#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১৭
#সুমাইয়া_আফরিন
‘তুই রাফতের সাথে দেখা করবি?’
‘হুম কেন?তোকেও সাথে নিতে হবে নাকি?’
‘আমি মরে গেলেও যাব না।’
অনু এতক্ষন আয়নার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। লারার এমন উদ্ভট টাইপের কথা শুনে পেছন ঘুরে তাকালো অনু। কিন্তু ইতিমধ্যে লারা চলে গেছে ঘর থেকে৷ মনের অজান্তেই ফিক করে হেসে দিল অনু। লারাটা একটু বাচ্চাদের মতো। ওর মা প্রতিনিয়ত ওর বিয়ের কথা জানায় অনুকে। কিন্তু লারা যতবার বিয়ের কথা শোনে ততবার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায় তার। ভেংচি কেটে দাঁত খিচিয়ে বলে ওঠে,
‘আমি এখন বিয়ে করবো না। আগে প্রেম করব তারপর বিয়ে করব বুঝতে পেরেছিস শাকচুন্নির দল।’৷
____________
অনু বসুন্ধরা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যেতে প্রচন্ড ভয় করছে তার। অধিক সংকোচ আর জড়তা কজ করছে তার মধ্যে। প্রতিনিয়ত অদ্ভুত এক অনুভুতি সৃষ্টি হচ্ছে তার হৃদয়ে। ধীরে ধীরে অনুর নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে।
অনু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চারটা বেজে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনু বড় বড় পায়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে গেল। রেস্টুরেন্টের দুই তালায় গিয়ে রাফাতকে খুজতে লাগল অনু। হঠাৎ অনু নিজের ডান পাশের টেবিলে তাকিয়ে দেখল রাফাত ও তার সাথে দুইজন ভদ্রলোক বসে আছে। অনু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।
রাফাত ওই দুইজন ভদ্রলোকের সাথে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। মুহূর্তেই অনুর মাথায় রাগ উঠে গেল। এখানে তার সাথে দেখা করতে এসে বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাফাত? অনু অগ্নিবর্ষন করে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। অনুর ইচ্ছা করছে এক ঘুষি দিয়ে রাফাতের নাক ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু রেস্টুরেন্টে আরো অনেকে আছে যার কারনে এটা করতে পারবে না সে।
অনু রাফন্বিত হয়ে রাফাতের পাশের টেবিলে বসে পড়ল। দুই জন ভদ্রলোকের মধ্যে একজন রফাতের সমবয়সি আরেকজন মধ্যবয়ষ্ক একজন পুরুষ। অনু দাঁত কিটমিট করতে থাকলো। চারটা বেজে গেছে অথচ রাফাতের মনেই নেই যে আজকে তারা দেখা করতে চেয়েছে।
‘এই লোকটা যদি একটুও আমাকে ভালোবাসতো তাহলে তো এতক্ষনে আমাকে খোজা শুরু করে দিত। সালা বজ্জাত লোক,, মিথ্যা নাটক,সব মিথ্যা নাটক। নাটক করছে যে সে তার বাবাকে শাস্তি দিতে চায়। কেন যে বিশ্বাস করছি লোকটাকে কে জানে!’
কথাগুলো আপনমে আওয়াচ্ছিল অনু। একজন ওয়েটারকে ডাক দিয়ে নিজের জন্য কফি আনতে বলল অনু। বসুন্ধরাতে কফির দামও অনেক। অনু এখানে মোটেও আসতে চায়নি কিন্তু বসুন্ধরা রেস্টুরেন্টের পেছনে অনেক বড় একটা লেক আছে। অপরুপ সৌন্দর্য দিয়ে ঘিরে রয়েছে লেকটি। লেকের শান্ত পরিবেশ অসম্ভব ভালো লাগে অনুর।লেকের ঠান্ডা ও শ্রান্ত বাতাস হানা দেয় এই রেস্টুরেন্টে। যার কারনেই আজকে অনু এখনে এসেছে।
রাফাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ৪ঃ০৫ বেজে গেছে। রাফাত চারদিকে তাকিয়ে অনুকে খুজতে লাগল। নিজের পাশের টেবিলে তাকিয়ে দেখতেই চমকে উঠল সে। পাশের টেবিলে বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর ফোনের দিকে তাকিয়ে নিউজ পড়ছে। অনুকে এভাবে বসে থাকতে দেখবে এমনটা আগে আশা করেনি রাফাত।
কিছুক্ষন পরেই রাফাতের মিটিং শেষ হয়ে গেল। রাফাত মিটিং শেষ হওয়ায় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুর টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। আচমকা রাফাত অনুর সামনের টেবিলে বসায় অনু একটু চমকে গেছে। কিন্তু তা প্রকাশ না করে অনু ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল,
‘আপনার কাজ শেষ?’
রাফাত অনুর কথায় বুঝতে পারল এই সময়ে মিটিং থাকায় অনু প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছে। রাফাত শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনুর দিকে। অনু বিব্রত কন্ঠে বলে উঠল,
‘লেকের পাড়ে যাবেন?’
রাফাত মাথাটা একটু নিচু করে ছিল। অনুর এমন কথায় মাথা উচু করে অবাক চক্ষুতে তাকালো তার দিকে। অনু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। অনুর এমন দৃষ্টি যেন রাফাতকে একটু বিপদে ফেলে দিল। এক নেশ্য আবদ্ধ হয়ে পড়ছে রাফাত। কোনোরকমে মাথা ডানদিকে ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো রাফাত।
লেকের পাড়ে রাফাত ও অনু পাশাপাশি হাঁটছে। দুজনের মধ্যে যেন এক অদৃশ্যমান দুরত্ব বিরাজ করছে। ভয়াবহ ধরনের নিরাবতা পালন করছে তারা। লেকের ঠান্ডা বাতাসে রাফাতের অবাধ্য চুলগুলো বারবার তার কপালে এসে আছড়ে পড়ছে। অনু তাদের দুইজনের মাঝের নিরবতা ভেঙে দিয়ে বলে উঠল,
‘সরি, না জেনে এতগুলো কথা আপনার ব্যাপারে বলা ঠিক হয়নি আমার।’
রাফাত একটু ইতস্তত বোধ করতে লাগল অনুর সাথে কথা বলতে। রাফাত কখনো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলে ঘাবড়ায় না কিন্তু এই একজন মেয়ে যার সাথে কথা বলতে গেলেই প্রতিনিয়ত ঘাবড়াতে থাকে সে। রাফাত অনুকে উদ্দেশ্য করে চাপা গলায় বলে উঠল,
‘এইসব কথা বাদ দাও না প্লিজ।’
অনু এবার থমকে গেল। বড় বড় পা ফেলে রাফাতের সামনে এগিয়ে গেল সে। রাফাত ভ্রু কুচকে অনুর দিকে তাকিয়ে রইল। রাফাত অনেক লম্বা, প্রায় ছয় ফুটের মতো। কিন্তু অনু মাত্র পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। যার কারনে রাফাতের সাথে কথা বলতে গেলে মাথাটা অনেক উচু করে কথা বলতে হয় তাকে।
অনু মাথা উচু করে রাফাতের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাফাত অনুর থেকে চোখ সরিয়ে আবার তার দিকে তাকালো। অনু ভাবলেশহীন স্বরে বলে উঠল,
‘তাহলে এখানে থেকে কি করব? আমি এই কথাটা বলতেই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।’
রাফাত অনুর কথায় অনেকটা অবাক হলো। সামান্য এই কথা বলার জন্য তাকে দেখা করতে বলেছে অনু?অনু আর কিছু না ভেবে চলে যেতে নিল। কিন্তু এক পা বাড়িয়ে আর এগোতে পারলো না সে। রাফাত শক্ত করে অনুর হাত চেপে ধরে আছে। এমন কিছুর জন্যে অনু প্রস্তুত ছিল না তাই বর্তমানে তার কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে।
রাফাত অনুর হাত ধরে হ্যাচকা টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,
‘আরেকটু কি থাকা যায় না?’
অনু জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে থাকল। তার হৃৎপিন্ড যেন গলায় এসে আটকে গেছে। অনু রাফাতের থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে বলল,
‘কেন কিছু বলবেন?’
রাফাত রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘কেন? থাকলে কি হবে? আমি বাঘ না ভাল্লুক যে এখানে বেশিক্ষন থাকা যাবে না?’
অনু রাফাতের কথায় অনেকটা অবাক হয়ে গেল। এসব কি বলছে রাফাত? সে বাঘ ভাল্লুক হতে যাবে কেন? অনু ভ্রু কুচকে রাফাতকে উত্তর দিল,
‘আমি কি বলেছি আপনি বাঘ আর নয়তো ভাল্লুক?’
‘তুমি এমন ভাব করো যেটাতে এটাই মনে হয়।’
অনু কি বলবে বুঝতে পারছে না। সামান্য বিষয়ে যে রাফাত এত রেগে যাবে তা কখনো বুঝতে পারেনি সে। অনু একটা গলা খাকারি দিয়ে রাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আমি এমনই। আচ্ছা চলুন ওইদিকে যাই।’
অনু আঙুল দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করল। মুহূর্তেই রাফাতের চোখে মুখে আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ল। অনু খেয়াল করল, রাফাতের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট আনন্দ, ঠোটের কোণায় এক ফিচলে হাসি। অনু একটু মুচকি হাসি দিয়ে রাফাতের পাশপাশি হাঁটতে থাকল।
অনেক বিষয় নিয়ে গল্প হলো রাফাত আর অনুর মাঝে। অনেক হাসাহাসি আর কিছু মিষ্টি মুহূর্ত আবদ্ধ হলো একে অপরের কাছে। আচমকা এক মেয়েলী কন্ঠস্বর ভেসে আসল পেছন থেকে। মেয়েলী কন্ঠস্বরের সাথে ভেসে আসছে রাফাতের নাম। রাফাত আর অনু পেছন ঘুরতেই ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিধানকারী একজন মেয়ে জড়িয়ে ধরল রাফাতকে। রাফাত এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। অবাক হয়ে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইল সে।
অনু এমন কিছু দেখে দুই পা পিছিয়ে গেল। বিব্রত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। মেয়েটি ভীষন লজ্জাজনক ভাবে জড়িয়ে ধরে আছে রাফাতকে। অনুর ভেতরটা যেন দুমরে মুচরে যাচ্ছে। কান দিয়ে গরম হাওয়া বের হতে শুরু করল তার। চোখে অশ্রুজল বিদ্যমান। এক শুকনো ঢক গিলে চোখ সরিয়ে নিল তাদের থেকে।
চলবে,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)