক কিছু হয়ে গেছে, তা বুঝতে পারিনি। আমাদের স্কুল বন্ধুদের নিয়ে ফেসবুকে একটা গ্রুপ রয়েছে, শায়লা ওখান থেকে এরই মধ্যে লিভ নিয়ে নিয়েছে। আমার মত নির্দোষ ব্যক্তিকেও ওর ফেইসবুক থেকে ছেঁটে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম শায়লা পুরো বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এখন সমাধানের চেষ্টায়।
“সোহেল তুই কই? আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে বন্ধু! শায়লা আবারো আমার সাথে বেঈমানি করেছে! একটু আগে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, আমি যেন ওর সাথে আর কখনো যোগাযোগ না রাখি! ও আমাকে না কি কখনো ভালবাসেনি, এখনো না। শুধুমাত্র টাইম পাস করার জন্য বন্ধু হিসাবে না কি আমার সাথে ওর সময় কাটানো! তোর সাথে কি শায়লার কোন কথা হয়েছে?” ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে আসিফের একটানা উদ্বেগ।
“না আমার সাথে শায়লার কোন কথা হয়নি। দোস্ত মন খারাপ করিস না, আমি এখুনি আসছি। বল তুই এখন কোথায়?”
ইচ্ছা করেই আজ প্রিয় বন্ধুর সাথে মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য হলাম। একটা মিথ্যা সম্পর্ককে ধ্বংস করতে। আর অযথাই বিষয়টাকে কমপ্লিকেটেড করতে চাইলাম না।
শায়লা যে আসিফকে ভালবাসে না, আর বিয়ে করা তো প্রশ্নই আসে না! এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই আসিফকে আমার মিথ্যা এই বলা। শায়লার ব্যক্তিত্ববোধ সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে। মেয়েটা যে এ জীবনে আর কখনোই আসিফের সামনে আসবে না, এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে আসতেই আসিফকে আজ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় পেলাম। এরপর প্রায় ঘন্টা দুই কথোপকথনের পর আসিফকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে শায়লা ওকে কখনোই মন থেকে ভালোবাসেনি, এখনোও না। মেয়েটা ওর জীবনে শুধুই একটা মরীচিকা। পরিবারের সাথে ওর সম্পর্কের উন্নতি, বিষয়টিতে কাজ করার অনুরোধও করলাম।
সে রাতেই আমি আসিফ সহ আমাদের কাছের পাঁচ বন্ধু পরিবারের একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করলাম! পরের শুক্রবার, ঢাকার কাছেই সুন্দর একটা রিসোর্টে। উদ্দেশ্য আসিফকে একটু স্বাভাবিক করা, পরিবারের সাথে তৈরি হওয়া ওর গ্যাপটা একটু কমানো। লায়লা ভাবি খুব সহজ সরল ভালো একজন মানুষ, অন্ততপক্ষে আমাদের বন্ধুদের তা ই ধারণা। পরদিন অফিস শেষে ভাবিকে পিকনিকের দাওয়াত দিতে ওদের বাসায় পৌঁছাতেই আসিফকে বেশ হাসি খুশি ও স্বাভাবিক বলেই মনে হলো। বুঝে নিলাম, শায়লার বিষয়টা এখন বিপরীতে হিত!
“দোস্ত তোর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। অযথাই নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছিলাম। তোর কথাই সত্য, শায়লা আসলে কখনোই আমাকে ভালবাসেনি। ও আমার সাথে সারা জীবনই টাইম পাস করল!” পিকনিকের সকালে রিসোর্টের ব্রেকফাস্টে বলা আসিফের কথাটাকে আর বাড়াতে দিলাম না।
“আজকের এই সুন্দর দিনে শুধু শুধু আজেবাজে প্রসঙ্গ নিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করেছিস কেন? যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো বিষয়টা যে অল্পতেই শেষ হয়ে গেল। আমার ভালো লাগছে, তোকে অনুতপ্ত হতে দেখে! দেরিতে হলেও যে ভুল বুঝতে পেরেছিস, এতেই আমি খুশি। আশেপাশে অন্যান্য উদাহরণ দেখ, এসব বিষয়ের পরিণতি খুব খারাপ!” আসিফ মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিল।
“ও আরেকটা কথা, ভাবির সাথে তোর সম্পর্কটা উন্নত করার যে পরামর্শটা দিয়েছিলাম। সেটার কি অবস্থা? ঠিকঠাক মত কাজ করছিস তো? মেয়েদের রোমান্টিক আর ভালোবাসার মানুষ বানানোর দায়িত্ব কিন্তু পুরুষদেরই!” আমার বলা শেষ কথাটাতে কিছু একটার ইঙ্গিত পেয়ে আসিফের দেওয়া জোর হাসিতে, সোমা আর লায়লা ভাবি এসেও যোগ দিল। আমরা সবাই মিলে এখন একটানা হাসি আর আনন্দে!
সমাপ্ত।