চক্রব্যূহ পর্ব-০১

0
163

#সামাজিক থ্রিলার
#চক্রব্যূহ
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

নীলফামারী জেলার বাবুর হাট থানার হিজলতলা গ্রামের মেয়ে পড়শী। খুবই মেধাবী। গ্লোডেন জিপিএ পেয়ে এসএসসি, এইচএসসি পাশ করেছে। এরপর ভর্তি যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করে ঢাকাভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। গ্রামের একটা সাধারণ মেয়ে ঢাকা শহরে এসেই থতমত খেয়ে গেল। প্রথমদিন ভার্সিটিতে ক্লাসে ঢোকার পর সবাই ওর দিকে যেন কেমন করে তাকিয়েছিলো। ও চুলে তেল দিয়ে লম্বা বেনী করে আয়রন বিহীন সালোয়ার কামিজ পড়ে পায়ে এক জোড়া চটি গলিয়ে ভার্সিটিতে এসেছিলো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ,মুখে কোনো প্রসাধনীর বালাই ছিলো না। ক্লাসে সবাই ওকে দেখে মিটমিট করে হাসছিলো।আসলে এর বাইরে খরচ বহন করার মতো সামর্থ ওর বাবার ছিলো না। বাবা একজন কৃ ষক। ওরা দু,বোন একভাই। ভাইটা সবার ছোটো। পড়শী ওর স্কর্লাশিপের টাকা দিয়ে এই পোশাকটুকু কিনেছে। ক্লাসে একদম পিছনের বেঞ্চটায় বসে কোনোরকমে পড়শি ক্লাসটা শেষ করলো। স্যার চলে যেতেই ও ক্লাস থেকে বের হয়ে একটা নিরিবিলি ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লো। ওর গ্রামের কথা খুব মনে পড়ছে। বাবা মায়ের কথা,ভাই বোনের কথা খুব মনে পড়ছে। গ্রামের মেঠাপথ আর সবুজ বনানী ওকে যেন হাত ইশারা করে ডাকছে। ওর স্কুল, কলেজের কথা মনে হতেই কান্নার বেগ যেন উথলে উঠলো। কোনো ক্রমে নিজেকে সামলে হেস্টেলে ফিরে এলো।

এভাবেই ওর ক্লাসগুলো চলছিলো। এক সপ্তাহ পার হয়ে যাবার পরও কেউ ওর বন্ধু হয়নি। তবে হোস্টেলে একটা মেয়ের সাথে ওর ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। ওর নাম জয়নব। ও একটা কোম্পানীতে রিসিপশনিস্ট পদে চাকরি করে। ও গ্রাম থেকে এসেছে। সরকারী কলেজ থেকে অনার্স পাশ করে এই অফিসে জয়েন করেছে। জয়নব খেয়াল করেছে পড়শী মনমরা হয়ে ভার্সিটিতে যায়। মাঝে মাঝে রুমে আনমনা হয়ে বসে থাকে। চোখের পাপড়িগুলো ভেজা থাকে। জয়নব অফিস থেকে ফিরে আজ আর চুপ থাকলো না। পড়শীকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ভার্সিটি ক্লাস কেমন চলছে? তুমি সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকো কেন?
এই কথাটা বলার সাথে সাথে পড়শি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলে। ওর কান্না দেখেই জয়নব বুঝলো গাঁয়ের এই সহজ সরল মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। তাই ওকে সাহস দিয়ে বললো,
—-,পড়শী এভাবে কাঁদলে তো কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। তুমি আমাকে বলো ভার্সিটিতে কেউ কি তোমার সাথে খারাপ কিছু করেছে? দেখো পড়শী তুমি আমাকে সবটুকু খুলে বলো। আমি সমাধান করার চেষ্টা করবো।
পড়শী এই সাতদিনের সব ঘটনা খুলে বললো। জয়নব সবটা শুনে বললো,
—-আমি তো ভেবেছি না জানি কি হয়েছে? এতো সামান্য ঘটনা। এতো অল্পতে চোখের পানি ফেলতে নেই। চোখের পানির অনেক মুল্য।
—-না,আপু।আমিও সহজে চোখের পানি ফেলি না। কিন্তু একদিকে ভার্সিটিতে মানিয়ে নিতে পারছি না অন্যদিকে বাবা মা ভাই বোন,আমার গ্রাম আমার স্কুল কলেজ কিছুই ভুলতে পারছি না। বার বার মনে হচ্ছে এই ঢাকা শহর আমার জন্য নয়।
—-শোনো, তুমি তো হেরে যেতে ঢাকা শহরে আসোনি। নিজের যোগ্যতায় চান্স পেয়েছো। জিততে তোমাকে হবে। ইনশাআল্লাহ তোমার নীতি আদর্শ ঠিক থাকলে দিন শেষে তুমি জিতে ফিরতে পারবে।

এরপর দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে জয়নব পড়শীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমে পারলারে গিয়ে চুলটা একটু ফ্যাশনেবল করে কেটে দেয়। মুখটা ফেসিয়াল করে দেয় যাতে চেহারার উজ্জ্বলতা বাড়ে। জীবনে পড়শী প্রথম পারলারে এসেছে। সব কিছু করার পর আয়নায় নিজের দিকে নিজে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেদিকে লক্ষ্য করে জয়নব বললো,
—-তুমি তো দেখতে এমনিতেই অনেক সুন্দর। ঘষা মাজার ফলে সেটা পরিপূর্ণভাবে পরিস্ফুটিত হওয়াতে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।

তারপর জয়নব আর পড়শী ঢাকা কলেজের অপজিটে দোজা মার্কেটে গিয়ে দুটো জিম্স আর চারটে ফতুয়া আর দুটো ওড়না কিনে দেয়। পড়শী যদিও বলেছিলো এই মুহুর্তে ওর কাছে টাকা নাই। কিম্তু জয়নব বললো,”তোমাকে ধার দিলাম। যখন হাতে টাকা আসবে আমাকে দিয়ে দিও।”
পড়শী এমনিতেই দেখতে বেশ সুন্দর। চুলগুলো কাটার ফলে রুপ যেন উপচে পড়ছে। হোস্টেলে ফিরে ও নিজেকে আয়নায় আবারও দেখলো। ওর চেহারায় খুশী উপচে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে জয়নব বললো,
—-দেখো আবার,কারো প্রেমে পড়ে যেও না। কারণ ভালোবাসার জন্য সঠিক মানুষটাকে পছন্দ করতে হয়। তা,না হলে সারাজীবন ধরে পস্তাতে হয়।

পরদিন ভার্সিটিতে ঢুকার সময় সবাই আবারও ওর দিকে তাকিয়েছিলো। কিন্তু ওদের এই দৃষ্টিতে কোনো তাচ্ছিল্য ছিলো না। সেখানে ছিলো একরাশ মুগ্ধতা। চুলগুলো পিঠের উপর ছড়ানো, মুখে হালকা প্রসাধনী,জিন্সের প্যান্টের সাথে ফতুয়া গলায় ওড়না প্যাঁচানো চোখে রিমলেজ চশমা সবমিলিয়ে পড়শীকে দেখে যেন চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। পড়শীর আজ ভার্সিটিতে এসে ভীষণ ভালো লাগছে। ক্লাস শেষ করে ও লাইব্রেরীর দিকে গেল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠার সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছিলো। সিঁড়ির গোড়ায় পড়শীকে দেখে ঐ মাস্তানের দল থেকে একজন বলে উঠলো,
—-এই মালটা মনে হয় ফাস্ট ইয়ারের। হেব্বি সেক্সি।
কথাগুলো পড়শীর কানে আসাতে কান মাথা সব গরম হয়ে গেল। এরমাঝে একটা ওর হাত ধরে টেনে বুকের কাছে এনে বললো,
—-তোমারে দেখার পর শরীরটা যে গরম হয়ে গেল। এখন এর দায় তো তোমাকে নিতে হবে।
ওদের এমন অসভ্যতায় পড়শীর মাথা গরম হয়ে গেল। ও চটাশ করে ঐ মাস্তানের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
—-মেয়ে মানুষকে একলা দেখলেই শয়তানী বুদ্ধি মাথায় ঘুরপাক খায় তাই না? এখন দেখ কেমন লাগে। গাঁয়ের কাদামাটি ছেনে বড় হওয়া এই আমাকে ভালো করে চিনে রাখ।
ওরা পড়শিকে একলা পেয়ে ওর দিকে তেড়ে আসতে গেল। তখনি পড়শি আর ঐ মাস্তানগুলোর চিৎকার চেঁচামেচিতে স্টুডেন্টরা জড় হতে থাকলো। অবস্থা বেগতিক দেখে চড় খাওয়া পাবলিক ওকে বললো,
—-এই চড়টার কথা আমার মনে থাকবে। তবে এর শোধ আমি তুলবো।
একথা বলে মাস্তানগুলো ওখান থেকে চলে গেল।
পড়শি ওদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হেসে লাইব্রেরীতে চলে গেল। ওখানে সবাই বলাবলি করছে নতুন এসে মেয়েটার এতো সাহস দেখানো ঠিক হয় নাই। বলা যায় না কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়িয়ে পড়ে। তবে কেউ কেউ এটাও বললো,
—-,আমাদেরও ভয় না পেয়ে ওর মতো করে প্রতিবাদ করা উচিত।
ঐ ছেলেগুলো সংসদের রুমে চলে গেল। চড় খাওয়া ছেলেটি চেয়ার ছুড়ে মেরে সোফায় বসে পড়লো। দলের একটা ছেলে বললো,
—-ইনান ভাই তুমি মাথা গরম করো না। এর শোধ আমরা তুলবো। সায়েম ভাইকে ফোন দিবো?
—-দে,ফোনটা ধরলে হয়। এখন কোন মেয়ের বুকে মুখ গুজে আছে কে জানে? এসব কাজে ব্যস্ত থাকলে ব্যাটাতো ফোন রিসিভ করবে না।ব্যাটা একটা মাগীবাজ।
সায়েম যখনি ওর শিকারী মেয়েটার ঠোঁটে ঠোঁটটা ডুবাতে যাবে অমনি ফোনটা আর্তনাদ করে বেজে উঠলো। সায়েমের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। ফোনটা রিসিভ করে বললো,
—-ঐ শালার ব্যাটা শালা ইনান ফোন করার আর সময় পেলি না তাই না? আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছি। তোদের এই সময়ে বাগড়া না দিলে হতো না?
—-তুমি কি নিয়ে ব্যস্ত থাকো সেটা আমরা জানি। আজ ভার্সিটিতে একটা মেয়ে আমার গালে থাপ্পড় মেরেছে।
—-খুব ভালো কথা। এখন চুড়ি পরে বসে থাক।
—-বস এটা তুমি কি বললে? এর শোধ তোমাকে নিতে হবে।
সায়েম ফিচেল হাসি হেসে বললো,
—-লাঞ্চের পর ভার্সিটিতে আসছি।
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে