পর্ব-৪
#সাদা ফুল
#ফারিয়া_আক্তার_নূপুর
–
খালি পায়ে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। প্রতি পাঁচজনকে একটি করে শ্রদ্ধার ফুল দিয়ে সারি বানিয়ে দাঁড় করে রেখেছেন শিক্ষকরা। একটু পরেই প্রভাতফেরি শুরু হয়। পিচ ঢালা পথে শহীদদের স্বরণে সকলে একসাথে উচ্চস্বরে গেয়ে চলে ” আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কী ভুলিতে পারি”। শহীদ মিনারে এসে একে একে সবাই গভীর শ্রদ্ধা অনুসারে পুষ্প নিবেদন করে। তারপরই শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুভ্রতা কবিতা আবৃত্তিতে নাম দিয়েছিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর শুভ্রতার নাম ডাকা হয়।শুভ্রতার নাম কানে আসতেই তীব্র মঞ্চের দিকে তাকায়। হৃৎপিণ্ডের লাব-ডাব নামক স্পন্দন দ্রুত গতিতে চলে। এতদিন পর চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় তীব্রের। প্রেয়সীর এই রূপ যেন জ্বলসে যাওয়া চাঁদের জ্বলজ্বলে রাশির মতো। মুগ্ধ চোখ তাকিয়ে আছে তীব্র তার চারপাশের সময় যেনো থমকে গিয়েছে। অয়ন মাঠের বাইরে ছিলো। যখন মাঠে আসে ততক্ষণে শুভ্রতা কবিতা আবৃত্তি শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে যায়। তীব্রের ঘোর কাটতেই শুভ্রতাকে না দেখে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে খুঁজতে থাকে আর একসময় পেয়েও যায়। প্যান্ডেলে এক কোণে চেয়ারে বসে খিলখিলিয়ে হাসছে শুভ্রতা। তীব্রের ডান হাতটি বুকের ওপর গিয়ে থামে চোখে তার অগোছালো একটা চাহনি। অনয় তখন মাঠের বাইরে ছিলো যখন আসে ততক্ষণে শুভ্রতা মঞ্চ থেকে নেমে গেছে। অনয় বুকে হাত দেখে ব্যস্তকন্ঠে তীব্রকে জিজ্ঞেস করে,
“তীব্র তুই ঠিক আছিস? বুক ব্যাথা করছে? বাড়ি চল, চাচাকে ডাক দেই এখানেই তো আছেন।
তীব্র অয়নের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
“বুকের ভিতরের যন্ত্রটা অস্বাভাবিকভাবে চলছে”!
এতটুকু বলেই অয়ন কিছু বলার আগেই তীব্র অয়নের উপর সেন্সল্যাস হয়ে পরে যায়। অয়ন বেশ ঘাবড়ে যায়। মঞ্চ থেকে তালহা রহমান ছেলের এই অবস্থা থেকে দ্রুত মাঠে নেমে আসে। কিছুক্ষণের মাঝেই বেশ ভীর জমে যায়। শুভ্রতাও উঠে আসে দেখার জন্য কি হয়েছে। কিন্তু ভীড়ের কারণে তেমন কিছুই দেখতে পায়না। শুধু শুনে “চেয়ারম্যানের পোলাডা আজ্ঞান হইয়া গেছে”। তীব্রকে তাড়াতাড়ি রিক্সায় করে বাসায় নিয়ে বাজারের ডাক্তারকে ডাকা হয়। তিথি রহমান ছেলের অবস্থা দেখে কেঁদেই দিয়েছেন। হায়রে বেচারা তীব্র। প্রিয় মানুষকে দেখার আনন্দে শেষ অব্দি অজ্ঞান হয়েই গেলো। কি লজ্জাকর ব্যাপার! ডাক্তার তীব্রকে পর্যবেক্ষণ করে জানায় তেমন কিছু হয়নি। একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে তারপর চলে যান। তিথি রহমান তীব্রের পাশে বিছানায় বসে বেশ কিছুক্ষণ চুলে বিলি কেটে দেন। দুপুর ১২টার দিকে তীব্রের ঘুম ভাঙে। নিজের বুকের ওপর ক্যামেলিয়াকে বসে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে। শুয়া থেকে উঠে বসে। তারপরই সকালের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা মনে পরতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠে তীব্র ।আহা কি লজ্জাজনক ব্যাপার ! তিথি রহমান রেনু রহমান লতা সবাই তীব্রের ঘরে চলে আসে হাসির শব্দ শুনে। তিথি রহমান ছেলে কাছে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে আব্বা? হাসতাছো ক্যা?
পাশ থেকে লতা রেণু রহমানকে ধীর কন্ঠে বলে,
“বড়মা ছোডো আব্বার ভাবখান কয় ভালা মনে হয়তাছে না। ধপাস ধপাস ফিট খায়, হুহা কইরা হাসে সাদা বিলাই লগে লইয়া ঘুরে এডিন কইলে ভালা না।”
রেণু রহমান কথাটা যেন মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। অসহায় চোখে একবার তীব্রের দিকে তাকালেন। লতা আবারো বলল,
“খারান বড়মা। আগে আমি বুইজা লই।”
এতটুকু বলে তীব্রের সামনে গিয়ে জ্ঞানী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ছোডো আব্বা রাইত বিরাতে, দিনে আপনি কি পরী দেহেন আপনার কাছে, যা আমরা কেউ দেহি না”?
তিথি রহমান বেশ বিরক্ত হন লতার ওপর। ধমক দিয়ে কিছু বলার আগেই তীব্র আবারও হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বিছানা থেকে নেমে রেণু রহমানের কাছে গিয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“দাদি তুমিও কি আমার সাথে পরী দেখতে চাও?”
রেণু বেগম চুপ করে থাকে। লতার কথাটাই তার কাছে এখন যেন সত্য লাগছে। তীব্র তাকে ছেড়ে দিয়ে তোয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে,
“খুব দ্রুত দেখাবো ইনশাআল্লাহ”।
–
বিকেলের মধ্যেই শুভ্রতার সব খবর নিয়ে ফেলে তীব্র। তারপর অয়নকে নিয়ে শুভ্রতার বাড়ির পথের দিকে আসে বাইক দিয়ে।বাইক থেকেই চোখ পরে বাড়ির পাশে মাঠের দিকে। মাঠের পাশেই বাইক থামিয়ে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে মাঠে খেলা করা শুভ্রতার দিকে। ভালোবাসা বড় অদ্ভুত। হুটহাট চলে আসে। কঠোর মনের যুবকের মনকে বানিয়ে তুলে নরম তুলতুলে সাদা শিমুল তুলার মতো। তীব্রের মনও বর্তমানে সেই তুলোর মত যা বাতাস উড়ে বেড়ায় তার শুভ্র ফুলের রমনীকে দেখতে।
–
৫.
পরেরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে রাস্তার ওপাশে দোকানে তীব্রের হাতে বিড়ালের দিকে নজর যেতেই শুভ্রতা খুশি হয়ে রাস্তা পার হয়ে খুব দ্রুত তীব্রের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তীব্রের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে নিঃসংকোচে বলে,
“আপনার বিড়ালটাকে আবারও একটু আদর করি”?
শুভ্রতার আচমকা সামনে আসা আর নিঃসংকোচ এই আবেদনে বেশ ঘাবড়ে যায় তীব্র যদিও ক্যামেলিয়াকে নিয়ে সে শুভ্রতার জন্যই দাড়িয়ে আছে। ক্যামেলিয়ার ব্যস্ত কন্ঠে ম্যাও ম্যাও ডাকে ধ্যান ভাঙে তীব্রর। তাকিয়ে দেখে ক্যামেলিয়াও শুভ্রতার কাছে যাওয়ার জন্য নড়ছে। তাই খুব সযত্নে শুভ্রতার হাতে তুলে দেয় ক্যামেলিয়াকে। শুভ্রতার এক হাতে কোলে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে মাথায় আদর করতে করতে বলে,
‘নাম কি ওর?”
ক্যা ক.. ক্যামেলিয়া।
কাঁপা কন্ঠে উত্তর দেয় তীব্র। শুভ্রতার উপস্থিতি এই শক্তপোক্ত যুবকের ভিতর কাপিয়ে তুলছে। শুভ্রতা পিটপিট করে তীব্রের দিকে তাকিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে,
” ক্যামেলিয়া অর্থ কী”?
“এক ধরনের ফুল”।
মিষ্টি হাসি দিয়ে শুভ্রতা বলে,
“ফুলও আমার খুব পছন্দের বিড়ালও”।
তীব্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্রতার হাসোজ্বোল চেহারার পানে। এতক্ষণে লায়লাও শুভ্রতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
“শুভ্র পিটি শুরু হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি চল।”
শুভ্রতা তীব্রের হাতে ক্যামেলিয়াকে দিয়ে বলে
“আল্লাহ হাফেজ ক্যামেলিয়া, আবার দেখা হবে।
ক্যামেলিয়াও শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে বলে,
“ম্যাওওওওওওও।”
শুভ্রতা চলে যাওয়ার পর দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে তীব্রকে কাঁপতে দেখে পিঠে হাত দিয়ে বলে,
“ভাই আবারও কি অজ্ঞান হয়ে যাবি”?
তারপর দুই বন্ধু হেসে উঠে আর ক্যামেলিয়া তাদের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
চলবে….