#সাংসারিক_রাজনীতি
#পর্ব_১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
খান বাড়িতে আজ বিরাট ভোজের আয়োজন করা হয়েছে৷ সবার জন্যই আয়োজন করা হয়েছে। গরীব-দুঃখী, ফকির-মিসকিন এমনকি আত্নীয় স্বজনের জন্যও ভোজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজকের ভোজে সারা পাড়ার মানুষও আমন্ত্রিত। তাই সকাল থেকেই সব পেশার মানুষই ঐ বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। মাঝে মাঝেই এইরকম ভোজের আয়োজন করা হয় খান বাড়িতে। তবে, এই প্রথমবার শেষ বারের থেকে এত দেরিতে হলো। শেষবার যখন হলো, তখন এ বাড়ির ছোট ছেলের বৌয়ের স্বাদের অনুষ্ঠান ছিল। আর আজ! আজ ছোট ছেলের জমজ ২ ছেলে-মেয়ের এই বাড়িতে প্রথম আগমন। সেই উপলক্ষ্যেই এই আয়োজন। কিন্তু! এইখানেই আছে একটা কিন্তু। সেটা এই পাড়ার সব মহিলাদের চর্চার বিষয়। আজকের দিনটাও ব্যতিক্রম নয়। আজকে যেন আরো নতুন করে সেই কিন্তুটাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে।কিন্তু একটাই। ছোট ছেলের ছেলে-মেয়ে দুটি নবজাতক নয়। আজ ৩ বছর এ পা দিয়েছে। ৩ বছর পরেই কেন খান সাহেব নিজের ছেলে-বৌমা আর নাতি-নাতনীকে ঘরে তুলছেন সেই কারণ কি?
কিছুদিন ধরেই অল্প অল্প করে ব্যাগ প্যাক করছে সুভা। কিন্তু আজ শেষ সময়ে এসেও মনে হচ্ছে, অনেক কিছুই বাদ পড়ে গেছে। তার উপর আছে ২ টা বাচ্চা। বাচ্চা কম বিচ্চু বলা ভালো। ২ কামরার ফ্ল্যাট এ বাচ্চাদের নিয়ে থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠেছে সে। সারাজীবন বাবার বাড়িতে ছিল একান্নবর্তী পরিবার। শ্বশুরবাড়ীতেও তাই। ইশশ! কত আনন্দই না হতো আগে। আজ ৩ বছর বাদে শ্বশুর বাড়ি তে যাচ্ছে সে আবার। সাথে করে দুটো বাচ্চাও। শ্বশুরবাড়িতে সবচাইতে বেশি ভালোবাসতো শ্বশুর নিজেই। কিন্তু সুভার ছোট্ট একটা ভুলের কারণে তাকে ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। সে তো আসতে চায় নি। রাজিব এর জোরাজোরিতেই আসতে হয়েছে আর মায়ের কথায়।
“হলো তোমার?”
“হলো আর কই? একা মানুষ আমি। একা একা দুটো বাচ্চা নিয়ে এতো কিছু কি পারি? তারউপর আছে আবার আপনার দুটো বাচ্চা। ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমার জান বের হয়ে আসছে। একটু হাতে হাতে সাহায্যও তো করতে পারো, তাইনা?”
“তুমি এতো টেনশন নিচ্ছ, কেন? আজই তো আর সব নিতে হবে না। পরে না হয় এসে নিয়ে যাবো। আজকের জন্য ওদের যা যা দরকার, তাই তাই নাও।”
“হুমম! তাই করি না হয়। আর ভালো লাগে না। কাজের মেয়েটারও আজই পেট খারাপ হতে হলো। ও বাড়িতে গেলে আর এতো সমস্যা হবে না। কত মানুষ আছে ও বাড়িতে। হাতে হাতেই কাজ হয়ে যাবে।”
“মা, দাদা কেমন হয়? ওল কি শিং আতে? ও কি বুতা? ওল কি লেজ আতে? মিনিল মতো?”
“তোমার আর তোমার বাপের মাথার মতো।” রেগে গিয়ে বললো সুভা। বাটিতে সুজি ঢেলে রাজিব এর হাতে দিয়ে বলে,” মেয়েকে খাইয়ে আমাকে একটু উদ্ধার করুন। একটু পর তো আবার পুত্রও উঠবে। তাকেও খাইয়েন।”
“পাপা, দাদা কি লকম হয়?”
রাজিব বুঝতে পারলো, বাচ্চারা সুভাকে বেশ জ্বালাচ্ছে। শুধুমাত্র সুভার বাচ্চাদের নিয়ে কষ্ট হয় বলেই ও ঐ বাড়িতে ফিরতে রাজি হয়েছে। না হলে, সারাজীবনেও সে ও মুখী হতো না। ” ও পাপায়ায়ায়া, দাদাল কি মাথা হয়? দাদা কার মতো হয়?”
“সোনা, দাদা হচ্ছে, তোমার পাপার পাপা। বুঝলে? পাপা যেরকম, দাদাও সেইরকম। মানুষের মতোই। বুঝলে? এখন চুপচাপ খেয়ে নাও ভালো মেয়ের মতো। না হলে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে। বুঝেছো?”
গাড়ি থেকে প্রথমে বাম পা বের করে যখন নামলো, প্রথমেই নজরে পড়লো খান ভিলা। তার সংসার এইটা। রাজিবের সাথে বিয়ের সুবাদে এই বাড়িতে তার প্রথম আসা ছিল না। সে ছোট বেলা থেকেই এই বাড়িতে আসতো। এই বাড়িটা তার বড় কাকার শ্বশুরবাড়ি। কাকির সাথে মাঝে মাঝেই সে আসতো এইখানে। তাছাড়া কোনো অনুষ্ঠান হলেও আসতো। সুভা যখন ৯ বছরের, তখন তার বাবা মারা যায়। বাবা মায়ের প্রেমের বিয়ে ছিল। দাদা বাড়িতে প্রথম প্রথম কেউ তেমন মেনে নিয়েছিল না সুভার মা কে। কিন্তু পরবর্তীতে ওর মা ই হয়ে উঠেছিল সবার নয়নের মণি। ওর বাবাকে নিজের থেকেও ভালোবাসে ওর মা। তাইতো, স্বামীর মৃত্যুর এতো বছর পরও, স্বামীর স্মৃতি আগলে আছে। অন্য কাউকে বিয়েও করেনি। সুভা আর শ্বশুর বাড়ির লোকের ভরসার হাত হয়ে আছে। রাজিব হচ্ছে, এই বাড়ির বড়ো ছেলের সেজো ছেলে। তারা দুজনেই একে অপরকে ভালোবাসতো বিয়ের আগে থেকেই। কিন্তু বলার অবকাশ পায়নি। কিছু বুঝে উঠার আগেই, দুই পরিবারের সদস্যরা ওদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। রাজিবের ইচ্ছে ছিল, সুভাকে আগেই তার মনের কথা জানাবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি। বাসর রাতেই দুটো মন জেনেছিল, তাদের হৃদয় একই ছিল। মনে মনে বড় কাকিকে অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিল সুভা। কেননা, উনার চাওয়াতেই এতো তাড়াতাড়ি এক হয়েছিল ওরা।
তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল ওদের সুখের সংসার। এই বাড়িতে প্রত্যেকটা মানুষ ছিল তার মনের মতোন। স্বামী, ননদ,দেবর,ভাসুর,জা,আর শ্বশুর -শাশুড়িকে নিয়ে সুখের হাট বসিয়েছিল সে। তবে, সবচাইতে বেশি ভালোবাসতো শ্বশুরমশাই। ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়ে তার মধ্যেই যেন বাবাকে খুঁজে পেয়েছিল সে। তার যতো আবদার ছিল, সব তার কাছেই করতো। তার সুখের সংসারে আরো সুখ বাড়িয়ে দিতেই পরের বছরই সে জানতে পারলো, সে মা হতে যাচ্ছে। খুশি যেন আর ধরছিল না তার। ভাবতেই অন্যরকম শিহরণ জাগছিল মনে। সেও মা হবে। এই বাড়ির আনাচে কানাচে ছোট ছোট পা ফেলে একটা বাচ্চা ঘুরে বেড়াবে। তাকে মা মা বলে ডাকবে। রাজিবও ভীষণ খুশি হয়েছিল। ৬ মাসের সময় আল্ট্রা করে জানতে পারে, তাদের টুইন বেবি হবে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। আনন্দে সুভার চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু রাজিবের মুখের হাসি উড়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল দুটো বাচ্চা জন্ম দিতে গেলে ওর সমস্যা হতে পারে। টোটালি বেড রেস্ট দিয়েছিল ওকে। বাড়ির সবাইকেই রাজিব সাবধান করে দিয়েছিল। সুভাকেও বুঝিয়েছিল। তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে চলা সুভাও যেন কিভাবে সব মেনে নিল। নিজের জন্য না হলেও গর্ভের সন্তানদের কথা চিন্তা করে, নিজেকে সম্পুর্ন বদলে নিয়েছিল।
প্রেগ্ন্যাসির ৭ মাস সময়ে এসে রাজিবের বাবা বলেছিল, এইবার স্বাদেএ অনুষ্ঠান করতে বড় করে। কিন্তু রাজিব এমনটা চায় নি। কারণ, যতো মানুষ, ততো ঝামেলা। সুভাও প্রোপার রেস্ট নিতে পারবে না। আর তাদের বাড়িতে মেহমান আসলে, যাওয়ার নাম গন্ধ নেয় না। কিন্তু খান সাহেব মানেনি। ঠিকই কাঙাল ভোজন থেকে শুরু করে, এলাকার প্রভাবশালী দের ও দাওয়াত দিয়েছিল। চারদিকে তখন খান বাড়ির জয়জয়কার। উৎসব, আনন্দে যে খান বাড়িই সেরা, সেটা বুঝতে আর কারো বাকি থাকে না।
কিন্তু অঘটন ঘটে আটমাসের শেষে। বাড়ির সব বউরা মিলে গিয়েছিল ননদের বাড়িতে। আর সুভার শাশুড়ী ছিল অসুস্থ। তাই, সেদিনের মাছের ঝোল টা সুভাকে রাধতে বলেছিল। সে সব করেই দিয়ে গিয়েছিল, সুভা শুধু চুলায় চাপিয়েছিল। সুভার আর তরকারির নুন-ঝাল দেখার কথা মনে ছিল না। ঐভাবেই রেখে দিয়েছিল সবার জন্য।
সেদিন রাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। খান বাড়িতে সবাই খেতে বসেছিল। এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই বুঝলো, তরকারি নুনে পোড়া।খান সাহেব এক নজর সবার দিকে তাকালো। তারপরই বিকট চিৎকারে বলে উঠেছিল, ” এই তরকারি কে রান্না করেছে?”
সুভা সহ সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে গেল। সুভা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিয়েছিল,” আমি বাবা। কেন? কি হয়েছে?”
” রান্নার সময় মন কোথায় থাকে? লবন কি তোমার বাপ কিনে দিয়ে গেছে যে এতো লবন দিয়েছো?”
ব্যস! এইটুকুই সুভা শুনেছিল সেদিন। এরপর আর কি কি বলেছিল, জানে না সে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল সে। হঠাৎই খান সাহেব সবাইকে বলেছিল ড্রয়িং রুমে যেতে। রাজিব আর সুভা বাদে সবাই তার কথায় সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। খান সাহেব রাজিবের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,” তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি যাও।”
কিন্তু রাজিব যেতে না চাইলে খান সাহেব তাকে হিড়হিড় করে টেনে তার রুমে নিয়ে এসে দরজা আটকে দেয় তাকে ভিতরে রেখেই। এরপর ড্রয়িং রুমের দিকে যেতে থাকলে সবাই ভাবে, হয়তো তাদের কিছু বলবে, তাই তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু খান সাহেব এরপর যা করেন, সেটা ছিল সবার কল্পনার ও বাইরে৷ উনি এসেই ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। সবাই চিৎকার করে বলছিল দরজা খুলে দিতে। সুভা আট মাসের পেট নিয়ে এগিয়ে এসে তাকে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই খান সাহেব তাকে টেনে নিয়ে আসে সদর দরজার দিকে। এরপর তাকে গেটের বাইরে রেখেই দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়। এতোক্ষণ সবাই দরজার কাছে এসে দরজা খুলতে বলছিল। কিন্তু হঠাৎ বাইরে থেকে সুভার চিৎকারের আওয়াজ পেয়ে ছুটে যায় জানালার দিকে। দেখে, সুভা ল্যাম্পপোস্টর আলোর নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। সুভা রাজিবের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাজিব হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে ঘরের ভিতরে। জিনিস পত্র তছনছ করছে। আর সবাইকে দরজা খুলতে বলছে। সুভা ভয়েই হোক আর প্রাকৃতিকভাবেই হোক, একসময় কাঁদতে কাঁদতে বুঝতে পারে, তার হয়তোবা পেইন উঠেছে। এছাড়া ডেলিভারি ডেট ও সামনেই ছিল। সে নিজের আর সন্তানদের জীবন বাঁচাতে সামনের দিকে ছুটে যেতে চাইলো রাস্তার দিকে। কিন্তু তার আগেই একটি বাইক এসে…
চলবে….