#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১৬
#সুমাইয়া_আফরিন
স্কুটি নিয়ে হসপিটালে পৌছে গেল অনু। যেখানে ফ্রম জমা দিতে হয় সেখানে গিয়ে স্নেহার ফ্রমটি চাইলো সে। প্রায় পাঁচমিনিট পর অনু হাতে পেল সেই ফ্রমটি। ফ্রমটি দেখেই অনু উল্লাসে চিৎকার দিয়ে উঠল। অনুর চিৎকার যেন আশে পাশের মানুষের নজর কেড়ে নিয়েছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তারা অনুর দিকে। অনু সবার তাকানোর ভঙ্গিকে উক্ষেপ করে আবার ফ্রমটিতে নজর দিল। সৌভাগ্যবশত রাফতই ফ্রমটা পুরন করেছিল। আর যেহেতু ফ্রমটি রাফাত পুরন করেছে সেহেতু ফ্রমটিতে রাফাতের নাম্বারই দেওয়া আছে।
অনু রাফাতের নাম্বারটা সেভ করার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। ফোন অন করতেই চমকে গেল সে। মাথায় যেন বাজ পড়েছে তার উপর। ৫৫ টা ফোন দিয়েছে ইরা, লারা আর মিমি।অনু তাড়াতাড়ি করে নাম্বারটি সেভ করে নিল নিজের ফোনে। ফ্রমটি আবার যথাস্থানে রেখে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসলো সে। এক মুহূর্তও দেরি না করে নাম্বারটায় ফোন দিল সে। কিছুক্ষন রিং হয়ে কেটে গেল ফোনটা। অনু আবার চেষ্টা করল কিন্তু আবারও ব্যর্থ হলো সে। অনুর মনে এখন সন্দেহ জাগতে লাগল এটা সত্যি কি রাফাতের নাম্বার নাকি অন্য কারো?
মাথায় হাজারো চিন্তা নিয়ে স্কুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল অনু। বাড়িতে ঢুকতেই সবাই অনুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারে।ইরা ব্যকুল কন্ঠে প্রশ্ন করল,
‘অনু এতক্ষন কোথায় ছিলি তুই?’
অনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিমি বলল,
‘কাউকে কিছু না বলে কেন গেলি তুই?আর কোথায় গেছিলি?’
লারাও কিছু বলতে যাবে তার আগে অনু বিরক্ত হয়ে বলল,
‘আরে বাবা তোরা তো দেখছি প্রশ্ন দিয়ে আমাকে গিলে খাবি।’
এক নিশ্বাসে কথাটা বলে একট দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনু। অনুর উপর দিয়ে এত ধকল যাওয়ার কারনে হাপিয়ে গেছে সে। মাথার অসম্ভব যন্ত্রনা ভোগ করছে সে। অনু ইরা, লারা আর মিমির দিকে খেয়াল করে দেখল সবাই নির্বিঘ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনু নিজের ভ্রু উচু করে বলল,
‘কি হয়েছে?তোরা এত টেন্সড হয়ে আছিস কেন?’
ইরা অনুর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। ইরা কন্ঠস্বর উচু করে ব্যাঙ্গত্নক ভঙ্গিতে বলল,
‘এটা তুই বলছিস অনু? রাতে এক ঘন্টা দেরি করে এলি। তারপর সকালে না খেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলি। আর এখন দুপুর একটা বাজে। দেখ, চারিপাশে আযান দিচ্ছে। নিজের ফোনটা একবার চেক কর তোকে আমরা তিনজন কতোবার কল করেছি। কোথায় ছিলি তুই এতক্ষন?’
অনু ইরার কথায় মুচকি একটা হাসি দিল। ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল তার যে আর কেউ তার পাশে থাকুক আর নাই থাকুক তার এই বন্ধু সবসময় তার পাশে থাকবে।অনু জিহবা দিয়ে ঠোটযুগল ভিজিয়ে নিল। মুহূর্তেই ঠোট লাল বর্ণ ধারন করল তার। অনু মুখে ফিছেল হাসি নিয়ে বলল,
‘ওকেয় মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস,,, প্লিজ পার্ডান মি। আই’ম রিয়েলি ভেরি সরি। তোদের সাথে কন্ট্র্যাক্ট করা উচিত ছিল আমার।’
লারা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে অনুর দিকে। লারা অভিমানি কন্ঠে বলে উঠল,
‘এটা তোর আগে ভাবা উচিত ছিল অনু। আমরা যে কতো পরিমান টেনশনে ছিলাম তা তুই বুঝতে পারবি না।’
অনু কিছুক্ষন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বাস্তবে আসলেই সে আজকে অনেক টেনশনে ফেলে দিয়েছে তাদের। অনুর নির্লিপ্ত চোখে ক্ষমা পাওয়ার উৎকৃষ্ট ইচ্ছা ভাসমান। মিমি অনুর অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোটের কোণায় এক ফালি হাসি নিয়ে বলল,
‘আরে এখন এসব বাদ দে তো। বলছিলাম যে, কোথায় গেছিলি তুই?’
অনু বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বলা শুরু করল সব কাহিনি। আজকে অনুর এত যাত্রা শুনে সবাই হা করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। কিন্তু অনু খেয়াল করল সবার ঠোটের কোণায় এক অদৃশ্য হাসি বিরাজ করছে। অনুর বুঝতে বাকি রইল না সবাই কালকের রাতে রাফাত আর তার সাথে ঘটে যাওয়া অফুরন্ত দৃষ্টগোচর মুহূর্তগুলো নিয়ে হাসছে।
অনুর কান দিয়ে গরম বাতাস বের হওয়া শুরু করল। বারবার নাকটা ফুলে যাচ্ছে তার। অনুর চারপাশে থাকা মানুষগুলোর মুখে মিটিমিটি হাসি বিরাজ করছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে অনুর। অনু কখনো এমন পরিবেশে পড়েনি। এক অসস্তিকর পরিবেশে ভুগছে সে। অনু সবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে ধপ করে চেয়ার থেকে উঠে দড়ালো।
অনুর এভাবে উঠে যাওয়াতে সবার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল।
অনু বজ্রদৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দাঁত কটমট করতে করতে কর্কশ সুরে বলে উঠল,
‘তোদের মতো শয়তান ফ্রেন্ড যেন আর কারো না হয়। তোদের সবকিছু বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’
ইরা,লারা আর মিমি নিজেদের পেটে অদক্ষেপ হাসি দমিয়ে রাখতে না পেরে অট্টহাসিতে মেতে উঠল। অনুর কানে তাদের হা হা হাসি ঢোলের মতো বাজতে লাগল। অনু রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল। অনুর এভাবে চলে যাওয়া দেখে ইরা লারা আর মিমি তাৎক্ষনিকভাবে থেমে গেল। অনু রুমে ঢুকতেই লারা আবার ফিক করে হেসে দিল। লারার হাসি দেখে ইরা আর মিমিও হেসে দিল।
অনুকে তাদের হাসি আরো লজ্জায় ফেলে দিল। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে আলনা থেকে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল সে। ওয়াশরুমে ঢুকে ঝরনাদ নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ঝরনার পানির প্রত্যেকটা বিন্দু অনুর শরীরের এক অন্যরকম শিহরন বইয়ে দিল। অনু বুঝতে পারল না সেই অজানা অনুভুতির রহস্য। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল সে।
অনু ওয়াশরুমে থাকা অবস্থায় তার ফোনে রিংটন বেজে ওঠে। অনু লারাকে ডাক দিয়ে বলল যেন সে তার ফোনটি ধরতে। লারা কল রিসিভ করে কানে ধরে বলল,
‘আসসালামুআলাইকুম।’
ফোনের অপরপাশ থেকে এক পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে আসলো লারার কর্ণকুহরে। অপরপাশ থেকে চিকন কন্ঠের অধিকারী মানুষটি বলে উঠল,
‘ওয়ালাইকুমুসসালাম। কে বলছেন?’
লারা অজানা মানুষটির কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। নিজে ফোন দিয়ে বলছে ”কে বলছেন”।লারা রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘আপনি ফোন দিয়েছেন তো আগে আপনি বলুন আপনি কে?’
ওপাশ থেকে আবারও সেই মধুর কন্ঠস্বর ভেসে আসলো লারার কানে। কিন্তু এবার কন্ঠস্বরের সাথে একটু রাগ মিশ্রিত আছে তা লারা বেশ বুঝতে পারল। রাগান্বিত মনোভাব নিয়ে লোকটি বলে উঠল,
‘ডিস্টার্ব করার জায়গা পাননি নাকি? আমি আগে ফোন করিনি আপনি আগে ফোন করেছিলেন। প্রায় এক ঘন্টা আগে।’
এবার লারা কান থেকে ফোনটা একটু দূরে সরিয়ে দিল। ফোনটি নিচে নামিয়ে ভাবতে লাগল সে যে এটা কে হতে পারে? ফোনের দিকে নজর দিতেই তার মনে পড়ল এটা অনুর ফোন। আর অনু তো তার কাজের সাথে সম্পর্কিত কাউকে ফোন দিতে পারে। জিহবায় কামড় দিয়ে কানে ফোন ধরল লারা।আমতা আমতা করে বলল,
‘সরি,,আসলে এটা আমার ফ্রেন্ড্রের ফোন। ও ওয়াশরুমে গেছে। আমার মনে হয় ও আপনাকে ফোন দিয়েছিল।’
অপরপাশের মানুষটি গম্ভির গলায় বলে উঠল,
‘আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে?’
লারা অনেকটা অবাক হয়ে গেল লোকটির কথা শুনে। তার মাথায় সমস্যা থাকতে যাবে কেন?লারা উচু স্বরে বলে উঠল,
‘দেখুন আপনার যা কথা আপনি অনুর সাথে বলুন। অনুই আপনাকে ফোন দিয়েছে। আর আমি মোটেও পাগল নই।’
ইতিমধ্যে অনু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পড়েছে। লারা অনুর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিতেই অনু ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল এটা রাফাতের নাম্বার। অনুর হৃদয় অস্মভব কম্পিত হচ্ছে। দষ্টিহীন ভয় আস্তে আস্তে অনুকে গ্রাস করতে লাগল। অনু জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকল। এমন অনুভুতির কারন অনুর অজানা।
অনু কানে ধরেই সালাম দিল ফোনের অপরাপাশে অবস্থানরত মানুষটিকে। লোকটি সালাম নিয়ে বলল,
‘কি সমস্যা আপনাদের?কেন ফোন দিয়েছেন?’
অনু শুকনো ঢক গিলে বলল,
‘রাফাত আমি অনু।’
রাফাত অনুর নাম শুনেই হতভম্ব হয়ে গেল। ঠোটের কোনায় অফুরন্ত হাসি ফুটে উঠল তার। অজানা খুশিতে এক তৃপ্তি অনুভব করছে সে। অনেক জড়তা আর আবেগ নিয়ে বলে উঠল,
‘অনু তুতুমি ফোন দিয়েছো আমায়?’
অনু রাফাতের কথায় ভ্রু কুচকে ফেলল। সামান্য ফোন দেওয়ায় রাফাত এমন করছে কেন?ফোন তো দিতেই পারে সে? অনু ভ্রু উচু করে বলল,
‘হুমম কেন? দিতে পারি না?’
ফোনের অপরপাশ থেকে এক কৃক্রিম হাসির শব্দ ভেসে আসলো অনুর কর্ণকুহরে। অনু নিশব্দে হাসিটা কর্ণগোচর করল। রাফাত হাসি মাখানো কন্ঠস্বরে বলে উঠল,
‘না না, তা হতে যাবে কেন?বলো,, কেন ফোন দিয়েছো?’
অনু অনেকটা ইতস্তত বোধ করতে লাগল রাফাতকে কথাটা বলতে। অনেকক্ষন চুপ করে থেকে অনু বলে উঠল,
‘আপনি আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?’
রাফাত অনুর কথা শুনে অবাকের চুড়ান্ত সীমায় পৌছে গেল। যেই মেয়েটা তাকে সহ্য করতে পারে না সে আজকে তার সাথে দেখা করতে চাইছে?ভুল শুনছে না তো সে?নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুক্ষন সময় লেগে গেল তার। রাফাত শিয়র হওয়ার জন্য আবার জিজ্ঞাসা করল,
‘কি বললে শুনতে পাইনি?’
‘দেখা করতে পারবেন আজকে?’
অনুর বাক্যটি শেষ করতে সময় লাগতে পারে কিন্তু রাফাতের সম্মতি জানাতে দেরি হলো না। অনু রাফাতের এমন উৎসাহ দেখে একটু অবাক হলেও বুঝতে দিল না তাকে। অনু রাফাতকে বিকাল চারটার দিকে বসুন্ধরা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলল। রাফাত অনুর প্রত্যেকটা কথায় রাজি। আজ যেন রাফাত যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে।
ফোন কেটে রাফাত আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ইয়েস ইয়েস বলতে বলতে টেবিলে গ্লাসে থাকা পানি হাতের সাহায্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সে। বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পড়ে থাকা পানির দিকে। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিল সে।
অনু লারার দিকে তাকিয়ে দেখল লারা চোখ মুখ কুচকে তকিয়ে আছে তার দিকে। অনু লারার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে ভালোভাবে পরখ নিল। লারা নিচু স্বরে বলে উঠল,
চলবে,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)